জাফর মুন্সী: শাহবাগ আন্দোলনের প্রথম শহিদ

রাজপথ থেকেই শেষ পর্যন্ত বন্ধু চিনে নিতে হয়, শেষ পর্যন্ত রক্ত দিয়েই নির্মিত হয় চিন্তার সাঁকো। ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে যখন দীপ্র দ্রোহে নির্মিত হচ্ছে প্রতিবাদের স্লোগান, দাবি আদায়ের ইস্পাতসম শপথ; তখন মতিঝিলের দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত জাফর মুন্সী জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন একা। হায়েনাদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে ওইদিনই তিনি ভর্তি হন হাসপাতালে। পরদিন ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি শহীদ হন।

এইটুকু বক্তব্য দীর্ঘ চার বছর ধরে আমরা গণমাধ্যমে, ব্লগে, ফেসবুকে, সভা-সমাবেশ আর প্রতিবাদের মিছিলে কতোবার উচ্চারণ করেছি। কিন্তু ২০১৩ সালের পর থেকে শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িত প্রতিটি মানুষের কাছেই বসন্ত তার সমস্তটুকু নিয়ে আসে প্রকৃত প্রস্তাবে শহিদ জাফর মুন্সীর হাত ধরেই। বস্তুত জাফর মুন্সীই আমাদের প্রথম জানিয়েছেন, ইতিহাসের দায় শোধে রক্তের দস্তখত প্রয়োজন।

এরপর একে একে ব্লগার ও স্থপতি রাজীব হায়দার, সিলেটের জগতজ্যোতি তালুকদার, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আরিফ রায়হান দীপ, সাতক্ষীরার সিটি কলেজের প্রভাষক এ বি এম মামুন, বগুড়ার জিয়াউদ্দিন জাকারিয়া বাবু, প্রকৌশলি ও লেখক অভিজিৎ রায়, বিজ্ঞান লেখক অনন্ত বিজয় দাশ, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনসহ আরও অনেকেই রক্ত দিয়ে ইতিহাসের দায় শোধ করে গেছেন।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ও জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধসহ সুনির্দিষ্ট ছয় দফা দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন যতো সামনে এগিয়েছে, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ততোই চাপাতিতন্ত্র চালিয়েছে আমাদের সহযোদ্ধাদের ওপর। সুতরাং, জাফর মুন্সীকে নির্মমভাবে হত্যা করার সাত বছর পর এই কথাটি পুনর্ব্যক্ত করা প্রয়োজন যে, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি আজ যতোটুকু পূরণ হয়েছে, তার সঙ্গে মিশে আছে আমাদের সহযোদ্ধাদের পবিত্র রক্ত। তাঁদের ক্ষত-বিক্ষত নিথর দেহ যতোটুকু এগিয়েছে শবযাত্রার মিছিলে, ততোটুকু পথ একেকটি যুদ্ধাপরাধী এগিয়েছে ফাঁসিকাষ্ঠের দিকে। তাঁদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই যুদ্ধাপরাধীমুক্ত একটি বাংলাদেশের দিকে হাঁটতে শুরু করেছি আমরা।

শহীদ জাফর মুন্সীর গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার ঘারুয়া ইউনিয়নের গঙ্গাধরদী। তাঁর পিতার নাম খোরশেদ আলী। জাফর মুন্সী দীর্ঘ ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে মতিঝিলের দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। থাকতেন কমলাপুর এলাকার একটি মেসে। তাঁর স্ত্রীর নাম জুলিয়া বেগম। যুবরাজ ও জিসান নামে তাঁর দুই ছেলে এবং জেবা নামে একটি মেয়ে রয়েছে। জাফর মুন্সীর বয়স ছিলো ৪৫।

২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, বুধবার সকালে অফিসের গেটে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে লাগানো ব্যানার ও পোস্টার ছিঁড়তে বাধা দেয়ায় জামায়াত-শিবিরের হামলায় আহত হন তিনি। ওই দিন মতিঝিলসহ রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে একযোগে তাণ্ডব চালায় সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াত-শিবির। তাদের নৃশংসতায় গুরুতর আহত হয় জাফর মুন্সী। তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিক্যালে এবং পরে ধানমণ্ডির গ্রীণ লাইফ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানেই ১৪ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার সকাল দশটার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়। জামাত-শিবিরের নারকীয় সহিংসতায় মৃত্যুর মিছিলে যোগ হয় আরও একটি নাম। জামাত-শিবিরের পৈশাচিক আক্রমণে জাফর মুন্সী শহিদ হলেও, তাঁর জীবনের বিনিময়ে অক্ষতই ছিলো যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি সংবলিত পোস্টার।

শহিদ জাফর মুন্সীর সঙ্গে আমাদের কোনো পরিচয় ছিলো না। ব্লগে, ফেসবুকে, পত্রিকার পাতায়, এমনকি আমাদের প্রতিদিনকার রাজপথেও আমরা পরস্পরকে চিনতাম না। কিন্তু পাঁচই ফেব্রুয়ারি দ্রোহের যে অনন্য মশালে সারা বাঙলার মানুষ জেগে উঠেছে, তখনই আমাদের সকলের পরিচয় আসলে নথিভুক্ত হয়েছে চেতনার মিছিলে। একটি আকাশের নিচে আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মানের স্বপ্ন নিয়ে। অহিংস আন্দোলনের পথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে এই গণজাগরণ মঞ্চ যখন অষ্টম দিনের স্লোগানে জানান দিচ্ছে তার অহোরাত্রি প্রতিবাদ, তখনই জামায়াত-শিবিরের চিরায়ত সহিংস আক্রমণে শহিদ হন জাফর মুন্সী।

জাফর মুন্সীই তাহলে সেই দেবদূত, যিনি জীবন দিয়ে জানিয়েছিলেন এ আন্দোলন আসলে ব্যাপ্ত, হয়তো আমাদের ভাবনার বাইরেও অনেকখানি ব্যাপ্ত। আমাদের বোধগম্যতার তিনিই তাহলে প্রাথমিক শিক্ষক, যিনি এই আন্দোলনকে প্রথম টেনে বের করে এনে স্থাপন করলেন ‘আমাদের’ শিরোনামে। মুক্তিযুদ্ধের দর্শন কেবল ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, লেখক, গবেষক বা সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মীদেরই বিবেচ্য বিষয় নয়; এর সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে গণ-মানুষের সার্বিক অধিকারবোধ। কেননা, মুক্তিযুদ্ধ একটি প্রকৃত গণযুদ্ধই ছিলো। তার প্রেরণাকে বুকে নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনও হতে হবে গণ-মানুষেরই। ‘জয় বাঙলা’ যেমন কোনো নির্দিষ্ট দলের স্লোগান নয়, তেমনি জয় বাঙলা স্লোগানে মুখরিত গণ-আন্দোলনও কেবলই গণ-মানুষের। এই শ্রেণি চেতনার নিরিখে শহিদ জাফর মুন্সী আসলে গণজাগরণ মঞ্চের একটি সংজ্ঞায়ন করে গেছেন, বা বলা ভালো, কারও কারও নির্ধারিত সংজ্ঞায় তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন এনে দিয়েছেন।

জাফর মুন্সীকে নির্মমভাবে হত্যার সাত বছর পেরিয়ে গেলো। কিন্তু আজ পর্যন্ত বিচারের কোনো আলো দেখতে পাইনি আমরা। ব্লগার ও স্থপতি রাজীব হায়দারের হত্যাকাণ্ডের রায় হলেও, তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। মৌলবাদী ও উগ্রপন্থীদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার আমাদের অন্যান্য সহযোদ্ধাদের ক্ষেত্রেও বিচারের দাবি কেবল হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী, ব্লগার, লেখক, প্রকাশক বা মুক্তচিন্তার অন্যান্য মানুষ হত্যার বিচার না হওয়াটাকে সরকার এক ধরনের বৈধতা দিয়ে দিচ্ছে। এতে হত্যাকারীরা তাদের চাপাতিদর্শন বাস্তবায়নের সুযোগ পাচ্ছে পুরোদমে।

জাফর মুন্সীর সন্তানরা যেনো সত্যিকার অর্থেই রাজাকার, জামায়াত-শিবিরমুক্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে, সেই লড়াই চালিয়ে যাবার দায়িত্ব আমাদের। আদর্শের সরণিতে রক্ত ধারায় এই দায়িত্ব আমাদের দিয়ে গেছেন শহীদ জাফর মুন্সী।

৩০ মাঘ ১৪২৬

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *