লেখাটি শুরু করতে চাই আমার খুব প্রিয় একটি বইয়ের নাম দিয়ে। ‘ফ্রিডম’। লেখকের নাম উইলিয়াম শেরিফ। কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই নামটা উল্লেখ করলাম। কারণ এ মুহূর্তে প্রসঙ্গটি অন্যরকম।
সম্প্রতি সেনাবাহিনী ইস্যুতে বাঙলাদেশ বেশ উত্তপ্ত। এই উত্তাপের নানা কারণ রয়েছে। সাম্প্রতিক সেনা-সমর্থিত সরকার, তাদের কার্মকাণ্ড ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে চারপাশে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। এইসব নানা ঘটনাবলী বিশ্লেষণ এই পোস্টের উদ্দেশ্য নয়। তবে আমি যে কোনো বিষয় নিয়ে একটু ভাবার চেষ্টা করি। যেহেতু অকর্মণ্য ব্যক্তি— তাই ভাবনার সীমা-পরিসীমা থাকে না।
বাঙলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠার ইতিহাস আমরা জানি। কিন্তু আলোচনাটা একটু ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপনের চেষ্টা করবো। বাঙলাদেশের সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। লক্ষ্য রাখতে হবে— একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি নয় মাসের ঘটনাই নয়; এখানে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত তার আগের সময়কার ইতিহাস এবং নিঃসন্দেহে সাতচল্লিশ পরবর্তী প্রেক্ষাপটের আলোতে সে ইতিহাস ধ্রুব সূর্যের মতো। তাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যদি বাঙালির জাতীয়তাবাদ উন্মেষের চূড়ান্ত লড়াই হয়— তবে তার প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছিলো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে, আরও পরিস্কার করে বললে আটচল্লিশের ২৪ মার্চ, কার্জন হলে জিন্নাহর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে। সে সময় বাঙালির প্রতিপক্ষ ছিলো পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী এবং সেই শাসক গোষ্ঠীর ব্যবহারে ব্যবহৃত হয়েছে সেনাবাহিনী। এই বক্তব্য কিন্তু কেবল পাকিস্তানের প্রেক্ষিতেই নয়; সব দেশের সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। অর্থাৎ সেনাবাহিনী শাসকগোষ্ঠী দ্বারা ব্যবহৃত হয়, হতে বাধ্য।
পাকিস্তান আমল থেকেই বাঙালির সেনাবাহিনী অভিজ্ঞতাটি ভালো ছিলো না। তবে এটাও ঠিক— মুক্তিযুদ্ধের কারণ হিসেবে যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিলো— তন্মধ্যে সেনাবাহিনীতে বাঙালি অফিসার নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না— এটাও ছিলো।
১৯৬৬ সালের ০৫ ও ০৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি পেশ করেন। সেই ছয় দফার শেষ দফাটি ছিলো—
আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা: (ক) আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সংবিধানে অঙ্গরাজ্যগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা-সামরিক বাহিনী বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে। (খ) কেন্দ্রীয় সরকারের সকল শাখায় বা চাকরি ক্ষেত্রে প্রতিটি ইউনিট থেকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ করতে হবে। (গ) নৌ-বাহিনীর সদর দপ্তর করাচি থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তর করতে হবে।
অতএব এইটুকু বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয় যে— একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য নয়; এ যুদ্ধ ছিলো বাঙালির যুদ্ধ, বাঙালির আত্ম-প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিকে লড়তে হয়েছিলো একটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর সঙ্গে। উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটি বাহিনী— যাদের পেছনে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন; তাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পরিচালনা করেন গেরিলা অপারেশন, প্রেমিকার থরো থরো দেহের মতোন মুক্তিযোদ্ধার হাতে চলে আসে যশোর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম— মুক্তাঞ্চলে উড়ে স্বাধীন বাঙলাদেশের সর্বজয়ী পতাকা।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ একদিকে যেমন ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা আর নারী নির্যাতনের স্মারক, তেমনি এই মুক্তিযুদ্ধই বীর যোদ্ধাদের অমিত সাহসিকতা, কবিতার প্রাণময় স্ফূলিঙ্গ আর ইতিহাসের মহাসড়কে রোম্যান্টিক দীপাবলীর আরতি। আর তাই, পরের ইতিহাস যাই হোক না কেনো, ১৭ই এপ্রিল, ১৯৭১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশের প্রথম সরকার (মুজিবনগর সরকার) গঠনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের শপথ বাক্য পাঠ করানো অবস্থায় খালেদ মোশারফকে দেখে আজকের এক তরুণ বলে উঠেছিলো— বাহ, এ যে একেবারে অ্যন্টনিও বেনদ্যোরাস। সেই থেকে অ্যন্টনিও বেনদ্যোরাসের জায়গাটি দখল করে নেন খালেদ মোশারফ। একাত্তরের এমন কয়েকটি মিথ আছে— যা ঐতিহাসিকভাবে পাস নম্বর না পেলেও, এগুলো মুক্তিযুদ্ধের সৌন্দর্য। হানাদারের গুলিতে ঝাঁঝড়া হয়ে যাওয়া এক সন্তানের মৃতদেহ দেখে এক ফোঁটা অশ্রুও ফেলেননি মা, ঘরে ঢুকে আরেক সন্তানকে পাঠিয়ে দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। আমার মুক্তিযুদ্ধ কেবল সাহসিকতার দিক থেকেই প্রবাদপ্রতিম নয়, এ মুক্তিযুদ্ধ— আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, পৃথিবীর যে কোনো শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মের চেয়েও শ্রেষ্ঠ— তা না হলে সেদিন ম্যাডিসন স্কয়ার কাঁপিয়ে তুলতেন না জর্জ হ্যারিসন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, যখন বঙ্গবন্ধু এসে নামেন বাঙলার মাটিতে— আমি জানি না, দৃশ্যটি কেমন ছিলো; তবে এইটুকু বলতে পারি— বাঙলা ১৩৪৮ সালের নববর্ষে লেখা রবীন্দ্রনাথের গান ‘ওই মহামানব আসে.. ..’ ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারি তার সার্থক উপমাটি খুঁজে পেয়েছিলো। এই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, এই আমার অহঙ্কার।
এই ‘আমার’ কিন্তু প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিক। তাঁরা কেউ শিক্ষার্থী, কেউ শিক্ষক, কেউ সামরিক বাহিনীতে কর্মরত, কেউ ব্যবসায়ি, কেউ প্রকৌশলি, কেউ চিকিৎসক, কেউ সবজিওয়ালা, কেউ পানের দোকানদার, কেউ শ্রমিক, কেউ বেশ্যা, কেউ বেশ্যার দালাল.. .. কিংবা আরও এন্তার। পেশার খাতিরে তাঁরা বুদ্ধি বেঁচে, পেশী বেঁচে, শ্রম বেঁচে, বেঁচে শরীর; তাঁদের কারো ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা আছে, কারও বা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও নেই; এঁদের কেউ শিক্ষিত, কারো বা অক্ষরজ্ঞানও নেই; এঁদের কেউ থাকে উত্তরবঙ্গে, কারো বা বাস দক্ষিণবঙ্গে— কিন্তু এঁরা সবাই বাঙলাদেশে থাকে, এঁরা বাঙলা ভাষায় কথা বলে। এঁদের হয়তো একত্রিত হবার সুযোগ নেই, রাজনৈতিক মিছিলে হয়তো এঁরা যায় না, কিংবা ব্লগ লেখা বা ব্লগ পড়ার মতে মানসিকতা হয়তো এঁদের নেই, এঁদের কেউ দাম দেয় না, কারও কারও ব্যবহার অত্যন্ত অভদ্র.. ..তবুও, রাস্তার মোড়ে, দেয়ালে দেয়ালে যখন ‘রাজবন্দীর মুক্তি চাই’ শিরোনামে ইসলামী ছাত্রশিবির অশ্লীল পোস্টরিং করে, তখন এঁরাও দাঁড়িয়ে সেই পোস্টার দেখে। রাজাকারের ছবি সম্বলিত সেই পোস্টর দেখে গলার ভেতর থেকে শব্দ করে থুথু গুলিয়ে আনে, সঙ্গে আনে বুকের ভেতরের ঘৃণা, তারপর থুথু ছুড়ে দেয় সেই জঘন্য পোস্টারে। তারপর হেঁটে চলে যায় নির্বিকার। মনে মনে দু’একটা অশ্রাব্য গালি দেয়।
পাঠক, ঠিক এই জায়গাটিতে এসেই, বর্তমান বাঙলাদেশের আঠারো কোটি জনতা হয়ে উঠেন একাত্তরের সাত কোটির প্রতীক। তবে সে সময়ও যেমন রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস জনসংখ্যার একটি অংশ ছিলো, এখনও আছে— পাকিস্তানের জয়ের উল্লাসে নৃত্যরত বেহায়ার দল তার প্রমাণ। এখন যারা বলবেন, বা যারা বলেন রাজনীতি আর ক্রিকেট এক জিনিস নয়— তাদের মতো দুমুখো ইতর প্রাণিদের একরাশ ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই দেবার নেই।
মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর সময়ে আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো ছিলো না। পঁচাত্তরে হত্যা করা হয় জাতির জনককে, মসনদে অধিষ্ঠিত হয় বেঈমানরা। লক্ষ্য করলে দেখা যায়— এই বেঈমানদের মদদ দিয়েছিলো সেনাবাহিনী, এমনকি জাতির পিতাকে হত্যার দায়ও সেনাবাহিনী কোনোদিন এড়াতে পারবে না। এই কলঙ্ক তাদের চিরকালের কলঙ্ক। এরপর দীর্ঘকাল সেনা শাসন চলে। আমি জানি না সেই দীর্ঘ সেনা শাসনে কয়জন সিপাহী উপকৃত হয়েছেন, আমি জানি না, কর্নেল তাহেরকে হত্যার সময় জোয়ানদের যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিলো— আজও তাদের সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে কিনা। জানি না, মিছিলে ট্রাক তুলে দিয়েছিলো যে সেনাবাহিনীর চালক, সেদিনের পর আর কোনো রাতে তার শান্তির ঘুম হয়েছে কিনা। নূর হোসেনের বুক ফুটো করে যে সিপাহীর ছোঁড়া বুলেট চলে গিয়েছিলো অসীমে, সেই সিপাহী কি পেলো জীবনে? সামরিক শাসন কোনোদিন কোনো সিপাহীর কথা ভাবেনি, তারা কোনোদিন চেয়ে দেখেনি বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকায় সেনা সদস্যরা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে থাকে— জানি না, সিএমএইচগুলোতে এঁদের কতোজনকে সেবা দেয়া হয়।
জাহাঙ্গীর গ্যাটের সামনে যখন সেনা সদস্য সিএনজি থামায়, সামরিক কায়দায় প্রশ্ন করে— ‘কোথায় যাস?’; তখন আসলে সে উপরওয়ালার স্বার্থ হাসিল করে; বৈষম্য সেখানেই তৈরি হয়ে যায়। অথচ— হয়তো বা এই দুইজনের পিতাই একাত্তরে কোনো এক যুদ্ধক্ষেত্রে পাশাপাশি যুদ্ধ করেছিলেন, সহযোদ্ধার দুর্বার সাহসের গল্প হয়তো অনেকবার নিজের সন্তানদের বলেছেন তাঁরা। এই কদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে জোয়ান লোক প্রশাসনের মেহেদীকে থাপ্পড় মেরেছিলো— আমি জানি না, সেই জোয়ানের ছোটো ভাই আছে কিনা, সেই ছোটো ভাইয়ের সামনে সে আর কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে কিনা।
সেনাবাহিনী সম্বন্ধে আমাদের নানা রকম ভাবনা; এই ভাবনার শিকার হতে হয় তাঁদের— যাঁরা হয়তো চাকুরির শেষদিন পর্যন্ত সিপাহীই থেকে যাবেন। আর যারা— শরীরের ভাঁজে প্রমোশনের গন্ধ শোঁকে, বেটার হাফের রেভলনের আঁচড়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের রিপোর্ট কার্ডে নিজেদের দক্ষতার গ্রাফ আঁকে, তাদের মাঝে কোনোদিনই দেশপ্রেম ছিলো না। আমি জানি, সেনাবাহিনীতে এমন অনেক অফিসার ও জোয়ান আছেন— যাঁরা রবীন্দ্রনাথের মতোই ভালোবাসেন বাঙলাকে। কিন্তু ইউনিফর্ম পড়লে সেই ভালোবাসাটা কেমন যেনো ‘কনট্রোলড’ রাখতে হয়।
তবে এরও ব্যতিক্রম দেখি। ক্যাডেট কলেজ থেকে আসা এমন অনেক শিক্ষার্থী আছেন, যাঁরা নিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তা বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন, এবং জানেন— একদিন এই পথেই নিজের মেধাকে দেশের সর্বোচ্চ কল্যাণে লাগাবেন। আবার বিপরীত চিত্রও আছে— কমিশন রেঙ্কেও থেকে যান অনেকেই, কোনোদিন এই চিন্তা করেন না যে— এতে তাঁর ক্যারিয়ার ভালো হলো, তিনি কেবল ভাবেন— ‘অন্যদের চেয়ে আরও তাড়াতাড়ি নিজেকে বাঙলাদেশের জন্যে কাজে লাগতে পারছি’।
বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে। কারণ সিভিলিয়ানের সাথে যদি মিলিটারির পার্থক্য করে দেয়া না যায়— তবে তারা একটি শব্দেই বন্দী হতে পারে— ‘বাঙালি’। এতে অনেকেরই গরম ভাতে ছাই পড়ে; ওসব ইতিহাস আমরা জানি, আপনারাও জানেন, বিস্তারিত লেখার প্রয়োজন নেই। একজন সেনা সদস্য অনেক সুবিধা পেয়ে থাকেন, সন্দেহ নেই— তবে এটাও মানতে হবে, তার জন্যেও তাঁকে পেরিয়ে যেতে হয় দুর্গম পথ। নবজাতক সন্তানের মুখ দেখতেও তার ছয় মাস লাগে। যতোই ইউনিফর্ম পড়ুক— ব্লাডি সিভিলিয়ান বলে গালি দিক, তাকে স্বীকার করতেই হবে— তার পিতাও তাই। তাঁর প্রেয়সীও হাজার স্বপ্নের বুননে অহোরাত্রি প্রতীক্ষায় থাকে তাঁর নিবিড় আগমনের, আমার জীবনানন্দ পড়া প্রেমিকার প্রতীক্ষার চেয়ে তা কোনো অংশেই কম নয়, হয়তো বা বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাদ ধ্বসে যখন অনেক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হলো— তখন এপি’র পাভেল রহমান অনেক ছবি তুলেছিলেন। সেই ছবিগুলোর মধ্যে একটি ছিলো— এক সেনা সদস্য কাঁদছেন। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পড়ে বুঝলাম— ওটা কিছু নয়, এই সেনা সদস্য জানে— ইউনিফর্ম খুললে সেও আমার মতোই বাঙালি, যারা মারা গেছে, তারা তাঁর ভাই।
আমার ইউনিফর্ম নিয়ে কোনো অ্যালার্জি নেই; তবে সেটা হৃদয়কে শক্ত করে ঢেকে রাখে— এতেই আমার আপত্তি।
নূর হোসেনকে যারা হত্যা করেছে আমি তাদের ঘৃণা করি; আমি তাদের অভিশাপ দিই, যারা ক্ষমতার জন্য হত্যা করেছিলো ডাক্তার মিলনকে। চিরদিন তাদের প্রতি লা’নত যারা সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা চালিয়েছিল। আমি অনন্তকাল তাদের গালি দেবো, যারা আমার বোন কল্পনা চাকমাকে গুম করেছে, চলেশ রিছিল আমার কবিতা, আমি আমার কবিতা হত্যার প্রতিবাদে চিরকাল স্লোগান দেবো, মানববন্ধনে দাঁড়াবো, মিছিলে হাঁটবো।
আর হ্যাঁ, ভয়াল মেঘমালার নিচে দাঁড়িয়ে আছি আমরা, পুরো বিশ্ব। তুমি ক্যান্টনমেন্টে, আমি তার বাইরে— অথচ ভয়াল মেঘমালার আকাশটা দুজনকেই বিষণ্ন করে রেখেছে।
পুরো বিশ্বকে আমার চেনা হয়ে গেছে; এখানে শুয়োরের বাচ্চারাই সভ্যতার নামে জিতে যায় প্রতিনিয়ত। আমি সভ্যতার নষ্ট চৌকাঠ পেরিয়ে এসেছি। আমি জানি, কে আমার পূর্বসুরী; কোথায় দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা আর আজ কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। রেসকোর্সের ইতিহাস আমার পড়া আছে, ‘বাঙালি’ শব্দটির ইতিহাস আমার মা আমায় শিখিয়েছেন। আমি বাঙলাদেশ বলতে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলকেই বুঝি। আঠারো কোটি জনতার অধিকাংশই যেখানে সম-নিরাপত্তায় বসবাস করেন, সেখানে ক্যান্টনম্যান্টের বাড়তি নিরাপত্তা— আমার মতো সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগায়। কারণ এই প্রাচীর ঘেরা ক্যান্টনমেন্টেই আমি অনেককে হারিয়েছি। ওই ক্যান্টনমেন্ট থেকেই বেরিয়ে এসেছিলো জাতির পিতার হত্যাকারীরা।
আমায় তোমরা যতোবার হত্যা করবে, ততোবার জন্মাবো। তোমাদের ক্যান্টমেন্টের প্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকবো আমি। কারণ ওইখানে কাজ করে আমার ভাই— জলপাই রঙের ইউনিফর্মের ভেতরে সে আসলে বাঙালি। বাঙালি সেনাসদস্য।
সে আমায় বলেছে— আমার হাত ধরে সেও আসবে বিজয় মিছিলে। বিজয়ের চল্লিশ বছরে মিলিটারী-সিভিলিয়ানের পার্থক্যের প্রাচীরে লাথি মেরে সে তার বুটের শক্তিটা দেখিয়ে দেবে তোমাদের। প্রমাণ করে দেবে— ‘বাঙালি’ ছাড়া, বাঙালির আর কোনো পরিচয় নেই, কোনোদিন ছিলোও না।
তাই আমি হাত বাড়িয়ে রেখেছি।
বাঙলাদেশের সবগুলো ক্যান্টনমেন্টের বাইরে এইভাবে লক্ষ-কোটি হাত বাড়িয়ে রয়েছেন মিলিটারিদের ‘ব্লাডি সিভিলিয়ান’ আত্মীয়-পরিজনেরা।