ছবিটির দিকে তাকাই এবং আবিষ্কার করি দেবব্রত বিশ্বাসকে। শিশির মঞ্চে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্নেহাংশু আচার্য, কনক বিশ্বাস ও অন্যান্যদের সঙ্গে তাঁর এই বসে থাকার ভঙ্গিমাই আমাদের কাছে মেলে ধরে দেবব্রত বিশ্বাসের যাবতীয় ইশতেহার। এই ইশতেহার কারিগরের নয়; বরং দ্রষ্টার বিশৃঙ্খলা ও কিমিতি, মৃত্যু ও শূন্যতা, পাপ ও প্রজ্ঞান একই সুরে নিবেদিত হয়েছে অসীমের সমীপে। আমাদের হাবা কৈশোরে তিনি ধরা দিয়েছিলেন জ্যোৎস্নার নাটকীয়তায়— কেন চেয়ে আছ গো মা…। তাই বলতে দ্বিধা নেই যুক্তি তক্কো আর গপ্পো ছবিতে ঋত্বিক ঘটকের ওষ্ঠে ধৃত দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠই আমাদের ঘর চিনিয়েছিলো। সন্ধ্যার কাকের মতো আকাঙ্ক্ষায় আমাদের ঘরে ফেরার পর্ব সমাপ্ত হলে আমরা রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাই মিছিলের মুখরতায়। আজও তাঁর কণ্ঠে এই গানের অদৃশ্য প্রশ্নবোধক চিহ্নটি জেগে ওঠে। বাঙলাদেশের আকাশ ও মৃত্তিকা পরস্পরের মুখ দেখে ভাঙা আয়নায়। আমাদের অশ্রু সীমানার পরপারে পৌঁছে যেতেই দেবব্রত বিশ্বাস হাত মেলান পল এলুয়ার, নেরুদা কিংবা রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে।
যে বর্ণাঢ্য, অথচ একাকী যাত্রার নাম দিয়েছিলেন ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত, তা-ই হয়ে উঠলো আমাদের আত্মার নির্বিকল্প অংশ। আমাদের রবীন্দ্রনাথ পড়ার ফ্রেম বদলে গেলো, শোনারও। তাঁর মুক্তস্রোতা গায়কীতে আমরা প্রথমবার গীতবিতানকে আবিষ্কার করলাম সমুদ্রশঙ্খের মতো। আমাদের আষাঢ় আর পঞ্জিকাতে আটকে রইলো না। আমাদের আষাঢ় আসে খর চৈত্রে, বৈশাখে, বসন্তে— যে কোনোদিন, কেবল ইউটিউব খুলে শুনে নিতে হয় দেবব্রতের কণ্ঠে আবার এসেছে আষাঢ় । বাঙলায় জর্জ বিশ্বাসের মতো আর কেউ ‘আষাঢ়’ উচ্চারণ করতে জানেন না। আমাদের বিস্ময় জাগে তখনই, যখন তিনি উচ্চারণ করেন … বিস্ময়ে তাই জাগে…। সত্যিই জাগে! বস্তুত দেবব্রত বিশ্বাস শব্দ যতোখানি উচ্চারণ করতেন, তার চেয়েও বেশি তাতে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয় তাঁর কণ্ঠের অনুগামী হয়েই প্রতিদিন স্নিগ্ধ হয়, প্রাপ্তমনস্ক হয়। দেবব্রত বিশ্বাস হয়ে ওঠেন আমাদের রবীন্দ্রপাঠের মাস্টারমশাই। স্বরলিপি বা রচনাবলী নয়, বরং বোধকেই তিনি শালগ্রামশিলা মনে করতেন।
বর্তমান সভ্যতার যে ঠমক নিয়ে আমরা কলার ঝাঁকাই, তার একটি ফাঁকি আছে। দৃশ্যের ডালপালায় ঝালরবাতি সাজিয়ে চোখ ধাঁধানোতেই তার সব কেরামতি। প্রজ্ঞা তার কাছে পুতুল— তাতে চিন্তার স্তব আছে কিন্তু অনুভবের মায়া নেই। চৈতন্যের গহন শিকড়ে নেমে খোঁজ করার প্রবণতা তার কাছে অনাদৃতই থেকে যায়। এই মায়ার পথ ধরেই দেবব্রত বিশ্বাস সঙ্গীতের সীমানা পার হয়ে যান। মূর্ত ও ইন্দ্রিয়সঞ্জাত উপলব্ধিকে তিনি পুনর্বিন্যস্ত করেন, যাকে সত্যজিৎ বলেছিলেন— লার্জলি ইমপ্রোভাইজেশনাল। ফলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মহাকাশে নতুন নতুন আশ্চর্য সব গ্রহ আবিষ্কৃত হলেও সূর্য একমেবাদ্বিতীয়ম এবং তিনিই দেবব্রত বিশ্বাস। তাই রাসবিহারী এভিনিউয়ের একতলা ঘরে মুক্ত আকাশে ভাসিয়ে দেয়া তাঁর মানব কণ্ঠস্বরকে আমরা স্বেচ্ছানির্বাসন মনে করি। অথচ আজ তো প্রমাণিত, তাঁর যাবতীয় ‘নিয়ম না-মানাই’ আমাদের মূল সংস্কৃতির ইতিহাস; যেমন পাশ্চাত্যে পল রবসন।
প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তারা বড়োজোর বুদ্ধিমান হন— এ কথা দেবব্রত বিশ্বাস, ঋত্বিক ঘটক, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা জীবনানন্দ দাশ আমাদের জানিয়ে গেছেন। প্রতিভার অনুগামী হবার স্বভাব না থাকলেই তো অধিকর্তা হওয়া সাজে। সুতরাং নিয়মরক্ষার শিশুসুলভ ভঙ্গিতে জর্জ বিশ্বাসকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ কারণে একমাত্র তাঁর কণ্ঠেই গায়ে আমার পুলক লাগে চোখে ঘনায় ঘোর… হয়ে ওঠে রাজনৈতিক বক্তব্য। অচলায়তনে রাজার বেশ তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন বলেই আমাদের মননে আজ হয়ে উঠেছেন ঋষ্যশৃঙ্গের মতো মৌল তপস্বী। ১১০ বছর তো কিছুই না, আরও শত শত বছর তাঁর জন্মদিনে ঘোষিত হবে সমাগতো রাজবদুন্নতধ্বনি।
শুভ জন্মদিন দেবব্রত বিশ্বাস— গীতবিতানের নব আনন্দভৈরবী; আমাদের নব মেঘদূত।