একটি দিনলিপি।
প্রাত্যহিক জীবনের ভাষায় রচিত।
বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ এক অর্জনের ইতিহাস এ দিনলিপির বিষয়বস্তু।
এটি কোনো মহাকাব্য নয়; এর অন্তঃস্রোতে যখন তখন শিল্পের মহাবাদল নেমে আসেনি।
এবং তারপরও- এটি সকল মহাকাব্যের অতীত, বান-ভাসানো এক মহার্ঘ শিল্পের প্রণয়োচ্ছ্বাসে ঋদ্ধ, বিদগ্ধ।
বাঙলা ১৩৯২ সনের ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬) মাসে এটি প্রথম প্রকাশিত হয় এবং এখনও নতুন।
বৈশাখ, ১৪১৭ সনে প্রকাশিত এর অষ্টাবিংশতি মুদ্রণের প্রচ্ছদ করেছেন কাইয়ুম চৌধুরী।
রজত জয়ন্তী সংস্করণটি সন্ধানী প্রকাশনীর প্রকাশ- মূল্য দুইশত সত্তর টাকা।
‘মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ ও জীবিত গেরিলাদের উদ্দেশে’- উৎসর্গপত্র।
পহেলা মার্চ থেকে সতেরোই ডিসেম্বর পর্যন্ত এখানে লিপিবদ্ধ।
দিনলিপি ছাপিয়ে বইটি হয়ে উঠেছে জাতির হৃদয়ছবি।
শহিদ জননী জাহানারা ইমাম লিখেছেন বইটি।
উনিশশো একাত্তর সালের দিনলিপি।
একাত্তরের দিনগুলি।
জাহানারা ইমাম জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৯ সালের আজকের দিনে; সুন্দরপুর মুর্শিদাবাদে। দীর্ঘ সময় শিক্ষকতা করেছেন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিশেবে বিভিন্ন সংগঠনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনোজগতে তিনি পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁর অধীত জ্ঞান-সম্ভার। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে তিনি বাঙলার হাজার মায়ের মতো তাঁর শ্রেষ্ঠ ত্যাগটি স্বীকার করেছেন- সন্তানকে পাঠিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে, আর ফেরেনি সন্তান- শহিদ হয়েছেন রুমী; আমাদের চেতনার আকাশে শহিদ জননী জাহানারা ইমাম এবং তাঁর সন্তান হয়ে উঠেছেন উজ্জ্বল নক্ষত্র আর নক্ষত্রের মাতা। জীবনের জ্যোতির্বিদ্যায় তা অপরাহত আর তুলনারহিত।
নিটোল ব্যক্তিত্বের সাথে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা আর চিন্তার সুর-সুতার মণিকাঞ্চনে জাহানারা ইমামের সাহিত্য মূর্ত হয়ে ওঠে। তাঁর রচনাগুলোর শ্রেণিবিভাগ করলে আমরা দেখবো, তিনি লিখেছেন অনেক, এবং তার প্রায় সবগুলোই শিল্পোমানে উন্নীত- স্পর্শ করেছে পাঠকের হৃদয়-মন। তাঁর রচনার মধ্যে যে গ্রন্থটিতে তিনি হৃদয়কে পাথর করেছিলেন, বুকের গহীনে বহন করা বেদনাকে সংহত করে দুঃখের নিবিড় অতলে ডুব দিয়েছিলেন আর তুলে এনেছিলেন বিন্দু বিন্দু মুক্তোদানার মতো অভিজ্ঞতার সকল নির্যাস- সে-ই একাত্তরের দিনগুলি একদিকে যেমন বাঙালির মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের এক অনন্য-অসামান্য দলিল, তেমনি বাঙলা সাহিত্যের এক বিজয়তোরণ। এ গ্রন্থে একদিকে যেমন রয়েছে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার চিত্র, পারিবারিক সৌহার্দ্যের বহমানতা, ইতিহাসের আকাশছোঁয়া সৌধ- তেমনি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান চিহ্নিতকরণও এ গ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্র সাতই মার্চের উত্তাল জনতরঙ্গের আঁচড়, তেইশে মার্চ প্রতিরোধ দিবসে একটি পারিবারিক আবহের প্রেক্ষিতে গোটা জাতির অবস্থার সত্য-অবলোকন, পঁচিশে মার্চে পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো নারকীয় গণহত্যা, তৎকালীন গণমাধ্যমের সত্য-অসত্য সংবাদ পরিবেশন, বাঙালির প্রবাদপ্রতিম প্রতিরোধ, কোজাগরী পূর্ণিমার পূর্ণ শারদচন্দ্রের দ্যুতির মতোন একজন বঙ্গবন্ধু, সেক্টর টু- দেবদূতের মতো খালেদ মোশাররফ, মায়াময়ী রঙধনুর প্রহেলিকার মতো গেরিলা বাহিনী, স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র, স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি- রাজাকার-আলবদর-আলশামস, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড, সাতকোটি বিপন্ন কোকিলের ঐকতানে ইতিহাস কাঁপানো মহামহীরূহ বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর সবকিছু ছাপিয়ে এবং সাথে নিয়ে একজন রুমী উঠে আসেন আমাদের বুকের আঙিনায়- দুইশত সত্তর পৃষ্ঠার এই বইটিতে জাহানারা ইমামের ইতিহাস-কথন চৌরাসিয়ার বাঁশির মতোন আমাদের ঘিরে রাখে, আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।
দুই
একটি পারিবারিক ঘটনা পরিক্রমার মধ্য দিয়ে বইটি শুরু হয়, এবং ধীরে ধীরে তা প্রবেশ করে ইতিহাসের আলোকোজ্জ্বল গহবরে। পহেলা মার্চ, ১৯৭১- সোমবার; এখান থেকেই বইটির শুরু। শুরুর বাক্যে আমরা যাঁকে পাই- রুমী- এরপর পুরো গ্রন্থেই রুমী জীবন্ত থাকেন, যেমন আছেন এখনও এবং থাকবেন অনন্তকাল।
বইয়ের শুরুতেই বাঙালির প্রতিরোধ আন্দোলনের একটি গার্হস্থ্য চিত্র আমরা পাই। রাজপথে আন্দোলন চলছে, চলছে স্বাধীন বাঙলার পতাকা উত্তোলনের কাজ- এবং এরই মাঝে একজন জাহানারা ইমাম- একজন মা, একজন স্ত্রী, একটি পরিবারের কর্ত্রী- তিনি দুই সপ্তাহ ধরে খুঁজে ফিরছেন পূর্ব পাকিস্তানের তৈরি সাবান, তেল, টুথপেস্ট, বাসন-মাজা পাউডার এবং আক্ষেপ নিয়ে বলেছেন- ‘কিন্তু পাই না’।
এই বোধটিও বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। এর ফলাফল কতোদূর ছিলো- সেটাও প্রথমদিকেই খুঁজে পাওয়া যায়। জাহানারা ইমাম লিখেছেন-
একমাত্র ইভা বাসন মাজা পাউডারটাই এখানকার তৈরি.. ..পিয়া নামের এক ঢাকাই টুথপেস্ট বাজারে বের হবো হবো করে এখনও বের হতে পারছে না, আল্লাহই মালুম কি কঠিন বাধার জন্য! (পৃষ্ঠা ১১)।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের ইঙ্গিত। পশ্চিম পাকিস্তানের, অর্থাৎ বর্তমান পাকিস্তানের পণ্য বর্জন, কেবল জনগণের চেষ্টাতেই সীমাবদ্ধ নয়, তা রূপ নিয়েছিলো একটি শিল্প-আন্দোলনের দিকেও। বাঙালির শিল্প, বাঙলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের) নিজস্ব পণ্য উৎপাদনের দিকে সকলের সচেতনতা এবং সম্মিলিত প্রয়াস। অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি স্বনির্ভরতার সাহসী পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছিলো, এবং এটাও স্পষ্ট যে- পশ্চিম পাকিস্তানি বর্বর শাসকগোষ্ঠী তাতে ভীত সন্¿স্ত ছিলো। তাই ‘কঠিন বাধা’ দিয়ে তারা স্বাধীনতার স্বপ্নের মূলোৎপাটন করতে চেয়েছিলো।
এরপর দৈনন্দিন জীবন এগিয়ে যেতে থাকে। আমরা জানতে পারি জাহানারা ইমামের পরিবারের সাথে একজন বিদেশীও থাকতেন। তাঁর নাম কিটি। যদিও দোসরা মার্চেই কিটির প্রসঙ্গ আসে, কিন্তু তাঁর পরিচয় পাওয়া যাবে পাঁচ মার্চ, শুক্রবারের দিনলিপি থেকে। জাহানারা ইমাম লিখছেন-
কিটি আমেরিকান মেয়ে- একটা স্কলারশিপ নিয়ে এদেশে এসেছে ডিসেম্বরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে মুনীর চৌধুরীর আন্ডারে ‘সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানে বাংলার মান নির্ধারণ’ বিষয়ে গবেষণা করার জন্যে। ন’টা ভাষা জানে। বাংলা ভাঙা ভাঙা বলতে পারে। তাড়াতাড়ি বাংলা শেখার জন্যে কোনো বাঙালি পরিবারে বাস করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলো কিটি। (পৃষ্ঠা ১৮)।
মুনীর চৌধুরী কোন মানের শিক্ষক ছিলেন- তা তাঁর জীবনী বা রচনা পড়লেই বোঝা যায়- কিন্তু তিনি কতোটা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক ছিলেন- তার একটি নিদর্শন এই কথাগুলো। আল-বদরের অমানুষগুলো এই মহান শিক্ষক মুনীর চৌধুরীকে হত্যা করে- চৌদ্দই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে।
মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব সময়ে বাঙালির প্রস্তুতির বেশ কয়েকটি ধাপ উঠে আসে গ্রন্থের মার্চের দিনগুলোর স্মৃতিচারণে। ঊনিশ মার্চের দিনলিপি থেকে জানা যায়- একটি অভিনব স্টিকারের কথা। ‘একেকটি বাংলা অক্ষর একেকটি বাঙালির জীবন’। স্টিকারটি পরিকল্পনা ও ডিজাইন করেছিলেন পটুয়া কামরুল হাসান (২ ডিসেম্বর, ১৯২১ – ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮)। তিনি ‘বাংলার পটুয়া সমাজ’ বলে একটি সমিতিও গঠন করেন- যাঁরা শাপলা ফুলকে সংগ্রামী বাঙলার প্রতীক হিশেবে গ্রহণ করবার প্রস্তাব দেয়।
স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্বকে তুঙ্গে তুলে দেয় ঢাকা টেলিভিশন। তখন এর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন শিল্পী মোস্তফা মনোয়ার (জন্ম ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৫)। তেইশে মার্চের প্রতিরোধ দিবসে একটি অবিস্মরণীয় প্রতিবাদ হয় তাঁর নেতৃত্বে। রাত সাড়ে নয়টার মধ্যেই টেলিভিশনের অনুষ্ঠান শেষ হবার কথা থাকলেও- সেদিন অনুষ্ঠান চলে চব্বিশ মার্চের প্রথম প্রহর পর্যন্ত। জাহানারা ইমাম লিখেছেন এর পেছনের কারণটি-
… নাটক ২৩ মার্চের রাত পৌনে এগারোটায় শুরু হয়ে শেষ হয় ২৪ মার্চের প্রথম প্রহরে। রাত বারোটা বেজে নয় মিনিটে ঘোষক সরকার ফিরোজ উদ্দিন সমাপনী ঘোষণায় বলেন- এখন বাংলাদেশ সময় রাত বারোটা বেজে নয় মিনিট- আজ ২৪ শে মার্চ বুধবার। আমাদের অধিবেশনের এখানেই সমাপ্তি। .. ..এতক্ষণে রহস্য বোঝা গেল। ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবসে বীর বাঙালিরা টেলিভিশনের পর্দায় পাকিস্তানের পতাকা দেখাতে দেয়নি। (পৃষ্ঠা ৩৬)।
এ এক অবিস্মরণীয় প্রতিবাদ- মুক্তিযুদ্ধ কোনো বিছিন্ন ঘটনা নয়, একটি সুদীর্ঘ আন্দোলনের ফসল আর সে আন্দোলনের রশ্মি ছড়িয়েছিলো চারদিকে, স্পর্শ করেছিলো সমস্ত আকাশ।
পঁচিশে মার্চ তারিখের নৃশংস গণহত্যার বিবরণ আছে ছাব্বিশ মার্চ, শুক্রবার থেকে একত্রিশ মার্চ, বুধবার পর্যন্ত লেখাগুলোতে। সেখানে কামাল আতাউর রহমান নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের এক স্নাতক পরীক্ষার্থীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা গা শিউরে ওঠার মতো। উল্লিখিত শিক্ষার্থী মোহসীন হলের আবাসিক ছিলো- তাঁর জবানিতে জাহানারা ইমাম তুলে ধরেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যার বর্ণনা- তবে বিশদভাবে নয়। ছাব্বিশে মার্চে লেখার একেবারে শেষ দুটো লাইনেই নৃশংস গণহত্যার মনস্তাত্ত্বিক তীব্রতা লক্ষ্যণীয়-
আবার আমরা সবাই নিচে নামলাম। দরজা খুলে উঠানে নেমে মিকির জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় দেখলাম মিকি মরে পড়ে আছে। (পৃষ্ঠা ৪২)।
মিকি তাঁদের গৃহপালিত কুকুরের নাম। একটি পশু- সে-ও সহ্য করতে পারেনি পঁচিশে মার্চের রাতের ভয়াবহতা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পশু বললেও প্রাণীজগত লজ্জা পাবে।
তিন
দিনলিপির এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত অংশে মুক্তিযুদ্ধের এক অবিনাশী তীব্রতা ধরা পড়ে। সেই সাথে উঠে আসে বিভিন্ন গণমাধ্যমের অপপ্রচার- নানা বিভ্রান্তির চিত্রও। চৌদ্দ এপ্রিলের লেখার শুরুটা বেশ চমকপ্রদ-
রুমীর খুব মন খারাপ। (পৃষ্ঠা ৬১)।
কেনো মন খারাপ- সে আলোচনা জাহানারা ইমাম করেছেন, কিন্তু তার আগে রুমীর মনন বোধ ও পড়াশুনার একটি চিত্র উঠে এসেছে। রুমী আই.এস.সি পরীক্ষার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলো। সে হিশেবে তাঁর বয়স সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এ সময়টাতেই তাঁর একটি দার্ঢ্য ব্যক্তিত্ব ও বোধ তৈরি হয়েছিলো। এর পেছনের কারণটি ছিলো তাঁর পড়াশুনা। এই রুমী- সচেতন বোধ সম্পন্ন এক তরুণ; তাঁর মন খারাপের কথা আমরা জানতে পারি চৌদ্দই এপ্রিলে। এর কারণ হলো- চীন পাকিস্তানকে দৃঢ় সমর্থন দিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে চীন সরকারের ভূমিকা সবারই জানা- ইতিহাসেও লিপিবদ্ধ আছে। এরা কেবল যে পাকিস্তান ঘেঁষানীতি অবলম্বন করেছিলো তাই নয়, চীনা রাইফেল ও অন্যান্য উন্নতমানের মারণাস্ত্র সরবরাহ করেছিলো পাকিস্তানকে, যা বাঙালির প্রাণসংহার করেছে। সবশেষেও, যখন বাঙালি ঠিক স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনে, তখনও একে অপমান করে বক্তব্য বিবৃতি দেয় চীনা সরকার। চীনের তৎকালীন সরকারের ভাষায় বাঙলাদেশের অভ্যুদয় বিবেচিত হয় রাশিয়া ও ভারতের ষড়যন্ত্র হিশেবে। কেবল এখানেই চীন থেমে থাকেনি, তিরিশের দশকে জাপান কর্তৃক মাঞ্চুরিয়ায় প্রতিষ্ঠিত তাঁবেদার রাষ্ট্র মাঞ্চুকোর সঙ্গে বাঙলাদেশকে তুলনা করে বিবৃতি দেয়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী আসন লাভের পর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তার প্রথম যে ভেটো প্রয়োগ করে- তা ছিলো বাঙলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। অতএব এ হেন ভূমিকার চীনপন্থীরা ঠিক কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছিলো, তা আলোচনা হতেই পারে। এ ধারার মূল দল ছিলো মোহাম্মদ তোয়াহা ও আব্দুল হকের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। এদের সম্বন্ধে লরেন্স লিফশুলৎসের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য, যেখানে তিনি বলেছিলেন- এদের ভূমিকা ভদ্রলোকের ভাষায় দ্বিধান্বিত, নিন্দুকের ভাষায় দালালীর সমতুল্য।
পঁচিশে মার্চ, ১৯৭১ সালের পর, আব্দুল হক ও তোয়াহা বিভক্ত হয়ে পড়ে। আব্দুল হক তত্ত্বের আলোকে মূল শত্রু হলো ভারত আর তাদের নিশ্চিহ্ন করতে তারা বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর মিত্র হিশেবে কাজ শুরু করলো ও মুক্তিযোদ্ধাদের খতমের লাইন গ্রহণ করলো। অন্যদিকে তোয়াহা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চাইলো কিন্তু ভারত ও সোভিয়ত ইউনিয়নের সমর্থনপুষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদেরও মেনে নিতে পারলো না। ফলে সে একই সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়তে লাগলো। তবে এরা দুজনেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো। যদিও সেই বিশ্বাসঘাতক চীনের দালাল-মুরিদরা এখনও চৈনিক বাতাসে গা এলিয়ে দেয়। এখন দেখার বিষয় হলো, রুমীর মতো আমরা কতোটা ‘সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন, মান-অপমান জ্ঞানসম্পন্ন একজন সচেতন মানুষ’ হিশেবে এগুলো বিশ্লেষণ করতে পারবো এবং আমাদের সঠিক কর্তব্যটি নির্ধারণ করতে পারবো।
রুমীর মুক্তিযুদ্ধে যাবার বিষয়ে জাহানারা ইমাম সম্মতি দেন একুশ এপ্রিল। এরপর মন্ত্রের মতো করে আমরা পড়ে যাই কয়েকটি তারিখের দিনলিপি- আমাদের সামনে আসে লিয়ন উরিস (আগস্ট ০৩, ১৯২৪- জুন ২১, ২০০৩)- এর লেখা মাইলা-১৮ (১৯৬১) আর কাহলিল জিবরানের (জানুয়ারি ৬, ১৮৮৩- এপ্রিল ১০, ১৯৩১) ‘প্রফেট’ (১৯২৩) কবিতার অংশ- যা বনি প্রিন্সের মতোই প্রস্ফুটিত হয়ে আছে তেসরা মে- এর দিনলিপিতে।
মুক্তিযুদ্ধের আটচল্লিশ বছর পর প্রায়শই একটি প্রশ্ন মনে জাগে- পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী না হয় অন্ধ-বর্বর; কিন্তু সেখানকার সাধারণ জনগণ- তারা তো পারতো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে। আজকাল অনেকের কণ্ঠে ও কলামে অতীত ভুলে যাবার কুৎসিত সঙ্গীত বাজে- কিন্তু একটি প্রশ্নের উত্তর তারা এড়িয়ে যায়। যে মুক্তিযুদ্ধ সারাবিশ্বে আলোড়ন তৈরি করেছিলো, বিশ্ব গণমাধ্যমে যে গণহত্যার তীব্র নিন্দা হয়েছিলো- পাকিস্তানি জনগণ তা জেনেও কেনো প্রতিবাদ করলো না? এর উত্তর হলো- পাকিস্তানি জনগোষ্ঠীর ন্যাক্করজনক মানসিকতা এবং হীন মনেবৃত্তি। এরা মূলত অশিক্ষিত এবং অধিকাংশই শিক্ষিতরাই খুব নিম্নমানের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শিক্ষা অর্জন করেছে। একাত্তরের দিনগুলিতে আমরা পাই-
.. ..ও দিকের (পশ্চিম পাকিস্তানের) লোকেরা কি বি.বি.সি, ভয়েস অব আমেরিকা, রেডিও অস্ট্রেলিয়া এসব শোনে না? শোনে, কিন্তু বিশ্বাস করে না। ওরা সরকারের ছেলে ভুলানো ছড়া শুনেই সন্তুষ্ট। (পৃষ্ঠা ১৩৪)
চার
আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের দিনলিপিগুলো একই সঙ্গে প্রগাঢ় বেদনা ও মহিমান্বিত বিজয়োল্লাসের দলিল। মেলাঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের দিনগুলোর এক নিটোল বর্ণনা পাওয়া যায় বিশ আগস্টের লেখায়। সেখানেই রুমীর বক্তব্য থেকে উঠে আসে কণ্ঠশিল্পী আজম খানের কথা। এক ভীষণ সাহসী গেরিলা যোদ্ধা আজম খান ও তাঁর উদাত্ত কণ্ঠের গান- একাত্তরের দিনগুলি গ্রন্থের মাধ্যমে আমাদের সামনে আসে নতুন এক ছবি হয়ে- কিংবদন্তীর মতো। আগস্টের লেখাগুলোতে আমরা রুমীদের গেরিলা অপারেশনের ইতিহাস জানতে পারি।
রুমী ধরা পড়ে উনত্রিশ আগস্টে, সেদিন রবিবার ছিলো। একত্রিশে আগস্ট ফেরত আসে সবাই- কেবল রুমী আসেনি। তবে শহিদ রুমীর পরিবারের দৃঢ়তা এবং তাঁর আদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শন পাঠককে যারপরনাই মুগ্ধ করে। সন্তানের আদর্শের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেই পাকিস্তানি সরকারের কাছে দয়া প্রদর্শনের আবেদন করেনি রুমীর পরিবার। প্রতিবাদ আর আদর্শের লড়াইয়ের এ এক অবিনশ্বর স্মারক।
তেরো ডিসেম্বরের লেখার মাঝামাঝি অংশে আমরা প্রথম শরীফ ইমামের অসুস্থতার সংবাদ পাই। আর চৌদ্দ ডিসেম্বরের শুরুর দুটি অনুচ্ছেদেই পাই তাঁর মৃত্যুর সংবাদ। চারজনের পরিবারের দুজন অনন্তলোকে, বাকি দুজন- মা আর সন্তান রইলেন নতুন বাঙলাদেশকে বরণ করে নেবার জন্যে।
একাত্তরের দিনগুলি মুক্তিযুদ্ধের এক কালানুক্রমিক ইতিহাস। ইতিহাসটি রচনা করেছেন এমন একজন- যিনি ও তাঁর পরিবার মুক্তিযুদ্ধের এক সাহসী প্রত্যয়াংশ। যদিও দিনলিপি- অর্থাৎ ব্যক্তিগত শোকস্মৃতি, তবুও তা অনন্ত হয়ে যেনো জেগে রয়েছে আমাদের সকলের অনুভূতির সঙ্গে। বইটির গ্রন্থস্বত্ব একাত্তরের দিনগুলি স্মারক ট্রাস্টের এবং আগেই উল্লেখ করেছি অষ্টাবিংশতি মুদ্রণ (রজতজয়ন্তী সংস্করণ) থেকে এই আলোচনাটি লেখা হয়েছে।
কেবল ইতিহাসের সত্য নির্যাসটুকু নয়, উপস্থাপনার ধরণেও একাত্তরের দিনগুলি সাহিত্যমান সম্পন্ন। বইয়ের বিভিন্ন্ স্থানে ব্যবহৃত বাগধারা-প্রবাদ প্রবচন-পুরাণ নির্ভর শব্দের সার্থক প্রয়োগ তার নমুনা। উদাহরণস্বরূপ-
‘.. ..বলা যেতে পারে সবে ধন নীলমণি (পৃষ্ঠা ১১)’,
‘.. ..পূর্ব পাকিস্তানে ভীমরুলের চাকে ঢিল ছুঁড়েছে (পৃষ্ঠা ১৪)’,
‘.. ..দেখছো না, এখন উলট-পুরাণের যুগ চলছে (পৃষ্ঠা ২০)’,
‘পড়াশোনা এতদিন শিকেয় তোলা ছিল, এবার টংয়ে উঠল। (পৃষ্ঠা ২০)’,
‘ওটা থাকলে লখিন্দরের লোহার ঘর বানিয়েও লাভ নেই (পৃষ্ঠা ৩১)’,
‘.. ..আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে জ্বলন্ত বালিতে খৈ ফুটছে (পৃষ্ঠা ৩৪)’,
‘.. ..মাছের মাকে নাকি শোক করতে নেই (পৃষ্ঠা ৮২)’,
‘যার কাজ তারে সাজে, অন্য লোকে লাঠি বাজে (পৃষ্ঠা ১০২)’,
‘সরু চুলে বাঁধা ডেমোস্থিনিসের খাঁড়া ঝুলছে মাথার ওপর (পৃষ্ঠা ১২৪)’,
‘একা রামে রক্ষা নাই, সুগ্রীব দোসর? (পৃষ্ঠা ২৪২)’।
পাঁচ
একাত্তরের দিনগুলি আমার সবচেয়ে প্রিয় বইগুলোর একটি। আমি আমার সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি এর আলোচনাটি লিখবার। বস্তুত সে কারণেই- লেখাটি দীর্ঘ হয়েছে। একাত্তর সালে সাতকোটি বাঙালির যৌথ খামারে রচিত হয়েছিলো যে মুক্তিযুদ্ধ, আজ দীর্ঘ আটচল্লিশ বছর পরও সেই ইতিহাসের কার্নিশেই নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচে ষোলো কোটি বাঙালি এবং আগামীতেও বাঙালি বেঁচে থাকবে তার এই ঋদ্ধ ইতিহাসের করতলে। যদি কোনোদিন এই ইতিহাসের সত্যপথ থেকে তার পদস্খলন ঘটে- সেদিনই নিঃশেষ হবে বাঙালি; তাই একাত্তরের দিনগুলি আমাদের পথপ্রদর্শক, আমাদের অনুপ্রেরণার অখণ্ড আকাশ।
আমি প্রতীক্ষায় রইলাম- একাত্তরের দিনগুলির হীরকজয়ন্তী সংস্করণ নিয়ে কোনো একটি আলোকোজ্জ্বল মেধাবী আলোচনার নিবিড় সৌন্দর্যে বিলীন হয়ে যাবে আমার এই ব্যর্থ আলোচনাটি।
আমার ব্যর্থতা সেদিন সুখী হবে। সৌন্দর্যে বিলীন হবার চেয়ে সুখ আর নেই।