চরাচরে অন্ধকার নেমে আসে— সুরের অন্ধকার। আমাদের যাবতীয় উপলব্ধি বলে— সুরের চারপাশ জুড়ে আলো, কেবলই আলো। গানের ঝর্ণাতলায় কেবলই প্রশান্তি, ‘তোমায় গান শোনাবো…’ বললে মনে হয়— এ যেনো বহু দূরের ওপার থেকে আসা এক মায়া, তাতে মিশে থাকে প্রেম-শান্তি আর প্রেরণা। কিন্তু আমাদের এই উপলব্ধি ভেঙে যায়, চরাচরে নেমে আসে সুরের অন্ধকার। আমরা বুঝে ফেলি কী গাঢ় বেদনায় সাজানো হয়েছে স্বরলিপি, হারমোনিয়ামের রিডগুলো থেকে ঝরে পড়ছে কান্না— সেই কান্না মিশে যাচ্ছে সাতচল্লিশ… একাত্তর… দুই হাজার তেরো… শিল্পী মিলিয়ে যাচ্ছেন ইতিহাসে, কাঁটাতারে, উদ্বাস্তু জীবনের দিনলিপিতে।
অতএব, চরাচরে অন্ধকার নেমে আসে— সুরের অন্ধকার। শিল্পী পূবালী দেবনাথ তাঁর সঙ্গীতযাত্রার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে আসেন রবীন্দ্রনাথের উদার সুরে, তাঁর করতলে বাঙলার ছেঁড়া মানচিত্র— ঢাকা, ফরিদপুর, কোলকাতা, বরিশাল, শিলচর, সিলেট… কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আজ কোথায়? দ্বারে দাঁড়িয়ে আছে দেবদূত, হাতে তার জ্যোর্তিময় খড়গ— অতএব, পূবালী দি স্মরণ করেন ঝড়ের কথা, ভাঙা দুয়ারের কথা… আমরা ফিরে যাই ইতিহাসে এবং ফিরে আসি আর এই আসা-যাওয়ার পথের মাঝে টুকরো-টুকরো ছড়িয়ে থাকেন রবীন্দ্রনাথ— যেনো ক্রুশবিদ্ধ যীশু— তাঁর অবয়বকে আমরা ধর্ম বলে স্বীকার করেছি; অথচ পাশ কাটিয়ে গেছি তাঁর রক্তক্ষরণের আখ্যান। আমাদের উদযাপনে তিনি ততোটাই ঈশ্বর, মননে যতোটা পরপুরুষ। অতএব, পূবালী দি গাইছেন— কার্যত স্বীকারোক্তির স্বরে তিনি সংলাপ বিনিময় করছেন আমাদের সঙ্গে— তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে…।
আমরা জানি না এবং চরাচরে সুরের অন্ধকার নেমে আসে; সেই অন্ধকারের সরণী ধরে হেঁটে আসেন শুভ দা— হৃদয়ের লেন্সে যাঁর এক্সট্রিম ক্লোজ শটের ডাকনাম— দেশভাগের পোর্ট্রেট। পূবালী দি’র গানে আমরা পুনর্বার জেনেছিলাম— গীতবিতানের পাতায় পাতায় নক্ষত্ররাজির মতোন শুয়ে থাকে আমাদের বিষাদ ও বিপন্নতা, আমাদের শ্রান্তি ও শান্তি; কিন্তু শুভ দা যখন মঞ্চে উঠলেন, তখন আমাদের মনে পড়ে গেলো— আজিজ মার্কেট বা কলেজ স্ট্রীট থেকে গীতবিতান কিনলে ইমিগ্রেশনে মানি রিসিট দেখাতে হয়। অর্থাৎ পূবালী দি যতোখানি মনোরৈখিক, শুভ দা ততোখানিই রাজনৈতিক এবং এই রাজনৈতিক মঞ্চে— কী আশ্চর্য— শুভ দা রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই উঠেন এবং তিনি ঘোষণা করেন— পৃথিবীটা বড়ো অশান্ত।
আমরা স্তব্ধ হই, কেননা আপাতবিরোধহীন রবীন্দ্রনাথকে আমরা আত্মগোপনে থাকা রাজনৈতিক কর্মীর মতো আবিষ্কার করি যিনি শিশু ভোলানাথের ছদ্মবেশে দেড়শ বছরেরও অধিক সময় ধরে বিদ্রোহ চালান করে যাচ্ছেন। ‘যদি প্রেম দিলে না প্রাণে…’— এ তবে হাহাকারের গান নয়! আমাদের না-জানার পাপ অজানার বিস্ময় দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় এবং চরাচরে আবারও অন্ধকার নামে— সুরের অন্ধকার আর এই অন্ধকার ভেদ করে হেঁটে আসেন এক উজ্জ্বল চক্ষু মাতাল। ‘অবনী বাড়ি আছো’— বাক্যটি বাঙলা সাহিত্যের এমন একটি বাক্য, যার পর প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসালে হাহাকার আর বিস্ময়সূচক চিহ্ন বসালে রাজনীতি।
শুভ দা স্কেল থেকে স্কেলে উঠছেন কিংবা নামছেন— আর আমরা ঘরছাড়া, বাড়িছাড়া, দেশছাড়া অবনীদের দেখতে পাচ্ছি এবং ঠিক তারপরই তিনি যখন গাইছেন— ‘এপার বাঙলা, ওপার বাঙলা, মধ্যে জলধি নদী…’— একটি বুড়ো বটগাছের চিত্রকল্প আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মাটি কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে সে, তার শিকড় চলে গেছে কোন সুদূরে… কোন অন্ধকারে।
চরাচরে অন্ধকার নেমে আসে— সুরের অন্ধকার।