একটি মহৎ দিন হঠাৎ কখনো জাতির জীবনে আসে যুগান্তের সম্ভাবনা নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারী এমনি এক যুগান্তকারী দিন।
এই বাক্যদ্বয়কে বলা যেতে পারে বাঙলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস নথিভুক্তির প্রথম বাক্য, বাঙালির আত্মোৎসর্গের প্রসব বেদনার প্রথম চিৎকার। নথিভুক্তিকার হাসান হাফিজুর রহমান। নথিটির নাম একুশে ফেব্রুয়ারী—১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত অমর ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংকলন। এরপর পেরিয়ে গেছে পঁয়ষট্টি বছর। সাতচল্লিশের বাঙলা ভাগের কলঙ্ক পূর্ব-পাকিস্তানকে ছুঁড়ে ফেলে ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তের ধারায় নির্মিত হয়েছে বাঙলাদেশ। মহান ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে নির্মিত হয়েছে মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের ভাষ্য। আমাদের চৈতন্যের পাঠাগারে এই সংকলনটি অবশ্য পাঠ্য হলেও, এখনও সম্ভবত অচর্চিত; কেননা, ভাষা আন্দোলনের দার্শনিক উপলব্ধি বর্তমানে কিছু উদ্যাপনের কাঠামোতে বন্দী। ফলে ফিরে যাবার দরোজা চেনা প্রয়োজন এবং অতি অবশ্যই ফিরে যাওয়া প্রয়োজন ভাষা আন্দোলনের এই প্রথম সংকলনটির কাছে। জাতি হিশেবে আমাদের ইতিহাসের পাঠ-প্রক্রিয়া যেহেতু এখনও অসম্পূর্ণ, সেহেতু বনসাই বুদ্ধিজীবীদের মুখোমুখি হবার আগে পুনর্বার নিজেদের শিকড় খুঁজে দেখা দরকার। আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি-ইতিহাস আর ঐতিহ্যের খোঁজ আমাদেরই করা প্রয়োজন কারণ আমরা আমাদের পূর্বসূরীদের মগজ আর মেরুদণ্ড বিক্রির দলিলপ্রাপ্ত হয়েছি।
দুই
সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছিলো বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির এক বছর পূর্তি উপলক্ষে। হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ওই তারিখ শিরোনামেই প্রকাশিত হয়েছিলো একুশের পথিকৃৎ সংকলনটি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান। এটি প্রকাশিত হয়েছিলো ‘পুঁথিপত্র প্রকাশনী’ থেকে। শহিদ মিনারের পশ্চিম দিক দিয়ে যে রাস্তাটি বকশিবাজার চলে গেছে, সেখানেই ছিলো তাদের বইয়ের ছোট্ট দোকান। এই সংকলনের বিভিন্ন লেখার সচিত্রকরণের দায়িত্ব দেয়া হয় শ্রদ্ধেয় চিত্রশিল্পী মুতর্জা বশীরকে।
তাঁর জবানিতে আমরা পাই, এর আগে তিনি কখনো কোনো সাহিত্যকর্মের অলংকরণ করেননি। একটি পাতলা নিব দিয়ে তিনি কিছু রেখাচিত্র এঁকেছিলেন। তাঁর বিচারে যদিও সেগুলো ছিলো দুর্বল ড্রয়িং, কিন্তু সে-ই ড্রয়িংগুলোই হয়ে উঠেছিলো আমাদের আন্দোলনের ইশতেহার। ভাষা আন্দোলনের তিনি একজন প্রত্যক্ষ সংগ্রামী। তাই ব্যারাকের চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া, শিক্ষার্থীরা আবদ্ধ অবস্থায় স্লোগান দিচ্ছে, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় স্লোগান ও বক্তৃতা—এসবই অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তাঁর রেখাচিত্রে ফুটে উঠেছিলো।
তবে এই সংকলনের অলংকরণের ক্ষেত্রে একটি দুর্বল মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। জানি না, ইতিহাস সেটাকে কীভাবে দেখে বা তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় সেটা কীভাবে মূল্যায়িত হবে; তবুও বলে রাখা প্রয়োজন যে, এই সংকলনের অলংকরণে তুলির মোটা আঁঁচড়ে যে কাজগুলো রয়েছে, সেগুলো বিজন চৌধুরীর আঁঁকা। কিন্তু সেখানে বিজন চৌধুরীর কোনো নাম দেয়া হয়নি। তৎকালীন পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা অনুমান করা যায় যে, তিনি সনাতন ধর্মাবলম্বী হবার কারণেই এটা করা হয়েছিল। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত হয়েছিলেন, তাঁরা এর পাঁচ বছর আগেও ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য নেচে নেচে দেশভাগের সায় দিয়েছিলেন। অতএব, সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি তাঁদের মধ্যে বিরাজমান থাকবে—এতে আর গবেষণা করার কী আছে? এর বহু পরেও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস সংশপ্তক-এর প্রচ্ছদ করেছিলেন শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী। কিন্তু প্রচ্ছদে তাঁর কোনো নাম দেয়া হয়নি। সাম্প্রদায়িকতার বিষে আক্রান্ত আমাদের পূর্ব-পুরুষরা কী ভয়াবহ অবিচার করেছিলেন একজন শিল্পীর প্রতি।
একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনটিতে মুর্তজা বশীরের সাতটি এবং বিজন চৌধুরীর পাঁচটি রেখাচিত্র রয়েছে। এর প্রচ্ছদ করেছিলেন শিল্পী আমিনুল ইসলাম। এর উৎসর্গ পৃষ্ঠায় পাঁচ লাইনের লেখাটি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের হস্তাক্ষরের অনুলিপি। মুর্তজা বশীর ১৯৫২ সালের মাঝামাঝি সময়ে একটি লিনোকাট করেছিলেন, যা এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়। এটাই বায়ান্নর রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম শিল্পকর্ম।
ক্রাউন সাইজের ১৮৩ পৃষ্ঠার এই সংকলনটির ভূমিকা ছাপা হয়েছিলো কোনো নাম ছাড়াই। কিন্তু এর ভূমিকা লিখেছিলেন স্বনামধন্য বিজ্ঞান লেখক আবদুল্লাহ আল-মুতী। সংকলনের প্রথম লেখাটির শিরোনাম ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা’। লেখাটি জেল থেকে গোপনে পাঠিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড খোকা রায়। কিন্তু তাঁর নামে লেখাটি ছাপা হয়নি, হয়েছিলো আলি আশরাফের নামে।
কবিতা লিখেছিলেন বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গনি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দীন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামালুদ্দীন, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান। গল্প ছাপা হয়েছিলো শওকত ওসমান (মৌন নয়), সাইয়িদ আতীকুল্লাহ (হাসি), আনিসুজ্জামান (দৃষ্টি), সিরাজুল ইসলাম (পলিমাটি) এবং আতোয়ার রহমান (অগ্নিবাক)। একুশের গান লিখেছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও তোফাজ্জল হোসেন আর একুশের ইতিহাস লিখেছিলেন কবির উদ্দিন আহমেদ।
‘একটি বেওয়ারিশ ডায়রির কয়েকটি পাতা’ শিরোনামে এবং ‘অমর একুশে ফেব্রুয়ারীর রক্তাক্ত স্বাক্ষর’ শিরোনামে একুশের নকশা এঁকেছিলেন যথাক্রমে মুর্তজা বশীর ও সালেহ আহম্মদ।
অনেক চেষ্টা করেও ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনটি প্রকাশ করা যায়নি। কারণ হিশেবে আনিসুজ্জামান লিখেছেন—
মূলত কাগজ কেনার পয়সা সময় মতো জোগাড় করা যায়নি।
সংকলনটি ছাপা হয়েছিলো রমাকান্ত নন্দী লেনের পাইওনিয়ার প্রেসে— স্বত্বাধিকারী এম এ মোহাইমেন বাকিতে সংকলনটি ছেপে দিতে রাজি হয়েছিলেন। ১৯৫৩ সালের মার্চে বইটি বের হলো, দাম দুই টাকা, কিন্তু এপ্রিলেই এটি নিষিদ্ধ হয়ে গেলো। বই বিক্রি করে ছাপার খরচ শোধ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলো না হাসান হাফিজুর রহমানের। পরে জমি বিক্রি করে প্রেসের সেই টাকা শোধ করেছিলেন তিনি।
এরপর ১৯৫৬ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় গেলে এর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। এরপরই বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনটি।
তিন
একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনটিই কবি হাসান হাফিজুর রহমানের প্রথম সংকলন নয়। আজ যখন দেখি তাঁর সঙ্গে নাসিরুদ্দীন সাহেবের সওগাত প্রেসে বসে আড্ডা দেবার স্মৃতিচারণমূলক লেখাতেও অনেকেই লেখেন এটাই তাঁর প্রথম সংকলন। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, তাঁর প্রথম সংকলনটি ছিলো দাঙ্গার পাঁচটির গল্প। কালো নরম মলাটে ট্রেডল মেশিনে ছাপা সেই সংকলনটি তিনি প্রকাশ করেছিলেন ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গার প্রেক্ষিতে। আজ আমাদের ইতিহাস থেকে এটা যেনো হারিয়েই গেছে।
একুশের প্রথম সংকলনটি হাতে নিলে আজও ভাষা আন্দোলনের সেই উত্তাপ আর প্রেরণা টের পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা আমরা ধারণ করতে পারছি কি? এর উত্তর নির্ভর করবে সময়ের সাথে আমাদের যাপিত জীবনে একুশের চেতনার প্রতিচ্ছবির রূপায়নের ওপর।