কিছুদিন আগে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন স্যারের সম্পাদিত ও সংকলিত একটি বই পড়ছিলাম। ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ শিরোনামের দুই খণ্ডের এই বইটির বিষয়বস্তু যেমন গুরুত্বপূর্ণ ও নতুন গবেষণার জন্যে অনুপ্রেরণামূলক, তেমনি নানাবিধ চিন্তা ও বিশ্লেষণে ঋদ্ধ তার ভূমিকা অংশটুকু। ভূমিকার শুরুর দিকে বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তৃতার কথা উল্লেখ করে মামুন স্যার লিখেছেন— ‘…একবার একটি বক্তৃতায় শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছিলেন যে, ১৯৭৫ সালের পর আওয়ামী কর্মীরাই মার খেয়েছে, মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছে এবং বারবার ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি উচ্চারণ করেছে। আওয়ামী লীগ থেকে তো বঙ্গবন্ধুকে আলাদা করা যায় না। কিন্তু এটি ভাবা ভুল হবে যে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে দলীয়করণ করেছে। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নন, তিনি সবার’। যদিও তথ্যসূত্র না থাকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যটির দিন তারিখ বা স্থান খুঁজে পাইনি এবং আপাতদৃষ্টিতে সেটি খুব একটা গুরুত্বপূর্ণও নয়। তবে বক্তব্যের যে অংশটি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে, তা হলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই অনিবার্য ঘোষণা— ‘বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের নন, তিনি সবার’। এই অমোঘ সত্যটিই বাঙালির মানস-দর্শন। বঙ্গবন্ধু সকলের— সকল দল, মত আর পথের ঊর্ধ্বে সমস্ত মানুষের এক অনন্য অভিধানের নাম ‘বঙ্গবন্ধু’।
বর্তমানের এই অস্থির সময়ে বিরাজমান রাজনৈতিক- সামাজিক দুর্বৃত্তায়নের কারণ অনুসন্ধানে ব্রতী হতে হলে অতি অবশ্যই পুনর্বার মুখোমুখি হতে হবে আমাদের ইতিহাসের এবং পাঠ করতে হবে বঙ্গবন্ধুর অমিত রাজনৈতিক আখ্যানের পাণ্ডুলিপি। তখনই আমরা বুঝতে পারি, বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য লালিত ইতিহাস অনুসৃত মুক্তিযুদ্ধের দর্শন থেকে আমাদের পদস্খলনই আজকের পরিস্থিতির কারণ। এই পদস্খলনের একটি যেমন মুক্তিযুদ্ধের পথ ধরে হাঁটা বাংলাদেশের পঁচাত্তর-উত্তর সময়ে নষ্ট পাকিস্তানি রাজনীতির কানাগলিতে পথ হারানো; অন্যটি হলো বাংলার কাদা-জলে মাখা গণ-মানুষের ঘামে-আদরে-ভালোবাসায় গড়ে ওঠা শ্যামলসুন্দর বঙ্গবন্ধুকে দর্শনের আকাশ থেকে রাজনৈতিক জানালায় বন্দী করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রতিটি রাজনৈতিক দল যেমন এর দায় এড়াতে পারবে না, তেমনি সাধারণ মানুষ হিসেবে আমরাও পারবো না নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকতে।
এই বাংলার মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পাঠশালা। তিনিও ছিলেন বাংলার আপামর জনসাধারণের চোখে তাদের প্রত্যাশার প্রপাত। চল্লিশের দশক থেকেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অভিযাত্রার যে ইতিহাস আমরা দেখি, তার পুরোটাই ছিলো গণ-মানুষ সংশ্লিষ্ট। মানুষের অধিকারের সঙ্গে থেকে, বলা ভালো, একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের জন্যে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা তাকে তিনি রাজনৈতিক বাস্তবতায় রূপ দিয়েছিলেন। সে-ই সংগ্রামে তিনি যে কেবল বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, তা-ই নয়; তাদের মানসকাঠামোও তিনিই নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। তাই স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য মানুষের বিস্মৃত জাতিসত্তাবোধকে তিনি জাগিয়ে তোলেন। যে জাতীয়তাবাদের ধারণায় তিনি আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বর্ণমন্দিরে, তা ছিল বিশ শতকের আধুনিক, উদার নৈতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবোধ। দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের মূর্ত চিত্র হিসেবে আমরা পাই বাহাত্তরের সংবিধান। কিন্তু যে প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো তারা কি দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার জন্যে বঙ্গবন্ধুকে সহযোগিতা করেছিলো? ১৯৭২-৭৫- এর শাসনামলের খতিয়ান দেখলে তা মনে হয় না; বরং খুব বেশি করে মনে হয়, তত্কালীন প্রজন্ম রাতারাতি সব হয়ে যাওয়ার দিবাস্বপ্ন দেখেছিলেন। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশকে পুনর্গঠিত করার জন্যে যে সময় প্রয়োজন, সে সময় তারা বঙ্গবন্ধুকে দেননি। আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয়ও কম ছিল না। পাকিস্তান ফেরত বা পাকিস্তানি ভাবাদর্শের অনেককেই প্রশাসনসহ নানা রাষ্ট্রীয় কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিলো। সুতরাং নবগঠিত বাংলাদেশেই বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের নীল নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। এরই মধ্যে ছাত্রলীগে ভাঙন ধরে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র আর মুজিববাদের দ্বন্দ্বে। সবখানেই দেখা যায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী; কিন্তু এই নেতাকর্মীরা যে সকলেই দলের আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করেছিলেন— এমন নয়। বরং এদের মধ্যে ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগিদের সংখ্যাই ছিল বেশি। পঁচাত্তরে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর আমরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কোনও প্রতিবাদের ইতিহাস পাই না। তত্কালীন অবৈধ সামরিক সরকারের বর্বরতা এর একটি কারণ কিন্তু তবুও যে প্রতিবাদগুলো তখন হয়েছে, তার প্রায় অধিকাংশই হয়েছে সাধারণ মানুষের উদ্যোগে। তলা কুড়ানিরা তখন দল বেঁধে ঘাতক জিয়ার মন্ত্রীসভায় ঠাঁই নিচ্ছে। পঁচাত্তর পরবর্তী এই বাংলাদেশবিরোধী রাজনীতিই কি তবে বঙ্গবন্ধুকে আমাদের কাছ থেকে দূরে নিয়ে গেলো? কথাটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়; কারণ, তখনও আওয়ামী লীগের বাইরে একটি বৃহৎ প্রগতিশীল রাজনৈতিক ধারা বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল ছিল। অবশ্য এদের অনেকেই রঙ বদলাতে শুরু করে, এবং ক্রমশই আমরা দেখতে পাই ১৯৭২-৭৫ সময়কালের রাজনীতি কী নির্মমভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতার কাছে। তাই আজ যখন আমাদের দেশে কার্যকর গণতন্ত্রহীনতার আলোচনা ওঠে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা ওঠে; তখন এ প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক— কেন বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ধারাকে টিকিয়ে রাখতে পারলেন না পরবর্তী রাজনৈতিক নেতারা? এই প্রশ্নের উত্তরটি খুঁজতে গেলেই আমরা আবিষ্কার করি এক নিষ্ঠুর সত্যকে। আমরা বুঝতে পারি, একজন বঙ্গবন্ধু ও তার মাত্র কয়েকজন সহযোদ্ধা ছাড়া আর কেউ-ই আসলে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের জন্যে বঙ্গবন্ধুর দর্শনটি বুঝতেই পারেননি অথবা চাননি। সুতরাং ক্ষমতার উত্তাপ পাওয়ার জন্যে পঁচাত্তরের পর তারা সামরিক ও মোল্লাতন্ত্রের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে রাজনীতি করেছে। সময়ের বিবর্তনে জিয়ার ভাগাড় থেকে এরশাদের ভাগাড়ে স্থানান্তরিত হয়েছে। নিজেদের স্বার্থ বজায় রাখার জন্যে দেশের ইতিহাসকে বিকৃত করেছে, রাষ্ট্রের ধর্ম বানিয়েছে এবং খুব সচেতনভাবেই সমগ্র ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার হীন ষড়যন্ত্র করেছে। এই নিদারুণ ইতিহাস বিকৃতি আর মিথ্যাচারের মধ্যে বেড়ে উঠেছে একটি প্রজন্ম। খুব সচেতনভাবেই তত্কালীন অবৈধ শাসকগোষ্ঠী তাদের মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো রাজনীতির নামে অস্ত্রবাজি আর সন্ত্রাসের বিষ। অতএব, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের কথা মনে রেখেও অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে বলছি— নীতিবোধ, মননধর্ম ও মানবিকতার সামগ্রিক স্তরে প্রায় নিঃশেষিত একটি প্রজন্মের হাত ধরে বাংলাদেশ কাগজে কলমে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। এ কথার পক্ষে আমার যুক্তি— স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনের মৌলবাদাক্রান্ত, দুর্নীতিপরায়ন ও আপোসকামীতার ইতিহাস। আমাদের প্রজন্ম বড়ো হয়েছে তথাকথিত গণতন্ত্রের কালে। কিন্তু সেখানেও ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কোনও সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হত না, যদি কালের ঝর্ণার মতোন একজন শহিদ জননী জাহানারা ইমাম রাজপথে না নামতেন। অতএব, জাতির প্রায় বিস্মৃত মৌলিক ও সত্য ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন শহিদ জননী ও গণ-আদালতের আন্দোলন। আমাদের প্রজন্ম আবছা হলেও আবিষ্কার করলো বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে। আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম— ব্যক্তির বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ অদ্বিতীয় হলেও বাংলাদেশকে খুঁজতে হবে আসলে বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর মানচিত্রে।
আমাদের জাতি চরিত্র ভরে গেছে ভোগবাদী খানাখন্দে। ব্যক্তি থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত এখন কেবলই নিজস্ব আখের গোছানোর চিন্তা। রাজনীতির মহৎ অর্থই কেবল নয়, বদলে গেছে আমাদের নানা পেশার সংজ্ঞা। শ্রমজীবী, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী এমনকি শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত এখন ব্যক্তিগত লাভ-লোকসানের চোখে রাষ্ট্রের অবস্থান বিচার করে। ফলে দলীয় চিন্তা বা ধ্যান ধারণার বাইরে গিয়ে ইতিহাসকে আর কেউ দেখতে চায় না। রাজনীতি হয়ে গেছে পুতুল কুচকাওয়াজসর্বস্ব, বুদ্ধিজীবীরা প্রায় সকলেই দলীয় সংকীর্ণতার দাস, রাজপথ জুড়ে বিভেদের কার্নিভাল, প্রতিষ্ঠান জুড়ে চাটুকারবৃত্তি। মৌলবাদের হিংস্র আষ্ফালন, মুক্তচিন্তার মানুষদের হত্যা আর দিকে দিকে সকরুণ মানবিক বিপর্যয়। এমতাবস্থায় আমরা কোথায় গিয়ে খুঁজবো আমাদের বঙ্গবন্ধুকে? দস্তয়েভস্কি বলেছিলেন যে, পুশকিন তার সমাধিতে কিছু গোপনীয়তাও নিয়ে গেছেন। সুতরাং আমাদের ফিরে যেতেই হবে বঙ্গবন্ধুর কাছে। ইতিহাসের যে অমোঘ গোপনীয়তা তিনি নিয়ে গেছেন তার কাছে হাত পাততে হবে এবং ছড়িয়ে দিতে হবে দিকে দিকে। কারণ বঙ্গবন্ধু আমাদেরই একান্ত একজন। তাকে ভালোবেসে তার আদর্শকে ধারণ করতে হলে আমাদের কোনও রাজনৈতিক দলের চৌহদ্দি মাড়াতে হয় না। বঙ্গবন্ধু মায়ের শাড়ির আঁচলে লেগে থাকা হলুদের গন্ধের মতো আপন। যে সাহস নিয়ে কোনও তরুণ প্রতিষ্ঠানের সমস্ত নষ্টামিকে জোর গলায় ‘না’ বলতে পারে, সে-ই সাহসের নাম বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু আমাদের আকাশ, কোনও রাজনৈতিক দলের ভুল বানানের পোস্টারের গুরুত্ব বাড়ানোর ফটোগ্রাফ নয়।
যে রাজনৈতিক দল মাল্টিক্লাসের দোহাই দিয়ে জামাত-বিএনপি’র সন্ত্রাসীদের দলে ভিড়ায়, যে দলের মন্ত্রীর কাছে পহেলা বৈশাখের বিভত্স যৌন নিপীড়নের ঘটনাকে কোনও বিষয়ই মনে হয় না, হেফাজতের প্রেস রিলিজ ধরে যে আওয়ামী লীগ সরকার পাঠ্যপুস্তকে চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িকীকরণ সম্পন্ন করে, অর্থের বিনিময়ে যে আওয়ামী লীগ তৃণমূলের নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপি’র কুখ্যাতদের হাতে নির্বাচনের টিকেট দেয়— সে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করে না; বঙ্গবন্ধু দর্শনের অমিত উচ্ছ্বাসকে ধারণ করার নৈতিক শক্তি তার নেই। আমরা বরং আমাদেরকেই প্রশ্ন করবো বারবার। স্মরণ করবো বঙ্গবন্ধুর সেই অবিনাশী উচ্চারণ— ‘প্রতিটি মহৎ অর্জনের জন্য প্রয়োজন মহৎ আত্মত্যাগ’ এবং প্রস্তুত করবো নিজেদের। আত্মত্যাগের এই অনন্যতাই হোক আমাদের জীবনের ইতিহাস, এখানেই নিহিত থাকুক আমাদের এপিটাফের বর্ণমালা এবং সতেরোই মার্চে জাতির পিতার জন্য নিবেদিত পঙক্তিমালা।