১৯২৯ সালে এরিক মারিয়া রেমার্কের ‘অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ বইটি নিষিদ্ধ করেছিল জার্মানির নাৎসী সরকার। কালো আইনে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের প্রদর্শনী বন্ধ করেছিল ব্রিটিশ সরকার। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ এবং তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ নিষিদ্ধ করা হয় যথাক্রমে ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে– বিএনপির শাসনামলে। এছাড়াও বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে বাজেয়াপ্ত করা হয় অধ্যাপক আবু সাইয়িদের গ্রন্থ ‘অঘোষিত যুদ্ধের ব্লু প্রিন্ট’ ।
সম্প্রতি বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশনী সংস্থা নিষিদ্ধ করে অতীতের সমস্ত নজির ছাপিয়ে গেছে। দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা ‘শ্রাবণ’ প্রকাশনীর বিষয়ে বাংলা একাডেমির পরিচালক জালাল আহমেদ যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা আরও গুরুতর। গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান–
গত বছর ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামের একটি বই নিষিদ্ধ করা হয়, উনারা এর প্রতিবাদে সরব হয়েছেন।১
তার মানে দাঁড়ায়, বাংলা একাডেমির কোনো অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা যাবে না, কোনো অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা যাবে না। স্টল বন্ধ করা, প্রকাশনী নিষিদ্ধ করা– বাংলা একাডেমির এইসব স্বেচ্ছাচারী আচরণ একটি আত্মঘাতী নজির স্থাপন করছে এবং আগামী দিনগুলোতে একটি স্বেচ্ছাচারিতার ভয়াবহ ফলাফল আমাদের দেখতে হবে।
Bangla Academy Ordinance, 1978 রহিতপূর্বক ২০১৩ সালের ৩৩ নম্বর আইন হিসেবে ‘বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের দশ নম্বর ধারায় ‘একাডেমির কার্যাবলি’ অংশের প্রথমেই বলা হয়েছে–
জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার সহিত সঙ্গতি রাখিয়া বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নয়ন, লালন ও প্রসার সাধন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ‘জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা’র বিষয়ে বাংলা একাডেমির ধারণা কী? খুব সরলভাবে বর্ণনা করলে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের সার্বিক স্তরে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষান প্রতিফলন। বর্বর পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া দমননীতির বিরুদ্ধে বাঙালির সূর্যমুখী উদ্বোধন ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যেমন, তেমনি বাহাত্তরের সংবিধানেও আমাদের জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে। কেবল বাংলা একাডেমি নয়, আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি অংশ মুক্তিযুদ্ধে অগণিত মানুষের রক্ত আর ত্যাগের সুফল ভোগ করছে। সুতরাং আমাদের প্রত্যেকের দায় আছে ত্রিশ লক্ষাধিক শহীদের রক্তের কাছে, আমাদের দায় আছে এদেশের চার লক্ষাধিক বীরমাতার কাছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, চেয়ারে বসে যারা স্বাধীন বাংলাদেশের সুফল ভোগ করছেন, তারা দায় মিটাচ্ছেন কি?
অমর একুশে বইমেলা কেবল একটি বইয়ের মেলা নয়, কেবলই বই প্রকাশ, কেনা-বেচার জায়গা নয়– এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাঙালির আত্মমর্যাদার ইতিহাস। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যে দুর্বার চেতনা, অমর একুশে বইমেলা তারই ধারক ও বাহক। সুতরাং বাংলা একাডেমি যেহেতু এটি আয়োজন করে (যদিও আইনে লিপিবদ্ধ তাদের বাইশটি কার্যাবলির কোথাও এই আয়োজনের উল্লেখ নেই) সেহেতু এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড সে-ই চেতনাকে ধারণ করে কি না, সেটাও বিবেচনার বিষয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা একাডেমির কর্মকাণ্ড এতটাই প্রশ্নবিদ্ধ যে, একুশের পারাবারপ্রতিম চেতনার অক্ষবিন্দু থেকে তারা যে বহুদূরে ‘পথ হারাইয়াছে’ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একাডেমি কর্তৃপক্ষ তাদের প্রাতিষ্ঠানিক তাঁবেদারির লেভেল লাগিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন– কার সন্দেহ নেই? উত্তর হচ্ছে জনগণের।
যাদের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন হয়, যাঁরা সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন একুশের বইমেলার জন্যে, যাদের সিংহভাগই কখনও বাংলা একাডেমির সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করেন না— তাদের মনে এই প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। কারণ গত কয়েক বছরের বইমেলায় বাংলা একাডেমি একের পর এক যে ধরনের স্বেচ্ছাচারিতার নগ্ন প্রদর্শন দেখিয়েছে, তাতে বইমেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন, এমন মানুষও বুঝেছেন যে, প্রতিষ্ঠানটি ‘জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার সহিত সঙ্গতি রাখিয়া’ কাজ করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ।
আসছে বইমেলায় ‘শ্রাবণ’ প্রকাশনীকে দু বছরের জন্য নিষিদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলা একাডেমি এবার জাতির সামনে তার প্রাতিষ্ঠানিক সন্ত্রাসী রূপটি দেখাতে পারল। গণমাধ্যমকে দেওয়া পরিচালকের বক্তব্যটিও একটি স্বেচ্ছাচার-সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের যোগ্য মুখপাত্রের বক্তব্য ছিল। প্রতিবাদে সরব হবার কারণে, ‘শ্রাবণ’ প্রকাশনীকে দু বছরের জন্যে বইমেলায় নিষিদ্ধ করে তারা প্রমাণ করল, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করা যাবে না। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতন নিয়ে তারা ধরাকে সরাজ্ঞান করবেন, আর জনগণ রাস্তায় তার প্রতিবাদ করতে পারবে না!
গণমাধ্যমে আমরা বিভিন্ন সময় সংবাদ পড়ি, অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে অপরাধীরা পাল্টা হুমকি দেয়। বাংলা একাডেমি তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের জায়গা; কিন্তু তার স্বেচ্ছাচারিতা এবং বিরুদ্ধমত দমননীতির নির্লজ্জতায় এবার তারা ষোলোকলা পূর্ণ করল।
এখানে একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন, কোনো একটি নির্দিষ্ট প্রকাশনী বা নির্দিষ্ট কোনো লেখকের বিষয় এটি নয়। কেউ যদি যুক্তি দেবার চেষ্টা করেন যে, ‘শ্রাবণ’ প্রকাশনী একাডেমির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করায় তাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাহলে এই কথাটি বলে রাখা ভালো যে, খলের ছলের অভাব হয় না। আজ প্রকাশনী নিষিদ্ধের প্রতিবাদে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের অন্যান্য প্রকাশনীকে পাই না। বাংলা ভাষায় যাঁরা বহুদিন ধরে লেখালেখি করছেন, তাদের কোনো প্রতিবাদ আমাদের চোখে পড়ে না।
এই যে নির্লিপ্ততা বা নিজের পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা, তাতে আসলে আখেরে কোনো ফল হবে না। কারণ অক্টোপাস তার সুঁড়গুলো সবে বের করতে শুরু করেছে। আজকে যে প্রকাশকরা নিজেদের নিরাপদ ভাবছেন, যে কারণেই ভাবুন না কেনো, আদতে তিনি নিরাপদ নন। যে লেখক ভাবছেন, এই প্রতিবাদ তাঁর জন্যে নয়, তিনি আদতে নিজের চৈতন্যের সমাধি তৈরি করছেন। আজকে শ্রাবণ প্রকাশনী আক্রান্ত হয়েছে, কাল অন্য আরেকটি প্রকাশনী হবে।
একাডেমির মহাপরিচালক যেভাবে হেফাজত তোষণ করছেন, তাতে অচিরেই বোধ করি তিনি হুমায়ুন আজাদ বা আরজ আলী মাতুব্বর নিষিদ্ধের ঘোষণা দিবেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের সঙ্গে আপোস করতে করতে কীভাবে মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়ে, বাংলা একাডেমির সাম্প্রতিক কার্যক্রম তার সবচেয়ে বড় নজির।
বর্তমানে জঙ্গিবাদের যে ভয়াবহ রূপ আমরা দেখছি, গ্রেফতারকৃত জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছে তা থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে সমাজের মর্মে মর্মে বিরাজ করছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শহীনতা আর ধর্মান্ধতার বিষ। কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়েই এর প্রতিকার সম্ভব নয়। এর জন্যে দৃঢ় সামাজিক-সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক আন্দোলনও প্রয়োজন।
দেশের যখন এই সঙ্কট পরিস্থিতি, তখন সাহিত্য বিকাশের ধারায় সবচেয়ে সাহসী আর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি নেবার কথা ছিল বাংলা একাডেমির। কিন্তু তারা তো সে পথে হাঁটছেনই না, উল্টো গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে বেহায়ার মতো জামাত-হেফাজতের ভয়ে তারা কতটা কাতর, সেটা প্রমাণের চেষ্টা করছেন। একে তো ক্ষমতা-বহির্ভূতভাবে প্রকাশনী নিষিদ্ধ করছেন, মেলা প্রাঙ্গনে কুপিয়ে লেখক হত্যা করলে মুখে কুলুপ এঁটে থাকছেন– আবার এরাই বইমেলার উদ্বোধনের দিন ‘জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় অমর একুশের চেতনা’ শীর্ষক বক্তৃতা দেবেন। অথচ, এই বিষয়ে তাদের কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই। কিছু মুখস্থ বুলি আওড়ে তারা প্রতি মুহূর্তে জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বেইমানি করে চলেছেন।
একুশ মানে মাথা নত না করা; অথচ বাংলা একাডেমি মৌলবাদ তোষণ করে মাথা নত করতে করতে এখন প্রায় মাথাশূন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখন লেখক-প্রকাশক-পাঠকদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এই নীতিহীন বাংলা একাডেমির একের পর এক অনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোই তারা মানবেন, না কি পাল্টা দ্রোহে আদর্শচ্যুত বাংলা একাডেমিকে তার আদর্শের কথা মনে করিয়ে দেবেন।
তথ্যসূত্র
১. বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ২৬-১২-২০১৬