গতকাল ছিলো বুদ্ধদেব বসুর জন্মবার্ষিকী। এই প্রসঙ্গেই আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মোনে হলো— বাঙালির কোনো আড্ডা নেই। ছোটোবেলা আমাদের কাছে আড্ডা মানে ছিলো যাচ্ছেতাই ব্যাপার। একেবারে উচ্ছন্নে না গেলে কেউ আড্ডাবাজিতে নাম লেখায় না। খানিক বড়ো হয়ে বুদ্ধদেব বসুর আমার যৌবন পড়ে দেখলাম, নাহ— ব্যাপারটা মোটেই খারাপ না যেহেতু ইংরেজি বিভাগের ডাকসাঁইটে ছাত্রও নিয়মিত আড্ডা দিতেন। স্কুল জীবনের শেষের দিকে কোনো একটি ঈদ সংখ্যায় কবি শামসুর রাহমানের লেখা পড়ে জেনেছিলাম শহরে বিউটি বোর্ডিং বলে একটা জায়গা আছে এবং ওখানেই আড্ডা দিতেন আমাদের ষাটের দশকের সৃজনশীল তরুণরা। অতএব আশ্বস্ত হলাম। কমালাকান্ত যে নসিবাবুর বৈঠকখানায় বোসতেন, একবিংশ শতাব্দীর অ্যাপার্টমেন্ট কালচার তা অনুমোদন করে না। মেসবাড়ির প্রতি একটা আগ্রহ ছিলো ছোটোবেলাতেই— ঘনাদা পড়ে। কিন্তু পরে বুঝলাম, বাস্তবে মেসবাড়ি মানে ব্যাচেলরের আস্তাকুঁড়, সময় মতো বউ জোটাতে না পারার শাস্তিভোগ। ওই বনমালি নস্কর লেনের মেসবাড়ি প্রেমেন্দ্র মিত্র খুঁজে পেতে পারেন; আমাদের পক্ষে অসম্ভব। মান্না দে আমাদের মগজে কফি হাউজ ঢুকিয়ে দিলেন, যদিও গানটির গীতিকার হিশেবে গৌরী প্রসন্ন মজুমদার এবং সুরকার হিশেবে সুপর্ণ কান্তি ঘোষ তখনও আমাদের কাছে কফির স্বাদের মতোই অচেনা। অতএব, আমাদের কাছে আড্ডার কিংবদন্তী হিশেবে টিকে রইলো ১ নং শ্রীশদাস লেনের বিউটি বোর্ডিং। জীবনে প্রথমবার যখন গিয়েছিলাম সেখানে, বাঙলাবাজারের বইয়ের দোকানগুলো পার হতে হতেই মোনে হয়েছিলো, বাঙালি হয়ে জন্মেছি— একটা জীবন আড্ডা মেরেই কাটিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু আমরা জানতাম না, ততোদিনে বাঙালির জীবনে বিউটি বোর্ডিং-এর আর কোনো অস্তিত্ব নেই; ওটা তখন খবরের কাগজের বিষয়। অতএব জীবনের মরণের সীমানা পার হয়ে খবরের কাগজের বিষয় হয়ে ওঠা বিউটি বোর্ডিং আমাদের পোষালো না। আমাদের ব্যর্থ মনোরথের চাকা ঘুরানোর দায়িত্ব নিলেন নব্বই দশকের অগ্রজরা। তাঁরা জানালেন আমাদের হাবা যৌবনের কালো ধোঁয়ার আকাশে এখনও তৃতীয়ার চাঁদের মতোন জেগে আছে আজিজ মার্কেট। অতএব আমরা বাঁচলাম। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা শওকত ওসমানের ঢাকা কলেজের পুকুর ঘাট আর ক্যান্টিনের আড্ডা তখন আজিজ মার্কেটের বইয়ের দোকানগুলোতে এসে সাবালক হলো। কিন্তু আমরা আরেকটু বড়ো হতে হতে আজিজ মার্কেট অনেক বড়ো হয়ে গেলো। এখন পোশাকের দোকানের ভিড়ে আজিজে বইয়ের দোকান প্রায় পোশাকি পর্যায়ে নেমে এসেছে।
তবে আড্ডা নিয়ে যতো বড়ো বড়ো কথাই বলি না কেনো, আমাদের সমাজ জীবনের মতো অভিধানেও আড্ডা মানে ‘দুষ্টু লোকদিগের মিলনের স্থান’। আমাদের বাঙলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধান আড্ডার অর্থে লিখেছে ‘মিলনকেন্দ্র’, জানি না কি বুঝে আমার বন্ধনীতে লিখেছে ‘চোরের আড্ডা’। শব্দের উৎপত্তি বিষয়ে জানি না, তবে এর পূর্ণ বিকাশ বোধ করি বাঙালি জীবনেই। আমাদের সমাজ জীবনে আড্ডাকে সর্বনাশা ভাবলেও অনেকেরই ব্যক্তিগত জীবনে আড্ডাই সর্বলাভের আসর। তবে দিন বদলের সাথে সাথে আড্ডারও বেশ রদ-বদল হয়েছে। তবে বুদ্ধদেব বসুর পর আমাদের ষাটের দশকের তরুণরাই সম্ভবত আড্ডাকে বইয়ের আকার দিয়েছেন। নিজের অজ্ঞতাটুকু স্বীকার করেই বলছি, এরপরের বিভিন্ন দশকের আড্ডার খতিয়ান আমরা খুব একটা পাই না। তবে নব্বইয়ের দশকের আড্ডাগুলোই সম্ভবত ছোটো কাগজ আর কবিতার ধারার একটি পরিবর্তন ঘটিয়েছিলো। সম্ভবত বলছি কারণ— এ সংক্রান্ত তেমন কোনো আলোচনা অগ্রজ লেখকদের লেখায় পাইনি। এখনও আড্ডার আলোচনা নিয়ে বই পড়তে বোসলে মর্তুজা বশীরের লেখায় শামসুর রাহমান বা জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর লেখায় সৈয়দ শামসুল হককে খুঁজতে হয়। ইলিয়াসকে খুঁজতে হলে হয়তো আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখা কোনো বই খুলতে হয়। বেলাল চৌধুরীর নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায় পড়ে হয়তো সলিমুল্লাহ হলের মাঠে কোনো তরুণ কবিকে খুঁজতে যাওয়া চলে। ষাটের দশকের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নানা বাঁক উপবাঁক পড়তে এবং জানতে যতোটা পরিশ্রমে আজকের তরুণ উল্টায় ইতিহাসের পাতা, ততোটাই আনন্দে খুঁজে সে সময়ের আড্ডাবাজদের দিনলিপি। লিখতে লিখতেই মোনে হলো, আসছে আটই ডিসেম্বর অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের প্রয়ানদিবস। আমি শুনেছি অতো বড়ো মানুষটাও জীবনের শেষ বয়সেও খুব আড্ডা দিতেন। বিচারপতি হাবিবুর রহমানও ছিলেন সেই আড্ডার একজন। জানতে ইচ্ছে করে, তাঁরা কী ভাবতেন? কী নিয়ে কথা বলতেন? তাঁদের এই আড্ডার কী কোনো নাম ছিলো? যেমন সুকুমার সেন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘হোমসিয়ানা ক্লাব’। তাঁদের ওই আড্ডাবাজিও আমাদের চিন্তার খোরাক হতে পারে। কেননা খান সারওয়ার মুরশিদের লেখা কালের কথা বইটি পড়ে মোনে হয়েছিলো, তাতে অধ্যাপকসুলভ বক্তব্য কই? তিনি তো তেমনই লিখলেন, যেমন আমি পড়তে ভালোবাসি। অর্থাৎ অগ্রজদের আদতে যতোটা রাশগম্ভীর অধ্যাপকসুলভীয় মোনে হয়, কার্যত তাঁরা সকলেই বোধ করি সে রকম নন। আড্ডাতে তাঁদের আরেকটি রূপ আছে আর যেহেতু ওটাই বাঙালির আসল রূপ, সুতরাং তার নথিভুক্তিকরণটা জরুরি। এই কাজটি যেমন করে গিয়েছেন আহমদ ছফা যদ্যপি আমার গুরু বইটিতে।
