জামায়াতে ইসলামীর নতুন ভণ্ডামি

দুটি তারিখ উল্লেখ করা যেতে পারে– ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর এবং ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর। প্রথম উল্লিখিত তারিখে রাজাকার গোলাম আযমকে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের ‘আমির’ ঘোষণা করেছিল। শেষোক্ত তারিখে তারা ঘোষণা করল বর্তমান আমিরের নাম। মাঝখানে যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী স্বাধীনতাবিরোধী এই দলটির আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। চলতি বছরের ১০ মে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে এই রাজাকারের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় কার্যকর করা হয়েছে।

রাজাকার গোলাম আযমের নাম আমির হিসেবে ঘোষণার পর সারা দেশে জনবিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। এরপর শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে শুরু হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সুতীব্র আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় বেড়ে ওঠে একটি প্রজন্ম। গণআদালতে শহীদজননীর ঘোষিত রায়ের দলিল হাতে ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারা দাঁড়ায় শাহবাগে। শুরু হয় শহীদজননীর আন্দোলনের দ্বিতীয় অধ্যায়।

সুনির্দিষ্ট ছয় দফা দাবির প্রেক্ষিতে চলমান এই আন্দোলনের জেরে পরিবর্তন হয় ট্রাইব্যুনালের আইন। এখন পর্যন্ত ছয় জন যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির রায় কার্যকর হয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের ছয় দফার মধ্যে যুদ্ধাপরাধী ও দেশবিরোধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সন্ত্রাসী অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিটিও আছে। বহুবার এ নিয়ে নানা কথার পরও যা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।

এই পটভূমিতে জামায়াতে ইসলামীর নতুন আমিরের নাম ঘোষণা এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত তার বিবৃতি গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ করা প্রয়োজন, বেশ কয়েক মাস আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘যুদ্ধাপরাধীমুক্ত আমির করছে জামায়াত’ এই শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়েছিল।

জামায়াতের নতুন আমির মকবুল আহমদের নামেও যুদ্ধাপরাধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। এই অভিযোগ নিশ্চিতভাবেই তদন্ত করবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু নতুন আমির হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর যে বিবৃতি দিয়েছেন মকবুল, তা জামায়াতের নতুন ষড়যন্ত্রের সূক্ষ্ম প্রকাশ। বিবৃতিটি প্রমাণ করেছে, বিগত সময়ে সাপের খোলস বদলের মতো জামায়াত তাদের খোলস বদল করছে মাত্র। স্বাধীনতাবিরোধী এই সংগঠনের মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা অনেকটা ‘ভূতের মুখে রাম নাম’ নেওয়ার মতোই।

আমাদের ভুলে যাওয়া উচিৎ নয় যে, ২০০৮ সালের ১১ জুলাই ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ’এর ব্যানারে জামায়াত-শিবিরের বিভ্রান্তিকর ভণ্ডামির সমাবেশে প্রতিবাদ করায় লাথি মারা হয়েছিল টাঙ্গাইলের ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীকে। সুতরাং জামায়াতের নতুন আমিরের বক্তব্য পুনরায় পড়ার পূর্বে তার পেছনের রাজনীতি পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। কারণ এটি গুরুত্বপূর্ণ। নতুন একটি ফাঁদ পাতার আগেই ইতিহাসের দলিলে স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন যে, এটি জামায়াতের দেশবিরোধী রাজনীতিরই আরেকটি রূপ মাত্র।

আমাদের রাজনীতিতে আগেও লক্ষ্য করেছি যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আরও অনেক নেতাকে এক কাতারে ফেলে একটি সরলীকরণের চেষ্টা হয়। কিন্তু ইতিহাস সরলীকরণের জায়গা নয়; বরং নির্মোহ। তবে এই সরলীকরণে তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ থাকার ভান ধরে অপরাজনীতির চাষাবাদ শুরু করেন। এতে নতুন প্রজন্মের সামনে একটি বিভ্রান্তি দাঁড় করানো যায়। প্রতি বছরই যেহেতু নতুন ভোটারের সংখ্যা বাড়ছে, বিভ্রান্তির ‘কারেন্ট জাল’ ফেলে তাদের ধরার একটি সম্ভাবনাও উঁকি দেয়।

জামায়াতের নতুন আমিরের বিবৃতি সেই পথেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। মানবতাবিরোধী অপরাধে তাদের অনেক নেতার সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর হওয়া এবং অনেকেই বিচারাধীন থাকায় তারা এখন ‘যুদ্ধাপরাধীমুক্ত জামায়াত’ গল্প ফাঁদার চেষ্টা করছে।

কিন্তু একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর মানবতাবিরোধী অপরাধ তো তাদের দলীয় সিদ্ধান্তের অপরাধ। ট্রাইব্যুনালের বেশ কয়েকটি রায়ের পর্যবেক্ষণে সংগঠন হিসেবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে দলটিকে। আর ‘ইসলামী ছাত্র শিবির’ নাম বাদ দিলে এটি ‘ইসলামী ছাত্র সংঘ’ ছাড়া কিছুই নয়। তাই বিবৃতির পরের লাইনেই তাদের দলের নেতা, দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি জামায়াতের শোক প্রকাশিত। সুতরাং তাদের আমিরের এই বিবৃতিতে তাদের চেহারা পাল্টে গেছে ভাবার কারণ নেই।

কথাটি বলা হচ্ছে এ জন্য যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই বিষয়টি ইতিবাচক চোখে দেখার চেষ্টা করেছেন। অবশ্য অনেকে এ-ও বলেছেন যে, প্রকাশ্যে ক্ষমা না চাইলে এই বিবৃতির কোনো মূল্য নেই। কিন্তু ক্ষমা চাইলেই কি রাজনৈতিক দল হিসেবে গ্রহণ করতে হবে জামায়াত-শিবিরকে? আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী হিসেবে চিহ্নিত রাজনৈতিক দল জামায়াত। তাদের রাজনীতি কখনও স্বাধীন বাংলাদেশে সক্রিয় থাকতে পারে না।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর থেকেই জামায়াত যুগপৎ রাজাকারদের রক্ষা এবং নতুনভাবে রাজনীতিতে প্রবেশের চেষ্টা অব্যাহত রাখছে। সারাদেশে তারা সাম্প্রদায়িক হামলা ও হত্যার মধ্য দিয়ে নানাবিধ তাণ্ডব করেছে এবং এখনও ছোবলের অপেক্ষায় আছে। নানাভাবে লবিস্ট নিয়োগ ও ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেও তারা যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে পারল না, তখনই নতুনভাবে রাজনীতির মোড়কে অপরাজনীতির ছক কষছে তারা। বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে, তারা বদলে গেছে। ব্যাপারটা যেন জামায় লেগে থাকা দাগ, ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে দিলেই হল!

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের বিরোধিতা যে আদর্শিক বিরোধিতা– এ কথা তাদের নেতারা এখনও বলেন। কখনও কখনও দায়মুক্তির জন্যও বলেন। একাত্তরের গণহত্যা, নারীনির্যাতন, লুণ্ঠন সবকিছুই জামায়াতের নেতাদের অনেকে ‘জায়েজ’ করার চেষ্টা করেন। ২০১০ সালের ২৭ জুলাই জামায়াতের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ও আপিল বিভাগে বিচারাধীন মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী এ টি এম আজহারুল ইসলাম বলেছিলেন, “জামায়াতের নেতারা অপরাধ করেননি, এক পাকিস্তান চেয়েছিলেন।”

সুতরাং আজ জামায়াতের নতুন কথায় বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এটাও তাদের রাজনীতি। মনে রাখতে হবে যে, ১৯৭১ সালের পর গা-ঢাকা দিয়ে থেকেও এই জামায়াত-শিবির স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের বিষ ছড়িয়েছে, সময় বুঝে ছোবল দেওয়াটাই এদের স্বভাব। যারা ভাবছেন জামায়াতের এখন করার কিছুই নেই, তাদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে, ১৯৭৯ সালে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলাভির উদারনীতির ইরান আয়াতুল্লাহ খামেনীর মৌলবাদী ইরানে রূপান্তরিত হওয়ার ঘটনা। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি জামায়াত-শিবির সেই রাজনীতিরই দীক্ষা নিচ্ছে।

পৃথিবীর আর কোনো দেশে কি যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত রাজনৈতিক দল রাজনীতি করতে পেরেছে? তাহলে বাংলাদেশে কেন পারবে? বস্তুত এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূল কেন্দ্রে যেতে হবে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র থেকে যে মানবিক বাংলাদেশের ধারণা আমরা পাই, তাতে কোনোভাবেই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল থাকতে পারে না।

রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সেই ধর্ম পুঁজি করেই জামায়াত-শিবির বাংলাদেশবিরোধী রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে। এই যুদ্ধাপরাধী সংগঠনের নতুন আমিরের বিবৃতি পড়ে বোঝা যায়, নির্বাচন সামনে রেখেই তারা তাদের দল গোছানোর নানাবিধ কার্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।

২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে নতুন ভোটারের সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ। আগামী নির্বাচনে যারা প্রথমবারের মতো ভোট দেবে, তাদের কাছে সত্য প্রকাশ করে জামায়াত-শিবিরের নতুন ভণ্ডামি পরিষ্কার করার উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন ‘এই কাদের মোল্লা সেই কাদের মোল্লা নয়’এর মতো জামায়াত-শিবির বলতে শুরু করবে, ‘এই জামায়াত সেই জামায়াত নয়।’

০৪ কার্তিক ১৪২৩

 

লেখাটি উল্লিখিত তারিখে বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত পাতায় প্রকাশিত হয়েছিলো। বিডিনিউজে লেখাটি পড়তে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *