যে মশাল দিয়ে গেছেন জাফর মুন্সী আর রাজীব হায়দার
আমাদের প্রাত্যহিক জীবন বসন্তের রঙে রঙিন হয়েও কী আশ্চর্য দ্রোহ টাঙিয়ে রাখে মধ্য ফেব্রুয়ারির সদর দরোজায়। কেবল রঙ কিংবা সঙ্গীতেই নয়; বসন্ত প্রাসঙ্গিক হয় মৃত্যু আর বিদ্রোহের কোলাজে, আমাদের নিয়ে চলে ইতিহাসের দায়মুক্তির সোপানে— ১৯৫২ আর ২০১৩ সালে।
মধ্য ফেব্রুয়ারির গনগনে উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা টের পাই কয়েকটি জীবন গিয়েছে চলে, জীবনের তথাগত মানে ছাড়িয়ে আরও সুদূরে, স্বদেশের মাটির গন্ধ গায়ে মেখে তারা অটল দাঁড়িয়ে আছেন সময়ের স্রোতোস্বিনী মহা-প্রান্তরে। এবং আমরা, যারা এখনও গোল্ড ফিশ মেমোরি নিয়ে পথ হারাই, তাদেরকে এই পূণ্যাত্মারা প্রায়শই টেনে আনেন কোমল গান্ধার থেকে বেথোফেনের ফিফথ সিম্ফোনির দুয়ারে।
আমরা আমাদের রক্ত আর ইতিহাসের ধারাটি পুনরায় সনাক্ত করি; কিন্তু কতোটা হেঁটে যেতে পারি তার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয় সময়ের ব্যাপ্ত চরাচরে। আমদানিকৃত সংস্কৃতির রঙচঙা ক্যাকাফোনি পেরিয়ে আমাদের প্রণয়াঞ্জলি নিবেদিত হবে শহিদ জাফর মুন্সী ও ব্লগার রাজীব হায়দারের পদতলে; কেননা যে সূর্যমুখী সংগ্রামের পথ ধরে আমরা হাঁটছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে তারাই তার অখণ্ড প্রেরণার প্রথম স্মারক মশাল।
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো ইতিহাসের দায়মোচনের প্রশ্নে। মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধে যে নরপিশাচরা বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিলো, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে যূথবদ্ধ মানুষ পথে নেমে এসেছিলো ইস্পাতসম দৃঢ়তায়। স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হলেও মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন যে বাস্তবায়িত হয়নি, ২০১৩ সাল থেকেই বাংলার মানুষ সে কথা জানাচ্ছে শ্লোগানে-প্রতিবাদে-দ্রোহে।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা এ অহিংস আন্দোলন সুনির্দিষ্ট ছয় দফা দাবিতে রচনা করে আন্দোলনের পথরেখা। তাতে ন্যায় বিচারের লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন, যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতে ইসলাম এবং তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী ছাত্র শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিসহ তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও উল্লেখ করা হয়।
২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসীদের নির্মম আক্রমণে আহত জাফর মুন্সী নিহত হন ১৪ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার। পেশায় তিনি ছিলেন অগ্রণী ব্যাংকের মতিঝিল প্রধান শাখার লিফটম্যান। সকল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সারাদেশ যখন উত্তাল, তখনও জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা চালিয়ে যাচ্ছিলো সন্ত্রাসী অপ-তৎপরতা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের এ সম্মিলিত প্রতিবাদে তারা বুঝে গিয়েছিলো বাংলার মানুষ জেগে উঠলে কোনো অশুভ শক্তিই টিকে থাকতে পারবে না। তাই হরতালের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী দল জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা ন্যাক্কারজনক আক্রমণ চালায় সহযোদ্ধা জাফর মুন্সীর ওপর। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে তিনি নিহত হন নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। জাফর মুন্সীকে হত্যা করে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের তাঁবেদার সন্ত্রাসীরা চেয়েছিলো গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে।
কিন্তু শহিদ জাফরের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সারাদেশের আন্দোলন আরও বেগবান হয়। কমলাপুরের মেসে থাকা এই মানুষটি নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন সংগ্রামের পথে ত্যাগের আলেখ্য কী করে বিদ্যুত স্ফূলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
সংঘবদ্ধ মানুষের প্রতিবাদ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। জাফর মুন্সীর আত্মত্যাগ রচনা করে সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায়। গণজাগরণ মঞ্চের ছয় দফাকে কেন্দ্র করে সর্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনে জাফর মুন্সীর রক্ত হয়ে উঠে শপথের নতুন রক্তালেখ্য। যুদ্ধাপরাধীদের তাঁবেদারি করতে থাকা সুশীতল সুশীলদের চোখে আঙুল দিয়ে জাফর মুন্সী দেখিয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে মেরুদণ্ড বিক্রি করে স্বাধীন বাংলাদেশে গলা চড়ানো যাবে না।
তার আত্মত্যাগ আমাদের জানিয়েছে এই দেশকে যুদ্ধাপরাধী জামাত-শিবির মুক্ত করতে রক্ত ঝরা সংগ্রামের পথেই হাঁটতে হবে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত। শহিদ জাফর মুন্সীর হত্যাকাণ্ডের বিচার আজও হয়নি। হত্যার তিন বছর পেরিয়ে গেলেও জাফর মুন্সী হত্যাকাণ্ডের কোনো সুরাহা করতে পারেনি রাষ্ট্র। এতে রাষ্ট্র লজ্জিত হয় কি না জানি না, তবে রাষ্ট্রের নাগরিক হিশেবে আমাদের লজ্জা হয়।
আমাদের সহযোদ্ধা জাফর মুন্সী হত্যার তিন বছর পেরিয়ে গেলেও বিচারের প্রশ্নে রাষ্ট্রের এই হিমশীতল নীরবতা আমাদের ক্ষুব্ধ করে। ন্যায়বিচার বা আইনের শাসনের প্রতি আস্থা রাখার ক্ষেত্রে কোনো স্বাধীন দেশের নাগরিককে এতোটা ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয় কি না আমাদের জানা নেই।
সহযোদ্ধা জাফর মুন্সীকে হত্যার মাত্র একদিন পরেই হত্যা করা হয় আমাদের আরেক সহযোদ্ধা ব্লগার রাজীব হায়দার শোভনকে। রাজীব হায়দারকে হত্যা করেই গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নীল নকশা প্রকাশ করতে থাকে যুদ্ধাপরাধীরা। রাজীব হায়দারকে হত্যার পরই আমাদের সামনে উন্মোচিত হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রকৃত চেহারা। আমরা বুঝতে পারি মৌলবাদ-জঙ্গীবাদের কী ভয়াল মেঘমালার নিচে আমরা অবস্থান করছি। গণজাগরণ মঞ্চকে ঘিরে আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ক শুরু করে নানা সুবিধাবাদী মহল।
রাজীব হায়দার ‘থাবা বাবা’ নামে ব্লগে লিখতেন। তার লেখা ছিলো যুক্তি নির্ভর ও দর্শনভিত্তিক। যুক্তির আলোকে যে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। সে-ই আলোচনার দ্বারই উন্মোচিত হতো তার লেখায়। প্রতিটি লেখকের নিজস্ব আদর্শ দর্শন থাকে, সেটাই স্বাভাবিক। সে-ই দর্শনকে নিয়েই তিনি তার লেখা তৈরি করবেন।
রাজীব হায়দারের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করলাম রাজীব হায়দারকে হত্যা করে হত্যাকারীরা ফেসবুকে নানা রকম মিথ্যাচার শুরু করলো। তার নামে ভুয়া ব্লগও তৈরি করলো নানা ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি-গোষ্ঠী ও গণমাধ্যম উঠে পড়ে লাগলো এটা প্রমাণ করার জন্য রাজীব হায়দার কতো বড়ো নাস্তিক, যেনো নাস্তিক হলেই তাকে হত্যা করা জায়েজ হয়ে যায়। রাজীব হায়দারকে হত্যা করে যুদ্ধাপরাধী ও মৌলবাদী অপগোষ্ঠী তাদের পুরোনো অপ-কৌশলকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করে নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্যে।
আমরা যদি যুদ্ধাপরাধীদের পত্রিকা ‘দৈনিক সংগ্রাম’- এর ১৯৭১ সালে প্রকাশিত রিপোর্টগুলো দেখি, তাহলে দেখবো মুক্তিযুদ্ধকে নানা প্রশ্নবিদ্ধ করার একটি অপ-কৌশল ছিলো নাস্তিক্যবাদের ধুয়া তোলা। দেশ স্বাধীনের পরও যতোবার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি উঠেছে, ততোবার এই যুদ্ধাপরাধীরা বিচারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ‘নাস্তিক্যবাদ’কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।
শহিদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও আমরা গজায়মান কিছু মৌলবাদী সংগঠনকে দেখেছি, যারা সে-ই আন্দোলনের বিরুদ্ধে এই একই অভিযোগ তুলেছিলো। এমনকি বর্তমান মহাজোট সরকারের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকেও অনেকবার এই কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করলাম হেফাজতে ইসলাম নামের একটি মৌলবাদী সংগঠন মধ্যযুগীয় তেরো দফা দাবি নিয়ে পথে নামলো। তাদের দাবি ও বক্তব্য শুনেই বোঝা গেলো এরা ইসলামকে নয়, জামায়াতে ইসলামীকে হেফাজত করার কাজে নেমেছে। এদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলতে শুরু করলো কিছু প্রগতি লেবাসধারী। বিষয়গুলো নিয়ে বিগত তিন বছরে অনেক আলোচনা হয়েছে; কিন্তু যে বিষয়টি আলোচনার অন্তরালেই রয়ে গেছে, তা হলো— কেনো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ আসলেই যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দোসররা নাস্তিক্যবাদের অবতারণা করে?
এর উত্তর খোঁজার আগে আমাদের জানতে হবে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আলোকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, তাতে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ একটি আদর্শিক লড়াই এবং সেই আদর্শের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই আমাদের স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতি, অর্থনীতি বা সমাজনীতির একটি বড়ো চ্যালেঞ্জ। একজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিশ্বাস তার নিজস্ব দর্শনের আলোকে প্রতিষ্ঠিত। আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে, অনেক তত্ত্ব বাতিল হয়ে যাচ্ছে। যুক্তির ধারার একটি বড়ো ঢেউ হলো বিজ্ঞান।
বিজ্ঞান বা দর্শনের ক্রমবিবর্তনও একটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। দর্শন ও বিজ্ঞানের ইতিহাস পাঠ করলে আমরা দেখতে পাই, একটি ভুল ধারণার ওপর ততোদিন পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত ছিলো, যতোদিন শুদ্ধ নতুন ধারাটির জন্ম না হচ্ছে। আবার এও আমরা দেখেছি জ্ঞানের নতুন ধারার বিকাশের অনেক ক্ষেত্রেই সৃষ্টি হয়েছে বাধা; কখনও কখনও প্রগতির পক্ষে দাঁড়িয়ে মানুষকে জীবনও দিতে হয়েছে। গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস, ব্রুনোর আত্মত্যাগী জীবনের কাহিনি আমরা সকলেই জানি। এ ঘটনাগুলোর পর বহু উন্নত হয়েছে মানবসভ্যতা। কিন্তু এই অসভ্য ঘটনাগুলো এখনও আমাদের তথাকথিত সভ্য সমাজের নিত্য সঙ্গী।
একজন ব্যক্তি— তিনি নাস্তিক না বিশ্বাসী, তাতে সত্যি বলতে কিছুই এসে যায় না। সভ্যতার কোনো উপকার বা অপকার সাধিত হয় না কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত দর্শন বা বিশ্বাসে। ব্যক্তির কাজই গুরুত্বপূর্ণ হয় আমাদের ভবিষ্যতের পথ নির্মানে। একটি রাষ্ট্র কতোটা মানবিক তা নির্ভর করে সে-ই রাষ্ট্রে বসবাসরত সকল নাগরিকের জীবন দর্শনের সাম্যাবস্থার ওপর। রাজীব হায়দারকে হত্যার পর আমরা দেখলাম অজানা কারণেই চিন্তাশীল একটি গোষ্ঠীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ছাড়লো রাষ্ট্র। চারজন ব্লগারকে গ্রেফতার করা হলো। সরকারের তাঁবেদারি করতে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির একটি অংশের আচরণও এমন হয়ে উঠলো যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতে হলে আগে আস্তিক-নাস্তিকের পরীক্ষা দিয়ে আসতে হবে।
গোটা দৃশ্যপটে আমরা বুঝতে পারলাম, প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সুযোগেও আমরা আসলে আরজ আলী মাতুব্বর বা আহমদ শরীফের সময়ের চেয়েও খারাপ একটি সময়ে বাস করছি। এই সময়ে কোনো প্রশ্ন করা চলবে না, কোনো প্রতিষ্ঠিত প্রথার বিরুদ্ধে আঙুল তোলা যাবে না। কেবল সেটুকু পথই হাঁটা যাবে, যেটুকু বিভিন্ন গোষ্ঠী দ্বারা অনুমোদিত। গত তিন বছরে আমরা ‘ধর্মানুভূতিতে আঘাত’ প্রসঙ্গে অনেক কথা শুনেছি।
