বছরটা কেটে গেলো।
কান্না-হাসির দোলায় দোলে অঞ্জলি। এ অঞ্জলি জীবনের কাছে কতক অর্থহীন, কতক নিরর্থক। অর্থগুলো নিছক হারায় স্বপ্নহীনতায়, আবার নিরর্থকেরা কেবলই আনাগোনা করে, চোখের করতলে নামিয়ে আনে শিশির ঝরা নিভৃত রাত্রি।
প্রণয়-ব্যাথার ছন্দে মৃদু বেজে যায় আপ্ত প্রহেলিকার মতো রবি ঠাকুরের গান- ‘এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে’। মনে প্রশ্ন জাগে- কবি কী মুখর ছিলো? প্রশ্ন জাগে- কবি কী নীরব হলো? উত্তর মেলে না- প্রশ্নগুলো পড়ে থাকে গীতবিতানের চৌকাঠে। গানের সুরটা তখনও শাশ্বতী- আমার এলোকেশী ঘরময় একলা শোনা বাঁশির মতো অকূল তিমির ভাসিয়ে ছুটে বেড়ায় সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠ- একমনে, একতারাতে, একা এক একাকীত্বের মতোন।
পাথরে রামকিঙ্কর, সুরের ঝর্ণাতলায় রবীন্দ্রনাথ
রামকিঙ্কর বেইজের (২০ মে, ১৯০৬- ২ আগস্ট, ১৯৮০) কথা অনেকেরই জানা আছে। পাথরের প্রলয়ে তিনি প্রাসাদ গড়েছেন কিনা আমার জানা নেই; তবে এইটুকু জানি- এই ভারতীয় সাঁওতাল ভাস্কর প্রেমের প্রপাতে প্রাণ এঁকেছেন অবিরাম। মূলত শান্তিনিকেতনেই তাঁর ভাস্কর প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। রবীন্দ্রনাথের মূর্তি গড়েছেন তিনি, গড়েছেন আরও অনেকেরই। আবার অনেকের মূর্তি তিনি গড়েননি। রবীন্দ্রনাথের সুরের ঝর্ণাতলায় যে সুচিত্রা মিত্র বেড়ে উঠেছেন, তিনি বেঁচে আছেন তাঁর কর্মে, আর তাঁকে ধরে রেখেছেন রামকিঙ্কর- পাথরের অবিনাশী নৈবেদ্যে। সুচিত্রা মিত্র জন্মগ্রহণ করেন ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯২৪ সালে। তাঁর পিতা সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৬৬) ছিলেন অনুবাদক ও লেখক। সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের আরেকটি পরিচয় আছে- তিনি রামায়ন-অনুবাদক কবি কৃত্তিবাস ওঝার (পঞ্চদশ শতাব্দী) উত্তরপুরুষ। সুচিত্রা মিত্রের মায়ের নাম সুবর্ণলতা দেবী। শিশুসাহিত্যিক হিসেবে সে আমলে সুচিত্রা মিত্রের পিতা বেশ জনপ্রিয়তা ছিলেন। তাঁর লেখা ‘চালিয়াত চন্দর’, ‘মা কালীর খাঁড়া’, ‘পাঠান মুল্লুকে’ পড়েনি এমন পড়ুয়া কিশোর নাকি কমই ছিলো তখন। আদালত থেকে বাড়ি ফিরলে হয় প্রমথেশ বড়ুয়া, দেবকি কুমার বসু, শিশির কুমার ভাদুড়িদের সঙ্গে আড্ডা, নয়তো লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন বাবা। লেখায় ডুবে গেলে জগৎ ভুলে যেতেন।
সুচিত্রা মিত্রের জন্ম হয়েছিলো ঝাড়খন্ডের ডিহিরী জংশন লাইনে শালবন ঘেরা গুঝান্টি নামের একটি রেলস্টেশনের কাছে, ট্রেনের কামরায়। তাঁর পৈত্রিক নিবাস কোলকাতার হাতিবাগান অঞ্চলে। সুচিত্রা মিত্রের জন্ম হয় পূজোর সময়। ট্রেনে জন্ম তাঁর- তাই ট্রেন নিয়ে নিজেই ছড়া লিখেছিলেন একটি।
শুনেছি, রেলগাড়িতে জন্মেছিলাম
দুই পায়ে তাই চাকা
সারাজীবন ছুটেই গেলাম
হয়নি বসে থাকা।
যাই যদি আজ উত্তরে ভাই
কালকে যাবো দক্ষিণে
পশ্চিমে যাই দিনের বেলা
রাত্তিরে ঘুরি পুবকে চিনে।
হিল্লী দিল্লী স্বদেশ বিদেশ
চক্করের আর নাই রে শেষ
প্রাণটা বাঁচে চাকা দুটো
কেউ যদি ভাই নেয় কিনে।
প্রায়ই ভাবি আপন মনে
ফুরোবে পথ কোন বিজনে
ছোটা ফেলে ছুটির আশায়
রই চেয়ে তাই নির্ণিমেষ।
সুচিত্রা মিত্রের জন্ম স্বাভাবিক সময়ের বেশ আগেই, মানে প্রিম্যাচিওর বেবি। দেখতে ছোট্ট ফুটফুটে একটা পুতুলের মতো। গুঝুন্ডির কথা মনে রাখতে বাবা আদরের মেয়ের নাম রেখে দিলেন গজু। সেটা ডাকনাম। কিন্তু এমন নামতো সব জায়গায় চলে না, তাই রবীন্দ্রভক্ত সৌরীন্দ্রমোহন রক্তকরবী থেকে নিয়ে মেয়ের আরেকটা নাম দিলেন নন্দিনী। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ওই নামও টেকেনি। গজু থেকে নন্দিনী, তারপর নন্দিনী থেকে সুচিত্রা এবং ধ্রুব মিত্রকে বিয়ে করায় হয়ে যান সুচিত্রা মিত্র। তবে শান্তি নিকেতনের সহপাঠী-সমসাময়িক আর আপনজনদের কাছে গজু নামটা এখনো আগের মতোই প্রিয়।
তিনি পড়াশুনা করেন কোলকাতার বেথুন কলেজিয়েট স্কুলে। স্কুল বসার আগে প্রার্থনা সংগীতের মতো করে গাওয়া হতো রবীন্দ্রনাথের গান। এখানে পড়ার সময় গানের চর্চা শুরু হয় দুই শিক্ষক অমিতা সেন এবং অনাদিকুমার দস্তিদারের কাছে। বিদ্যান্বেষী সুচিত্রা মিত্র পরবর্তীতে পড়াশোনা করেছেন স্কটিশ চার্চ কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষা: তোমার প্রেমে ধন্য করো যারে
গানের সঙ্গে সুচিত্রা মিত্রের সখ্য একেবারে ছোটোবেলা থেকেই। প্রতি সন্ধ্যায় মা যখন ‘সন্ধ্যা হলো গো ও মা’ গাইতেন, ভালো তো লাগতোই, কেনো যেনো খুব কান্নাও পেতো! স্কুলের সঙ্গীত শেখার আগে অবশ্য রেডিওতে প্রতি রোববার পঙ্কজ কুমার মল্লিকের সঙ্গীত শিক্ষার আসরও শুনতেন মন দিয়ে। সুতরাং মায়ের মতো পঙ্কজ মল্লিককেও সুচিত্রা মিত্রের পরোক্ষ শিক্ষক বলা যেতেই পারে। সঙ্গীত শিক্ষার আসর শুনে শুনে অসংখ্য গান শেখা হয়ে গিয়েছিলো। নাচটাও জানা ছিলো ভালো। ফলে দেরিতে স্কুলজীবন শুরু করলেও সেখানে সবার প্রিয় হয়ে উঠতে সময় লাগেনি। শান্তি নিকেতনেও তাই। ম্যাট্রিক পরীক্ষার কিছুদিন আগে হঠাৎই একটা সুখবর আসে- শান্তি নিকেতনে সঙ্গীতে ডিপ্লোমা করার স্কলারশিপ পেয়েছেন সুচিত্রা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্পর্শে সঙ্গীত শিক্ষার সুযোগ! সামনে জীবনের সবচেয়ে বড়ো স্বপ্ন পূরণের দ্বার এভাবে খুলে যেতে দেখে যেমন আনন্দে আত্মহারা হলেন, ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগেই লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাটাও তেমনি পেয়ে বসলো তাঁকে। বয়স মাত্র ১৭ তখন। এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেবেন কী করে? দ্বিধা-দ্বন্ধে একটু বেশি সময় কেটে গেলো। তাতে জীবনে প্রথমবারের মতো জানা হলো, আনন্দ-বেদনা, দুঃখ-হতাশা প্রায় হাত ধরাধরি করেই চলে। নইলে স্কলারশিপ পাবার কয়েক দিনের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-সংবাদ শোনার আঘাত সইতে হয়! ভেবেছিলেন যাবেনই না শান্তি নিকেতনে। রবি ঠাকুরই নেই, গিয়ে কী হবে সেখানে! আগে থেকেই মন বলছিলো, পড়ালেখা বন্ধ করলে লোকে এক সময় হয়তো বলবে, ‘আর কিছু পারে না তাই শিল্পী হয়েছে’- তাই শান্তি নিকেতনে না গিয়ে বেথুন কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষাটাই দিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণের বিশ দিন পর তিনি পৌঁছেন শান্তি নিকেতনে।
শান্তি নিকেতনে ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, শান্তিদেব ঘোষ এবং শৈলজানন্দ মজুমদার, ভিভি ভাঝালভাড়ে খুব যত্ন করেই গড়ে তুলেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্রকে। তবে সুচিত্রা ছিলেন শান্তিদেব ঘোষের মানসকন্যা। খুব শুদ্ধতাবাদী। সে কারণে আইপিটিএ-র প্রিয় সহশিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গেও রবীন্দ্রসঙ্গীতে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহারের প্রশ্নে বিরোধ দেখা দেয়। এমনিতে দেবব্রত বিশ্বাসকে শিল্পী হিসেবে খুবই পছন্দ করতেন। একমাত্র ছেলে কুনাল সঙ্গীত শিল্পী হতে চাইলে সুচিত্রা তাঁকে বলেছিলেন,
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা দেবব্রত বিশ্বাসের মতো শিল্পী হতে পারবে মনে করলে চেষ্টা করে দেখ, নইলে পড়ালেখায় মন দাও।
কুনাল আর শিল্পী হওয়ার চেষ্টা করেননি, লেখাপড়া করে প্রকৌশলি হয়েছেন।
সঙ্গীতজীবন নিয়ে নানা মিথ থাকে শিল্পীদের। এসবের কিছু আছে একেবারে স্টেজ থেকে তুলে আনা- হৃদয় আরশিতে সেঁটে সেগুলো কিংবদন্তী হয়। সে রকমই এক ঘটনা ঘটে কোলকাতার রবীন্দ্র সদনে বিশ্বভারতীর শিল্পীদের অনুষ্ঠানে। সহ-শিল্পীদের নিয়ে একটু দেরিতে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন সেখানে গিয়ে বিপদজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। শিল্পীদের দেরি দেখে দর্শকরা ভীষণ উত্তেজিত। কেউ কেউ মঞ্চের দিকে এটা-ওটা ছুড়ে মারতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় গাইতে যাওয়া মানেই মানসম্মান খোয়ানোর আশঙ্কা। সবার পরে গাইতে হবে বলে সুচিত্রা মিত্র এলেন আরো পরে। এসেই দুই বান্ধবী মোহর (কণিকা), আর বাচ্চু (নীলিমা)কে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে দেখে উইংস থেকে সোজা মঞ্চে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
কিছু ভাবিস না। আমি দেখছি।
মঞ্চে গিয়ে একটা চেয়ারের ওপর হারমোনিয়াম তুলে শুরু করলেন গান। গান তো নয় যেনো ম্যাজিক! মুহূর্তেই থেমে গেলো সব চিৎকার। একটানা বেশ কিছু গান গেয়ে সুচিত্রা বিদায় নিলেন শ্রোতাদের কাছ থেকে, নিরাপদ পরিস্থিতিতে কণিকা, নীলিমাও পেলেন শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করার সুযোগ।
নিঃসঙ্গতার ক্ল্যামোফেজ
মানুষ- কার্যত নিঃসঙ্গ। এই কথাটার বিরুদ্ধে হাজার যুক্তি-প্রতিযুক্তি দাঁড় করানো যেতে পারে; কিন্তু কোনোদিন অস্বীকার করা যাবে না যে- মানুষ নিঃসঙ্গ এবং একাকীত্বের মহিমান্বিত আলেখ্য তার জীবন। শিল্পীর জীবনের একটা দিকই আমরা দেখি- কখনো দেখি না, তাঁর অন্তরাত্মার ছবি- আসলে দেখতে চাইও না।
প্রিয়তম নিঃসঙ্গতাকে আরও আপন করে পাই সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে। তিনি যখন গান- ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’। এ যেনো একলা চলার প্রেরণা- ক্যানভাসে এঁকে দেন তিনি। তাঁর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের এই গান হয়ে উঠতো প্রেরণা- তবে কখনোই তাতে কোনো ফাঁকি ছিলো না। এ কেবল মানুষকে, তার ভেতরের জগতকে বোঝানো- তুমি একলা, তবুও তোমায় চলতে হবে- কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুমি আসলে একা।
সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে এই গানটি ইন্দিরা গান্ধীর খুব প্রিয় ছিলো। ইন্দিরা গান্ধীর বিখ্যাত একটা কথা আছে সুচিত্রা মিত্রকে নিয়ে। ভারতের এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলতেন,
সুচিত্রার কন্ঠে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলরে’ শুনে আমি একলা চলার প্রেরণা পাই।
ইন্দিরা গান্ধী রবীন্দ্র সঙ্গীত বুঝতেন না-কেউ আবার এ কথা ভেবে বসবেন না যেনো! জওহরলার নেহরুর সুযোগ্যা কন্যা যে শান্তি নিকেতনেও শিক্ষা গ্রহণ করেছেন তা ভুলে গেলে চলবে কী করে! ইন্দিরা গান্ধীর ‘প্রিয়দর্শিনী’ নামটা রবীন্দ্রনাথেরই দেয়া। দেখতে ভীষণ শৈল্পিক ছিলেন বলে ইন্দিরাকে এ নামে ডাকতেন রবীন্দ্রনাথ।
সবার মাঝে থেকেও সুচিত্রা মিত্র ছিলেন সবার চেয়ে আলাদা। এবং একলাও। একলা চলার গান গেয়ে গেছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন অন্যদের। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, শেষ জীবনে নিজেই হয়ে পড়েছিলেন একা! বিয়ের সাত বছর পরই বিচ্ছেদ। ছোটো বোন অকালে মারা যাওয়ায় তাঁর মেয়েটিকেও নিয়ে এসেছিলেন নিজের ঘরে। ছেলে কুনালের সঙ্গে তাঁকেও পেলে-পুষে মানুষ করেছেন নিজের সন্তানের মতো। প্রকৌশলি ছেলে জীবিকার টানে চলে গেলো দেশের বাইরে। মেয়ে স্বামীর সংসারে। ব্যক্তিজীবনে সে-ই থেকে সুচিত্রা মিত্রের সত্যিকার অর্থেই একলা চলার শুরু।
তাঁর একাকী জীবনের একটা ছাপ বয়সের সাথে তাল মিলিয়ে শরীরকে কাহিল করে তুলেছিলো। একই সাথে কণ্ঠকেও কাবু করে ফেলছিলো। প্রকৃত শিল্পীর মৃত্যুর পথে যাত্রা তো সেখান থেকেই শুরু- যেখানে তার কণ্ঠ হতে থাকে ম্লান। একটা ঘটনা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা লেখা থেকে জানা যায়। আশাপূর্ণা দেবীর জন্মদিনে গান গাইতে বসেছেন সুচিত্রা মিত্র। গান শুরু করেছেন। কণ্ঠ কেমন যেনো ম্রিয়মান। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চেয়ে দেখেন, সুচিত্রা মিত্র কাঁদছেন!
এ কি! দিদি, আপনি কাঁদছেন কেন?
জবাবটা শোনালো আর্তনাদের মতো,
গলায় সুর লাগছে না। তাহলে আর বেঁচে থেকে লাভ কী?
সুচিত্রার ভক্তভাগ্য
বলা হয়ে থাকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাসের মতো তিনিও রবীন্দ্রসঙ্গীতকে সাধারণ শ্রোতার কাছে পৌঁছে দেয়ায় খুব বড়ো ভূমিকা রেখেছেন। সুচিত্রা মিত্রও যে চাপা গলার সাবেকি ঢঙ ছেড়ে উদাত্ত কন্ঠে, স্পষ্ট উচ্চারণে গাইতেন, তা কে না জানে! তো এভাবে গেয়ে যে শুধু সাধারণের কাছেই প্রিয় হয়েছিলেন তা কিন্তু নয়। তাঁর ভক্তের তালিকায় এমন বিখ্যাত সব ব্যক্তিরা রয়েছেন যা দেখলে অবাকই হতে হয়। মহাত্মা গান্ধী, পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, বার্ট্রান্ড রাসেল, ইন্দিরা গান্ধীর মতো জগদ্বিখ্যাতরাও আছেন সেখানে! ভক্তদের কেউ কেউ আবার প্রিয় শিল্পীকে মুখে প্রশংসা করেই থেমে থাকেননি। কবি বিষ্ণু দে লিখেছেন কবিতা। রামকিঙ্কর ঘণ্টার পর ঘণ্টা সামনে বসিয়ে রেখেছেন সুচিত্রা মিত্রকে, গড়েছেন তাঁর আবক্ষ মূর্তি।
নেহেরুর সঙ্গে একটা মজার ঘটনা আছে সুচিত্রা মিত্রের। সুচিত্রা মিত্র জগত ভুলিয়েছেন সুরের জাদুতে- এ কথা সবাই জানেন। তাঁর গান প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলো পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর ক্ষেত্রে। নেহরু তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সংক্ষিপ্ত সফরে কোলকাতায় গেলেন। দলীয় সমর্থকরা আনন্দ মিছিল করে বরণ করলেন তাঁকে। কিন্তু বিরোধীরা রাস্তায় নামলেন কালো পতাকা হাতে; আনন্দ নয়, বিক্ষোভ জানাতে। সেদিনই আকাশবাণীতে সুচিত্রা মিত্রের প্রোগ্রাম। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাল্মিকী প্রতিভা থেকে গাইলেন, ‘কাজের বেলায় উনি কোথা যে ভাগেন, ভাগের বেলায় আসেন আগে।’ কারো বুঝতে বাকি রইলো না, আইপিটিএ-র সক্রিয় সদস্য সুচিত্রা মিত্র ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে কটাক্ষ করেই এ গান গেয়েছেন। পরিণতি যা হবার তা-ই হয়েছিলো। টানা ছয় বছর ‘আকাশবাণী’তে নিষিদ্ধ ছিলেন সুচিত্রা মিত্র। কিন্তু মজার ব্যাপার, তাবেদাররা এভাবে এক হাত নিলেও স্বয়ং নেহরু কিন্তু প্রায় সন্তানের বয়সী শিল্পী সুচিত্রার ওপর ক্ষেপে যাননি, বরং গান শুনে একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন তাঁর!
আরও একটি ঘটনা। স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত তখনো বড়ো শিল্পী হয়ে ওঠেননি, তবে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আকাশবাণী দিল্লিতে একটা সঙ্গীত প্রতিযোগিতা হচ্ছে। স্বাগতা সেখানে প্রতিযোগী আর সুচিত্রা মিত্র বিচারক। এখন মূলত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হলেও ওই প্রতিযোগিতায় স্বাগতালক্ষ্মী কিন্তু প্রথম হয়েছিলেন ভজনে। তাঁর ভজন অভিভূত করেছিলো সবাইকে। সুচিত্রা মিত্র ডেকে বলেছিলেন,
তুমি আমার কাছে এসো। আমি তোমার কাছে ভজন শিখবো, তোমায় আমি রবীন্দ্র সঙ্গীত শেখাবো।
কমিউনিস্ট সুচিত্রা ও ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
সুচিত্রা মিত্রের জীবনে গণনাট্য সংস্থা (আইপিটিএ)র প্রভাব খুব চোখে পড়ার মতো। পরিবারের সাংস্কৃতিক আবহ তাঁকে সততা, উদারতা, মনের স্বচ্ছতা দিয়েছিলো তা হয়তো ঠিক, তবে আইপিটিএ যে মনে সমাজতান্ত্রিক চেতনা প্রোথিত করেছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর কণ্ঠেও যে আইপিটিএ-র প্রভাব নেই তা-ই বা বলি কী করে! চিরকাল গণসঙ্গীতের মতো করে উদাত্ত কণ্ঠেই তো রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে গেলেন। তো একটা সময় আইপিটিএ-র সক্রিয় কর্মী ছিলেন বলে অনেকে ‘কমিউনিস্ট শিল্পী’ হিসেবেই দেখতেন সুচিত্রা মিত্রকে। কারো কারো ধারণা গণসঙ্গীত গাইলে কণ্ঠ নষ্ট হয়ে যায়। সুচিত্রারও তাই হয়েছে বলে ভেবেছিলেন ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তো একবার ডেকার্স লেনে রবীন্দ্র জন্মোৎসব উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সুচিত্রা মিত্র গাইলেন, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।’ শুনে ধূর্জটি বাবু স্তম্ভিত! সেদিনের অভিজ্ঞতার কথা সবিস্তারে লিখেওছিলেন তিনি, সে লেখার একটা বাক্য খুবই স্মরণীয়,
শুনেছি মেয়েটি কমিউনিস্ট, কিন্তু কমিউনিজম ওর গলার কোনো ক্ষতি করেনি।
আমার বাঙলাদেশের হৃদয় হতে
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সুচিত্রা মিত্র বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বারবার বলেছিলেন- ওরা (পাকিস্তানিরা) অন্যায় করছে, ওদের মানসিক বিকৃতি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে; ওদের প্রতিহত করা আমাদের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে স্বাধীন হতে চলেছে বাঙলাদেশ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ তখন সময়ের ব্যাপার। কোলকাতায় পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে উড়ছে বাঙলাদেশের পতাকা। সেদিন পতাকার নিচে সার বেঁধে দাঁড়িয়েছেন কয়েকজন। সবাই গাইছেন বাঙলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন সুচিত্রা মিত্র।
এ ঘটনার ১৭ বছর পরের কথা। বাঙলাদেশ সেবার বন্যায় বিপর্যস্ত। লক্ষ লক্ষ মানুষের দিন কাটছে অর্ধাহারে-অনাহারে। সেবারও ঘরে বসে থাকতে পারেননি সুচিত্রা মিত্র। দুর্গতদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে কোলকাতার রাস্তায় নেমেছিলেন অসংখ্য মানবতাবাদী। সেখানেও ছিলেন ‘দিদিমনি’।
প্রিয় বই ‘মনে রেখো’ থেকে উদ্বৃত
কোলকাতার আজকাল পত্রিকার সাংবাদিক অলোকপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় সুচিত্রা মিত্রের জীবনীগ্রন্থ ‘মনে রেখো’র অনুলেখক। প্রতিদিন ভোরবেলা আমরা যেমন দরজার সামনে থেকে সংবাদপত্র তুলে নিই, অলোকপ্রসাদ তেমনি শব্দ তোলেন হৃদয়ের করিডোর থেকে, তাকে জারিত করেন অনুভূতির রসে, এবং তারপর ব্যবহার করেন লেখায়। আমার ইচ্ছে করছিলো তাঁর পুরো বইটিই তুলে দিই- কিন্তু সম্ভব নয় বলে কেবল অংশবিশেষ তুলে ধরছি।
তাঁর আত্মকথা মনে রেখো প্রথমে আজকাল শারদ সংখ্যায় ১৯৯৪ সালে, পরে বই হিসেবে প্রকাশিত হল ১৯৯৫-এর বইমেলায়। আর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তুমুল জনপ্রিয়।
প্রথম অংশে তুলে ধরবো বইটি লেখার অনুমতি চাইতে গিয়ে তাঁর কী দশা হয়েছিলো। আজকালের রবিবাসরে তিনি এই নিয়ে একটি নিবন্ধও লিখেছিলেন সম্রাজ্ঞী ও অর্বাচীন শিরোনামে।
সাংবাদিকের পেশায় থাকার সুবাদে যে-কয়টা ‘প্রাইজ অ্যাসাইনমেন্ট’ জীবনে পেয়েছি, তার সেরার তালিকায় সুচিত্রা মিত্রর আত্মকথা ‘মনে রেখো’ অনুলিখন করার কাজ। সম্পাদক মশাইয়ের নির্দেশে সটান হাজির সুচিত্রা মিত্রর দোর গোড়ায়। অশোকদা একটা মুখবন্ধ খামে থাকা চিঠি দিয়েছিলেন হাতে, সুচিত্রা মিত্রকে দেওয়ার জন্য। চিঠিটা অমিতাভ চৌধুরির লেখা। দরজা খুলে এবং আমাকে ভেতরে ঢুকতে না দিয়ে উনি চিঠিটা পড়লেন। আমি কম্পমান হৃদয়ে, তবুও, ওঁর অসম্ভব রূপ এবং ব্যক্তিত্বের বর্ণচ্ছটার দিকে তাকিয়ে। চিঠি পড়া শেষ করে উনি স্পষ্টভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আরও স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, কী ভেবেছেন বলুন তো আপনারা? আমি গান গাইব, না আপনাদের সঙ্গে বকবক করব? বকবক করাটা আমার কাজ নয়। আর ঘটা করে আত্মজীবনী লেখার কোনও বাসনাও আমার নেই। আমাকে রেহাই দিন।
আমি তখন সত্যিই কম্পমান। সম্পাদকের প্রাইজ অ্যাসাইনমেন্ট। এমন নিদারুণ ব্যর্থতার কথা বলাও পাপ। দাঁড়িয়েই আছি। আমি দরজায় বাইরে। উনি দরজার ভেতরে।
এবার ওঁর কণ্ঠ- আমার কথা আপনি শুনতে পেলেন না?
আমি এই প্রথম একটা কথা বলার সুযোগ পেলাম যেন।
আমাকে আপনি বলবেন না।
কেন? অপরিচিত মানুষকে তো আপনিই বলতে হয়।
মানে, আপনি কত বড়। আমি অনেক ছোট।
ছোট-বড়র কথা হচ্ছে না। আপনি আমার কথা শুনতে পেয়েছেন? বুঝতে পেরেছেন? আপনি এবার আসুন। আমার অনেক কাজ আছে।
প্রচন্ডভাবে ভেঙ্গে পড়তে পড়তে বলি, আপনি দরজা বন্ধ করুন, আমি ঠিক চলে যাব।
আমি কারও মুখের ওপর দরজা বন্ধ করি না। আপনি আসুন। তারপর আমি দরজা বন্ধ করব।
আমি খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচার মতো বলি, পরে একদিন আসব?
আপনি বোধ হয় আমার কথাটা বুঝতে পারেননি। আত্মজীবনী বলার বা লেখার ইচ্ছে বা অবসর, কোনোটাই আমার নেই।
‘সম্পাদকের কাছে আমার মাথাটা কাটা যাবে’- বলেই ফেলি ভেতরের কথাটা।
আপনার মাথা বাঁচানোটাও আমার কাজ?
একদিন যদি একটু সময় দেন। আধ ঘণ্টা।
আধ ঘণ্টায় আত্মজীবনী লেখার কথা সম্ভবত উনি আগে কখনো শোনেননি। আমি ওইটুকু সময়ের কমও চাইতে পারলাম না, বেশি তো নয়ই।
আধ ঘণ্টা? আধ ঘণ্টা কী করবেন?
একটু কথা বলতাম আপনার সঙ্গে। এমনি।
এমনি-এমনি কথা? আমার কিন্তু এখন সত্যিই কাজ আছে।
বুঝলাম, এমন কঠিন দরজা পেরোনো খুব কঠিন। স্বগতোক্তি করলাম, ‘ঠিক আছে, যাচ্ছি। পরে একদিন আসব।’
লাভ নেই বুঝে জিজ্ঞাসা করিনি। আপন মনেই বলেছি। জিজ্ঞেস করলাম এবার, ‘একটা প্রণাম করি?’ কেন, রাজি হইনি বলে?
এ তো দেখছি কথা বলাও পাপ। না বলাও পাপ।
আপনার গানে অনুপ্রেরণা পাই। সে জন্য।
আমার গান তো নয়, রবীন্দ্রনাথের গান।
কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছিল খুবই। কিন্তু কী কথার কী যে বিচার হবে, কে জানে?
এরপরের অংশটুকু নেয়া হলো ঘরে-বাইরে অনুচ্ছেদ থেকে।
তখন তাঁর সত্তর বছর। কিন্তু হাঁটায়, চলায়, কথাবার্তায় যৌবনের দীপ্তি। যত বয়স হয়েছে, মাথায় শুভ্র চুল উড়িয়ে ততই যেন সুন্দর হয়ে উঠেছেন। বলেছিলেন, আমি ‘গ্রেসফুলি’ বুড়ো হয়েছি।
কিন্তু তাঁর মনটার কোনও বুড়োত্ব ছিল না। চৌকাঠের বাইরে বেরোলে তাঁকে ঘিরে যেন ব্যক্তিত্ব ছাপিয়েও অতিরিক্ত একটা কাঠিন্য ছুঁয়ে থাকত। মানুষজন সেই কঠিনকে টপকানোর সাহস পেত না। কিন্তু তাঁর ভেতর-ঘরের চৌকাঠ টপকে ঢুকে পড়লে দেখা যেত, এক আবেগপ্রবণ বালিকা যেন সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বুদ্ধির দীপ্তি, মনন – সব কিছু নিয়েই হৃদয়-চালিত এক মেয়ে বলে বারবার মনে হয়েছে তাঁকে। এই মেয়ে কুটনো কোটে, রান্না করে, পুতুলও গড়ে।
‘কৃষ্ণকলি’ তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান। জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ গান তো পুরুষের গান। আপনি শুধু এ গান করেনই না এই গান তো শ্রোতাদের কাছে আপনার সবচেয়ে জনপ্রিয় গানও হয়ে উঠেছে।
বলেছিলেন, আমি শুধু নারী, এ কথা তোমাকে কে বলেছে? কোনও মানুষই শুধু নারী নয়, শুধু পুরুষ নয়। দুটো সত্তাই থাকে ভেতরে।‘কৃষ্ণকলি’ আমার পুরুষসত্তা গায়।
তাঁর প্রচুর প্রতিরোধ অগ্রাহ্য করে পুজো সংখ্যার জন্যে আত্মকথা লেখার সম্মতি যখন মিলল, তার পর সময় ছিল খুব কম। উনি ক’দিন পরেই যাবেন আমেরিকার বাল্টিমোরে ছেলের কাছে। ফলে বাড়িতে, রবিতীর্থের গানের ক্লাসে, ওঁর অনুষ্ঠানে যেতে যেতে গাড়িতে বসে কথা বলেছি দিনে, রাতে। লিখতে লিখতে ওঁকে দেখিয়ে নিয়েছি। এভাবেই কিস্তিতে কিস্তিতে কম্পোজ হয়েছে।
লেখা শেষ হয়নি, কিন্তু আজকাল-এ বিজ্ঞাপন বেরোবে শারদ সংখ্যায়। কী নাম হবে তাঁর আত্মকথার? বললেন তোমরা ঠিক কর। একটুও খাটবে না, সেটা কী করে হয়!
অশোকদা নাম ঠিক করলেন – মনে রেখো। ওঁকে জানালাম। বললেন, কেউ মনে রাখবে না। রবীন্দ্রনাথকে বাঙালি কখনও ভুলতে পারবে না। আমাকে খামোকা কেন মনে রাখবে লোকে? আমি কেউ না।
এটা বড্ড বেশি বিনয় হচ্ছে। সুচিত্রা মিত্রকে এটা একদম মানায় না।
আমাকে কি মানায়, না মানায় সেটাও তুমি বলে দেবে?
কথা বলাও বিপদ। বললাম, ঠিক আছে, কেউ না মনে রাখুক, আমরা তো রাখব।
ব্যস, সে জন্য ঘটা করে নাম দেব ‘মনে রেখো’। বড্ড জ্বালাচ্ছ কিন্তু।
এই ‘জ্বালাচ্ছ’ শব্দটা সম্বল করে মনে রেখো নামটাই সাব্যস্ত হল।.. .. .. ..
সুচিত্রা মিত্র একজন পূর্ণ মানুষ- বুদ্ধির দীপ্তিতে, অনুভবের গভীরতায়। সিংহ দরজা তার হৃদয়ে। কিন্তু তাঁর দশতলার ফ্ল্যাটটা তার মাপের তুলনায় খুবই ছোট। ঘর-ভর্তি, প্যাসেজ-ভর্তি বই আর বই। ছোট ঘর নিয়ে কোন খেদ নেই তাঁর। খুব প্রিয় তাঁর দশতলার ফ্ল্যাটের বারান্দা। বলতেন, এখানে দাঁড়ালে আকাশটা খুব কাছে মনে হয়।
পড়াশোনা, লেখালেখি তাঁর আর-এক প্যাশন। তিনি বারবার বলতেন, গানের ছবি যদি আঁকতে না পারি, গানটা ঠিকমতো গাওয়া যায় না। এর পাশাপাশি বলতেন, রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গেলে রবীন্দ্রনাথকে পড়া দরকার। নিজের মতো করে বোঝা দরকার। তার পরই তো গানটা হয়ে উঠবে নিজের গান। যেমন মোহরের গান, জর্জের গান।
ক্ষীরের পুতুল পুরোটাই ছন্দে রূপান্তরিত করেছিলেন। বারবার বলতাম, এটা এবার মঞ্চে আনুন। বলতেন, দাঁড়াও, আগে মনের ভেতরে পুরো ছবিটা ফোটাই।
বাল্মীকি প্রতিভা এককভাবে মঞ্চে গাইতেন। একবার চন্দননগরে রবীন্দ্রভবনে যাবেন বাল্মীকি প্রতিভা গাইতে। আমি সঙ্গে যাব। বাড়ি গিয়ে দেখি জ্বর। ভাল করে দাঁড়াতে পারছেন না। ওষুধ খেলেন। জিজ্ঞেস করলাম, যেতে পারবেন?
বললেন, যেতে হবেই। কত মানুষ অপেক্ষা করবেন রবীন্দ্রনাথের বাল্মীকি প্রতিভা শোনার জন্যে।
একবারও বললেন না তাঁর গান শোনার জন্যই অপেক্ষায় থাকবেন মানুষজন। এবং কী আশ্চর্য, ‘স্বস্তিক’-এর দশতলার ফ্ল্যাটের দরজা থেকে যখন বেরোলেন, তখন তাঁকে দেখে কে বলবে একটু আগেই তাঁর দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছিল।
বাইরের মানুষের সহানুভূতি একদম অপছন্দ তাঁর। কখনও বাইরের কাউকে টের পেতে দেননি তাঁর অসুস্থতার কথা। চন্দননগরে গেলেন। রবীন্দ্রভবনের সেই সন্ধেয় তাঁর একক বাল্মীকি প্রতিভা কোনও দর্শকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়, এ জীবনে। বনদেবী থেকে দস্যু থেকে বাল্মীকি হয়ে সরস্বতীতে এসে থামলেন রবীন্দ্রগানের সরস্বতী। একা সুচিত্রা অনেক হয়ে ছড়িয়ে পড়লেন শ্রোতাদের, দর্শকদের হৃদয়ে।
আজ সুচিত্রা মিত্রের প্রয়াণ দিবস। আমার রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার যে শ্রবণেন্দ্রিয় তা গড়ে উঠেছে মূলত ছয়জনের গান শুনে। সুচিত্রা মিত্র তাঁদের একজন। জীবনের যেটুকু তরঙ্গে এখনো উচ্ছ্বলতা খেলা করে- রবীন্দ্রনাথের গান তাতে শীর্ষবিন্দু। সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান- আমার মৌন-মুখর অলোকানন্দা, প্রেরণার শঙ্খচিল, গীতবিতানের প্রাণশ্বাস, মুগ্ধ সময়ের পোট্রেট এবং সবশেষে, সবটুকু শেষ হলে- আমার নিঃসঙ্গতার এপিটাফ।