এটা দর্শনের লড়াই

বর্তমান সময়ে সম্ভবত সর্বাধিক উচ্চারিত শব্দ-যুগল হলো ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, খেলাধূলা এমনকি বিনোদন জগতেও আজকাল এই শব্দ-যুগল ব্যবহৃত হয়। দুশ্যটি খুব চমৎকার! একদিকে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র নামে একের পর এক উৎসব, বক্তৃতা আর বিবৃতি চলছে; অন্যদিকে রামু, নাসিরনগর, বাঁশখালি, গোবিন্দগঞ্জ—একের পর এক সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ঘটছে। দেশের আদমশুমারী রিপোর্ট অনুযায়ী, ভিন্ন ধর্ম ও জাতিসত্তার মানুষ কমছে, দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তারা প্রাণের ভয়ে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে আমরা একটি বুদ্বুদের মধ্যে বাস করছি। ইস্যুর পর ইস্যু এসে জড়ো হচ্ছে এবং আমরা প্রতিবাদের পর প্রতিবাদ করে যাচ্ছি অতঃপর লবডঙ্কা! সম্প্রতি পাঠ্যপুস্তকে চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িকতার যে নজির সরকার দেখালো, তা দেখে আঁৎকে উঠেছেন অনেকেই। নড়েচড়ে বসেছেন শিক্ষাবিদ্গণ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে শিক্ষাব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ—এ কি আজকে থেকে? সত্যি বলতে, একাত্তরের পর থেকেই এই বিষক্রিয়া শুরু হচ্ছে। আজ যখন ধর্মীয় উগ্র সাম্প্রদায়িক বিষে আমাদের শরীর নীল হয়ে নিস্তেজ হতে চলেছে, তখন আমাদের মনে হলো—ব্যাপারটা ভয়ানক!বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ তুমুল আলোচিত, জনপ্রিয়, গুরুত্বপূর্ণ এবং সত্যি বলতে আমাদের জাতীয় জীবনে এখনও অচর্চিত। কেননা, এই ভাষণের বহুল উৎকলিত বাক্য “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”—এখনও আমাদের কাছে যুগপৎ অধরা এবং প্রাসঙ্গিক। আমাদের স্বাধীনতা এসেছে সত্য, কিন্তু মুক্তি এখনও আসেনি। কেনো? এর উত্তরটি দিয়েই আজকের লেখাটি শেষ করবো।

মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি সামরিক যুদ্ধ ছিল না; এটি প্রথমত দর্শনের যুদ্ধ, দ্বিতীয়ত জনযুদ্ধ। পাকিস্তানের চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক ভূত-দর্শনের বিরুদ্ধে বাঙলার অসাম্প্রদায়িক মানব-দর্শনের যুদ্ধ হলো মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু লক্ষ্যণীয়, যে বহুত্ববাদের দর্শনের ভিতে দাঁড়িয়ে আমাদের পূর্ব-পুরুষরা প্রবাদপ্রতিম সাহসিকতায় যুদ্ধটি করেছিলেন, তাঁরাই মুক্তিযুদ্ধের পর একে কেবল বাঙালির যুদ্ধ বা একটি নির্দিষ্ট দলের যুদ্ধ প্রমাণ করতে চাইলেন। অর্থাৎ মগজের ভেতরে থাকা পাকিস্তানি দর্শনের চাষ শুরু হলো। বিপত্তিটা শুরু হলো ১৯৭২ সালেই এবং তা ১৯৭৫ সালের মতো নৃশংস বেইমানির কালো ইতিহাসকে অনিবার্য করে তুললো। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পাকিস্তানি দর্শন একেবারে খাপ খোলা তলোয়ারের মতো ধ্বংস করতে লাগলো আমাদের সামগ্রিক চেতনার ঐশ্বর্যকে। বলাই বাহুল্য, দীর্ঘ একটি সময় এদেশে সামরিকতন্ত্র এবং মোল্লাতন্ত্র শাসনের নামে আসলে পাকিস্তানতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। গণতন্ত্রের বৃত্তে বাঙলাদেশ ফিরেছে বটে, কিন্তু ঘাড়ের পাকিস্তানি ভূত তখন আরও শক্তিশালী। গণতন্ত্রের যে ফাঁক-ফোকর তার ভেতরে ঘাপটি মেরেছিলো মৌলবাদ আর এখন তা গণতন্ত্রকেই গিলে ফেলেছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে ‘সংখ্যালঘু’ শব্দের রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছে, বিভিন্ন নৃ-জাতিগোষ্ঠীর ওপর চালানো হচ্ছে নির্মম নির্যাতন। মানচিত্র বদলেছে কিন্তু শাসকের মানসিকতা বদলায়নি। ফলে বাঙলাদেশবিরোধি পাকিস্তানি অপ-দর্শন খুব ভয়ানক যোগ্যতায় শাসন করছে সর্বত্র। এখন এই অপ-দর্শনকে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দর্শন দিয়ে কতোটা পরাস্থ করতে পারবো, তার ওপর নির্ভর করছে আগামির বাঙলাদেশ। এর আগেও জানা প্রয়োজন, আদৌ আমাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনটি পরিষ্কার কি না। বা প্রশ্ন উঠতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের দর্শনটি আসলে কোথায় লিপিবদ্ধ আছে? এ প্রশ্নের সহজ ও সত্য উত্তরটি হলো— মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রেই লিপিবদ্ধ আছে আমাদের যাবতীয় দর্শনের অমিত শক্তি। সেখানেই আছে আমাদের ইশতেহারের রূপরেখা। বস্তুত সে কারণেই, আমাদের বুদ্ধিজীবীমহলে বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে যতোটা আলোচনা আছে, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্র নিয়ে ততোটা নেই। অথচ, সেটাই আমাদের পরিত্রাণের হাতিয়ার।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, লড়াইয়ে আমরা পিছিয়ে আছি বা লড়াইটি খুব শক্ত। কিন্তু আদতে তা নয়। রাষ্ট্রযন্ত্র এবং মৌলবাদ এখন হাত ধরাধরি করে চলছে— এ কথা সত্য; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো মানুষই রাষ্ট্রের দিনলিপি লেখে। সেই মানুষের কাছে এখনও ‘মানুষ’ শব্দটি খুব পবিত্র। এ বোধকে ক্ষয়িষ্ণু হতে দেয়া যাবে না। এই বোধই আমাদের ও আগামি বাঙলাদেশের চৈতন্যের পাণ্ডুলিপি।

২৪ পৌষ ১৪২৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *