সাম্প্রদায়িক রাজনীতি: একটু তলিয়ে দেখার চেষ্টা
সাম্প্রদায়িকতা আজকের সমস্যা নয়—বাঙলাদেশে তো নয়ই। একটি মোটা দাগে সাম্প্রদায়িকতার ইতিহাস তৈরি করলে দেখা যায় উনিশ শতকের শুরু থেকেই এই বিষফোঁড়া আমাদের ক্রমাগত অকেজো করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লক্ষ্যে বা অসাম্প্রদায়িক চেতনার ওপর ভর করে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ নানাভাবে এই বিষফোঁড়াকে পরাজিত করেছে বটে, কিন্তু সমূলে বিনষ্ট করতে পারেনি। ফলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এই সাম্প্রদায়িকতাকে ঘাড়ে চাপিয়ে যেমন ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান দুটো রাষ্ট্র তৈরিতে সফল হলো, ঠিক তেমনিভাবেই পাকিস্তানও চেয়েছিলো সাম্প্রদায়িকতার ঘোল খাইয়ে অখণ্ড পাকিস্তানের অসম্ভব স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে—নির্মোহভাবে বললে পশ্চিম পাকিস্তানিরা অর্থনৈতিক ও জীবনযাপনের নানা ক্ষেত্রে যে বৈষম্যমূলক শোষণের পাহাড় তৈরি করেছিলো—তারই বিরুদ্ধে বাঙলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন বাঙলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তৎকালীন সাংস্কৃতিক কর্মীদের বড়ো সফলতা ছিলো এই যে, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের গতিপথে তাঁরা নিজেদের কাজকে সংযুক্ত করতে পেরেছিলেন। বাঙলার মানুষের ভাষা ও মনন বোধে সাংস্কৃতিক আত্ম-পরিচয়ের দার্ঢ্যতাকে তাঁরা অসামান্যতার সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন। ফলে রাষ্ট্রভাষা বাঙলার জন্যে যেমন লড়াই করেছেন মানুষ, তেমনিভাবে যূথবদ্ধ প্রতিবাদে উদযাপন করেছেন রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ। ফলে আওয়ামী লীগের ছয় দফা ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঐতিহাসিক এগারো দফার মাধ্যমে যে দুর্বার রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, তাকে ধর্মের ধুয়া তুলে বা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পানি পড়া খাইয়ে অক্ষচ্যুত করতে পারেনি পাকিস্তানের বর্বর শাসকরা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন হলো, বাহাত্তরের সংবিধানে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপূর্ণভাবে না হলেও প্রতিফলিত হলো। কিন্তু ‘স্বাধীনতা’র যে সুবৃহৎ অর্থ, তার প্রেক্ষিতে বাঙালি সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়নি। এই প্রশ্নের উত্তরটি খুঁজতে গেলেই আমরাদের সর্বাগ্রে হয়তো অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথাটি মোনে হয়, এবং বরাবরের মতোই আড়ালে পড়ে যায় আমাদের মনোজগতের স্বাধীনতাহীনতার কথা। বাঙলাদেশ নামক রাষ্ট্র তৈরি হলো, তার সংবিধান, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারিত হলো; কিন্তু এই বাঙলার যাঁরা মানুষ, তাঁদের মনোজগতের স্বাধীনতার কথা আলোচিত হলো না। বস্তুত এখান থেকেই অদ্যাবধি বাঙলাদেশ তথা সারা বিশ্বের বিষফোঁড়া ‘সাম্প্রদায়িকতা’র বিষয়ে একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে।
দুই
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষয়বস্তু অনুসন্ধান এতো স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়, সেটা আমার উদ্দেশ্যও নয়। এই লেখাটিতে বরং অনুসন্ধান করা যেতে পারে পাকিস্তানি ভূতগ্রস্থ যে মানসিকতা সাতচল্লিশে পাকিস্তান সৃষ্টির পর উৎসাহে টগবগে হয়েছিলো, তার অপসারণ না ঘটিয়ে কী করে আমরা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা করতে পারি? সুতরাং, একটু বাড়াবাড়ি শুনালেও সত্য যে, ১৯৭১ সালে আমাদের মস্তিষ্কের মুক্তিযুদ্ধটি হয়নি, এমনকি হয়নি এখনও। আবার এটাও সত্য যে, রাষ্ট্র গঠন তুলনামূলকভাবে যতোটা সহজ, রাষ্ট্রের মানুষের মনন গঠন ততোটা নয়। ফলে সদ্য স্বাধীনতা-প্রাপ্ত বাঙলাদেশের অনেক ক্ষেত্রেই পাকিস্তানের ধ্যান-ধারণা পোষণকারীরাই নানা পদে বহাল হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে জীবন বাজী রেখে দেশ স্বাধীন করলেন, তাঁদের বিষয়ে আমাদের অভিমত কী হবে? এই প্রশ্নের উত্তরটি পেতে হলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বর্তমানে ফিরতে হবে এবং বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা এও আবিষ্কার করতে পারি যে, অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ভুল বলেননি; অর্থাৎ “একজন রাজাকার সারাজীবন রাজাকার থাকলেও, একজন মুক্তিযোদ্ধা সারাজীবন মুক্তিযোদ্ধা থাকেন না”। সে কারণেই পঁচাত্তরে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পর রাষ্ট্রযন্ত্রে পাকিস্তানিকরণের ভয়ানক সব নজির আমরা দেখতে পাই। পঁচাত্তরের পরই বাঙলাদেশ তার পথ হারায়। আর কেউ মানুক বা না মানুক, নির্মম সত্য হলো— সেই হারানো পথ থেকে এখনও উত্তরণ ঘটেনি বাঙলাদেশের। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা এক কথা নয়। বাঙলাদেশে কোনটি আগে ঘটেছে, সেটি নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মোনে করি, বাঙলাদেশ নামক রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িকতার চাষ আগে থেকে শুরু হয়েছে। কারণ, বঙ্গবন্ধু শাসনামলেও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের নানা পর্যায়ে আমরা তার নজির দেখতে পাই। আর এ নজিরগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তাতে গণ-মানুষের চিন্তাধারার প্রতিফলন ছিলো না, বরং সমস্ত ঘটনাগুলোই মূলত ছিলো সেনাবাহিনি ও আমলাকেন্দ্রীক। যেমন ১৯৭২ সালেই গণভবন থেকে সুভাষ বসু ও অন্যান্যদের ছবি সরিয়ে সেখানে সলিমুল্লাহ, ইসমাইল হোসেন সিরাজী বা অন্যান্য ‘মুসলমান’ বুদ্ধিজীবীদের ছবি প্রতিস্থাপন বা ১৯৭৩ সালে বাঙলা একাডেমির ক্যালেন্ডার থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবি বাদ দেয়া বা সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ থাকলেও কেবল ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বরাদ্দ দেবার সিদ্ধান্তগুলো রাষ্ট্রের যে সকল পর্যায় থেকে গৃহীত হয়েছিলো, সেখানে শক্তভাবে কাজ করেছে পাকিস্তানি মানসিকতার আমলাতন্ত্র। এই আমলাতন্ত্রের ধারা রাজনীতিতে প্রবহিত হয়েছে সন্দেহ নেই। ৭২-৭৩-৭৪ সালেই একটি বিশেষ ধর্মকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, ফলে সাম্প্রদায়িক বিষ যে আসলে মগজে বিদ্যমান, তা স্পষ্ট বোঝা যায়। এই বিষক্রিয়ার পরিণতিই পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট। মোনে রাখতে হবে, বাঙলাদেশকে সাংবিধানিকভাবে সাম্প্রদায়িক করার প্রায় সবকটি উদ্যোগ সামরিক সরকারের আমলগুলোতেই নেয়া হয়েছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনিতে কাজ করা বা পাকিস্তান আমলে নিয়োগকৃত সেনা-সদস্যদের অনেকেই পাকিস্তানের ভাবাদর্শ লালন-পালন ও পোষণ করতো, সুযোগ মতো রাষ্ট্রে তারা সেটি ব্যবহার করেছে। এখন জনগণ যেহেতু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত এবং এটিও রাষ্ট্র চরিত্রের বাকি শর্তসমূহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, নিপীড়িত বা লাভবান হয়, সেহেতু রাষ্ট্র বিশেষ কোনো সম্প্রদায়ের (ধর্মীয় বা জাতিগত) প্রতি পক্ষপাতিত্ব করলে কোনো না কোনোভাবে জনগণের কিছু অংশ তা থেকে ফায়দা নেবে বা তার রোষানলে পড়বে। আবার রাষ্ট্র কোন সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হচ্ছে, সেটি নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সক্রিয় থাকা ব্যক্তির মানসিকতা দ্বারা। এই মানসিকতা হঠাৎ করে তৈরি হয় না। দীর্ঘ দিনের চর্চায় মানুষের মনন ও বোধে একটি কার্যকর শুভ পরিবর্তন ঘটে। সে চর্চাটি মর্মত ও মুখ্যত পারিবারিক। কেননা, পরিবারই একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আরেকটি রাষ্ট্র হিশেবে কাজ করে। পারস্পরিক সম্পর্কের বিবেচনায় একমাত্র পরিবারই ব্যক্তির মানস গঠন করে— সমাজে ক্রিয়াশীল বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো গঠিত মানস পরিবর্তন করে মাত্র।
