পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন: মনোজগতে আধিপত্যবাদের রাজনীতি

প্রসঙ্গ-কথা

বাঙলাদেশ একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে মুক্তিসংগ্রামের মহাবাদলের মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে উনিশশো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—এ দীর্ঘ সংগ্রামমুখর পথ পরিক্রমায় বাঙলাদেশের সৃষ্টি। এ লড়াই একদিকে যেমন ছিলো শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনতার সশস্ত্র অভ্যুত্থান, তেমনি ছিলো শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেয়া দাস-মনোবৃত্তির বিরুদ্ধে স্বকীয় সত্তার উদ্বোধন। এই দুই ধারার লড়াই সমান্তরালে চলেছে, কখনও একটি অপরটিকে প্রভাবিত করেছে। জনতার সশস্ত্র অভ্যুত্থানে আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণ ছিলো; অন্যদিকে স্বকীয় সত্তার উদ্বোধনে একটি সচেতন মধ্যবিত্ত সমাজ তৈরি হয়েছিলো। এই দুই ধারারই চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিলো স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠন। লক্ষ্যণীয় যে, নানাবিধ দমনীতির পরও বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী এই দুইটি ধারাকেই কৌশলে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের কাজে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছিলো। এর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ ছিলো সাতচল্লিশের দেশভাগ। দেশভাগের প্রধান কুশীলবদের কেউ-ই ব্যক্তিগতভাবে ধার্মিক ছিলেন না, কিন্তু প্রত্যেকেই ধর্মকে ব্যবহার করেছিলেন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নিজেদের আলাদা মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য। ফলে পাকিস্তান কী ভারত—কোনো রাষ্ট্র গঠনেরই দার্ঢ্য দার্শনিক কোনো ভিত্তি নেই। ফলে পাকিস্তান আন্দোলনে তুমুল সাড়া দেয়া বাঙালি মধ্যবিত্ত মুসলমানও তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং ১৯৪৮ সাল থেকেই নিজস্ব সাংস্কৃতিক বলয় পুনর্নিমাণের আন্দোলন শুরু হয়। সে অর্থে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১—এ দীর্ঘ সময়ে বাঙালি তার মুক্তি সংগ্রামের দার্শনিক ইশতেহার রচনা করে। কার্যত মুক্তিযুদ্ধই একটি স্বচ্ছ অসাম্প্রদায়িক দার্শনিক ভিত্তির ওপর রচিত জনযুদ্ধ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজনীতি নির্মিত হয়েছে দর্শনরহিতভাবেই। ভূ-খণ্ড স্বাধীন হয়েছিলো, কিন্তু মনোজগৎ তখনও পাকিস্তানি ভূতগ্রস্থ ছিলো। ফলে বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের শাসনামলে এই মনোজগৎ আড়ালে থাকলেও নিষ্ক্রিয় ছিলো না এবং তারই চূড়ান্ত বেদনাদায়ক পরিণতি ছিলো পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা। এরপর সামরিকতন্ত্র ও মোল্লাতন্ত্র হাত ধরাধরি করে বাঙলাদেশ শাসন করেছে আর তাতে রসদ যুগিয়েছে পাকিস্তানি ভাবাদর্শগ্রস্থ আমলাতন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধের দর্শনকে আড়াল করা হয়েছে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক অপ-দর্শন দিয়ে। শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তককে তখন ব্যবহার করা হয়েছিলো রাজনৈতিক হাতিয়ার হিশেবে। পঁচাত্তরের পর তিনটি প্রজন্ম বড়ো হয়েছে পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাব্যবস্থাকেন্দ্রীক অপরাজনীতির ভিতর দিয়ে। ছিয়ানব্বই সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে মুক্তিযুদ্ধের কিছু মৌল বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয় বটে, কিন্তু গোটা শিক্ষা ব্যবস্থায় তার কোনো প্রভাব প্রতিয়মান হয় না। ২০০১ সালে বিএনপি-রাজাকার জোট ক্ষমতায় এসে আবার পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনে এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করে। এ পর্যন্ত আমরা পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তনগুলোকে মোটা রাজনৈতিক দাগে দেখে আসছিলাম। সম্প্রতি ২০১৭ সালের পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তনগুলো একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠ্যপুস্তকের রাজনীতিকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু মূলত তথাকথিত রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের বাইরে গিয়ে পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রতিক পরিবর্তনগুলোর পেছনের রাজনীতিকে তুলে ধরা। বস্তুত সে কারণেই এই নিবন্ধের শিরোনামে সচেতনভাবেই ‘মনোজগতের আধিপত্যবাদের রাজনীতি’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে।

শিক্ষাব্যবস্থাকেন্দ্রীক আধিপত্যবাদী রাজনীতির ইতিহাস

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শিক্ষাব্যবস্থাকেন্দ্রীক একটি রাজনীতি শুরু হয়। এই রাজনীতি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলেও ছিলো, বস্তুত তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান আমলেও এটি শুরু হয়; কিন্তু সরাসরি বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মনো-দর্শনের বিরুদ্ধে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় দর্শন চাপানোর কাজ জোরপূর্বক শুরু করে পাকিস্তান। তেইশ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও পাকিস্তানি শিক্ষাব্যবস্থার সাম্প্রদায়িক প্রভাব তৎকালীন প্রজন্মের মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিলো। প্রশ্ন উঠতে পারে, যে প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোতে, সে প্রজন্ম কী করে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলো? এর উত্তরটি হলো—পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক অপ-দর্শন যেমন ক্রিয়াশীল ছিলো তেমনি ক্রিয়াশীল ছিলো তার বিরুদ্ধে জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধ যে প্রজন্ম গড়ে তুলেছিলো (যেমন: ভাষা আন্দোলন বা যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনকালীন প্রজন্ম) তাদের পঠন-পাঠন বা বেড়ে উঠার ওপর তৎকালীন উপমহাদেশে ক্রিয়াশীল গান্ধীর অহিংস আন্দোলন ও সুভাষ বসুর সশস্ত্র বিপ্লবের মিথষ্ক্রিয়া বিদ্যমান ছিলো। পরবর্তীতে বাঙলাদেশ স্বাধীন করার আন্দোলনেও আমরা এই দুই ধারার রাজনৈতিক মিথষ্ক্রিয়া লক্ষ্য করি। এই প্রজন্মই মূলত আন্দোলনের ধারাটি রচনা করেছিলেন, যার হাল ধরেছিলেন পরবর্তী প্রজন্ম, যাদের জন্ম পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে। ওই প্রজন্মকে স্কুলে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত গাইতে হয়েছিলো, পাকিস্তানি ভাবাদর্শের পাঠ্যপুস্তক পড়তে হয়েছিলো কিন্তু তারা রাজপথে পূর্ববর্তী প্রজন্মের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শী। সুতরাং মনস্তত্ত্বগতভাবে তারা একদিকে যেমন পাকিস্তানি মৌলবাদী দর্শন, যার ভিত রচিত হয়েছিলো ধর্মকে কেন্দ্র করে, তার মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছে; অন্যদিকে এই অপ-দর্শনের বিরুদ্ধে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনও তাদের আন্দোলিত করেছে। পরবর্তীতে যখন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজের অস্তিত্বের জন্যেই ধর্মকেন্দ্রীক পাকিস্তানি মৌলবাদী দর্শন পরিত্যাগ করে। এখানে বাঙালি চেতনাবোধ তাদের মাঝে খুব কাজ করেছে, এ কথা বলা যায় না। কেননা, স্বাধীন বাঙলাদেশে এরাই আবার সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গোড়ায় পানি ঢালতে আরম্ভ করে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। সুতরাং এ কথা বললে নিশ্চয়ই ভুল বলা হবে না যে, মুক্তিযুদ্ধ করেছিলো যে প্রজন্ম, তাঁরা একটি দ্বান্দ্বিক মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর ভেতরে বড়ো হয়েছে। সেখানে পাকিস্তানি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটিকে নিজের করে পাবার একটি বাসনা ছিলো। একটি স্বাধীন দেশ হলে সেটা তার পক্ষে সম্ভব। কিন্তু এর বাইরে আপামর জনসাধারণ, যাঁদের জন্য মূলত আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পর সরকার গঠনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারলেন না। ফলে সেই মধ্যবিত্ত, যে পাকিস্তানি মানসকাঠামোর বীজ নিয়ে বড়ো হয়েছে, নিজের জন্য মুক্তিযুদ্ধও হয়তো করেছে, সে স্বাধীন দেশে হঠাৎ ক্ষমতাধর হয়ে পড়লো এবং বুঝতে পারলো ধর্মকে ব্যবহার করলে তার পক্ষে টিকে থাকাটা আরও সহজ, কেননা পাকিস্তানি অপ-দর্শন তাকে এই শিক্ষাই দিয়েছে।

১৯৪৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত যে কটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে, সেগুলোর কোনটি বাতিল হয়েছে, কোনোটির আংশিক গৃহীত হয়েছে, কোনোটির কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে; কিন্তু পূর্ণাঙ্গভাবে কোনো শিক্ষা কমিশনই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বাস্তব রূপ দিতে পারেনি। এর একটি তালিকা উল্লেখ করা হলো।

সময়সালসরকারকমিটি প্রধানপ্রতিবেদন প্রকাশ ও ভবিষ্যত
পাকিস্তান আমল১৯৪৯পূর্ববঙ্গ সরকারমওলানা আকরাম খাঁরিপোর্ট পেশ: ১৯৫১
সরকার রিপোর্ট বাতিল বা গ্রহণ কোনোটিই করেনি
পাকিস্তান আমল১৯৫৭পূর্ব পাকিস্তান সরকারখান আতাউর রহমানরিপোর্ট পেশ হবার আগেই সরকার বিলুপ্ত হয়
পাকিস্তান আমল১৯৫৮পাকিস্তান সামরিক সরকারমোঃ শরীফরিপোর্ট প্রদান: ১৯৫৯
পাকিস্তান আমল১৯৫৯পাকিস্তান সরকারতৎকালীন প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানসুপারিশ প্রদান: ১৯৬২
বাঙলাদেশ আমল১৯৭২বঙ্গবন্ধু সরকারড. কুদরত-ই-খুদারিপোর্ট পেশ: ১৯৭৪
চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়নি
বাঙলাদেশ আমল১৯৭৮-৭৯জিয়াউর রহমানের অবৈধ সামরিক সরকারতৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা কাজী জাফর আহমেদরিপোর্ট পেশ: ১৯৭৯
বাঙলাদেশ আমল১৯৮২এরশাদের অবৈধ সামরিক সরকারতৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খানরিপোর্ট পেশ ও বাতিল: ১৯৮৬
বাঙলাদেশ আমল১৯৮৭এরশাদের অবৈধ সামরিক সরকারঅধ্যাপক মফিজ উদ্দিনরিপোর্ট পেশ: ১৯৮৮
বাঙলাদেশ আমল১৯৯১বেগম খালেদা জিয়ার সরকারনির্বাহী আদেশকোনো কমিটি বা কমিশন না করেই বিভিন্ন কার্যক্রম চালানো হয়।
বাঙলাদেশ আমল১৯৯৬বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকারঅধ্যাপক শামসুল হকরিপোর্ট প্রকাশ: ১৯৯৭
বাঙলাদেশ আমল২০০৩বেগম খালেদা জিয়ার সরকারঅধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়ারিপোর্ট প্রকাশ: ২০০৪
বাঙলাদেশ আমল২০০৭বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকারঅধ্যাপক কবীর চৌধুরীখশড়া: ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৯
রিপোর্ট গ্রহণ: ০৭ ডিসেম্বর, ২০১০

এই হলো গত সত্তর বছরে গঠিত শিক্ষা কমিশন বা কমিটি। মোট এগারোটি কমিশন/কমিটি হয়েছে যার মধ্যে সাতটি স্বাধীন বাঙলাদেশে। উপরোক্ত প্রতিটি কমিশন/কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু কোনোটিই সরকার কার্যকর করেনি সম্পূর্ণভাবে। আবার কোনো কোনোটি জনতার দাবির মুখে বাতিল হয়েছে। লক্ষ্যণীয় পাকিস্তান আমলে (১৯৬২ সাল থেকে) যে রিপোর্টগুলো এসেছে সেগুলো বিতর্কিত এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। বর্তমানের অনেক রাজনৈতিক নেতাই সে-ই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। স্বাধীন বাঙলাদেশের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টগুলো পড়লে বোঝা যায়, একমাত্র কুদরত-এ-খুদা কমিশনের রিপোর্টেই রাষ্ট্র পরিচালনার চার মৌল নীতি— গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ— মোটামুটি প্রতিফলিত হয়েছিলো। স্বাধীনতার মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই এই কমিশন তৈরি হয়েছিলো। এরপর যে কমিশনগুলো তৈরি হয়েছিলো, সেগুলো এই কমিশনেরই বিভিন্ন সুপারিশ গ্রহণ বর্জন বা পরিবর্তন। সুপারিশগুলোর একটি তুলনামূলক আলোচনা করলে বোঝা যায়—

শিক্ষা কমিশনকমিশন প্রদত্ত সুপারিশের মূল বক্তব্য
১৯৭২ সালের কুদরত-ই-খুদা কমিশনসংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার চার নীতিকে শিক্ষারও চার নীতি হিশেবে ঘোষণা
১৯৭৮ সালের কাজী জাফর কমিশনচার নীতি অস্বীকার। ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল ও ধর্ম শিক্ষার গুরুত্ব
১৯৮৮ সালের মফিজ কমিশনধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা বাতিল। ধর্ম ও নৈতিকতার ওপর গুরুত্ব আরোপ
১৯৯৭ সালের শামসুল হক কমিশনমুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও অসাম্প্রদায়িকতা
২০০৩ সালের মনিরুজ্জামান কমিশনধর্মীয় নৈতিকতার ওপর গুরুত্ব
২০০৭ সালের কবীর চৌধুরী কমিশনঅসাম্প্রদায়িকতা, তবে চার মূল নীতি নয়

স্বাধীন বাঙলাদেশের সাতটি শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে মোটা দাগে যে বিষয়গুলো উঠে আসে, তা থেকে প্রাসঙ্গিক কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হলো।

প্রপঞ্চআলোচনা
বৈষম্য ও শিক্ষা ধারাপ্রায় সকল কমিশনই তাদের রিপোর্টে বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা বাতিলের সুপারিশ করেছে, কিন্তু সব সরকারের আমলেই বৈষম্য ও শিক্ষার ধারা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ভাষামাতৃভাষা হিশেবে বাঙলা; দ্বিতীয় ভাষা হিশেবে ইংরেজি। ১৯৭২ সালে বলা হয়েছে— “পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষা ব্যতিত অন্য কোনো ভাষা শিক্ষার প্রয়োজন নাই। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে একটি উন্নত আধুনিক ভাষা বাধ্যতামূলকভাবে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত উত্তমরূপে শিখতে হবে। ঐতিহাসিক কারণে বাংলাদেশের বাস্তব পরিবেশ যা, তাতে ইংরেজি দ্বিতীয় ভাষা হিশেবে শিক্ষা দেয়া হবে”। ২০০৩ সালে প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি শিক্ষা চালু করা হয়।
ধর্মীয় শিক্ষা১৯৭২ সালে ধর্ম শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভেতরে না রাখার সুপারিশ করা হয়। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম পর্যন্ত বৃত্তিমূলক শিক্ষা হিশেবে ধর্ম শিক্ষাকে বিবেচনার কথা বলা হয়।
১৯৮৮ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে ক্লাশ সময়ের ১০ ভাগ ও তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৮.৮৫ সময় ধর্ম শিক্ষার জন্য রাখার প্রস্তাব করা হয়।
১৯৯৭ সালে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়।
২০০৩ সালে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়।

পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক তৈরির ক্ষেত্রে যে রাজনীতি, তারও বিকাশ ধারা লক্ষ্যণীয়।

১৯৭৪প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যক্রম তৈরি করবে শিক্ষা পরিদপ্তর ও নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যক্রম তৈরি করবে শিক্ষা বোর্ড।
১৯৭৫কুদরত-ই-খুদা কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যক্রম তৈরির জন্য ‘বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়ন কমিটি’ গঠিত হয়।
১৯৮১শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন কেন্দ্র’ গঠিত হয়।
১৯৮৩এই কেন্দ্র ও টেক্সটবুক বোর্ডকে একত্র করে গঠিত হয় ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’।

কুদরত-ই-খুদা কমিশনে বলা হয়েছিলো এই ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড’- এর কাজ হবে পাঠ্যপুস্তক সংক্রান্ত গবেষণা। বর্তমানে তারা সরকারি পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক তৈরি, মুদ্রণ ও বিতরণের কাজ করে থাকে।

২০১৭ সালের পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন: জাতীয় শিক্ষা পাঠ্যক্রম ও তার বাইরের বই পর্যালোচনা

২০১৭ সালে যে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে, তা নিয়ে সর্বমহলে বিতর্ক সমালোচনা শুরু হয়েছে। বছরের প্রথম দিনই শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুলের সোয়া চার কোটি শিক্ষার্থীর মাঝে বিনামূল্যে ৩৬ কোটি ২১ লক্ষ বই বিতরণ করেছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এটি একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। ফলে পহেলা জানুয়ারি ‘বই উৎসব’ হিশেবেই পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু এ বছর ‘বই উৎসব’- এর উৎসবমুখরতা কাটতে না কাটতেই আমাদের সামনে এক ভয়াবহ চিত্র উন্মোচিত হয়েছে। এই চিত্র উন্মোচনে প্রথমত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং দ্বিতীয়ত গণমাধ্যম কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। যে সমালোচনা তৈরি হয়েছে সম্প্রতি বছরের পাঠ্যপুস্তক ঘিরে, তার তিনটি দিক রয়েছে। প্রথমত: বানান, ব্যাকরণ ও বাক্য-গঠন সংক্রান্ত ভুল; দ্বিতীয়ত: বিভ্রান্তিকর ও ভুল তথ্য পরিবেশন; তৃতীয়ত: সাম্প্রদায়িকীকরণ। বর্তমান নিবন্ধে তৃতীয় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে প্রাসঙ্গিকভাবেই, কেননা এর সঙ্গে রাজনীতি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। অতীতে আমরা দেখেছি পাঠ্যপুস্তকে তথ্যগত বিভিন্ন অসামঞ্জস্যতাও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটানো হয়েছে। যদিও তিনটি বিষয়কেই সমান গুরুত্ব দেয়া উচিৎ, তবুও নিবন্ধের দৈর্ঘ্য বিবেচনা করে কেবল তৃতীয় উপাদানটি অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকীকরণ নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে।

এ বছর মোট ৭৮টি পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। জাতীয় শিক্ষা পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত এই ৭৮টি বইয়ের বাইরেও বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেনসহ বিভিন্ন ধরনের স্কুলে যে বইগুলো পড়ানো হয়, সেগুলোও পর্যালোচনা করে দেখা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণের প্রস্তাব আসে মূলত তিনটি ধর্মভিত্তিক সংগঠনের কাছ থেকে। এক, হেফাজতে ইসলাম (১৬ মে, ২০১৬ তারিখে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপির মাধ্যমে); দুই, কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড— বেফাক (২০১৬ সালের ০৩ মে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে) এবং তিন, ইসলামী ঐক্যজোট (০৩ মে, ২০১৬ সালের সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে)। তাদের স্মারকলিপি ও সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মোট চারটি অভিযোগ এই তিনটি মৌলবাদী সংগঠনই উল্লেখ করেছে। সেগুলো হলো:

  • এক: পাঠ্যসূচিতে ‘ইসলামি’ ভাবধারার লেখা বাদ দেয়া হয়েছে। হিন্দুত্ববাদ প্রচারের রচনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তার স্থলে।
  • দুই:  ষষ্ঠ শ্রেণির ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ে তারা ৫৮টি ভুল আছে বলে দাবি করেছে।
  • তিন: হিন্দুত্ববাদ প্রচারে এনসিটিবি ও বোর্ডসমূহে হিন্দুদের রাখা হয়েছে।
  • চার: পাঠ্যসূচিতে হিন্দু ও নাস্তিক লেখকদের রচনা বেশি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

উল্লেখ্য যে, হেফাজত, বেফাক ও ইসলামী ঐক্যজোট সবচেয়ে বেশি দাবি তুলেছিলো প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাঙলা বইয়ের বিষয়ে। তাদের দাবি অনুযায়ী ষষ্ঠ শ্রেণির ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ে ৫৮টি ভুল থাকলেও মাত্র ৬টি ভুলের কথা তারা উল্লেখ করেছে। যেহেতু তারা বাঙলা বইয়ের বিষয়ে বেশি দাবি তুলেছে এবং মেরুদণ্ডহীন বর্তমান সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি সেগুলো মেনে নিয়ে পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণ করেছে, সেহেতু দ্বিতীয় থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বাঙলা বইয়ের বিষয়েই বিশদ আলোচনা তুলে ধরা হলো।

শ্রেণিঅংশবাদ পড়া লেখাযুক্ত হওয়া লেখাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে হেফাজতের দাবি
দ্বিতীয় শ্রেণিসবাই মিলে করি কাজতাদের দাবি উল্লিখিত গদ্যগুলো বাঙলা বই থেকে ২০১৩ সালে বাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই দাবি ভুল। সবাই মিলে করি কাজ [হযরত মুহাম্মদ (স) জীবনচরিত], খলিফা হযরত আবু বকর (রা.) এবং খলিফা হযরত ওমর (রা.) শীর্ষক বিষয়গুলো বাঙলা বইয়ে না থাকলেও ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা বইয়ে অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ২০১৩ সালে বিদায় হজ  ও শহিদ তিতুমীর  শীর্ষক নিবন্ধ দুটি বাঙলা বইয়ে না থাকলেও ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ বইয়ে ছিলো। অতএব, পাঠ্যক্রম থেকে এগুলো বাদ পড়েনি— এ বিষয়টি তাদের কেউ বলেছে কী?
তৃতীয় শ্রেণিখলিফা হযরত আবু বকর (রা.)
চতুর্থ শ্রেণিখলিফা হযরত ওমর (রা.)
পঞ্চম শ্রেণিগদ্য অংশবিদায় হজ
শহিদ তিতুমীর
কবিতা অংশকবি গোলাম মোস্তফা রচিত প্রার্থনাকবি কাদের নওয়াজ রচিত শিক্ষাগুরুর মর্যাদা
হুমায়ুন আজাদ রচিত বই  কবিতামুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কোরান বিরোধী কবিতা।
ষষ্ঠ শ্রেণিগদ্য অংশএস ওয়াজেদ আলীর রাঁচি ভ্রমণসৈয়দ মুজতবা আলীর নীল নদ আর পিরামিডের দেশভারতের ঝাড়খণ্ডের রাজধানী রাঁচি হিন্দুদের একটি তীর্থস্থান।
কবিতা অংশসানাউল হকের কবিতা সভাজসীমউদ্দীনের কবিতা আসমানী
আনন্দপাঠসত্যেন সেনের গল্প লাল গরুটাড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র সতততার পুরস্কারলাল গরুটা ছোটোগল্পের মাধ্যমে কোটি কোটি মুসলিম শিক্ষার্থীদের হিন্দুত্ববাদ শেখানো হচ্ছে।
সপ্তম শ্রেণিগদ্য অংশরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বলাই
মোতাহার হোসেন চৌধুরীর লাইব্রেরি
রণেশ দাশগুপ্তের মাল্যদান
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লাল ঘোড়া
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়ালা
লীলা মজুমদারের পাখি
হাবীবুল্লাহ বাহারের মরু ভাস্কর
মাল্যদান গল্পে  শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের বিষয়টি এসেছে। লাল ঘোড়া  গল্পে পশুর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে যা মুসলমানদের পশু কোরবানিতে বাধা দেবার ষড়যন্ত্র।
কবিতা অংশরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলাদেশের হৃদয়
সুকুমার রায়ের আনন্দ
কালিদাস রায়ের অপূর্ব প্রতিশোধ
জসীমউদ্দীনের বঙ্গবন্ধু
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মে দিনের কবিতা
স্বর্ণকুমারী দেবীর উপদেশ
ফয়েজ আহমদের স্মৃতিসৌধ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নতুন দেশ
জসীমউদ্দীনের আমার বাড়ি
সুনির্মল বসুর সবার আমি ছাত্র
গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের শোনো একটি মুজিবরের থেকে
সুকুমার রায়ের শ্রাবণে
সিকান্দার আবু জাফরের গরবিনী মা-জননী
সুফিয়া কামালের সাম্য
বাংলাদেশের হৃদয় কবিতায় দেবী দূর্গার প্রশংসা করা হয়েছে।
আনন্দ কবিতায় ফুলকে ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে, যা ইসলামের পরিপন্থী।
অপূর্ব প্রতিশোধ কবিতায় ইসলামের প্রশংসা করা হলেও কবি হিন্দু।
আনন্দপাঠশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লালুএই গল্পের মাধ্যমে মুসলিম শিক্ষার্থীদের পাঁঠাবলির নিয়ম-কানুন শেখানো হচ্ছে।
অষ্টম শ্রেণিগদ্য অংশকাজী নজরুল ইসলামের প্রবন্ধ বাঙালির বাংলাকাজী নজরুল ইসলামের ভাব ও কাজ
কবিতা অংশজসীমউদ্দীনের দেশ
বুদ্ধদেব বসুর নদীর স্বপ্ন
জসীমউদ্দীনের রুপাই
কালিদাস রায়ের বাবুরের মহত্ত্ব
কায়কোবাদের প্রার্থনা
আনন্দপাঠউপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর রামায়ণের কাহিনী (আদিখণ্ড)মুসলিম শিক্ষার্থীদের হিন্দুদের রামায়ণ পড়ানো হচ্ছে বলে হেফাজতের দাবি।
নবম-দশম শ্রেণিগদ্য অংশসঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রমণকাহিনী পালামৌমোতাহার হোসেন চৌধুরীর প্রবন্ধ লাইব্রেরি
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ফুলের বিবাহ
পালামৌ ভারতের একটি পর্যটনকেন্দ্র সুতরাং এটি বাদ দিতে হবে।
কবিতা অংশজ্ঞানদাসের সুখের লাগিয়া
ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের আমার সন্তান
লালন শাহের সময় গেলে সাধন হবে না
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাঁকোটা দুলছে
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর খতিয়ান
শাহ্ মোহাম্মদ সগীরের বন্দনা
আলাওলের হাম্দ
আব্দুল হাকিমের বঙ্গবাণী
কাজী নজরুল ইসলামের উমর ফারুক
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মিছিল
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মে দিনের কবিতা
জ্ঞানদাসের সুখের লাগিয়া কবিতায় রামকৃষ্ণের ভক্তি ফুটে উঠেছে।
ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের আমার সন্তান কবিতায় দেবী অন্নপূর্ণার প্রশংসা ও তার প্রতি প্রার্থনা ফুটে উঠেছে।
লালন শাহের সময় গেলে সাধন হবে না কবিতাটিতে বাউলদের বিকৃত যৌনাচারের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাঁকোটা দুলছে কবিতায় দেশভাগকে হেয় করে কৌশলে ‘দুই বাংলা এক করে দেওয়া’ অর্থাৎ বাঙলাদেশকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।

পর্যালোচনা করে দেখা গেছে হেফাজত যে ২৯টি পরিবর্তনের কথা বলেছে, তার পুরোটাই মেনে নিয়েছে এনসিটিবি। সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির দুটি পাঠ্যবই ছাপা হবার পর যখন দেখা গেলো হেফাজতের দাবি মতে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর রামায়ান-কাহিনী  ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লালু  বাদ পড়েনি, তখন চার কোটি টাকা মূল্যের ১৫ লক্ষ বই বাতিল করে আবার তা ছাপানো হয়, যেনো হেফাজতের দাবি নিখুঁতভাবে মানা হয়।

জাতীয় শিক্ষা পাঠ্যক্রমের বাইরেও সাম্প্রদায়িকীকরণের চূড়ান্ত নজির রয়েছে, কিন্তু সেগুলো দেখার কেউ নেই। এ বইগুলো মূলত শিশু শিক্ষার জন্য বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেনসহ নানা ধরনের বিদ্যালয়ে ব্যবহূত হচ্ছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রম বিষয়ে কারও কোনো নজরদারি নেই, ফলে তারা বর্ণবাদী এবং সাম্প্রদায়িক কুশিক্ষায় শিশুদের মনোজগৎ ধ্বংস করে দিচ্ছে। এরা বর্ণ শিক্ষা দেবার ক্ষেত্রে যে ধরনের বাক্য ব্যবহার করেছে, সেগুলো ওয়াহাবীবাদের সমর্থকরা ব্যবহার করে। এমন কিছু বই, যেগুলো রাজধানীর বিভিন্ন কিন্ডারগার্টেনসহ নানা ধরনের বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত।

  • ৩৮/২-খ, বাংলাবাজার থেকে প্রকাশিত ফ্রেন্ডস বুক সেন্টারের হিমেলের বাল্যশিক্ষা বইয়ে অ-তে রয়েছে ‘অজু করে পাক হও’। আ-তে ‘আযান শুনে জামাতে যাও’। ই-তে ‘ইসলাম শান্তি চায়’। ঈ-তে ‘ঈমান বাড়ায় শক্তি’। এ-তে ‘এক হও মুসলমান’। ঐ-তে ‘ঐশী বাণী আল কোরান’ ইত্যাদি। এরা স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ সবগুলোতেই ইসলামী প্রথা ও রীতির প্রতিফলক বাক্য রচনা করেছে। অথচ বইটি কোনো মাদ্রাসার জন্য লেখা হয়নি। এদের বইয়ের ইংরেজি অংশেও একই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ইংরেজি বা বাঙলা সব ছড়াই ইসলামভিত্তিক। যেমন: এদের ইংরেজি অংশে ত দিয়ে শব্দ রাখা হয়েছে তড়ড় বাক্য গঠন করা হয়েছে বাঙলায়— “চিড়িয়াখানায় আল্লাহর কুদরত দেখো”। ছবি হিশেবে ব্যবহৃত হয়েছে চিড়িয়াখানার গেট। এই গেটে আল্লাহর কী কুদরত, তা বোঝা শক্ত!
  • ৪৭/১ বাংলাবাজার থেকে প্রকাশিত হিউম্যান পাবলিকেশন্সের অ আ ক খ এবং ১৪, বাংলাবাজার থেকে প্রকাশিত সাজু পাবলিকেশন্সের আমার বর্ণমালা বই দুটির বাক্য হুবুহু এক এবং তিনটি বাদে বাকি সবগুলো ইসলামী রীতি প্রথার প্রতিফলক বাক্য।
  • ১৬/১৭, বাংলাবাজার থেকে প্রকাশিত শাহ্ আলী (রাঃ) লাইব্রেরীর আদর্শ লিপি বইয়েরও একই পরিস্থিতি। এখানেও ইসলামী বাক্যের বাইরে আর কোনো বাক্য পাওয়া যায়নি। একই ঠিকানা থেকে প্রকাশিত শিশু সাহিত্য সেন্টারের বইগুলোও ভয়ানকভাবে সাম্প্রদায়িক বাক্যে পরিপূর্ণ।

এই বইগুলো পাশাপাশি রেখে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাঙলা ৫০টি বর্ণের মধ্যে ২৯টি বর্ণ দিয়ে ইসলাম ধর্মভিত্তিক বাক্য রচনা করা হয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ মিল হলো, সব কয়টিতেই তৃতীয় ব্যঞ্জনবর্ণ ‘গ’ দিয়ে বাক্য রচনা করা হয়েছে— “গান শোনা ভালো নয়”। এসব বইয়ের মধ্যে যেসব ইংরেজি ছড়া ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো মূল নানা ছড়ার বাক্য বদলে ধর্মভিত্তিক করা হয়েছে। যেমন:

Brightly Shining Silver Star,

Who has made you as you are?

Sparkling over land and sea,

High above the highest tree.

Allah created you and me

In truth so perfectly.

পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন: আধিপত্যবাদের রাজনীতি কায়েমের কৌশল

২০১৭ সালের পাঠ্যপুস্তকে যে সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হয়েছে, তা হঠাৎ করে হয়নি। আবার ব্যাপারটি এমনও নয় যে, এখানেই শেষ। বস্তুত একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার বড়ো ফলাফলটি আমরা প্রত্যক্ষ করলাম এ বছরের পাঠ্যপুস্তকে। এর পরে কী কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। বস্তুত শিক্ষার্থীদের মনোজগতে একটি সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে দেয়া হলো এবং এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থাপত্র গ্রহণ করা হয়নি। প্রশ্ন হলো, পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন কি কোনো একক সিদ্ধান্তে হতে পারে? নিশ্চয়ই না। এর জন্য একটি কমিটি নিশ্চয়ই রয়েছে, যারা পরিবর্তনের কারণগুলো পর্যালোচনাপূর্বক সংযোজন, বিয়োজন বা পরিমার্জন করেন। সে কমিটির কার্যাবলীও নিশ্চয়ই একক সিদ্ধান্তে পরিচালিত হয় না। সেখানেও মতামতের ক্ষেত্রে সংখ্যাধিক্য বিবেচনায় নেয়া হয়। অর্থাৎ সমাজে অন্যান্য সংগঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, তার অভিজ্ঞতায় আমরা বলতে পারি, এখানেও নিশ্চয়ই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গৃহীত হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা এনসিটিবি’র কর্তা ব্যক্তিরা স্বেচ্ছায় এই সাম্প্রদায়িকীকরণ করেছেন। কিন্তু বিষয়টি এতো সরল সম্ভবত নয়। কেননা, বাঙলাদেশের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বলে, সরকার পরিবর্তন হলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের একটি রদ-বদল ঘটে। সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ব্যক্তিরাই তখন প্রশাসনের নানা পর্যায়ে আসেন। প্রশাসন বা অন্যান্য ক্ষেত্রে এই দলীয়করণ ভালো না মন্দ, সে আলোচনা এখানে নয়; কিন্তু যে আলোচনাটি গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো— বর্তমান মহাজোট সরকার প্রায় সাত বছরের অধিক সময় ধরে ক্ষমতায় থেকে কাদের নিয়োগ দিলেন, যারা হেফাজতের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী পাঠ্য পুস্তকে পরিবর্তন করলো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে বাঙলাদেশের গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার দিকে তাকাতে হবে। এই কিছুদিন আগে এডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত একটি আলোচনায় বলেছেন, বর্তমান সরকারের সময় জামায়াতে ইসলামের ৭২ জন রোকন পর্যায়ের নেতা বিভিন্ন স্থান থেকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা মার্কায় নির্বাচন করে চেয়ারম্যান পদে জয় লাভ করেছে। তাছাড়া প্রায়শই গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, জামাত-বিএনপি’র নেতারা এখন দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগদান করছে। এটি তো গেলো প্রকাশিত তথ্য, এমন অপ্রকাশিত নানা তথ্য রয়েছে, যেগুলো এখনও হয়তো আমরা জানতে পারি না। প্রশাসনের নানা পর্যায়ে এখন জামায়াতের ভাবাদর্শের লোকজন বেশ শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। কাজটি তারা করেছে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতা ও অসততার সুযোগে। এরা ভোল পাল্টে এখন বঙ্গবন্ধুর বাণী আওড়াচ্ছে এবং সরকারও তেলে টইটুম্বুর হয়ে এদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে বসাচ্ছে। তাছাড়া আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যেও অনেকেই সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ ধারণ ও লালন করে। এরা মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা বললেও আদতে এদের প্রতিটি কাজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধি। হেফাজতের মতো উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গেও আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার দহরম মহরম সম্পর্ক। এরা আদতে এক থালার লোক।

নানা অপকৌশল অবলম্বন করে এরা ধীরে ধীরে রাষ্ট্রযন্ত্রে আবার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এবং প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিচয়ে। এই ভয়ানক অনুপ্রবেশকারীদের আওয়ামী লীগ ‘মাল্টি ক্লাশের’ দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে আক্ষরিক অর্থেই যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেন, তারা ধীরে ধীরে হয়ে পড়ছেন সংখ্যালঘু। ফলে মতামত দেবার স্বাধীনতা তাঁদের থাকলেও, তা কোনো কাজে লাগছে না। ২০১৭ সালের পাঠ্যপুস্তকে যে সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটেছে, তা হলো এই ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধবিরোধিদের প্রতিষ্ঠারই ফলাফল। সরকারের আপোষনীতি তো আছেই, প্রশাসনেও এই আপোষকে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানানোর মতো লোকের অভাব নেই। বস্তুত শিক্ষাক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াটিই গত কয়েক বছরে প্রতিষ্ঠা করেছে স্বাধীনতাবিরোধি চক্রের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতা।

পাকিস্তানি আমলে নজরুলের কবিতার ‘মহাশ্মশান’ কেটে ‘গোরস্থান’ বানানো হয়েছিলো। জসীমউদ্দীনের নিমন্ত্রণ  কবিতার নাম পাল্টে করা হয়েছিলো ‘দাওয়াত’। তেমনি হেফাজতের আবদার রাখতে গিয়ে বর্তমান পাঠ্যপুস্তকের ইংরেজি বইয়ের একটি চরিত্রের ‘উত্তম’ নাম বাদ দিয়ে ‘অলিউল’ রাখা হয়েছে। গণমাধ্যমের সূত্র মতে জানা যায়, ‘উত্তম’ হিন্দু শব্দ হওয়াতে হেফাজত তাতে আপত্তি জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ২০১৭ সালের ১৯ জানুয়ারি দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের কিছু অংশ উদ্ধৃতি করছি—

.. .. এরপর উত্তম নামটি রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন বোর্ড কর্মকর্তা রতন সিদ্দিকী। এক পর্যায়ে তা মানেনও ইসলামী নেতারা। কিন্তু ওই সময় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা রতন সিদ্দিকীকে বলে ওঠেন, ‘স্যার, হুজুরদের বক্তব্য ঠিক আছে। হুজুরদের বক্তব্য অনুযায়ীই পাঠ্যবই রচনা হওয়া উচিৎ।

এই রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, পাঠ্য পুস্তক বোর্ডের উপরের চেয়ারে কারা বসে আছে। কথা হলো, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কী এ সম্বন্ধে জানে না? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে সামান্য কথা বলতে হবে। রাজধানীর অধিকাংশ সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মূলত জামাতি ভাবাদর্শের। গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক এক সময় ‘সংগ্রাম’ ও ‘কিশোর কণ্ঠ’ পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। তার সমস্ত দলিলপত্র নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও এ বিষয়ে তারা কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি। সুতরাং রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষদের সংখ্যালঘু করে রাখা হয়েছে। ফলে তাদের মতামত রাখার সুযোগ না থাকলেও দায় নিতে হচ্ছে। এটা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের মানুষদের প্রতি একটি মানসিক নির্যাতনও বটে। যেমন বাঙলাদেশের অনেকেই এই দহনযন্ত্রণায় ভোগেন যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সাড়ে বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। আওয়ামী লীগের হাতেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটেছে।

যোগাযোগের সবচেয়ে কার্যকরী হাতিয়ারটির সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটেছে

কয়েকটি নির্দিষ্ট বয়সের অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগের সবচেয়ে কার্যকর পন্থাটি হলো পাঠ্যপুস্তক। পৃথিবী জুড়ে পাঠ্যপুস্তকের বিষয় এবং তার মধ্য দিয়ে ইতিহাস ও রাজনীতির দীক্ষা শিক্ষার্থীদের মনোজগতে পৌঁছে দেবার নানা প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা হয়েছে। বেশ কিছু গ্রন্থও রচিত হয়েছে এ বিষয়ে। তার মধ্যে মিশেল ডাব্লিউ অ্যাপেলের তিনটি প্রবন্ধ যুগান্তকারী কিছু তথ্য আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। একটি প্রবন্ধের নাম আইডিওলজি অ্যান্ড কারিকুলাম , যেখানে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষাক্রমের রাজনীতি তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েতবিরোধী বেশ কয়েকটি প্রজন্ম গড়ে তুলেছে কেবল পাঠ্য পুস্তকের মাধ্যমে। ২০১৪ সালের ১৩ জানুয়ারি নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়তেও এমন একটি তথ্য উঠে আসে, যা জাপান এবং সাউথ কোরিয়া বিষয়ে। দুটো রাষ্ট্রই তাদের পাঠ্যপুস্তকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট ইতিহাসের বয়ান পরিবর্তন করে নিজেদের মতো ইতিহাস তৈরি করে। ফলে জাপান এবং সাউথ কোরিয়ার বর্তমান প্রজন্ম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস জেনে বড়ো হয়েছে। চীন এবং হংকং ঔপনিবেশিকতার যে নিজস্ব বয়ান তৈরি করেছে, তাও তারা পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে করেছে। জন লিমন হার্ট তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য সিআইএস’ রাশিয়ানস– এ আমাদের জানিয়েছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর বিভিন্ন রাষ্ট্রের পাঠ্যপুস্তকে মার্ক্স ও লেলিনবাদ বিরোধী বক্তব্য বিশ্লেষণ অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সিআইএ কীভাবে কাড়ি কাড়ি ডলার খরচ করেছে। সুতরাং সব দেশেই সব সময়েই পাঠ্যপুস্তককে যোগাযোগ ও মানসকাঠামো গঠনের সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হিশেবে বিবেচনা করা হয়। বাঙলাদেশে এই মাধ্যম আরও শক্তিশালী, কেননা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যপুস্তকের বাইরে আর কিছু তেমন গুরুত্ব পায় না। অন্যদিকে পাঠ্যপুস্তকে যা দেয়া হচ্ছে, যেহেতু পরীক্ষা সেগুলোর মধ্য থেকেই হবে, সেহেতু এগুলো শিক্ষার্থীরা পড়তে বাধ্য। অন্যদিকে আমাদের শিক্ষকদের নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে ক্লাশ নেবার স্বাধীনতা দেয়া হয় না, তাঁদেরও পাঠদান করতে হয় নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তক ও পাঠ্যসূচির ভেতরে থেকেই।

সুতরাং সম্প্রতি পাঠ্যপুস্তকের যে সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটেছে, তা ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে চলে গেছে এবং এর আলোকে ক্লাশও শুরু হয়ে গেছে। আর কিছুদিন পর পরীক্ষা শুরু হবে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। অর্থাৎ একটি প্রজন্ম এই বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতা মাথার মধ্যে নিয়ে বড়ো হবে। ধরা যাক, আগামি পাঠ্যপুস্তকগুলো যদি অসাম্প্রদায়িকও হয়, তবুও তার মনোজগত পরিবর্তন হবে না বা হওয়াটা কঠিন। কারণ, ইতোমধ্যেই তার কাছে একটি বার্তা পৌঁছে গেছে যে, এই পাঠ্যপুস্তকে যা রাখা হয়েছে তা কতিপয় হুজুরের পরামর্শে রাখা হয়েছে; আগামিতে তা পরিবর্তন করলে তার প্রথমেই মোনে হবে বা তাকে বোঝানো হবে যে, হুজুরদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। রাষ্ট্র যে হুজুরদের নয়, রাষ্ট্র যে সবার— এই ধারণা তখন তাকে দেয়া অনেক কঠিন কাজ হয়ে পড়বে। সুতরাং আর কে কতোটা আশাবাদী আমি জানি না, তবে আমি তাকিয়ে আছি এই প্রজন্মের বড়ো হবার দিকে এবং আতঙ্কবোধ করছি এই কারণে যে, আগামিতে কতোজন নিবরাস এই প্রজন্ম থেকে বের হবে।

শেষ কথা

পাঠ্যপুস্তকে যে গরমিল রয়েছে, তার মাত্র একটি দিক নিয়ে এখানে আলোচনা হয়েছে— “সাম্প্রদায়িকতা”। তথ্য ও তত্ত্বগত ভুল, ব্যাকরণগত ভুল, উপস্থাপনার ভুল, অসম্পূর্ণ তথ্যসহ আরও অন্তত ১৩ রকমের ভুল রয়েছে চলতি বছরের পাঠ্যপুস্তকে। সেগুলো পড়েই একটি প্রজন্ম এ বছরের শিক্ষাবর্ষ শেষ করবে। এর চেয়ে আত্মঘাতী আর কোনো ঘটনা আমার চোখে পড়ে না। শিক্ষা ও পাঠ্যপুস্তক নিয়ে এক ধরনের নোংরা রাজনীতি চলছে বাঙলাদেশে। এমনিতেই শিক্ষা ব্যবস্থা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে, বিগত কয়েক বছরে তাকে একেবারে শয্যাশায়ী করে ফেলা হয়েছে। আমাদের সকলের এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। না হলে সরকার এই রোগাক্রান্ত শয্যাশায়ী শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রথমে মর্গে পাঠাবে, তারপর ফরমালিন দিয়ে সেটাই আবার আমাদের সামনে হাজির করবে। আগামি প্রজন্মের মগজের কফিনের শেষ পেরেকটা ঠুকার আগেই আমাদের প্রতিরোধ যেনো রাষ্ট্রের যাবতীয় অসভ্যতাকে আঘাত করতে পারে। জয় বাঙলা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *