ফিরে দেখা নিমতলী ট্র্যাজিডি

গত ৩ জুন পালিত হলো নিমতলী ট্র্যাজিডির এক বছর। ২০১০ সালে সংগঠিত এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নিঃশেষ হয়ে যায় অনেকগুলো প্রাণ, স্তব্ধ হয়ে যায় শত কণ্ঠস্বর; আর সেই সাথে ধুলিস্যাৎ হয় কতো কতো স্বপ্ন- তার কোনো হিসেব নেই। এক বছর পর নিমতলীতে সংগঠিত সেই ভয়াবহ অগ্নিকা–ের দিকে ফিরে তাকালে আজও আমরা আতঙ্কিত হই। মনে প্রশ্ন  জাগে- এরকম একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটার পরও কি আমরা সচেতন হয়েছি? হইনি। আজও নিমতলীর সে-ই একই দৃশ্য, কেমিক্যালের গোডাউনে ঠাসা, ঘিঞ্জি জীবন ধারণ আর সেই সাথে আবারও কোনো দূর্ঘটনার আতঙ্ক। এই এক বছরে নানা মহল থেকে এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে- কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। পরিস্থিতি আগের মতোই রয়ে গেছে- মাঝখান থেকে নিভে গেছে ১২৫ জন মানুষের জীবন। আর যারা আহত হয়েছিলেন- এখনও তারা ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন, শরীরের ক্ষতে আর মনের গহীনে বহন করে ফিরছেন সে-ই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের স্মৃতি।

বাঙলাদেশসহ বিশ্বের যে কোনো দেশে অগ্নিকাণ্ডের মতো দূর্ঘটনার নির্মম শিকার হন মূলত নারীরাই। ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব ম্যাডিসিন’ এর চলতি সংখ্যার একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের মতো ভয়াবহ দূর্ঘটনায় প্রধানত নারীরাই আক্রান্ত হন বেশি। বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত রাষ্ট্রগুলোতে- যেখানে নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ অপ্রতুল কিংবা নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি এখনও আশাব্যঞ্জক নয়। যেহেতু গৃহে নারীকেই সময় দিতে হয় বেশি এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতে নারীর কাজ ঘরেই সীমাবদ্ধ থাকে- তাই গৃহস্থালি অগ্নিকাণ্ডে তাদের মারাত্মক শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়। অন্যদিকে নারীর কর্মক্ষেত্রের সুযোগ বলতে যা আছে- সেখানেও অগ্নিকাণ্ডের মতো দূর্ঘটনা মোকাবেলার কোনো বিজ্ঞানসম্মত উপায় অনুসরণ করা হয় না। এ কারণেই পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন কল-কারখানায় সংগঠিত দূর্ঘটনাগুলোতে নারীই বলি হয়ে থাকে নির্বিচারে।

নিবন্ধে উল্লিখিত বক্তব্যের সাথে বাঙলাদেশের পরিস্থিতি মিলিয়ে দেখলে এ কথা সহজেই অনুমেয় যে- অগ্নিকাণ্ডের মতো দূর্ঘটনায় আক্ষরিক অর্থেই নারী প্রধান শিকার। নিমতলীর ঘটনায় নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা ৭৫। পুরুষও এরকম ঘটনার শিকার হয়ে থাকে। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা আসলে কতোটুকু প্রস্তুত, বা আদৌ প্রস্তুত কি?

নিমতলীতে এমন একটি দূর্ঘটনা ঘটার পরও সেখানে আক্ষরিক অর্থে কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে? হয়নি। নিমতলীর ঘটনা স্মরণে গত ৩ জুন ‘অগ্নিসচেতনতা দিবস’ হিসেবে পালন করেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ডিএমসি) বার্ন ইউনিট ও বাংলাদেশ সোসাইটি ফর বার্ন ইনজুরিস। এ উপলক্ষে বার্ন ইউনিট মিলনায়তনে আয়োজিত এক সভায় স্বাস্থ্য মন্¿ণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের জন্য ৫০-শয্যা যথেষ্ট নয়। শয্যার সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। তিনি আক্ষেপ করে এটাও বলেন, নিমতলীর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি যাদের দোষী চিহ্নিত করেছিল, তাদের কারোরই বিচার হয়নি। একজনেরও যদি বিচার হতো, তাহলে অন্যরা তাদের রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে ফেলত।

কিন্তু এ বিচার কেনো হয়নি? এ প্রশ্নটি আমাদের মনে আসবেই। এমন একটি দূর্ঘটনার জন্য যারা দায়ী তারা এখনও প্রকাশ্যে ব্যবসা করে বেড়াচ্ছে- বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে প্রশাসনের প্রতি, এতো স্পর্ধা তাদের হয় কি করে? তাছাড়া প্রশাসনের ঢিলেঢালা মনোভাবের প্রশ্নও এখানে আসছে। এক বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও আজও তদন্ত কমিটির কোনো রিপোর্ট দেশবাসী জানতে পারেনি। টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়েছিলো; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ওই সময় সরকার আদেশ দিয়েছিলো নিমতলী থেকে কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সরানোর। কিন্তু গোডাউনগুলোও সরানো হয়নি। ঝুঁকির মধ্যেই রয়ে গেছে নিমতলীর বাসিন্দাদের জীবন। বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামন্তলাল সেন বলেন, দেশে যেন আর কোনো ভয়াবহ অগ্নিকা– না ঘটে সেটি প্রতিরোধ করতে প্রচারাভিযান চালাতে হবে। মানুষকে সচেতন করা গেলে আগুনে পুড়ে মৃত্যু কমানো সম্ভব হবে।

নিমতলীর নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে নবাব কাটরা (নিমতলী) যুব সংঘ নির্মাণ করেছে স্মৃতিস্তম্ভ। নাম ‘নিমতলী ট্র্যাজেডি’। নবাব কাটরার গলির ভেতরে ঢুকতেই পঞ্চায়েত কমিটির মোড়ে চোখে পড়বে এই স্মৃতিস্তম্ভ।

৩ জুন সকালে এর উদ্বোধন করেন স্থানীয় সাংসদ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। স্মৃতিস্তম্ভে খোদাই করে লেখা আছে ‘আজ এবং আগামী প্রজন্মকে সচেতন করার লক্ষ্যে “নিমতলী ট্র্যাজেডি” নির্মিত। এটি একটি সচেতনতার প্রতীক’। আমরা এই প্রতীকটিকে ধরে রাখতে চাই- কেবল হৃদয়েই নয়, আমাদের কাজে এবং সচেতনতায়।

কিন্তু নিমতলীতে দাহ্য ও রাসায়নিক পদার্থের গুদাম সরানোর বিষয়ে সরকারকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ এ দূর্ঘটনার মূল কারণই ছিলো এই দাহ্য ও রাসায়নিক পদার্থের গুদামগুলো। এতো প্রাণ যে কারণে নিভে গেলো, তার বিচার জনগণ প্রত্যাশা করে। এই জনদাবির প্রতি সরকারের অবিলম্বে নজর দেয়া উচিত বলে মনে করি।

২৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *