নিখিল তালুকদারের পিতার নাম নীলকান্ত তালুকদার। কিন্তু নীলকান্ত তালুকদারের পিতার নাম আমরা জানি না, কিন্তু নিখিল তালুকদার নিশ্চয়ই তাঁর ঠাকুরদার নাম জানতেন। আমাদের পক্ষে সেই নামটি আর জেনে নেয়া সম্ভব নয়; উল্টো ঠিকুজি-কুষ্ঠিসমেত নিখিল তালুকদারকে এই মুহূর্তে মাটিচাপা দিতে পারলেই আমাদের স্বস্তিলাভ সম্ভব। আমাদের আরামদায়ক রাষ্ট্রীয় জীবনের আলুলায়িত রোজনামচায় নিখিল তালুকদার একটি অস্বস্তির নাম। বলছি না— অহোরাত্রি তিনি আমাদের মাথার ভেতরে ঘুরছেন। এমনও বলতে চাইছি না যে, তার শব আমাদের জীবনযাপনে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমনকি এটা বলার মতো বেবোধও আমি নই যে, রামশীল গ্রাম থেকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতাল অব্দি নিখিল তালুকদারের ছুটে বেড়ানোটা আমাদের যত্নাতীত দৈনন্দিন জীবনের দরজায় প্রতিদিন কড়া নাড়ছে। আমরা তার মেরুদণ্ডের এক্স-রে প্লেটটি দেখিনি কিন্তু এ সংক্রান্ত খবরা-খবর পড়লে (যদিও বর্তমানে আমরা নিরাপদভাবে এইসব সংবাদ এড়িয়ে যেতে পারছি) মনের অজান্তেই আমরা একবার সোজা হয়ে বসি, দরকার মতো পিঠে হাত দেই এবং তৃপ্তিবোধ করি যেহেতু আমাদের মেরুদণ্ডের হাড় অক্ষত আছে। কিন্তু কোনো এক অলৌকিক কারণে এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হতে পারি না, বরং আমাদের সন্দেহের কাঁটা ক্রমাগত বড়ো হয়, খচখচ করে এবং কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই নিখিল তালুকদারকে চিতায় তুলে বিদায় করতে পারলেও আমরা রাষ্ট্রযন্ত্র অনুমোদিত শান্তিগুলি ঠিকঠাক খুঁজে পাই না। আমাদের কেবলই মনে হয়, নিখিল তালুকদার একটি নামমাত্র এবং এই ধরনের বিশেষ্য পদ গত প্রায় পঞ্চাশ বছরে অনেকবার পরিবর্তিত হয়েছে। এর ঠিকটাক হিসাবও আমরা দিতে পারি না, কারণ এই সংক্রান্ত কোনো পরিসংখ্যানই রাষ্ট্র সংরক্ষণ করেনি— এবং এই পর্যন্ত ভাবার পর আমরা আতঙ্কিত হই, পুনরায় নিজ নিজ মেরুদণ্ডের খোঁজ করি, যুগপৎ আশ্বস্ত ও আতঙ্কিত হই, নিজেদের নিখিলের জায়গায় কল্পনা করি— ‘কল্পনা’ শব্দটি শুনলে আমরা পুনরায় আঁতকে উঠি, যেহেতু আমরা কল্পনা চাকমাকেও মনে রাখতে চাই না। আমাদের সিনেমার মতো সাজানো জীবনে রাষ্ট্রীয় প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী শান্তি নেমে আসে না। কিন্তু হাবা হাসি দিয়ে আমরা রাষ্ট্রকে এই মর্মে আশ্বস্ত করি যে, আমরা ভালো আছি; উপরন্তু আমাদের মেরুদণ্ডও অক্ষত আছে, চাইলেই সেটা আপনার হাঁটুর তলায় সঁপে দেবার মতো অনুগত নাগরিক আমরা এবং আমাদের মাঝে যারা তুলনামূলক রাষ্ট্রঘনিষ্ঠ, তারা পুলিশের হাঁটুর কুশলও জিজ্ঞেস করেন। দশাসই মজবুত না হলে সেটা ঠিকঠাক আমাদের চেপে ধরতে পারবে কি? ‘শৃঙ্খলা নিরাপত্তা প্রগতি’ বিভাগের কর্তারা আমাদের জানান যে, বাজেটে তাদের হাঁটুর জোর বাড়ানোর বরাদ্দের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীদের মেডুলা অবলংগাটা অব্দি গিলে ফেলার বরাদ্দ আছে— অতএব, নিখিল তালুকদার বলে কেউ নেই, ‘পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু’ শব্দত্রয় মূলত রাষ্ট্রদ্রোহীদের প্রোপাগান্ডা এবং আন্তর্জাতিক হওয়াই যেহেতু আমাদের কর্তব্য সেহেতু নিখিল তালুকদারের চেয়ে জর্জ ফ্লয়েডের টিআরপি বেশি, এবং কভার ফটো বেশি এবং হ্যাশট্যাগ বেশি কিন্তু আমাদের মেরুদণ্ড নিয়ে, কী আশ্চর্য, আমরা এখনও দ্বিধাগ্রস্ত।
আইনের চা ও প্রয়োগের বিষকুট
চলতি বছরের গোড়ার দিকে (২৫ জানুযারি ২০২০) দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের একটি পরিসংখ্যান জানা যায়। সে অনুযায়ী, ২০১৯ সালেই সারাদেশে পুলিশের হেফাজতে ১৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান খান প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন—
সম্প্রতি উত্তরা পশ্চিম থানা ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘটনা দুটি তদন্তেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মৃত্যুর অভিযোগটি হচ্ছে আত্মহত্যা। তবে তার আত্মহত্যায় কারো প্ররোচনা রয়েছে কি না সে বিষয়টিও আমি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি। তদন্ত রিপোর্ট পেলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।১
যে ঘটনার প্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেটি ছিলো চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারির ঘটনা। নিহতের নাম আবু বক্কর সিদ্দিক বাবু; গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি) একজন কর্মকর্তা ছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তদন্তের যে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আমরা জানি না, তা বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা। পুলিশের হেফাজতে একজন গ্রেফতারকৃত যদি অসুস্থ হন বা আত্মহত্যাও করেন, সে বিষয়ে পুলিশ কর্তৃপক্ষ কি দায় এড়াতে পারেন?
পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নিজেই স্বীকার করছেন, এ ধরনের ঘটনায় তাদের দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
তবে আবু বক্কর সিদ্দিকের ঘনিষ্ঠজনরা একে হত্যা বলেই মনে করেন। এ বিষয়টি তদন্তে পুলিশ চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলো, তবে এ বিষয়ে আর কোনো সংবাদ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না এবং অন্যান্য অনেক অন্যায়ের মতো এটাও ধামাচাপা পড়ে যায়।
গত বছরের আরেকটি ঘটনাও সম্ভবত আমাদের মনে নেই। ঘটনাটির সূত্রপাত হয়েছিলো ১৬ ডিসেম্বর রাতে, নিহতের নাম আলমগীর হোসেন। পুলিশী নির্যাতনে তারও মৃত্যু হয় এবং পারিবারিক সূত্রে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে আমরা জানতে পারি, তার নামে কোনো মামলা ছিলো না।
খুঁজলে এমন অসংখ্য ঘটনা বেরিয়ে আসবে। নিকট অতীতের দু একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখপূর্বক বর্তমান কলমচি এই কথার স্বপক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে চান যে— আমরা সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোই ভুলে গেছি, সুতরাং রাষ্ট্র কর্তৃক সংগঠিত অতীত অপরাধসমূহের বিচার আমরা কী করে চাইবো?
সম্প্রতি পুলিশ কর্তৃক নিখিল তালুকদারের হত্যাকাণ্ড অতীতের হত্যাকাণ্ডগুলোরই একটি ধারাবাহিকতা। এই তথ্য অস্বীকারের সুযোগ নেই কেননা, পুলিশ হেফাজতে নিহতের সংখ্যাটি আঁতকে উঠার মতো। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে ২০১৯ সালে নিহত হয়েছেন ১৮ জন, ২০১৮ সালে ১৭ জন এবং ২০১৭ সালে ১৫ জন২। এই বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভাগীয় তদন্তের কী কী বক্তব্য ছিলো— আমরা জানি না, কয়টি ঘটনার প্রেক্ষিতে মামলা হয়েছে— তাও জানি না; এমনকি সবগুলো হত্যাকাণ্ডের ফলোআপ-নিউজও আমাদের কাছে নেই।
তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, নিখিল তালুকদারের হত্যাকাণ্ড আসলে পূর্ববর্তী হত্যাকাণ্ডগুলোর ধারাবাহিকতা। যেহেতু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক এই হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে এবং এগুলোর কোনো বিচারও হয়নি— সুতরাং যাদের মধ্যে এই অপরাধপ্রবণতা রয়েছে, তারা একে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি প্রদর্শনে কোনো কারচুপি করে না।
উপরন্তু এই অপরাধগুলো ধামাচাপা পড়ে যায়। কারণ এইসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে সমাজে দু এক দিনের বেশি প্রতিবাদও চলে না আর সবচেয়ে বড়ো কথা হত্যাকাণ্ডের শিকার যারা হয়েছেন, তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ থাকে না। উদ্যোগ না থাকারই কথা। একে তো স্বজন হারানোর বেদনায় তারা কাতর থাকেন; তার উপর পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তোলার মতো সাহস তাদের থাকে না। না থাকারই কথা— কারণ আমাদের আঙুলগুলো তো কেবল ইভিএমের বোতাম টেপার জন্য— পাঁচ বছরে একবার কাজে লাগে— রাষ্ট্রের অন্যায়-অবিচারের দিকে সেটা তাক করতে নেই, এ কথা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমাদের শিখিয়েছে।
আইন আছে তবুও পুলিশ কেনো মারে?
একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এই প্রশ্নটি যেমনই হোক এর উত্তর বেশ গোলমেলে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ কী সেটা পুলিশ অ্যাক্ট ১৮৬১-তে৩ বলা আছে। কিন্তু সেটা যদি নাও জানি, তবুও নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বিনা বিচারে কাউকে গ্রেফতারের আগে বা পরে কিংবা পুলিশ হেফাজতে নিয়ে মেরে ফেলার আইন অন্তত পুলিশের হাতে নেই। পুলিশ আইন অমান্যকারীদের আটক বা গ্রেফতার করে মাত্র, বিচার করার ভার আদালতের। তাহলে পুলিশের হাতে এতোগুলো মানুষ মারা গেলো কেনো?
এই প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাপি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ প্রায় একই রকম। যুক্তরাষ্ট্র পুলিশের হেফাজতে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের ভিডিওটি আমরা দেখেছি। নিখিল তালুকদার হত্যাকাণ্ডের কোনো ভিডিও নেই বলে এর নৃশংসতা আমরা অনুমান করতে পারি না, তা তো নয়। লক্ষ্যণীয় যে, দুইক্ষেত্রেই পুলিশ সদস্যের ভেতরে জিঘাংসাবৃত্তির প্রকট প্রভাব রয়েছে। সুতরাং এরা আইনের লোক হলেও এরা প্রত্যেকেই যেমন হত্যাকারী, তেমনি জঘন্য হত্যাকারীর সব ধরনের মনস্তাত্ত্বিক লক্ষণই তারা লালন করে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, নিখিল গোপালগঞ্জের রামশীলের কৃষক না হয়ে যদি কোনো কেষ্ট-বিষু্ব হতেন বা জর্জ ফ্লয়েড হোয়াইট সুপ্রিমেসির কোনো ধ্বজাধারী হতেন— তাহলেও কি একই রকম নৃশংসতার শিকার তাদের হতে হতো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে সমাজে নিখিলের শ্রেণিগত অবস্থান আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় এবং আমরা সম্ভবত নিজেরাই নিজেদের প্রতি থু থু ছিটিয়ে দেই, কেননা নিখিলের বিষয়ে আমাদের প্রতিবাদও শ্রেণিকাঠামোগত দোষে দুষ্ট। তার ওপর সাম্প্রতিক ডিজিটাল আইন নামক কালাকানুন সম্বন্ধে আমরা একইভাবে ভুক্তভোগী এবং চতুর সাবধানী— সুতরাং গোপালগঞ্জের চেয়ে মিনিয়াপোলিস বরং ভালো!
জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গণমাধ্যমে ইতালিয়ান আইনজীবী ফেবিও আনসেলমোর (Fabio Anselmo) দেয়া একটি বিবৃতি আমরা স্মরণ করতে পারি—
Their lives are considered less important
ইউরোনিউজকে দেয়া এই বিবৃতি থেকে আমরা নিখিলের হত্যাকারী পুলিশ সদস্য এ এস আই (সহকারী উপ-পরিদর্শক) শামীম হাসানের মানসিকতা অনুমান করতে পারি। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে— এগুলোর কোনো বিচার হয় না এবং বিভাগীয় তদন্ত বলে যেটা চালানো হয়, সেগুলোও আলোর মুখ তেমন দেখে না।
আরেকটি কথাও বলে রাখা ভালো যে, প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে আমাদের চতুরতাও পুলিশ হেফাজতে পরবর্তী অন্যায় মৃত্যুটির জন্য দায়ী। এই কথা আমরা বুঝি হয়তো কিন্তু বলতে বড়ো বাধে!
নিখিল হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মামলা, বিচার বা দফারফা
কৃষক নিখিল তালুকদারকে হত্যার বিষয়ে ০৭ জুন তার ছোটো ভাই মন্টু তালুকদার বাদী হয়ে কোটালীপাড়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার এফআইআর নম্বর- ০১, তারিখ: ০৭/০৬/২০২০ এবং পেনাল কোডের ধারা ইউ এস ৩০২/৩৪। এ এস আই শামীম হাসান এবং তার সহযোগী রেজাউলকে গ্রেফতারও করে পুলিশ।
আপাতদৃষ্টিতে অপরাধী এখন পুলিশের হেফাজতে কিন্তু আমাদের সংশয়ের কারণ বিদ্যমান। আমরা সকলেই জানি ২০১৩ সালে ৫০ নং আইন হিসেবে একটি আইন প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ সরকার যার নাম নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩। আইনটি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে লেখা হয়েছে—
যেহেতু ১৯৮৪ সালের ১০ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার অথবা দণ্ডবিরোধী একটি সনদ স্বাক্ষরিত হইয়াছে; এবং
যেহেতু ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর স্বাক্ষরিত দলিলের মাধ্যমে উক্ত সনদে বাংলাদেশও অংশীদার হইয়াছে; এবং
যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করিয়াছে; এবং
যেহেতু জাতিসংঘ সনদের ২(১) ও ৪ অনুচ্ছেদ নির্যাতন, নিষ্ঠুর, অমানবিক ও লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড অপরাধ হিসাবে বিবেচনা করিয়া নিজ নিজ দেশে আইন প্রণয়নের দাবি করে; এবং
যেহেতু বাংলাদেশে উপরিউক্ত সনদে বর্ণিত অঙ্গীকারসমূহের কার্যকারিতা প্রদানে আইনী বিধান প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়;
সেহেতু এতদ্দ্বারা নিম্নরূপ আইন করা হইল৪
কার্যকরী এই আইনটি থাকা সত্ত্বেও কৃষক নিখিল তালুকদার হত্যাকাণ্ডের মামলাটি কেনো পেনাল কোডের আওতায় করা হলো? কার্যকরী একটি আইনকে পাশ কাটিয়ে যাবার অর্থই তো দূরভিসন্ধিমূলক। তাহলে কি আমরা ধরেই নিতে পারি, এই আইনটিতে যেনো মামলা না হয়— সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপতৎপরতা পুরোদমে ক্রিয়াশীল?
কেনো ক্রিয়াশীল, সেটা জানতে হলেও আমাদের একটু অতীত ঘাঁটতে হবে।
সরকার এই আইনটি প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এর বাতিল চেয়ে আসছে। ২০১৭ সালে পুলিশ সপ্তাহ উদ্বোধন করতে গেলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছেও তারা এই মর্মে দাবি উত্থাপন করেন। আবার ২০১৯ সালের খবরের কাগজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তিন বছরে পুলিশ হেফাজতে ২০৫ জনের মৃত্যু ঘটলেও মামলা হয়েছে হাতেগোনা।
এই সমস্ত বিষয় একটি কার্যকর আইনকে কীভাবে নিহতের পরিবারের কাছে ভয়ের উৎস করে তুলছে, তা আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। কৃষক নিখিল তালুকদারের ক্ষেত্রেও ঘটনা তাই ঘটেছে। সুস্পষ্ট আইন থাকতেও ৩০২ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে— অর্থাৎ শুরুতেই আইনের ফাঁক চিনিয়ে দেয়া হয়েছে।
পাঠক ইতোমধ্যেই অবগত আছেন যে, নিহত নিখিলের পরিবারের সাথে পাঁচ লক্ষ টাকার একটি সমঝোতার খবরও গণমাধ্যম আমাদের জানিয়েছে। সেক্ষেত্রে এই প্রশ্নটি উঠতেই পারে— তবে আর আমাদের কথা বলে লাভ কী?
আমাদের কথা বলা দরকার, কারণ নিখিলের পরের ব্যক্তিটি কে আমরা জানি না— সে আমি, আপনি, আমরা যে কেউই হতে পারি। সেক্ষেত্রে আমরা নিজেদের প্রশ্ন করতে পারি, পাঁচ লক্ষ টাকার আউট অব কোর্ট সেটেলমেন্টে আমরা কতোখানি তুষ্ট হতে পারবো।
এবং শেষ পর্যন্ত যেনো এই সত্যে নিজেদের কাছে সৎ থাকতে পারি— ‘আউট অব কোর্ট’ সেটেলমেন্ট আসলে ‘নেসেসিটি অব কোর্ট’-কেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। সেক্ষেত্রে ব্যক্তিজীবনে বা বিবৃতিতে আমরা যেনো কোনোদিন আদালতের মুখাপেক্ষী না হই।
সাম্প্রতিক সময়ের নিখিল তালুকদার কিংবা জর্জ ফ্লয়েড বা অতীতের এমন নাম জানা বা না-জানা অনেক মানুষ প্রতিদিন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যান কতোটা আত্মপ্রবঞ্চক আর অসভ্য আমরা।
এই হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার আমরা চাই, কারণ, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে যেনো এই লজ্জা বহন করতে না হয়।
তথ্যসূত্র
১. পুলিশ হেফাজতে এক বছরে ১৬ মৃত্যু, দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫ জানুয়ারি ২০২০
২. বেড়েই চলেছে পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, ডয়েচে ভেলে, ২৫ জানুয়ারি ২০২০
৩. পুলিশ অ্যাক্ট ১৮৬১ সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী পাঠক এই লিঙ্ক থেকে পড়তে পারেন।