রাষ্ট্র- পুনর্বার ভাবো: মৌলবাদীরাই তোমার ক্যান্সার
চারপাশে নানা কিছু চলছে। নানা সংবাদের বাতাবরণে মুখর এখন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো। সন্দেহ নেই, এগুলো প্রয়োজনেই হচ্ছে। ‘প্রয়োজন’ শব্দটি বড়োই আপেক্ষিক, নানা স্তরে উপস্তরে তার গ্রহণযোগ্যতার গ্রাফ উঠানামা করে। এখন সময়টি বড়ো নচ্ছাড়। স্বীকার করতেই হবে, তীব্র একটি অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে গোটা জাতীয় জীবন। বিশ্বায়নবাদীরা যদি ‘জাতীয় জীবন’কে অস্বীকার করতে চান, তবে তাঁদেরও বলি- আন্তর্জাতিক জীবনেও অস্থিরতা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এই স্থির-অস্থিরের দৌড়োদৌড়িতে চাপা পড়ে যাচ্ছে অনেক খবর, কিংবা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে না, যতোটা হওয়া উচিত ছিলো।
যৌনপল্লী উচ্ছেদের নানামুখী মহড়া আমরা লক্ষ্য করছি বেশ কয়েকদিন যাবত। হঠাৎ করে এমন একটি ঘটনা কেনো ঘটছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, বা আমার মতো নগন্য মানুষের মেধায় তা কুলোচ্ছে না। তবে একটি বিষয় পরিস্কার যে, ভয়ানক দুর্দিন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এটা কেবল এজন্য নয় যে, যৌনকর্মীদের আহত করে জোরপূর্বক উচ্ছেদের মাধ্যমে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে, মাদারীপুরের যৌনপল্লী উচ্ছেদে কিন্তু অমান্য করা হয়েছে হাইকোর্টের রায়ও। উচ্ছেদ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছে ‘ইসলামে কওম পরিষদ’ নামের একটি সংগঠন। এ সংগঠনটির জন্ম, বেড়ে ওঠা কিংবা দর্শন-অপদর্শন নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু এরা যে রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করলো, হাইকোর্টের রায়কে অমান্য করলো, সে বিষয়ে আমার মাথাব্যাথা হবার ঢের কারণ আছে; কেননা, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনকে কে বা কারা বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে, কোন দর্শনের ছুতোয় বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি কটাক্ষ করে কার্যক্রম পরিচালনা করে, তথাকথিত ‘বাংলা ভাই’ থেকে প্রায় সব ধরনের মৌলবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ইতিহাস দেখলেই তা বোঝা যায়। এরা ধর্মকে ঢাল হিশেবে ব্যবহার করছে, বিভ্রান্ত করছে সাধারণ মানুষকে এবং দিনের শেষে মানুষের অধিকারের বুকে পদাঘাত করে ন্যায় ও শান্তির মিথ্যা বুলি আওড়াচ্ছে। এরা মৌলবাদী, উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী; অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারাকাত যাদের অর্থনীতিকে একটি ত্রিভুজের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন এবং সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দুটি আর কেউ নয়, যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতে ইসলাম ও তাদের পঙ্গপাল দোসররা।
মাদারীপুরে যে ঘটনাটি ঘটেছে, তাকে বিচ্ছিন্ন কিংবা সামান্য ঘটনা ভাবা হবে নিতান্ত একটি বোকামি। একটি দল, যাদের নাম ‘ইসলামে কওম পরিষদ’, তাদের কী এখতিয়ার আছে এ কাজটি করার? এরা কারা? এই যে মৌলবাদীদের আষ্ফালন, উদ্ধত আচরণ, এর মূলে কারণটা কী? এর কারণ খুব পরিস্কার। প্রথমত, রাষ্ট্র মৌলবাদীদের প্রশ্রয় দিয়েছে, এবং সেটা করেছে সে ঐতিহাসিকভাবেই। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনারত রাজনৈতিক দলগুলো এইসব মৌলবাদীদের প্রশ্রয় দিয়েছে কেবল ভোটের রাজনীতিতে টিকে যাবার জন্য। মাঝখান থেকে খেসারত দিয়েছে সমাজ; মুক্তিযুদ্ধের চেতনানির্ভর একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণ-বৈষম্যমুক্ত সমাজের স্থলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি আতঙ্কগ্রস্ত পাণ্ডুর সমাজ, যেখানে জামাত-আতঙ্ক, শিবির-আতঙ্ক, হেফাজত-আতঙ্ক মানুষকে তাড়া করে বেড়ায়। শুরু থেকেই এদের দমনে রাষ্ট্রের সক্রিয় হওয়া উচিত ছিলো, কিন্তু রাষ্ট্রের শীতনিদ্রা ভাঙে দেরিতে; আফসোস, মাদারীপুরে ততক্ষণে লুট হয়ে যায় আমার বোনের সমস্ত সঞ্চয়।
এটা হয়তো সবাই একবাক্যেই মানবেন যে, কেউ যৌনকর্মী হয়ে জন্ম নেন না। আজ যাঁদের উপর অন্যায়ভাবে খড়গহস্ত চালিয়ে, মধ্যযুগীয় কায়দায় উচ্ছেদের বর্বরতা দেখানো হলো, তাঁরা জন্মেছেন আমাদেরই দেশে, আমাদের কারো পরিবারেই। এরপর সমাজের চোরাগলিতে কতোটা পথ হারিয়ে আজ তাঁরা জীবনের এ জটিল চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছেন, সে বিশ্লেষণটা না হয় সমাজবিজ্ঞানীরাই করবেন। কিন্তু তাঁদের এ জীবনের জন্য রাষ্ট্র কী দায়ী নয়? রাষ্ট্র কী পারবে এই নারীদের চোখের জলের দায় এড়াতে? রাষ্ট্র ও সমাজের যুগপৎ প্রতারণায় প্রতারিত হয়ে যে নারীরা খুঁজে নিয়েছে নিজস্ব জীবনের ব্যাকরণ, নিজের বেঁচে থাকার অবলম্বন, তাকে কীসের ভিত্তিতে উচ্ছেদ করবে রাষ্ট্র? কার পাপ ঢাকতে? কার লাম্পট্য রাষ্ট্রকে বড়ো বেশি বিব্রত করে তুলেছে? কেনো এই প্রসঙ্গ আসলে হেফাজতের নেতা আবদুল আউয়াল ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা শামীম ওসমানের মাঝে কোনো পার্থক্য থাকে না? এ উত্তরগুলো কে দেবে? বারো বছর আগে নারায়নগঞ্জে যাকে ‘পাপ’ বলে উচ্ছেদ করেছিলো রাষ্ট্র, বারো বছর পর মাদারীপুরেও তাকে ‘পাপ’ হিশেবেই দেখছে। অর্থাৎ, আহ্নিক গতি-বার্ষিক গতি বদলালেও রাষ্ট্রের কপট মানসিকতা বদলায়নি।
এবার কয়েকটি সোজা কথায় আসা যাক। সহজ কথা যেমন সহজে বলা যায় না, তেমনি সোজা কথাও সোজা করে বলা যায় না। যদি কোনো দল নিজেদের ‘ইসলামি’ দল বলে পরিচয় দেয়, তবে তার কাজ হলো ধর্ম প্রচার করা কিংবা ধর্মের যে অমোঘ বাণী, তা নিয়ে কাজ করা। কিন্তু বাংলাদেশে যারা ইসলামি দল বলে নিজেদের পরিচয় দেয়, তাদের মূল আকর্ষণটাই থাকে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে একটি ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রণয়ন করা। একাত্তর-পূর্ব সময় থেকেই এ বিষয়টি লক্ষ্যণীয়, এমনকি বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, তার মূলেও ছিলো এইসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলাম এবং তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী ইসলামী ছাত্র সংঘ (বর্তমানে ইসলামী ছাত্র শিবির) ধর্মের নামে বাংলাদেশবিরোধী বর্বরতা চালিয়েছে, পাকিস্তানি হায়েনাদের সঙ্গে লাম্পট্যের কূটনীতি চালিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও দেখা গেছে, যতগুলো ধ্বংসযজ্ঞ, অমানবিকতা ও বিভৎস বর্বরতা ঘটেছে, তার অধিকাংশের মূলেই ছিলো কোনো না কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বা ধর্মাশ্রিত দল। এখানেই মূল খটকাটি বাঁধে। ধর্ম শান্তি ও ন্যায়ের কথা বলে, কিন্তু সে-ই ধর্মের আওয়াজ তুলে যৌনপল্লী উচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটিয়ে, তাতে লুটপাট করে কী বোঝাতে চায় এইসব অপোগণ্ডরা? আমরা কয়েক মাস আগেই দেখেছি হেফাজতে ইসলাম নামে একটি মধ্যযুগীয় সংগঠন জামায়াত-বিএনপি’র প্রত্যক্ষ মদদে ঢাকার শাপলা চত্বরে কী অমানবিক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তারপর ভাড়াটে প্রচারযন্ত্র দিয়ে তাকে জায়েজ করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। এর আগে এদেরই কিছু মূর্খ পালের গোদা নারায়নগঞ্জের যৌনপল্লী উচ্ছেদে জিহাদী ভূমিকা পালন করেছে। এগুলো কি আদৌ ধর্ম প্রচারে বা ধর্মের কোনো কারণে? যে সূফীবাদের হাত ধরে বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটেছে, তাঁদের তো কখনও এমন ধ্বংসযজ্ঞ করতে দেখিনি। এই মদদপুষ্ট ইসলামি দলগুলো তবে কোন হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এই কাজে নেমেছে? তারা যাকে অন্যায় বলছে, সেটা আদৌ অন্যায় কি না, সেটার বিষয়ে কোনো আলোচনা কি হচ্ছে? হচ্ছে না। তাহলে প্রশ্ন হলো, এতো সাহস তারা কোথায় পায়? আমি সোজা বাংলায় যা বুঝি, তা হলো- রাষ্ট্রের নির্লজ্জ প্রশ্রয়ের কারণেই এরা এতোটা বাড় বেড়েছ। হাইকোর্ট যৌনপল্লী উচ্ছেদে সময় বেঁধে দিয়েছে, এটা কোনো সভ্যতার মাঝে পড়ে না; কারণ এই উচ্ছেদেই সব সমস্যা চুকেবুকে যাবে না। আর মাননীয় আদালত কী বলবেন- পুরুষের মগজের ভেতরে যে পাপ-লাম্পট্য নষ্ট পুঁজের মতো অবস্থান করছে, তার বিরুদ্ধে রায় দেবার কিংবা না ধুয়ে মুছে পরিস্কার করার কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়া সম্ভব কি না?
মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা আর জঙ্গীবাদের বিষবৃক্ষগুলো চারপাশে ভয়ানকভাবে বেড়ে উঠছে। এদের বিষাক্ত নিঃশ্বাসে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানবিক বাঙলাদেশ। রাজনৈতিক দলগুলো যদি অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ না হয়, এইসব ভুঁইফোড় মৌলবাদীদের প্রতিহত না করে; যদি এখনও ভোটের হিশেবে নির্ধারণ করে তাদের মৌলবাদঘেঁষা ভবিষ্যৎ কর্মপরিধি, তবে একদিন নমিনেশন দেবার জন্য যোগ্য-আদর্শিক নেতা খুঁজে পাবেন না। শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার, আইভি রহমানের মতো নেতৃবৃন্দের জীবন এইসব মৌলবাদীদের হাতেই গিয়েছে, সে কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।