রায় হয়েছে, তবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি
১৯৭১ সালের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি এক অনন্য বিজয় অর্জন করেছিলো। মাত্র নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীকে পরাজিত করে বাঙালি প্রমাণ করেছিলো স্বাধীনতার দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা আর মুক্তির মন্দির সোপানতলে প্রাণ বলিদান দেবার দৃঢ় প্রত্যয়। যে গণহত্যা আর বিভৎস নারী নির্যাতন চালিয়েছিলো পাকিস্তানের অমানুষ সেনাবাহিনী, তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ মদদ দিয়েছিলো এদেশীয় রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসের কুলাঙ্গারেরা। জামায়াতে ইসলাম এবং তাদের সহযোগী ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ (বর্তমানে ইসলামী ছাত্র শিবির) যে নৃশংসতা চালিয়েছিলো ১৯৭১ সালে, তার দ্বিতীয় কোনো নজির ইতিহাসে নেই। কেবল মুক্তিযুদ্ধের সময়ই নয়, স্বাধীনতা-উত্তর সময়েও এই যুদ্ধাপরাধীরা চালিয়েছে বাঙলাদেশবিরোধী অপতৎপরতা, হিংস্রতার ভয়ানক নিদর্শন রেখেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাঙলাদেশে। পঁচাত্তর পরবর্তী প্রেক্ষাপটে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা করে তৎকালীন অপরাজনৈতিক শক্তি। তবে তারও অবসান ঘটেছে। বিয়াল্লিশ বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। ইতিহাসের দায় কাউকে না কাউকে শোধ করতে হয়। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি সে দায় শোধের কাজটি নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারের অন্তর্ভুক্ত করে বাঙালির স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ঘটিয়েছে।
গতকাল ৯ অক্টোবর যুদ্ধাপরাধী আব্দুল আলীমের রায় ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। সর্বোচ্চ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে এই নরপিশাচকে। এখানে একটি প্রশ্ন উঠবে- কার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করা হলো? একজন নরপশুর, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য যার নামে ১৭টি অভিযোগ দাখিল করেছে অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কীসের স্বার্থে তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় নেয়া হলো? বাঙলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক দার্ঢ্য অবস্থানে দাঁড়িয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্য শুরুর মধ্য দিয়ে। কাদের মোল্লার মতো নরপিশাচ কসাইয়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় প্রত্যাখ্যান করে প্রজন্মের যোদ্ধারা রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, শুরু হয়েছে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। প্রিয় মাতৃভূমিকে রাজাকার, জামাত-শিবিরমুক্ত করার জন্য এক অবিনাশী আন্দোলন গড়ে তুলেছে গণজাগরণ মঞ্চ। স্পষ্ট হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি। এই তীব্র গণ-আন্দোলনের দাবানলে ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন হয়, রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করার সুযোগ তৈরি হয়। গত পাঁচই ফেব্রুয়ারির পর বেশ কয়েকটি মানবতাবিরোধী অপরাধীর রায় দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু রাজাকারের মাস্টারমাইন্ড খ্যাত গোলাম আযমের রায় দেয়া হয়েছে নব্বই বছরের কারাদণ্ড, যা মেনে নেয়নি বাঙলার মানুষ। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেছে এই রায়ের বিরুদ্ধে।
যে অজুহাতে গোলাম আযমের রায় দেয়া হয়েছিলো নব্বই বছরের কারাদণ্ড, সে-ই একই অজুহাতে রাজাকার আব্দুল আলীমের রায় দেয়া হলো আমৃত্যু কারাদণ্ড। এটি সত্যিই আমাদের আশাহত করে, মনের মধ্যে অসন্তোষের সঞ্চার ঘটায়। জিয়াউর রহমানের মন্ত্রীসভার সদস্য আব্দুল আলীম স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জয়পুরহাট মহকুমার (বর্তমান জেলা) শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলো। তার স্বাধীনতাবিরোধী অপতৎপরতা ও যুদ্ধাপরাধের বর্ণনা পাওয়া যায় তৎকালীন সংবাদপত্র, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থ ও তার দ্বারা নির্যাতিত ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সাক্ষ্য