অস্তিত্ববাদ সংক্রান্ত এ আলোচনাটি আরও পেছন থেকে শুরু হতে পারতো এবং এ কথাটি নির্দ্বিধায় সত্য যে, যে কোনো দার্শনিক বিষয় বা উপাদানের ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য এর অতীত ইতিহাসটি জানা আবশ্যক। এখন ইতিহাসটি যদি জন্মের গাছপাথর হয়, তাহলে এর ব্যাখ্যা প্রদান করা সম্ভব। আর যদি ‘দর্শনের ইতিহাস’ বলতে দর্শনের মা-খালা কিংবা জ্ঞাতিগোষ্ঠীর বিবরণ প্রকাশ হয়, তবে নিঃসন্দেহে আমি সঠিক পথেই এগুচ্ছি। এ কথাটির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে একটি খটকা থেকে গেলো। লেখাটি যেহেতু দর্শনকেন্দ্রীক তাই এর ঠিক-বেঠিকের সঠিক হিসেব বের করা সম্ভব নয়, কেননা দর্শনের আলোচনাতেই নির্ধারণ করে দেয়া আছে যে, সমাজের মানুষের একটি বিশেষ পর্যায়ের বিশ্লেষণী চিন্তাধারার প্রতিফলনই মূলত দর্শন। তবে এ চিন্তাধারার বিকাশটি ঘটেছে বেশ পরে, যতোদূর জানা যায়, মানুষ যখন প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের পন্থা খুঁজতে আরম্ভ করলো, তখন থেকেই। এ পন্থা খোঁজার জন্য পরিবেশ প্রকৃতির নানা রহস্যের জাল উন্মোচনের প্রয়াসেই পরিবেশ মানুষের চিন্তার প্রেক্ষণবিন্দুতে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে অবশ্য মানুষ তার নিজের চারপাশ, সম্পর্ক, স্বীয় দেহ এবং অন্যের দেহ নিয়েও ভাবতে থাকে; বস্তুত এ পর্যায়ে দর্শন একটি বহুমাত্রিকতার রূপ পরিগ্রহ করে। এ বহুমাত্রিকতার আলোকে দর্শন পথ চলেছে, এবং এখনো চলছে। দর্শনই আদি জ্ঞানের মূল ভাণ্ডার। তবে দর্শন যেমন পথ বাতলে দিয়েছে, তেমনি নিজের পথ বদলেও নিয়েছে সুবিধামতো। তাই কালক্রমে মানুষের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পুরাতন দার্শনিক কল্পনা বাস্তব জীবনে ভিত্তিহীন প্রমাণিত হলে তার স্থানে অধিকতর সঠিক সমাধান আবিষ্কৃত হতে থাকে। ফলে বর্তমানে দর্শন বলতে কেবলমাত্র কল্পনার ওপর নির্ভরশীল কোনো বিষয়ে আর অবশিষ্ট নেই। তবে জ্ঞান বিকশিত হবার পরও অনেকে দর্শনকে কল্পনা নির্ভর করে রাখতে চাইছেন, যাতে দর্শনের সঙ্গে সম্পর্কশূন্য হয়ে পড়েছে বাস্তবতা। যেখানে প্রাচীন কালে জীবনের সমস্যাই দর্শনের বিকাশ ঘটিয়েছে, সেখানে এখন দর্শনই হয়ে পড়েছে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। দর্শনের এ সঙ্কটের সুনির্দিষ্ট নিদের্শ দেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে কার্ল মার্কস। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস দর্শনকে জীবনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে বলেন যে, দর্শন হবে জীবন ও জগৎকে বৈজ্ঞানিক ও সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। দর্শন হবে বৃহত্তম সংখ্যক মানুষের স্বার্থে জগৎ ও সমাজকে পরিবর্তিত করার ভাবগত হাতিয়ার। দর্শন অবাস্তব কল্পনা নয়, এটি জগৎ ও জীবনের মৌলিক বিধানের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। আর এ ব্যাখ্যারই অপর নাম হচ্ছে দ্বন্ধমূলক বস্তুবাদের তত্ত্ব।
অস্তিত্ববাদ আধুনিক দর্শনের একটি চিন্তাধারা। প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর যুগে জার্মাানি এবং ফরাসি দেশে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং অন্যান্য দেশের বিপর্যস্ত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই চিস্তার উদ্ভব এবং বিস্তার দেখা যায়। এ দর্শনের মূল হচ্ছে মানুষ এবং বিশেষ করে ব্যক্তির অস্তিত্ব। কিন্তু এ প্রশ্নের আলোচনাকারীদের মধ্যে মতের পার্থক্যও আছে।
অস্তিত্ববাদের সমর্থক ও বিরোধীরা যেভাবে অস্তিত্ববাদের মূল্যায়ন করেছেন, ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং আজকের অস্তিত্ববাদ যেভাবে একটি সামগ্রিক রূপ পরিগ্রহ করেছে, এতে এর সঠিক সংজ্ঞায়ন দুষ্কর হয়ে উঠেছে। অস্তিত্ববাদ বলতে অনেকে মনে করেন ‘শখবাদ’ (Faddism), ‘অবক্ষয়বাদ’ (Decadentism), ‘মানসিক অসুস্থতা’ (Morbidity), ‘সমাধিক্ষেত্রের দর্শন’ (The Philosophy of Graveyard); অনেকে আবার অস্তিত্ববাদ বলতে বুঝে থাকেন ভয়, গভীর ভীতি (Dread), উদ্বেগ (Anxiety), মনস্তাপ (Anguish), একাকীত্ব (Aloneness), দুঃখ এমনকি মুত্যুও।
অস্তিত্ববাদ চিন্তাধারাকে বোঝার জন্য উনিশ শতকের ইউরোপে উদ্ভূত ‘জীবনের দর্শন’ নামক তত্ত্বটির পরিচয় থাকা আবশ্যক। বস্তুত ‘জীবনের দর্শন’ই অস্তিত্ববাদের উৎস ও পটভূমি। ঊনিশ শতকে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়, বিশেষত জীববিদ্যায় ও মনোবিজ্ঞানে যে বিষ্ময়কর আবিষ্কারগুলো ঘটে, তাতে জীবন ও জগতের এতোদিনের সহজ ব্যাখ্যা অকেজো হয়ে দাঁড়ায়। জীবন ও জগৎ বস্তু বটে, তবে সে বস্তু সহজ নয়, সে বস্তু জটিল। তার যান্ত্রিক ব্যাখ্যা মানব মনের বহু প্রশ্নের উত্তর দিতেই অক্ষম। এতোদিনকার ভাববাদী বা অষ্টাদশ শতকের যান্ত্রিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যার বিফলতার প্রতিক্রিয়ায় একদল চিন্তাবিদের কাছে জীবন এক অজ্ঞেয় রহস্যের আঁধার বলে প্রতিয়মান হতে থাকে। জীবন হচ্ছে এক অসীম শক্তির উৎস; এ না বস্তু, না চেতনা। এর গতি আছে এবং প্রকাশ আছে, কিন্তু সে গতি বা প্রকাশ আমাদের বুদ্ধির আয়ত্বযোগ্য নয়। একে মানুষ কেবল তার সহজাত সংজ্ঞা, ইনট্যুইশন বা সম্মোহিত অনুভূতির মাধ্যমেই উপলদ্ধি করতে পারে। আর যেহেতু সংজ্ঞা বা সম্মোহিত অবস্থা নিছক ব্যক্তিগত বিষয়, তাই জীবনের উপলদ্ধি ব্যক্তিগত ছাড়া সমষ্টিগত জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না। জীবনের কোনো বিজ্ঞান তৈরি করা সম্ভব নয়, জীবন কেবল অনুভূতি বা উপলদ্ধির বিষয়। জীবনের এরূপ ব্যাখ্যাই শপেনহার১ (১৭৮৮-১৮৬০) এবং হেনরি বার্গসঁ২ (১৮৫৯-১৯৪১) প্রমুখ দার্শনিকের তত্ত্বে দেখা যায়। ডেনমার্কের আত্মবিমোহিত বুদ্ধিজীবী সোরেন কিয়ের্কেগার্ডের রচনাতেও এ ‘জীবনদর্শন’ এর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কিয়ের্কেগার্ডের হাতে এ দর্শনের জন্ম হলেও, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরই এ দর্শনের বিকাশ ঘটে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন স্থানে এর ভাবধারা একটি আলোড়ন সৃষ্টি করে। এ আলোড়ন সৃষ্টির পেছনে যে নামটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ-পল সার্তে। তাঁর বৈপ্লবিক চিন্তাধারা সাম্প্রতিক দর্শন ও সাহিত্যের জগতকে এমনভাবে আলোড়িত করেছিলো যে, আধুনিক অস্তিত্ববাদ বলতে এখন সার্তের অস্তিত্ববাদকেই বোঝানো হয়। সার্ত অস্তিত্ববাদকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে, “এটি একটি মতবাদ, যা মানবজীবনকে সম্ভবপর করে তোলে; এবং যে মতবাদ অনুযায়ী প্রতিটি সত্য এবং প্রতিটি কর্ম পরিবেশ ও মানুষের আত্মিকতা উভয়কেই বোঝায়”। লেখক হিসেবে অস্তিত্ববাদের এ সংজ্ঞাটি কিন্তু আমার কাছে সন্তোষজনক বলে মনে হয় না, এর কারণ সম্ভবত এই যে, সব জীবন দর্শনই, এমনকি শপেনহারের দুঃখবাদী দর্শনও মানব জীবনকে কম বেশি সম্ভবপর করে তোলার চেষ্টা করে বা সে রকমের উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে মনে হয় এবং ভাববাদী দর্শন কোনো-না-কোনো দিক দিয়ে পরিবেশ ও আত্মিকতাকে বোঝায় বলে বলা যায়। তবে সার্তের এ সংজ্ঞায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে, যা অস্তিত্ববাদ সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে সত্য। এ বিষয়টি হলো, আত্মিকতাই অস্তিত্ববাদের প্রারম্ভিক সূত্র। এ আত্মিকতা অবশ্য ভাববাদী আত্মিকতা থেকে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন।
অস্তিত্ববাদের মতে দর্শনের করণীয় হচ্ছে বিষয় এবং বিষয়ীকে অবিভাজ্য ও সামগ্রিক সত্তা হিসেবে ব্যাখ্যা করা। বিষয় এবং বিষয়ী, জ্ঞান এবং জ্ঞাতার অবিচ্ছেদ্য সত্তাই হচ্ছে অস্তিত্ব। এ অস্তিত্বকে ব্যক্তি উপলদ্ধি করতে পারে, কিন্তু তখন তার অবস্থান হয় অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্বের সঙ্কট সীমানা। মৃত্যু, যন্ত্রণা, পাপবোধ, অসন্তোষের মধ্যেই মানুষ সে সীমানায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে। বুদ্ধি বা যুক্তির মাধ্যমে এ অস্তিত্বকে জানা সম্ভব নয়।
এক কথায় অস্তিত্ববাদের সংজ্ঞায়নটি হয়তো করা যাবে না, কিন্তু সহজ কথায় বলা যায়, অস্তিত্ববাদ হলো এমন একটি দার্শনিক আন্দোলন- যা ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করে, সাধারণ অর্থে নয়; বিশেষ অর্থে; বিমূর্ত, কাল্পনিক বা বস্তুগত ধারণা হিসেবে নয়, মূর্ত ও বাস্তব ধারণা হিসেবে; অর্থাৎ অস্তিত্ব যেভাবে বাস্তবে কোনো একটা বিশেষ ঐতিহাসিক অবস্থায় প্রকাশিত হয়, সেভাবে।
তথ্যসূত্র
১. আর্থার শপেনহার ঊনবিংশ শতকের জার্মান ভাববাদী দার্শনিক। তাঁর দর্শনের মূলে ছিলো বাস্তব সমাজ ও জগৎ সম্পর্কে হতাশা ও অবিশ্বাস। তিনি ছিলেন বস্তুবাদের বিরোধী এবং পুঁজিবাদ যখন সাম্রাজ্যবাদী যুগে প্রবেশ করে শপেনহারের দর্শন তখন অধিকতর প্রভাবশালী হয়ে উঠে
২. হেনরি বার্গসঁ ফরাসী দার্শনিক। বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে শক্তিশালী প্রভাব রেখেছেন। তাঁর লেখার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতাও যুক্তি ও বিজ্ঞানের পাশাপাশি থেকে বাস্তব ঘটনা বিচারে গুরুত্বর্পূর্ণ। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী এ দার্শনিক ‘চূড়ান্ত’ বলে কোনো কিছু স্বীকারের বিপক্ষে মত দিয়েছেন এবং তাঁর দর্শনের, এমনকি সাহিত্যেও ‘চূড়ান্তবাদ’ (Finalism) কে তিনি অস্বীকার করেছেন।