রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা

বর্তমান সময়টি ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে আমরা উদযাপন করছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ, অন্যদিকে বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে। এ সময়ের নানা নথিপত্র, রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ, খবরের কাগজের নানা লেখা নিঃসন্দেহে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নানা গবেষণার মূল্যবান আকর হয়ে থাকবে। তার ফলাফল বা প্রতিক্রিয়া কী হবে তা জানি না, তবে এগুলো যে আগামী প্রজন্মকে আজকের সময়টি চিনতে সাহায্য করবে— সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে বাংলাদেশের রাজনীতির নানা সমীকরণ, চড়াই-উৎড়াই ও ঘাত-প্রতিঘাতের সময় গেছে। এই রাজনৈতিক অভিঘাত কেবল যে দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন এনেছে তাই নয়; দেশের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাপনেও ফেলেছে বড়ো ধরনের ছাপ। পাঁচ দশকের বাংলাদেশ আজকে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে— এই প্রশ্নের উত্তরে সকলেই একমত হবে যে, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির খবরা-খবর সংবাদপত্রে পড়লেই বোঝা যায়, আশি বা নব্বইয়ের দশকের মতো আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ এখন আর কেবলই কথার কথা নয়। সাম্প্রতিক কোভিট পরিস্থিতিতে পৃথিবীর বড়ো বড়ো রাষ্ট্রগুলোই যেখানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ তার সাধ্যমতো চেষ্টা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে চলেছে। কারও কারও কাছে হয়তো এই পরিস্থিতিও সন্তোষজনক নয়— কারণ কোভিড পরিস্থিতির সময়ে চলমান নানা দুর্নীতি ও লুটপাট যদি বন্ধ করা যেতো, তবে হয়তো অর্থনৈতিক অঙ্কের গ্রাফগুলো আরেকটু উর্ধ্বমুখী হতো।

রাষ্ট্র হিসেবেও বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে অবস্থান করতে পারছে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেও বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্র’ হয়ে ওঠা নিয়ে তৎকালীন বুদ্ধিজীবী সমাজে এক ধরনের সংশয় ছিলো। মনে পড়ে নতুন শতাব্দী নিয়ে ২০০০ সালের শুরুর দিকে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি খবরের কাগজের বিশেষ সংখ্যায় তৎকালীন বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের রাষ্ট্র হয়ে ওঠা নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছিলেন। কিন্তু দুইটি দশক অতিক্রম করা বাংলাদেশের প্রশ্নে আজ আর তাঁদের কোনো সংশয় নেই। অনেকেই জীবিত নেই, তবুও যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের লেখা পড়ে অন্তত সেটি বোঝা যায়।

গত দুই দশকে নানান টানাপোড়েনের পরও বাংলাদেশ যেমন ইতিহাসের পথে তার রাজনৈতিক গতিধারা খুঁজে পেয়েছে, তেমনি নতুন সমস্যাও তার সামনে এসেছে। এটা অবশ্য কেবল বাংলাদেশের জন্যই নয়, গোটা পৃথিবীর ক্ষেত্রেই সত্যি। গোটা বিশ্বব্যাপী দুটো ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ ও স্নায়ুযুদ্ধের পরও বিংশ শতাব্দীকে যদি চিহ্নিত করা হয় নবজাগরণের শতক হিসেবে, তাহলে একবিংশ শতাব্দীর গত দুই দশক চিহ্নিত হবে একই সঙ্গে প্রযুক্তিগত উন্নতি এবং সাম্প্রদায়িক মনোবিন্যাসের দশক হিসেবে। এই দুটি বিপরীত ধারা আমাদের সম্ভবত আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখাবে, কেননা উনিশ ও কুড়ি শতক থেকে আমরা জেনে এসেছি প্রগতির যে কোনো উন্নয়ন কূপমণ্ডুকতা ও সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা বিস্তারের প্রতিষেধক। কিন্তু বর্তমান শতাব্দীতে আমরা দেখছি, প্রতি মুহূর্তে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের খবর আসছে আবার একই সঙ্গে তীব্র সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবৈষম্যমূলক জাত্যাভিমান বাড়ছে। এই দ্বন্দ্ব সম্ভবত একবিংশ শতাব্দীর নতুন দ্বন্দ্ব। মানুষ নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে, মহাবিশ্ব, মহাকাশ, জীবনের ধারা ও জিনগত বিবর্তন সম্বন্ধে নতুন নতুন জ্ঞান আহরণ করছে আবার একই সঙ্গে নানাবিধ শাস্ত্রের অন্তর্গত অন্ধবিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরছে। মানুষ তার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জন্য সমাজের কাছে দায়বদ্ধ হতে পারে না। সমাজ বা সভ্যতা ততোক্ষণ ব্যক্তি মানুষের ধর্মীয় বোধ সম্বন্ধে চিন্তিত নয়, যতোক্ষণ পর্যন্ত না সেটি কাঠামোবদ্ধ সমাজ-সভ্যতার অন্তর্নিহিত মূল্যবোধকে আক্রান্ত করছে। কিন্তু পৃথিবীব্যাপী মানুষ আজ আর ধর্মকে তাদের ব্যক্তিগত আচার বা প্রথাতে সীমাবদ্ধ রাখেনি। এমনকি ধর্মীয় জ্ঞান বা দর্শনের চর্চাও নিজের গণ্ডির মধ্যে রাখেনি। ধর্ম এখন যতোটা না নিজের পালনীয়, তার চেয়েও যেনো বেশি অন্যকে তা পালনে বাধ্য করা বা তার কাছে নিজস্ব ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার প্রবণতায় এসে ঠেকেছে।

ব্যক্তির এই সীমাবদ্ধ চিন্তাধারা থেকেই সম্প্রদায়গত ধারণার জন্ম নেয় আর তখনই নিজস্ব সম্প্রদায় বা তার মতাদর্শিক বিকাশ মুখ্য হয়ে ওঠে। তখন স্রষ্টার চেয়ে শাস্ত্র গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়— কারণ শাস্ত্র একটি বস্তুগত ধারণা এবং তার বয়ান আপেক্ষিক বিচারে তুলনীয়।

বর্তমান শতাব্দীর একেবারে সূচনালগ্নেই ধর্মীয় সম্প্রদায়গত অভিঘাতের বিভৎস নজির দেখতে পায় পৃথিবী। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জঙ্গী সন্ত্রাসীদের হামলার মাধ্যমে চলমান শতক প্রবেশ করে সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতার নতুন ন্যারেটিভে। নানাবিধ গবেষণা আর তথ্য-উপাত্তে নতুন নতুন তত্ত্ব সামনে এলেও আড়ালে পড়ে যায়— বা বলা ভালো, আড়ালে ফেলা হয়— বিংশ শতাব্দীর একটি পুরোনো ধারণা— ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। বরং বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক নানা গবেষণাতেই দেখি উল্টো সুরে বলা হয়, ধর্মভিত্তিক শাসনব্যবস্থা দিয়ে ধর্মীয় উগ্রবাদকে দমন করার কথা। অর্থাৎ বেড়াল বলে মাছ খাবো না!

দুই

বাংলাদেশের রাজনীতির আলোচনাতে ফিরে এলেও দৃশ্যপট খুব একটি পরিবর্তন হয় না। নানাবিধ উন্নয়নের সঙ্গে বোধের সম্মিলন না ঘটলে যে কী বিপদ হতে পারে, তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেটের অবাধ প্রসার। জঙ্গীবাদ ও তথাকথিত ধর্মীয় জিহাদের নামে মানুষ হত্যার নীলনকশায় এখন ইন্টারনেট যেভাবে ব্যবহূত হচ্ছে, তাতে আতঙ্কিত হয়ে যাচ্ছেন তথ্যপ্রযুক্তি গবেষকরাই। বাংলাদেশেও এর ব্যত্যয় ঘটছে না।

তবে মানসিকতার দিক থেকে ব্যক্তিমানুষের ধর্মবোধ যে আর নিজস্ব চৌহদ্দির মধ্যে থাকছে না, এর পেছনে আছে সুনির্দিষ্ট রাজনীতি। ফলে বাংলাদেশে যারা ধর্মপ্রচারের নামে ওয়াজ নসিহত করে, খোঁজ নিলে দেখা যায়, তাদের প্রত্যেকেরই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির মাখামাখি এখন এতোটাই নিবিড় যে, কোনটা ধর্মের প্রকৃত বাণী আর কোনটা কাঠমোল্লাদের বিকৃত বয়ান— তা বোঝার চেষ্টাও এখন কেউ করেন না। এটা কিন্তু পক্ষান্তরে যাঁরা নিজেদের ধার্মিক বলে দাবি করেন, তাঁদেরই অজ্ঞতার ফল। আপনার ধর্ম সম্পর্কে যখনই আপনার অজ্ঞতা প্রকাশ পাবে, তখনই মোল্লা-পুরোহিতরা তার সুযোগ নিবে। ফলে আপনার ধর্মীয় রীতিনীতি কখন রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠবে, আপনি টেরও পাবেন না।

ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সবচেয়ে করুণ কৌতুকটি হচ্ছে যে সকল রাজনীতিবিদ কিংবা রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থক এমনকি সাধারণ মানুষও ব্যক্তিজীবনে খুব একটা ধর্মচর্চা করেন না কিন্তু নিজ নিজ ধর্মমতে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস রাখেন, তাদেরকেও লোকসম্মুখে ধর্মীয় বয়ান দিতে হয় বা ধর্মের লেবাস পরতে হয়। আবার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্যও ধর্মকে হাস্যকরভাবে ব্যবহার করতে হয়। এই যে কিছুদিন আগে করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন নিলেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তা— তাঁকে নিয়ে টেলিভিশন চ্যানেলে ডা. জাফরুল্লাহ সাহেবের করা সাম্প্রদায়িক মন্তব্য সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানুষ প্রতিবাদ করেছেন। প্রতিবাদের চেয়েও হতাশাই ব্যক্ত হয়েছে বেশি কারণ ডা. জাফরুল্লাহ সাহেবের তারুণ্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি নিজেও নিজেকে একজন বামপন্থী ভাবাদর্শের মানুষ হিসেবে পরিচয় দেন। অথচ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য তাঁকেই কিনা এমন এক সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করতে হলো, যা তাঁর তারুণ্যের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে উগ্রপন্থা ও সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানো মানুষগুলোর প্রোফাইলে ঢুকলেই দেখা যায়, তাদের প্রচারিত মতের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে এই কাণ্ড তারা করেন কেনো? এখানেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সম্প্রসারণ তত্ত্ব। অর্থাৎ ধর্মকে মোটা দাগে কেবল রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যক্তির মগজে একে পারসেপশন তৈরির অনুঘটক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এ কারণেই অনন্ত জলিল ভিকটিম ব্লেমিং- এর আগে ধর্মের দোহাই পাড়ে, ভোটের আগে রাজনীতিবিদদের ধর্মীয় আচার পালনের ছবি ভাইরাল হয় বা সারাজীবন শিল্প মাধ্যমে জড়িত থেকে অর্থ উপার্জন করা শিল্পীকে আমরা হঠাৎ করেই দেখি ‘গান-বাজনা-নাটক-সিনেমা হারাম’ জাতীয় ফতোয়া দিতে।

তবে এই দৃশ্যপট সম্ভবত দীর্ঘস্থায়ী হবে না। গত দুই দশকে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এতো দ্রুত হচ্ছে যে, মানুষ কোনো কিছুর সঙ্গেই থিতু হতে পারছে না। গোটা পৃথিবীতেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি যখন কেবলই ভোক্তা, তখন আত্মপরিচয়ের সংকট অবশ্যম্ভাবী। বাংলাদেশেও তাই চলছে।

১৯ মাঘ ১৪২৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *