১৯৭৫ সালের তেসরা নভেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর বাঙলার ইতিহাসে দ্বিতীয় কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয় এই দিনে। বাঙলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম (১৯২৫-১৯৭৫), প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫), মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী (১৯১৭-১৯৭৫) এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে (১৯২৬-১৯৭৫) জেলখানার অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করে স্বাধীনতাবিরোধী সামরিক ও বেসামরিক চক্র। এই নৃশংস ঘটনার পরদিন (০৪ নভেম্বর, ১৯৭৫) তৎকালীন উপ কারা মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করলেও দীর্ঘ একুশ বছর এ মামলাটি ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিলো। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার প্রক্রিয়া শুরু করে এবং ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. মতিউর রহমান মামলার রায় দেন ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর এবং রায়ে উল্লেখ করা হয়—
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ছিল একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা। বঙ্গবন্ধুকে হতার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে ষড়যন্ত্রকারীরা জাতীয় চার নেতাকে তাদের সরকারে যোগদানের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জাতীয় এই চার নেতা সেই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এ কারণে তাদের নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়। আসলে হত্যাকারীরা ও তাদের দোসররা চেয়েছিল পাকিস্তান ভাঙার প্রতিশোধ নিতে, রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ও সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশটিকে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের আবর্তে নিক্ষেপ করতে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পুনর্গঠন ও গণতান্ত্রিকতার পথ থেকে সদ্য স্বাধীন দেশটিকে বিচ্যুত করা এবং বাংলাদেশের মধ্যে থেকে একটি মিনি পাকিস্তান সৃষ্টি করা।
১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্টের পর স্বাধীন বাঙলাদেশ মূলত বেহাত হয়ে যায়। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির হাতে চলে যাওয়া দেশের গণমাধ্যমও তখন ক্ষমতাসীনদের ভাষায় কথা বলেছে। ১৯৭৫ সালের ২৩ আগস্ট গ্রেফতার করা হয় জনাব তাজউদ্দীন আহমদকে। সরকারি ভবন থেকে গ্রেফতার করা হয় উপরাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। খুনী মোশতাকের মন্ত্রীসভায় প্রধানমন্ত্রী না হওয়ায় কারাগারে প্রেরণ করা হয় জনাব এম. মনসুর আলীকে এবং জনাব এ এইচ এম কামারুজ্জামানসহ আরও ২০ জনকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয় ২৩ আগস্ট।
দৈনিক ইত্তেফাক এই গ্রেফতারের সংবাদ পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশ করে ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট।
একই দিনের ইত্তেফাকে তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর একটি বিবৃতি ছাপানো হয়, যেখানে তিনি বলেন— ‘দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করিতেছে’।
২৪ আগস্টের ইত্তেফাকের আরেকটি সংবাদ হচ্ছে— রাষ্ট্রপতি সকাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যবৃন্দ।
এই সংবাদগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে এ কারণে যে— পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের জাতির পিতার নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং তেসরা নভেম্বর জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে সর্বদাই আমরা একটি সরল বাক্য রচনা করি— ‘কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা…’। কিন্তু আদতে রাষ্ট্রের তৎকালীন প্রতিটি বিভাগ পঁচাত্তরের এই কলঙ্কজনক অধ্যায়ের জন্য দায়ী। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা সাধারণত অনেক বড়ো বড়ো কথা বলেন, কিন্তু তারা যে কোনো মুহূর্তে, যে কোনো ক্ষমতার কাছে নতজানু হতে পারেন।
পঁচাত্তরের আগস্ট পরবর্তী ইতিহাস অনেকেই জানেন। তেসরা নভেম্বর কারা অভ্যন্তরে হত্যা করা হয় জাতীয় চারনেতাকে। চৌঠা নভেম্বরের ইত্তেফাক বা অবজারভারে এর কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়নি। কারণ সম্ভবত এই যে, গভীর রাতের এই ষড়যন্ত্র জানার আগেই পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিলো।
পাঁচই নভেম্বরের দুটো পত্রিকার প্রথম পাতাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সংবাদ পরিবেশনের পদ্ধতিতেও খানিকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই দিনের দুটো পত্রিকারই একটি উল্লেখযোগ্য খবর হচ্ছে— সংগ্রামী ছাত্রসমাজের বঙ্গবন্ধু স্মৃতি দিবস পালন। ইত্তেফাকের শিরোনাম— ‘শহরে মৌন মিছিল’ আর অবজারভারের শিরোনাম— Homage Paid to Bangabandhu.
যদিও দুটো পত্রিকাই পরিস্কারভাবে সরকারি নির্দেশ প্রচার করেছে যে— হরতাল করা যাবে না।
পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট এবং তেসরা নভেম্বরের সংবাদ ও সরকারি ভাষ্যের মধ্যে একটি মৌলিক তফাৎ পাওয়া যায়। ইত্তেফাক এবং অবজারভারেও সেটি সুস্পষ্ট। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ইত্তেফাক হয়ে উঠেছিলো খুনীদের কণ্ঠস্বর। ১৬ আগস্ট ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়টি পড়লেই তা স্পষ্ট বোঝা যাবে।
তাছাড়া আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ইত্তেফাক ও অবজারভার— দুটো পত্রিকাই সরকারি ভাষ্য হুবহু ছাপিয়েছে, হয়তো অন্যান্য পত্রিকাও ছাপিয়েছে। কিন্তু ইত্তেফাকের সংবাদ-সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় যতোটা নির্লজ্জের মতো তৎকালীন সরকারের তাঁবেদারি করেছে, অবজারভারের ভাষা ততোটা কদর্য ছিলো না।
কিন্তু তেসরা নভেম্বর পরবর্তী প্রেক্ষাপটে আমরা দেখছি— দুটো পত্রিকাই খানিকটা নমনীয় নীতি অবলম্বন করেছে। এমনকি তৎকালীন খুনী সরকারও দম্ভ-দাপট না দেখিয়ে খানিকটা সুর পাল্টে কথা বলেছে। যেমন জাতীয় চারনেতাকে হত্যাকাণ্ডের পর সরকার বিচার বিভাগীয় তদন্তের জন্য উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠনের কথা বলছে। এই সংক্রান্ত ইত্তেফাকের খবরটি পড়লে বোঝা যায়— সরকার সামরিক বাহিনীর ভাবমূর্তি সম্বন্ধে চিন্তিত ছিলো।
০৬ নভেম্বর দুই পত্রিকাই জাতীয় চার নেতার সমাধি ও জানাজা সম্পর্কিত খবর প্রকাশ করে।
ইত্তেফাক ‘আমরা মর্মাহত’ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয়ও প্রকাশ করে।
এই আলোচনাতে একটি বিষয়ের ইঙ্গিত করা বাঞ্ছনীয়। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টে খুনীরা সরকারি পাহারায় যে দম্ভ দেখিয়েছিলো, তার প্রতিফলন ঘটেছিলো সরকারি এবং সংবাদপত্রের ভাষ্যে। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, তৎকালীন সংবাদপত্রে জনগণের ভাষ্য ছিলো অনুপস্থিত। তেসরা নভেম্বরে যেভাবে সরকার সেনাবাহিনীকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে— তা থেকে কি মনে হয় না— সেনাবাহিনী সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিলো। দ্বিতীয়ত, ক্রমাগত বঙ্গবন্ধুর খুনী ও তাদের পাহারাদার সরকারের সাফাই গাইতে গাইতে ইত্তেফাকও কি জনগণের আস্থা হারিয়ে একেবারে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলো? সেজন্যই কি ইমেজ উদ্ধারের জন্য খবরের কাগজগুলো তেসরা নভেম্বরের পর তাদের সংবাদ প্রকাশের ধারায় পরিবর্তন আনে?
এই প্রশ্নগুলোর তো সরাসরি উত্তর পাবার উপায় নেই, তবে ইতিহাসের জার্গনগুলো থেকে এসব খুঁজে বের করা অসম্ভব নয়। কারণ, পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে জনগণের ভূমিকা বারবার ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই দাঁড় করানোটা কতোটা সত্য— সেটা সম্ভবত খুঁজে বের করার সময় এসেছে।
১৮ কার্তিক ১৪২৬