এখনও মাথা উঁচু করে তাঁর পোর্ট্রেটের সামনে দাঁড়ালে আমাদের মনে পড়ে— এক সাগর রক্ত সংগ্রাম সাঁতরে পেরিয়ে তবুও কী বিষণ্ন স্বাধীনতার সৈকত! এবং এখনও তাঁর চশমার কাঁচেই আমাদের পড়ে নিতে হয় মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ের বিশ্বাস ও বিদ্রুপ; খুঁজে নিতে হয় বিজয় আর বিস্মৃতির অন্তবর্তী শব্দার্থ ও বাক্যরচনাসমূহ। তাঁর জীবনবৃত্তান্ত এ কারণেই নথিভুক্ত হয় আমাদের প্রজন্মের না-দেখা মহাসংগ্রামের মহাবাদলে। একাত্তরের দিনগুলি গ্রন্থ আমাদের জানিয়ে দেয়— বাঙলার হাজার শহিদ জননীর একজন জাহানারা ইমাম কিন্তু একাত্তরের পরের দিনগুলিতে তিনিই হয়ে ওঠেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক নির্বিকল্প অংশ, ইতিহাসের এক ক্ষত-বিক্ষত রোজনামচা। স্মৃতিভ্রষ্ট স্বজাতিকে তিনি সক্রিয় স্মরণের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, কেননা তিনি তো জানতেন— যুদ্ধ তখনও বাকি। আর এই গূঢ় বাক্য তিনি প্রজন্মের কানে পৌঁছে দিয়েছেন এবং আজও তিনি সেই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। ১৯৯৪ সালের আজকের দিনটি যদি শহিদ জননীর জীবনযাপনের ছেদচিহ্ন হয়, তাঁর সহযোদ্ধারা যদি মনে করতে পারেন যে, এই দিনটিতে তাঁরা ফিরে এসেছিলেন, যেন বিসর্জিত প্রতিমা দশমী দিবসে— তবে আমাদের প্রজন্মের কাছে এই দিনটিই তাঁর জীবনদর্শনের আরেকটি সূচনাবিন্দু। মায়েদের কোনো মৃত্যুদিন নেই— এই সরল ঘোষণা শহিদ জননী আমাদের মননধর্মে খোদাই করে গেছেন। তাঁর শেষ চিঠিতে তিনি যখন বলেন— “তবু আমি জানি জনগণের মতো বিশ্বস্ত আর কেউ নয়”— তখন জনতার হাজার হাজার বর্গমাইলে আমরা তাঁকে আবিষ্কার করি সে-ই পরিশ্রমী-সৎ কৃষক হিশেবে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বীজ ছড়িয়ে দেয়াই যাঁর প্রধান সাধনা। পঁচাত্তরের পর মুক্তিযুদ্ধের অপ্রতিম আদর্শ যখন চাপা পড়ে গিয়েছিলো অজস্র রাজনৈতিক কুনাট্যে, যখন সূর্যোদয়ের বাঙলাদেশে নেমে এসেছিলো পরাজিত শকুনরাত এবং দীর্ঘ একটি সময়ে সামরিকতন্ত্র ও মোল্লাতন্ত্র হাত ধরাধরি করে রাজত্ব করেছে স্বাধীন বাঙলাদেশে— শহিদ জননী তখন একাত্তরের শ্রম ও স্বপ্ন দিয়ে পুনর্বার আমাদের সংগ্রামের চক্ষুদান করেন। ইতিহাসের আগুনের ভেতর দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর অগণিত সন্তানদের ভেতরে এই উপলব্ধির জন্ম দিয়েছিলেন যে— মুক্তিযুদ্ধের অচর্চিত বর্ণমালাই আমাদের রাজনৈতিক আদর্শলিপি। শিক্ষক জাহানারা ইমাম ব্যক্তিজীবনের লেখচিত্রকে যূথবদ্ধ সমীকরণের অংশ করে তোলেন একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। যেহেতু মায়েদের চেয়ে বড়ো কোনো শিক্ষক হয় না, সেহেতু আমাদের মতো মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম শহিদ জননীর ইতিহাসের ক্লাশে শিক্ষাগ্রহণ পর্ব শুরু করি এবং বাঙলাদেশের রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রেক্ষাপটকে অর্জুনের মতো একাগ্রতা নিয়ে বিচারের পথে হাঁটতে শুরু করি।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির এক ভয়াবহ সময়ে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের কাছে তিনি মেলে ধরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের যুগপৎ বিশ্বাস ও বিশ্বাসঘাতকতার সমুদয় তথ্যাদি। তাঁর সহযোদ্ধাদের তিনি নিয়োজিত করেছিলেন ইতিহাসের দক্ষ পাহারাদার হিশেবে এবং আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন মহাফেজখানা ভ্রমণের পরিচয়পত্র। তত্কালীন রাষ্ট্র তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করে কেননা রাষ্ট্র জানতো শহিদ জননী আসলে দায়িত্ব নিয়েছিলেন অনাগত প্রজন্মের কাছে স্বাধীন বাঙলাদেশের রক্তপরীক্ষার প্রতিবেদন পৌঁছে দেবার। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধাগণ মৌলবাদের আশীর্বাদপুষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার চক্ষুশূল হয়েছিলেন, নিপীড়ন আর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন কিন্তু সংগ্রামের পথ অরক্ষিত রাখেননি। ১৯৯৪ সালের আজকের দিনে শহিদ জননীর জীবন-সরণিতে ছেদচিহ্ন পড়ে বটে কিন্তু তিনি অধিকার করেন আমাদের এবং অনাগত অনেক প্রজন্মের হৃৎ-সরণির সবটুকু। যদিও ১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও শহিদ জননীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির দাবিগুলোর কোনো বাস্তবায়ন হয় না। বললে অত্যুক্তি হয় না যে— গণআদালতের রায় কার্যকর করতে না পারার রাজনৈতিক ব্যর্থতাই ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতায় আসার অন্যতম কারণ। এরপর একটি দীর্ঘ সময় স্বাধীন বাঙলাদেশে আমরা স্বাধীনতাবিরোধীদের আষ্ফালন দেখেছি, দেখেছি জঙ্গীবাদ ও মৌলবাদের নারকীয় তাণ্ডব। এবং সেই ভয়াল সময়ের প্রতিটি মুহূর্তে আমরা শহিদ জননীর একাত্তরের দিনগুলি বইয়ের পাতায় আশ্রয় নিয়েছি। আমরা বুঝতে শিখেছি, রাজনৈতিক সমীকরণ ততোক্ষণ আদর্শনিষ্ঠ হয় না, যতোক্ষণ না পর্যন্ত তা স্বার্থনিরপেক্ষ হতে পারে। স্বাধীন বাঙলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্কে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হবার কথা ছিলো ধ্রুব তত্ত্ব, অথচ দিনকে দিন এই শাশ্বত সত্যকে পরিণত করা হয়েছে একটি চলক হিশেবে। বোধগম্যতার এই বাস্তবতায় শহিদ জননীর সহযোদ্ধাগণ তাঁকে যেভাবে দেখবেন, আমাদের দেখার চোখটা ভিন্ন হবে— এটাই স্বাভাবিক। দিনশেষে শহিদ জননীর ‘রাজনৈতিক অবস্থান’ আমাদের চোখে একা এবং বন্ধুহীন। কেননা, তিনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকেই স্বাধীন বাঙলাদেশের রাজনৈতিক আদর্শ হিশেবে দেখেছিলেন, এবং সেই পাটাতনে দাঁড়িয়েই তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধাগণ গণআদালতের রায় কার্যকরের দাবি পেশ করেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সেই দাবি মানা হয়নি; এমনকি এই দাবি কার্যকরের ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক অনুকূল পরিস্থিতি প্রয়োজন ছিলো, তা থাকা সত্ত্বেও মানা হয়নি। ১৯৯২ সালের ১২ এপ্রিল লাখো জনতার পদযাত্রার মাধ্যমে শহিদ জননী ও তাঁর সহযোদ্ধাগণ গণআদালতের রায় কার্যকর করার দাবি সংবলিত স্মারকরিপি নিয়ে জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রীর কাছে পেশ করেন। রাষ্ট্রের কাছে দাবি আদায়ের এর চেয়ে নিয়মতান্ত্রিক পন্থা আর কী হতে পারে! তার দু’ বছর পর শহিদ জননীর জীবনাবসান হয়; তারও দু’ বছর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। কিন্তু গণআদালতের রায় অকার্যকরই থেকে যায়। এখন প্রশ্ন হতে পারে, শহিদ জননী কি জানতেন— বিপ্লবীরাও একদিন সোনা-রূপার দোকান খুঁজে বের করবে এবং তাঁর লেখা ক্যান্সারের সাথে বসবাস আদতে আমাদের কাছে মূল অর্থের অতিরিক্ত কিছু তুলে ধরবে। তিনি তো বাঙলাদেশের মাটির গন্ধ জানতেন, কেননা, সেই মাটিতে মিশে আছে শহিদ রুমী ও তাঁর সহযোদ্ধাদের রক্ত; সুতরাং তাঁর চোখের সামনে দিয়ে বদলে যাওয়া বাঙলাদেশের রাজনীতিতে তিনি যে বড্ডো তপোক্লিষ্ট— তা নিশ্চয়ই তিনি জানতেন। আর একারণেই তিনি রাষ্ট্রের কাছে বা রাজনৈতিক দলের কাছে দাবি জানিয়েছেন ঠিকই কিন্তু তিনি তাঁর সমগ্র বিশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেছেন এই দেশের জনগণের কাছে। “জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস”— রাজনীতিতে বহুল ব্যবহৃত এই বাক্যটি যখন শহিদ জননী তাঁর শেষ চিঠিতে লেখেন, তখন বাক্যটি সঠিক স্বরতন্ত্রে উচ্চারিত হয় এবং রাজপথে নির্মিত হয় একটি রাজনৈতিক মানচিত্র। আমার এই বক্তব্যের সপক্ষে প্রমাণ যদি কেউ চান, তাঁর হাতে সবিনয়ে নিবেদন করা যেতে পারে ২০১৩ সালের শাহাবাগ আন্দোলনের ইতিহাসপত্র। তাই আজও যখন যুদ্ধাপরাধী জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়নি, আজও যখন মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন মত প্রকাশের পদে পদে বাধা, আজও যখন রাজনীতি থেকে ধর্মকে বিযুক্ত করা যায়নি, এখনও মৌলবাদী অপশক্তির সঙ্গে মিলেমিশে রাষ্ট্র নিজেই শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যপুস্তকে চালায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িকতা— তখন শহিদ জননীর আদর্শের ক্লাশরুমে আমাদের পুনরায় প্রবেশ করতে হবে। তাঁর আদর্শের দীক্ষামন্ত্র থেকে আমরা যে সরে এসেছি, তা প্রতিদিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতিই প্রমাণ করে।
আমরা যারা দাবি করি— আমরা শহিদ জননীর সন্তান, নানা প্রসঙ্গে নানা উপলক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে ‘মা’ বলে সম্বোধন করি; তাদেরও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার প্রশ্ন করা উচিত— আমরা কি সত্যি বিশ্বাস করি আমরা তাঁরই আদর্শের উত্তরাধিকার? শহিদ রুমীর গৌরবোজ্জ্বল আত্মদানের ইতিহাস তো আমাদের প্রতিদিনের পাঠ্য। আমরা তো জানি শহিদ জননীর সন্তানেরা মাথা উঁচু করে প্রাণ দিয়েছিলেন সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে। রাষ্ট্রব্যবস্থার কুচকাওয়াজের পুতুলধ্বনি উচ্চারণকে তাঁরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বলেই তাঁরা শহিদ জননীর সন্তান। আর আমরা? আপোস আর লোভের কার্নিভ্যালে নিজেরাই নিজেদের খুঁজে পাই না। মগজ আর মেরুদণ্ড জিম্মা দিয়ে আমরা যতোই ফেসবুকে শহিদ জননীকে ‘আম্মা’ বলি না কেনো— এ মূলত আত্ম-প্রবঞ্চনাই।
শহিদ জননী আজও তাঁর দায়িত্ব পালন করে চলেছেন— মায়েরা যেমন হন, তেমনই। বৈশাখে ও বসন্তে আমাদের রক্তকিংশুকে তিনি জেগে আছেন— কেবল জননী হিশেবেই নন, এক স্থির চক্ষু গাঢ় অভিভাবক হিশেবেও। আমাদের প্রতিদিনের আপোষের জবাবদিহি তাঁর কাছে দিতে হবে। আদর্শচ্যুত সন্তানদের ক্ষমা করবেন, অতোটা ক্ষমাশীল মায়েরা কোনোদিনই ছিলেন না। বিধিবদ্ধ অক্ষরেখায় ক্ষমাহীন নক্ষত্রের আগুন-স্থানাঙ্ক নির্ণয় করতে পারেন বলেই তাঁরা জননী। ইতিহাস সাক্ষী— একারণেই পৃথিবীর জননীরা বারবার ‘শহিদ জননী’ হয়েছেন।