তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাঙলা কথাসাহিত্যের এক প্রাতঃস্মরণীয় নাম। একালে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের আগ্রাসী তৎপরতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে মানব অস্তিত্বকে; নৈরাজ্য-নৈরাশ্য-অনিশ্চয়তা-ক্লেদ-শঙ্কা আর মনস্তাপে বৃহদাংশ মানুষ খনন করেছে আত্মপ্রতারণার নির্বিঘ্ন বিবর। অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের ইতিবাচক দৃষ্টান্ত অধিকার সতর্ক একাংশ মানুষকে করেছে আশাবাদে সন্দীপিত, প্রাণিত করেছে স্বপ্নময় আলোকময় ভবিষ্যত রচনায়। তবুও প্রত্যাশার বিপরীতে নিরাশার আধিপত্যই মহাসমরোত্তর বিশ্বমানসের প্রবল ও প্রধানতম চেতনাস্রোত। সমকালীন প্রতীচ্য-সাহিত্য ঐ হতাশা নিমজ্জিত জীবনেরই শিল্প-অন্বেষা। এ সময়ের প্রাতীচ্য প্রভাবিত বাঙলা সাহিত্যে মুখ্যরূপে প্রতিফলিত হয়েছে বিপন্ন যৌবনের বেদনাবিলাস; লিবিডো-চেতনার ছায়ান্ধকার ভুবনে অভিযাত্রার মধ্যেই শিল্পীর রোম্যান্টিক চিত্ত অন্বেষণ করেছে বন্ধ্যা যুগের জীবন-উৎস। না-অর্থক এই চেতনাস্রোতের বিপরীতে বাঙলা সাহিত্যে বিকীর্ণ হয়েছে যে স্বল্পালোকিতো রশ্মি- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তার শিল্পিত প্রতিনিধি।
সাহিত্য স্রষ্টাদের নিয়ে কেবল বললেই হয় না, এর একটা প্রমাণ দেয়া চাই, প্রমাণও যদি না জোটে তো একটা সম্ভাবনার রেখাপাত করা চাই, যাতে করে বোধগম্য হয় যে, তিনি আসলেই ‘বলা টুকু’ প্রশ্নাতীতভাবে ‘শোনার যোগ্য’। তারাশঙ্কর যুগন্ধর; কালের দ্বৈরথকে ধারণ করেই তিনি শিল্পী। তাঁর রচিত চৌষট্টিটি উপন্যাস, আটত্রিশটি ছোটোগল্প, দশটি নাটক ও প্রহসন, চারটি প্রবন্ধ এবং সাতটি স্মৃতিকথা ও ভ্রমণকাহিনী ঘেঁটে এই সত্য উপলব্ধি করার প্রয়োজন নেই। মিত্র ও ঘোষ থেকে প্রকাশিত তারাশঙ্করের পঁচিশ খন্ডের রচনাবলী পাঠে তাঁকে যতোটুকু না চেনা যাবে, তার ছয় আনাই হয়ে উঠবে কবি উপন্যাসটি পড়লে। যদিও উপন্যাসের ক্রমিকে কবি তারাশঙ্করের দ্বাদশ উপন্যাস। কবি লিখেছেন বাঙলা ১৩৫০ সালে। একই বছরে তিনি লিখেছেন মন্বন্তর ও পঞ্চগ্রাম। তিনি খ্যাতি কুড়িয়েছেন, তাঁর তীব্র সমাজভেদী দৃষ্টির সামনে আছড়ে পড়েছে হরিজন সম্প্রদায়ের ছবি, এবং তিনি ভেসে গেছেন কবির কবিয়াল শব্দে; তাঁর বুকের মন্বন্তর কুয়াশা হয়ে গেছে, দূরে চলে গেছে পঞ্চগ্রাম।
কবি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো পাটনার পত্রিকা মণীন্দ্রনাথ সমাদ্দার সম্পাদিত প্রভাতীর ১৩৪৭ এর চৈত্র থেকে ১৩৪৮ এর ফাল্গুন সংখ্যা পর্যন্ত। পরবর্তীতে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কবি নামে একটি ছোটোগল্প, যা এই উপন্যাসের বীজগল্প, তা প্রবাসীতে প্রকাশিত হয়েছিলো।
বিরহ মিলনের অন্তর্লীন ভালোবাসার জীবন্ত বাণীরূপ তারাশঙ্করের এই উপন্যাস। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাঢ় বাঙলার অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ ও সমাজের ছবি। হিন্দু সমাজের একেবারে নিম্ন শ্রেণি ডোম বংশজাত কবিয়াল- যার পূর্বপুরুষ সকলে ডাকাত, বর্তমান আত্মীয় স্বজনও তাই, তবুও নিতাই কবিয়াল। উপন্যাসের একেবারে শুরুতেই সে বিষয়ে তারাশঙ্কর বিষ্ময় প্রকাশ করে গেছেন।
শুধু দস্তুরমত একটা বিষ্ময়কর ঘটনাই নয়, রীতিমত এক সংঘটন। চোর ডাকাত বংশের ছেলে হঠাৎ কবি হইয়া গেল।
দেবকীকুমার বসুর প্রযোজনা ও পরিচালনায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চিত্র মায়ার মঞ্চ নাটকের পরিচিতি গ্রন্থ। প্রথম প্রকাশ ২১ জানুয়ারি ১৯৪৯। ছবিগুলো ১৯৫৩ সালের চতুর্থ সংস্করণের।
এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে- তারাশঙ্কর যখন সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ করেন, বাঙালি মধ্যবিত্তের নিশ্চিত জীবনে তখন ফাটল ধরেছে। তাই তাঁর চৈতালি ঘূর্ণি থেকে মন্বন্তর পর্যন্ত উপন্যাসগুলোতে একটি ভাঙনের সুর আমরা শুনতে পাই। কবি কিংবা পঞ্চগ্রাম-এ সে সুরের লহরেই আরেক অর্কেস্ট্রা বাজালেন তিনি। পঞ্চগ্রাম এর কৃষক সম্প্রদায় থেকে কবির কবিওয়ালা ও ঝুমুরদলে প্রবেশ লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শের মধ্যেও বদল ঘটালো। নিতাই কবিয়াল- কবিগানে নাম করে উঠে, হয়ে ওঠে কবিয়াল, তার জীবনে আসে দুই নারী- ঠাকুরঝি ও বসন, দুজনের দুই রকমের আকর্ষণ, এবং দুজনের স্মৃতিতেই শেষতক কবিয়ালের প্রতিধ্বনিময় নিবেদন-
জীবন এতো ছোটো কেনে।
কবি ও পঞ্চগ্রাম– এ দুইটি উপন্যাসে তারাশঙ্কর জীবন ও জীবিকাভিত্তিক শ্রেণির ছবি আঁকলেও, তফাত অবশ্যই আছে। পঞ্চগ্রাম এর কৃষকসমাজ দরিদ্র ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত হলেও তারা প্রান্তবাসী মানুষ নয়। এরা উৎপীড়িত ও অবহেলিত হলেও সমাজের মূল স্রোতের সাথে এরা সম্পৃক্ত। কিন্তু কবি উপন্যাসের নিতাই কবিয়াল কিংবা ঝুমুরদলের বসন সে ধারার নয়। নিতাই সম্বন্ধে আগেই বলা হয়েছে। অন্ত্যজ ডোম শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী- যেমন কালিন্দীর সাঁওতালদের প্রতিনিধিত্ব ঘটেছিলো। বসন রূপোপজীবিনী- সমাজের চোখে ঘৃণিত।
কবি উপন্যাসে গভীর দৃষ্টি ফেললে দেখা যায়- তারাশঙ্করের অন্যান্য উপন্যাসের মতো এখানেও একটা ‘বদল’ ঘটেছে, তবে তা অবশ্যই শ্রেণি বদল নয়, কারণ নিতাই কবিয়ালের সামাজিক অবস্থা অন্ত্যজ হলেও ঝুমুরদলের অবস্থা অন্ত্যজ ছিলো না। তাছাড়া নিতাইয়ের ঝুমুরদলের সাথে ভিড়ে যাওয়াও কোনোভাবেই তার সমাজ বদলের চিত্র নয়। অন্যদিকে, বসনের সাথে নিতাইয়ের পরিণয়, সে কেবল হৃদয়জ ভালোবাসারই প্রকাশ, এবং তা-ও বসনের সেই চারিত্রিক সরলরেখা থেকেই উদ্ভূত, যা নিতাই কামনা করেছিলো। তাই দেখা যায়- মন্দির প্রাঙ্গণে অসুস্থ ও পক্ষাঘাতগ্রস্থ ভিক্ষুকের দল দেখে বসনের হৃদয় হু হু করে কেঁদে উঠে। তাঁর নারী হৃদয়ের এই কোমল দিকটি সেদিন হঠাৎ উন্মোচিত হয় নিতাইয়ের সামনে।
বস্তুত কালিন্দীর সাথে বিবেচনায় এই উপন্যাসে একটি বৃহৎ সমাজের উন্মেষ ঘটেছে। সাঁওতালি গ্রাম ছিলো কালিন্দীর পার্শ্বধারা, অন্যদিকে ঝুমুরদল এবং নিতাই কবিয়ালের সমাজবৃত্তান্ত কবি উপন্যাসের মূলধারা। তবে সামাজিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সাঁকো ডুবে গেছে প্রেম ও চেতনার মিহিন ঢেউয়ে। নিতাই ঠাকুরঝিকে ভালোবাসে, কৃষ্ণচূড়ার তলায় বিছিয়ে রাখে তার নিটোল অপেক্ষা, ঠাকুরঝি আসেন ‘পশ্চিমসমীপবর্তী দ্বিপ্রহরের সূর্যের অগ্রগামিনী ছায়ার মত’। নিতাইয়ের কণ্ঠে গান হয়ে ওঠে ঠাকুরঝি।
কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদো কেনে
কালো কেশে রাঙা কুসুম হেরিছো কি নয়নে।
তারপর ঔপন্যাসিকই সিদ্ধান্ত টেনে দেন-
ঠাকুরঝি’র কোমল কালো আকৃতির সঙ্গে তার প্রকৃতির একটা ঘনিষ্ঠ মিল আছে, সঙ্গীত ও সঙ্গতের মত।
ঠাকুরঝি’র প্রতি এই ভালোবাসা নিতাই কবিয়ালের বেঁচে থাকে, তার ধ্বংস হয় না, ফিকে হয় না এই নিটোল ভালোবাসা। তাই দেখা যায়, বসনকে যখন জড়িয়ে ধরে, তখনও হৃদয়ের মাঝে জেগে ওঠে ঠাকুরঝি। নিতাই কবিয়াল কেবল কবিগানেই সুর খুঁজে পায়, সম্পর্কের সুরে দোহারের সাথে তাল মেলে না।
নিতাই কবিয়াল শেষ পর্যন্ত জীবনের সুরকেই অন্বেষণ করে; সে কবি, তার বিলাপের আর্তস্বর কবিগান, তার বেদনার ঝুম বৃষ্টিও কবিগান। জীবনের কাছে তার যে মমতা- তা অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ হয়ে চমৎকার ভাষাশিল্পে উপস্থাপিতো হয়েছে কবি উপন্যাসে। তাই উপন্যাসের শেষে এসে যখন নিতাই কবিয়াল বলে- ‘মা গো, জীবন এতো ছোটো কেনে’; তখন আসলে পাঠকের তন্ত্রীতেই মর্সিয়া ওঠে, সে-ই বেদনাই প্রতিধ্বণিত হয়- ‘মা গো, জীবন এতো ছোটো কেনে’।
তারাশঙ্করের উপন্যাসে পুরাণের ব্যবহার সার্থক। কবি উপন্যাসেও তার ব্যতয় ঘটেনি। নিতাই কবিয়ালের পরিচয় নিয়েই আলোচনায় বলা আছে-
.. ..নজির অবশ্য আছে বটে,- দৈত্যকূলে প্রহ্লাদ। কিন্তু সেটা ভগবৎ-লীলার অঙ্গ। মূককে তিনি বাচালে পরিণত করেন, পঙ্গু যাঁহার ইচ্ছায় গিরি লঙ্ঘন করিতে পারে, সেই পরমানন্দ, মাধবের ইচ্ছায় দৈত্যকূলে প্রহ্লাদের জন্ম সম্ভবপর হইয়াছিলো; রামায়নের কবি বাল্মিকী ডাকাত ছিলেন বটে, তবে তিনি ছিলেন ব্রাক্ষ্মণের ছেলে। সেও ভগবৎ-লীলা। কিন্তু কুখ্যাত অপরাধপ্রবণ ডোমবংশজাত সন্তানের অকষ্মাৎ কবিরূপে আত্মপ্রকাশকে ভগবৎ-লীলা বলা যায় কি না সে বিষয়ে কোনো শাস্ত্রীয় নজির নাই।
তাছাড়া মহাদেব কবির সাথে কবিগানে আসলে, তাঁকে সাহস দেয়া হয়। সেখানেও পুরাণের আশ্রয়-
গুরু-শিষ্যই যুদ্ধ হোক। রাম-রাবণের যুদ্ধের চেয়ে দ্রোণ-অর্জুনের যুদ্ধ কম নয়। রামায়ন সপ্তকাণ্ড, মহাভারত হলো অষ্টাদশ পর্ব।
কবি একটি অসাধারণ আত্ম-অন্বেষণমূলক জীবনধারার উপন্যাস। নিতাই কবিয়ালের ‘সকল হলো সারা’র পরে যেটুকু পড়েছিলো, তা নিতান্তই তার ধ্যান নিমীলিত নেত্রে উন্মীলিত হওয়া জীবনের এক গাঢ় প্রতিচ্ছবি। এই প্রতিচ্ছবি কেবল নিতাইয়ের গূঢ়তারই নয়, তা স্বয়ং তারাশঙ্করেরও। তর্পণ ও তপস্যার মধ্য দিয়ে তিনি শেষে পৌঁছে দিয়েছেন জীবনের গভীর দার্শনিক ভাষ্যে-
মা গো, জীবন এতো ছোটো কে নে