আজকে বাঙলাদেশে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের যে বিভৎস রূপ আমরা দেখিছি, সেটা তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, প্রতিষ্ঠান হিশেবে ‘পরিবার’ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে পরিবারের মতোন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করছে মৌলবাদীরা। উদাহরণ হিশেবে উল্লেখ করা যেতে পারে দুটি ঘটনা। সম্প্রতি গণমাধ্যম ও পুলিশি অনুসন্ধানে জানা গেছে আইএসের মতো জঘন্য সংগঠনে যোগ দিতে বেশ কিছু পরিবার চলে গেছে— লক্ষ্যণীয়, পরিবারসমেত তারা তথাকথিত জিহাদ করতে গেছে; অন্যদিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিখোঁজ তরুণদের বিষয়ে বা ধরা পড়া জঙ্গীদের বিষয়ে পরিবার কিছুই জানে না। তাদের জীবনাচরণের সঙ্গে তাদের পারিবারিক কোনো যোগাযোগ নেই। অর্থাৎ পরিবারের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক আলগা হয়ে গেছে এবং সেই সম্পর্ক স্থাপিত হচ্ছে বাইরের অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। যেমন একজন শিশুর সিংহ ভাগ সময় কাটছে হয় স্কুলে না হয় কোচিং সেন্টারে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে পরিবারের কোনো সদস্য মসজিদ বা উপাসনালয়ে অনেক সময় কাটাচ্ছেন বলে গর্বিত হন অনেক পরিবার। অনেক সময় কাটানোতে সমস্যা নেই, কিন্তু এই সময়টাতে তারা কী করছে, সেটা জানার, বোঝার বা উপলব্ধি করার তাগিদ পরিবারের নেই। ফলে ব্যক্তির মানসিকতার আমূল পরিবর্তন ঘটছে। শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতে পড়াশুনা করে আসা ছেলে ভয়ানক জঙ্গী সন্ত্রাসী হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই বলতে পারেন এটি একটি ব্যতিক্রম মাত্র, তাঁদের মোনে করিয়ে দিতে চাই, এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জঙ্গী সংশ্লিষ্টতাও ব্যতিক্রম ছিলো, এখন সেটা আর ব্যতিক্রম নেই। সাম্প্রদায়িকতার চাষাবাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অংশে কম হচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের উদাহরণ দিলাম, কারণ আমাদের জাতীয় ইতিহাসে প্রগতিশীল নানা আন্দোলনে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা প্রবাদপ্রতিম।
তিন
আমার মতামতটি বিতর্কের উর্ধ্বে তো নয়ই, প্রশ্নাতীতও নয়। রাষ্ট্র কাঠামোতে বিরাজমান মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা যেমন জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে আবার এই জনগণের মধ্য থেকেই যেহেতু নেতা তৈরি হচ্ছেন, নির্বাচন করছেন, সংসদে গিয়ে আইন প্রণেতা হচ্ছেন— সুতরাং রাষ্ট্রের ছড়িয়ে দেয়া সাম্প্রদায়িকতা আবার রাষ্ট্রের শিরা-উপশিরাতেই জমা হচ্ছে। এ এক দুষ্টচক্র। এ চক্র ভাঙার কাজটি পরিবার থেকে শুরু হওয়া উচিৎ এবং অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ভেবেই বলে রাখা ভালো— ‘অসাম্প্রদায়িক’ বা ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মানস চেতনা কখনোই কোনো তাত্ত্বিক বিষয় নয়, বরং এটি অনেক বেশি চিন্তার এবং যাপনের। এই চিন্তার সূত্রপাত যদি হয় পরিবার, তবেই রাষ্ট্র ও সংবিধানে তার যাপন চলতে পারে।