থেকে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত ‘হানাদার বাহিনীর বর্বরতা মধ্যযুগীয় ঘাতকদেরও হার মানিয়েছে’ শিরোনামযুক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে জয়পুরহাট শান্তি কমিটির নেতা জয়পুরহাট ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মুসলিম লীগের আব্দুল আলীমকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো- প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর সংখ্যালঘুদের দেশে ফেরার নিশ্চয়ই আর কোনো বাধা নেই। উত্তরে সে বলেছিলো যে, ওদের ক্ষমা নেই। ওরা দেশে ফিরলেই ওদের সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হবে। বস্তুত জানোয়ার ইয়াহিয়া খানের লোক দেখানো সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে যেসব মুষ্টিমেয় সংখ্যালঘু ফিরে এসেছিলো, তাদের আর পৃথিবীর আলো দেখতে হয়নি। সে-ই মানুষের স্বজনরা যদি বিজ্ঞ আদালতকে প্রশ্ন করেন- ‘শারীরিক অবস্থা বিবেচনা’ কী এতো জঘন্য একটি অপরাধের শাস্তি কমানোর কারণ হতে পারে? বিজ্ঞ আদালত কী বলবেন- আমি জানি না।
মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা কে কোথায় গ্রন্থের ৩৮-৩৯ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে-
আলীম সেই সময়ে নিজের হাতে বাঙালিদের লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারতো। এছাড়া বেয়নেট চার্জ করে বহু বাঙালিকে মারার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে রয়েছে।
এই হত্যার শাস্তি কি তবে আমৃত্যু কারাদণ্ড? আদালত নিজেও স্বীকার করেছেন মানবতাবিরোধী অপরাধের সতেরোটির মধ্যে নয়টি ঘটনায় আলীমের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে চারটি ঘটনায় আলীম যেভাবে হত্যা ও গণহত্যা ঘটিয়েছে, তা ‘অত্যন্ত জঘন্য’। আদালতের বক্তব্যে জানা যায়- কোনো মানুষ, যে শারীরিক ও মানসিকভাবে অযোগ্য, তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো উচিৎ নয়। কিন্তু আব্দুল আলীমের অপরাধ এতোটাই ঘৃণ্য, তাকে মুক্ত রাখলে মানবতার অবমাননা হবে। এ কারণে তাকে কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে বাকি জীবন কাটাতে হবে। তাহলে হয়তো কৃতকর্মের জন্য তার ভেতরে অনুশোচনার সৃষ্টি হবে। আদালত একজন মানবতাবিরোধী অপরাধীর কাছে কী অনুশোচনা কামনা করে? দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছরে যে নরপিশাচের কোনো অনুশোচনা হয়নি, উপরন্তু সে নানাভাবে দেশকে বাধাগ্রস্থ করেছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চেতনা প্রচারের মাধ্যমে।
এখানে একটি বিষয় আলোচনা প্রয়োজন যে- যুদ্ধাপরাধী আব্দুল আলীমকে মুক্তিযুদ্ধকালীন হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবল’ হিশেবে উল্লেখ করা হয়। এই দায়ের পরও তার সাজা যখন হয় আমৃত্যু কারাদণ্ড, তখন তা সন্তোষজনক হয় না কোনোভাবেই এবং তাই এ দাবি উঠেছে যে, এ রায়ের বিরুদ্ধে অবিলম্বে উচ্চ আদালতে আপিল করা হোক।
রাজাকার আলীমের বিরুদ্ধে যে ধরণের মানবতাবিরোধী অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে, তাতে তার সর্বোচ্চ শাস্তিই প্রত্যাশা করে জনগণ। আদালত নিজেও সে কথাটি স্বীকার করেছেন যে, তাকে মুক্ত রাখলে মানবতার অবমাননা হবে। কিন্তু মুক্ত না রাখার মানে এই নয় যে, তাকে লঘুদণ্ড প্রদান করা হবে। তার যে অপরাধ, তাতে সর্বোচ্চ শাস্তিই বাঞ্ছনীয়। গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করার সুযোগ প্রতিষ্ঠিত করেছে। এখন ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার দাবি রাষ্ট্রপক্ষের কাছে উত্থাপন করেছে গণজাগরণ মঞ্চ।
১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করার অর্থ হলো, রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। যে অপরাধ বাঙলার মানুষের সাথে করেছিলো মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তরা, তার যথাযথ ও কার্যকর শাস্তি না হলে, সে কলঙ্ক কখনোই মুছবে না। ততোদিন লড়াই করে যেতে হবে আমাদের। বাধা থাকবেই, নানা ষড়যন্ত্রের নীল নকশা আঁকবে যু্দ্ধাপরাধীরা; কিন্তু সবকিছু অতিক্রম করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। হয়তো প্রস্তর-বন্ধুর পথ; কিন্তু এ লড়াইয়ে আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত। জয় বাঙলা।