আওয়ামী লীগের অনেক রাজনৈতিক নেতা ধর্মনুভূতিতে আঘাত লাগার ভয়ে হেফাজতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন করেছেন। আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক জনাব হাছান মাহমুদকে মেরুদণ্ড বাঁকা করে তেঁতুল হুজুরের সামনে বসে থাকার সেই ছবিটি তৎকালীন দোদুল্যমান পরিস্থিতির একটি খাঁটি উদাহরণ। গত তিন বছরে আমরা এও লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশে ‘ধর্মানুভূতি’ বলতে আসলে নির্দিষ্ট একটি ধর্মকেই বোঝানো হয়। অন্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার প্রতিনিয়ত খর্ব হলেও তাতে কারও কোনো মাথা ব্যথা নেই; কারণ রাষ্ট্রের নিজেরই ধর্ম ‘ইসলাম’।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জমি দখলের মহোৎসব আমরা বিভিন্ন সময় খবরের কাগজে দেখি। ঘাড় নিচু মাথা নিচু করে তারা দেশ ত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে ভাঙচুর হচ্ছে কিন্তু তখন ‘ধর্মানুভূতি’ প্রসঙ্গে কোনো আলোচনা হচ্ছে না। আবার ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রেও একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। তুহিন মালিক ইজতেমাকে নিয়ে কটূক্তি করলে কোনো উচ্চবাচ্য হয় না; কারণ উচ্চবাচ্য করা বা না করাটুকু নির্ভর করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে বক্তার অবস্থানের ওপর। এই সরল সত্যটি এখনও বাংলাদেশের মানুষের কাছে কতোটা স্পষ্ট, সেটি ভাববার বিষয়। কারণ রাষ্ট্রকে সুযোগ মতো সুবিধাজনক অবস্থান নিতে দেখে আমরা ক্লান্ত।
কিছুদিন আগে আমাদের সহযোদ্ধা রাজীব হায়দারের হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় ঘোষিত হয়েছে। আত্মস্বীকৃত খুনিদের লঘু দণ্ড দিয়ে আমাদের বিচার ব্যবস্থা কী সত্যনিষ্ঠতা থেকে সরে আসেনি? তাহলে কী ধরে নিতে হবে বিচার ব্যবস্থার ভেতরেও অনুভূতি সংক্রান্ত ভূত ক্রিয়াশীল? কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা আদর্শ যাই হোক না কেনো, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে তাঁর অবস্থান কতোটা পরিষ্কার— সেটাই হতে হবে বিবেচ্য। এই বিবেচনা কেবল জনগণ করলেই হবে না, রাষ্ট্রকেও করতে হবে। তবে জনগণের মানস কাঠামোতে এই ধারণাটি স্পষ্ট হলে রাষ্ট্র তার বিচ্যুতি সংশোধন করতে বাধ্য।
গণজাগরণ মঞ্চের এই তিন বছরের আন্দোলনে আমরা অনেক সহযোদ্ধাকে হারিয়েছি। তারা প্রত্যেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ছিলেন সোচ্চার কণ্ঠস্বর, ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মেধাবী ও সাহসী যোদ্ধা। তাদের হারিয়ে যুক্তি, মনন, সৃজন ও মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের আরও বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। কিন্তু এ লড়াইয়ে আমাদের সহযোদ্ধাদের পবিত্র রক্ত আমাদের অনন্য অনুপ্রেরণা।
শহিদ জাফর মুন্সী ও রাজীব হায়দারের কাছে আমাদের প্রতিজ্ঞা, তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশটির জন্যে লড়াই চলমান রাখবোই। আগামীকাল ১৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল পাঁচটায় প্রজন্ম চত্বরে যখন আলোক প্রজ্জ্বলন হবে তাদের স্মরণে। আলো হাতে চলা এই আঁঁধারের যাত্রীদের জন্য কেবল শোকগাথা নয়, এ হোক আমাদের প্রত্যেকেরই নিজের কাছে নিজের প্রতিজ্ঞার পুনরুক্তি। সহযোদ্ধা শহিদ জাফর মুন্সী ও রাজীব হায়দারের লড়াই সম্পন্ন করতে পারিনি বলেই এখনও প্রজন্ম চত্বরে যাই, মিছিলে হাঁটি— তাদের স্মরণ করি শ্রদ্ধায়, গৌরবে আর লড়াইয়ের দৃঢ় প্রতিজ্ঞায়।