খুব দূর থেকে নন, কাছেই, আবার একেবারে কাছেও নন- যতোটা দূরত্ব থাকলে ‘দূর’টাকে মনে হয় প্রিয় ব্যালকনি আবার ‘কাছে’র অর্থ ধরা পড়ে চেনা অভিধানের চৌকাঠ পেরিয়ে, তিনি ততোটা দূরত্বে থেকেই এক মনে পাশা খেলে যান আমার মধ্যবিত্ত নাগরিক যৌবনের অগোছালো হৃদয় ঘরে; কখনো কবিতার স্নিগ্ধতায় তাঁর অতলস্পর্শী শব্দমাল্য আমাকে আহ্লাদে জড়ায় উদ্ভিন্নযৌবনা নারীর কাতরতায়, কখনো ছোটোগল্পের মহিমায় তিনি ছোটো নন, বেশ বড়োসড়ো হয়ে ধরা দেন আমার দেড় ইঞ্চি দৃষ্টি সীমানায়, তাঁর উপন্যাস, যদিও একমাত্র চতুরঙ্গ ছাড়া আর কোনোটি আমার ভালো লাগেনি, তবুও কেমন এক অনির্দেশ্য নিয়তির চিহ্নসুষমা যেনো সাঁটা আছে সেখানে, একেবারে ঠাসবুনুটে- কেবল আমারি জন্য এবং তারও অনেক পরে, যখন আমার স্বপ্নের ক্যানভাসগুলো ভেসে যেতে লাগলো স্ট্যানসিলে-ফেস্টুনে-স্লোগানে, আমার মগজের কোষে কোষে ধ্বনিত হয়েছিলো ‘লেনিন ছাড়া আর কোনো পাঠ্য নেই’- এই জাতীয় ঘোষণা- তখন আমি তাঁর প্রবন্ধের মুখোমুখি হই; আমি চোখ ফেরাতে পারিনি; মনে হয়েছিলো, আমি যেনো দামিনীর প্রেমে পড়েছি- তাকে না পারছি ছেড়ে যেতে, না পারছি ভালোবাসতে; কেননা তাকে ছেড়ে যাবার শক্তি আমার ছিলো না, অন্যদিকে তাকে ভালোবাসতে ঋষি হতে হয় অথচ আমি ঋষি হতে পারিনি, আমি প্রেমিক হয়েছিলাম- আমার অন্তর্গত সত্তায় সিক্ত টি-ব্যাগের মতো ঝুলেছিলো এক টুকরো না-ছোঁয়া প্রেম; আমি ডাকঘরে কোনো চিঠি পাঠাইনি, অথচ কী আশ্চর্য রক্তকরবীর প্রজ্জ্বোলতা আমাকে টেনিসনের লোটাস ইটারদের মতো নেশাগ্রস্থ করে তুলেছে, জয়সিংহ আমাকে ছুঁড়ে ফেলেছে নন্দিনীর বুকে- সেদিন আমার দ্বিতীয় জন্ম হয়েছিলো; আমি পুনশ্চর কোলে মাথা রেখে শুয়েছি, দেখেছি বিষণ্ন বলাকার উড়ে যাওয়া, আমি প্রেমিক থেকে পুরুষ হয়ে উঠেছি, চোখ রেখেছি ক্যামেলিয়ার স্তনে; আমার দুর্বিনীত তারুণ্যকে বিপন্ন করেছেন ফ্রয়েড আর তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে গীতবিতান, আমি পুর্ণবার নেশাগ্রন্থ হই- একজন দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে গীতবিতান ঈশ্বর হয়ে ওঠে- সেই প্রথমবার, অপ্রয়োজনীয় ঈশ্বরে অবিশ্বাসী আমি মেনে নিয়েছিলাম- ঈশ্বর বড়ো সুরেলা, বড়ো মধুর, আমি স্থির করেছিলাম- ঈশ্বরের আরেক নাম গীতবিতান; কিন্তু এখানে শেষ হলো না- কারণ কেবল ভালোবাসতে পারাটাই অহঙ্কার নয়; তাই নির্দয় প্রশ্নে বিদ্ধ করেছি তাঁকে, বহুবার বাতিল করেছি তাঁর বহু সৃষ্টি, কতোবার মনে হয়েছে বিশ্ব-যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে তিনি অকেজো, বড্ডো সেকেলে; তারপরও বৃষ্টি এসেছে, আমার নাগরিক জীবনের চৌকাঠ ডুবে গেছে বন্যার জলে; এবং তিনি আমাকে উষ্ণ করেছেন, আমাকে অর্থবহ করেছেন; লোকাল বাসে ঝুলতে থাকা আমার দীনতাকে তিনি চিত্রকলায় পূর্ণ করেছেন, তিনি আমাকে ভালোবেসেছেন, এমনকি তাঁর বই বেঁচে যখন কিনেছি বিদেশী সিগেরেট কিংবা গিয়েছি পানশালায়- তখনও; তিনি আমার সমস্ত জীবনালোকের পুষ্পসার, আমার নক্ষত্রলোকের ক্রিস্টালে তিনি বন্দী, উদ্বায়ী এবং জ্বলছেন- তিনি রবীন্দ্রনাথ; আমার আকাশ।