বই থেকে আড্ডার সর্বশেষ বিষয়বস্তু পড়েছিলাম অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের বইয়ে। সাক্ষাৎকারে তিনি পণ্ডিত আহমদ শরীফের নেতৃত্বে আড্ডার কথা উল্লেখ করেছেন। তখন থেকে ‘গুঁড়ি’ শব্দটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ— গুগল ম্যাপে খুঁজে না পেলেও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এরপর আড্ডা সম্বন্ধে কেমন যেনো আমাদের গৎবাঁদা ধারণাটাই টিকে গেলো। আজকাল অবশ্য আর আড্ডা নেই। অতএব, আমাদের আড্ডার বইও এখন নেই। এখন সকলে ‘বসেন’। এসএমএস করে ‘বসার’ কথা বলেন। কেউ কেউ সবিনয়ে অন্যকে জানান— ‘আপনার সঙ্গে একটু বোসতে চাই’। কথাটা সম্ভবত এই ভেবেই বলেন যে, ‘আপনার সঙ্গে একটু আড্ডা মারতে চাই’ কথাটা পাছে সস্তা হয়ে যায়।
সমরেন্দ্র দাসের একটি বই পড়েছিলাম কলকাতার আড্ডা নামে। সেখানে তিনি জানিয়েছিলেন— আড্ডায় সকলের মর্যাদা সমান হতে হবে। অর্থাৎ আড্ডাতে থাকতে হবে সাম্যের পরিসর। যার যা অসাম্যবোধ, প্রভেদ ইত্যাদি আছে, সব ছেড়ে ছুড়ে আড্ডায় বোসতে হবে। ব্যাপারখানা তেমনই যদি হয়, তবে কী আদৌ তেমন কোনো আড্ডা হবে? প্রত্যেকেই যে আমরা একটা করে ধারণা পোষণ করি, সত্য হোক মিথ্যে হোক, করি তো! সুতরাং আমার চোখে ‘তিনি’ হয়তো বিশাল মাপের মানুষ; তাঁর সঙ্গে বোসে আমি আড্ডা দেবো কী? হয়তো সে কারণেই আজকাল আড্ডার আরেকটি নাম হয়েছে সাক্ষাৎকার। সেখানে যা থাকে, তাকে আড্ডা বলা যায় না। আমরা আসল মানুষটিকে খুঁজে পাই না। কিছু কেজো গল্প আর কেতাবি ভাষাই সম্বল হয়। ফলে যা চাইছি, তা হচ্ছে না, আর যা চাইছি না, ঠ্যালায় পড়ে তা গিলতে হচ্ছে। গোপাল হালদার ১৯৪৩ সালে ‘আড্ডা’ নামে একটি লেখা যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। পরে, ১৯৫৬ সালে, আড্ডা বিষয়েই চারটি লেখাসহ তাঁর আড্ডা (পুঁথিপত্র, ২০০৪) বইটি প্রকাশিত হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন আড্ডাই বাঙালির প্রধান বৈশিষ্ট্য। কথাটির পক্ষে তিনি যতোগুলো যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন, তা আজকাল আমরা প্রেমিকাকে ভালোবাসা বোঝাতেও ব্যবহার করি না। এই হলো আড্ডার প্রতি প্রেম— আর হবেই না কেনো; যে বাঙালি আড্ডা দিচ্ছে সেই ‘চণ্ডীমণ্ডপের আমল’ থেকে তার কাছে এ তো বুক পকেটে রাখা এক ট্র্যাডিশন। তবে ওখানেও তিনি লিখেছেন— ‘একটু ঢিলেমি, একটু আয়াস, একটু গল্প, একটু পরচর্চা’। এখন পাঠক পরচর্চা প্রসঙ্গে বিতর্ক করতে পারেন, তবে মোনে রাখা দরকার, আড্ডায় বোসে টোকন ঠাকুরের কবিতা নিয়ে কথা বলাটাও পরচর্চা। অতএব, সে প্রসঙ্গ থাক।
আড্ডার বই নেই, এর সহজ কারণ, আমাদের আড্ডাই নেই। এই ভবিষ্যদ্বাণী অবশ্য গোপাল হালদার করে গেছেন। তিনি বলেছিলেন— “মানি ইকনমি আসছে, তাই আড্ডা, আর টিকবে না”। কথা সত্য। টিকছে না তো। কারণ এই যুগে “টাইম ইজ মানি”। এখন এই টাইমকে মানি দিয়ে মূল্যায়ন করে ক্ষেত্র-বিশেষে আড্ডা টেকানো হচ্ছে। “অমুকের সঙ্গে আজ আড্ডা হবে, সঙ্গে থাকবেন তমুক”— তো আমরা কারা? আমরা আড্ডা দেবোও না, মারবোও না; হয় শুনবো, নয় দেখবো— কখনও দুটো একসঙ্গেই করবো। আজকাল সাহিত্য আড্ডা হয়, চিত্রশিল্পীরা ছবি আঁঁকেন আড্ডা দিতে দিতে, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতে আড্ডা দেন রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পীরা। লাইভ টেলিকাস্ট হয়। আমরা আমাদের চোখ আর কানের সদ্ব্যবহার করি। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে, আমাদের দেখানো হচ্ছে, দ্যাখ ব্যাটারা শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য কতো কষ্ট করে কার্টুন আঁঁকেন। অমনি অমনি আহমাদ মোস্তাফা কামাল হওয়া যায় না। “একলা থাকার গল্প লিখতে কতোবার একলা থেকেছেন?”— হয়তো এসএমএস করে বা ফেসবুকে কমেন্ট করে সরাসরি লেখককে এই প্রশ্নগুলো করার কথাই সঞ্চালক আমাদের বারবার মোনে করিয়ে দেন। তারপর আমাদের কান মলে দিয়ে বলেন, জেমকন পুরস্কার না পেলে যে আমরা কান্নাপর্ব পড়ি না এই বিষয়ক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে সঞ্চালক বিদায় নেন। আমরা গবেটের মতো বোসে থাকি আরেকদিন আরেকটি আড্ডা শোনার জন্যে। এর বাইরেও ফেসবুকে আমারা আড্ডা দেখি। সাহিত্যিক রেজা ঘটকের সঙ্গে সাংবাদিক নজরুল কবীরের দীর্ঘ জীবনের আড্ডার খতিয়ান আমাদের ফেসবুকে যার যার টাইমলাইনে পড়তে হয়। সাংবাদিক জাহিদ নেওয়াজ খানের ছাত্র জীবনের নানা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার গল্পও তিনি পোস্ট করলে পড়তে পারি। অথচ এইগুলোর খতিয়ান থাকা দরকার। আমাদের চোখের সামনে থেকে আশি-নব্বইয়ের দশককে আড়াল করা হচ্ছে; আমরা তাঁদের জীবনের উজ্জ্বল প্রাপ্তি বা দীর্ঘ হতাশা— কিছুই আমরা জানি না। তাঁদের আড্ডার কোনো বই নেই, বই নিয়ে তাঁরা কী ভাবতেন— তাও জানি না। এই যে কানাগলিতে আটকে গেলো আমাদের প্রজন্ম— কে উদ্ধার করবে আমাদের? আগের প্রজন্ম তাঁর আড্ডার কথাগুলো লিখুন, কেবল ফেসবুকে বা ব্লগে না, বই আকারেও লিখুন। আমরা পড়ি। বিউটি বোর্ডিং খবরের কাগজে উঠে গেছে, মধুর ক্যান্টিন, টিএসসি, আজিজ মার্কেট, শাহাবাগটাও যদি খবরের কাগজে চলে যায়, তবে আর কী থাকবে আমাদের সামনে? আশির দশক নব্বই দশকের কাঁধে হাত রাখুক, নব্বই দশক শূন্য দশকের হাতে তুলে দিক তাঁদের অর্জন এবং ব্যর্থতা— তবেই না পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে আমরা কিছু একটা করে যেতে পারবো।