এক আশ্চর্য অগ্রহায়নের সন্ধ্যা তার সবটুকু বিষণ্নতাকে ছুটি দিয়ে একান্তই আমাদের হয়ে গিয়েছিলো। নগরীর জ্যাম ঠেলে গ্যালারি টোয়েন্টি ওয়ানে এসে আমরা দেখলাম জীবনের গায়ে রৌদ্র মাখাতে গেলে কার্যত পেরিয়ে আসতেই হয় স্যাঁতস্যাঁতে উঠোন এবং পুনর্বার তার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু কথাটা যতো সরল তার বাস্তবায়নের ইশতেহার ততোটা কঠিন। কেননা শেষ পর্যন্ত জীবনের সংজ্ঞা, বলা ভালো নিজের কাছে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করা, মোটেই সহজ নয়। বর্ণিল আলো, মায়াবী মুখ, প্রেসের ক্যামেরা আর মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাসের মতোন বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য— এসবই নিতান্ত তুচ্ছ হয়ে যায়; বরং সমকালীন আর চাক্ষুষ চোখে এক অপ্রাকৃত স্বপ্ন আত্মবিভাজনের খেলাকেই ক্ষণজীবী ও ক্ষীণজীবী করে তোলে। না, শিল্পীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তিনি হয়তো তাঁর ভূমিকা বদলের অভিজ্ঞতার কথা শোনাতে চেয়েছিলেন। এবং এও সত্য যে, আমার একলার বিবেচনাই মুখ্য নয়; তবুও আমার দেখার চোখ যদি মিথুন আহামেদের ইমেজ-নিরপেক্ষ আত্মবিভাজনের খেলাকে অতিক্রম করে খুঁজে পায় তার লুকোনো ধ্বনিপথ, যে পথে একদিন আমি সেতুবন্ধনের চেষ্টা করেছিলাম প্রত্ন-সময়ের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ের— তবে এর জন্যে কিছুটা ধন্যবাদ শিল্পী এবং তাঁর শিল্পগুলো ভাগাভাগি করে নিতেই পারেন। অতএব, আপাত চোখে এ লেখা হয়তো শিল্পীর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যটি পূরণ করবে না; কিন্তু দিনের ঘৃণ্যতা, নির্বোধ লোভের গ্লানি আর অনর্থক স্বার্থের দহন কী করে তুচ্ছ হয়ে যায় এক জোড়া চোখের ইতস্তত হাসিতে— সে আমি মিথুন আহামেদের প্রদর্শনীটিতে না এলে জানতামই না। অতএব প্রদর্শনীটি মিথুন আহামেদের, কিন্তু এ আমার ঘরে ফেরার এক ঐতিহাসিক আয়োজন। মানবিক শ্রম আর স্বপ্নের ওড়াওড়িতে সেদিন আসলে আমিই একা জয়ী হয়েছিলাম। ইতিহাসের আগুনে পুড়ে যেতে যেতে আমি যে চোখের দিকে তাকিয়ে উন্মুল প্রবেশ করেছিলাম বোরহেসের গল্পে সে-ই চোখের কী অলৌকিক পুনর্আবিষ্কার! আমি তো জানতাম, আমার চক্ষুদান কেবলই সম্ভব ওই চোখের দিকে তাকিয়ে। আমি হঠাৎ বুঝতে পারি, বস্তুত সেদিনই প্রথম বুঝতে পারি, মিছিলের মতোই জীবনের উপপাদ্যেও প্রেম থাকে আর তাকে অর্জুনের একাগ্রতা দিয়ে বিচার না করলে উদ্বাস্তু হয়ে যেতে হয়। এই বোধ প্রদর্শনীটিকে হঠাৎই নিয়ে যায় ইতিহাসের কাছে। আর এই ইতিহাস অবশ্যই স্বনির্মিত নয়, এমনকি নয় শিল্পীরও নিজস্ব— বরং তা উদ্ভাসিত এবং চূড়ান্তভাবে নির্মিত সে-ই মাদল বাজা সন্ধ্যা রাগের হাতে। তিনি হয়তো বা সন্ধ্যার মিতা, কিংবা বহুকালের প্রতীক্ষা জড়ানো স্ক্রীনের আলোতে ফুটে ওঠা রক্তকরবী, যিনি ঐহিত্যের সমানুপাতে রূপকল্প জুড়ে দিয়েছিলেন সমগ্র প্রদর্শনীতে; কিন্তু আমাকে টেনে নিয়েছিলেন তাঁর অপার্থিব চলনে। সুতরাং, গোটা প্রদর্শনী সম্বন্ধে আমার যেটুকু কথা তার দৈর্ঘ্য এর চেয়ে বেশি হবার নয়।
তাহলে আমি কী দেখছিলাম আর কেনোই বা ছিলাম প্রদর্শনীর শেষ অবধি? এ কথা বহু পুরোনো যে, যা দেখছি বা দেখা যাচ্ছে, তা কখনোই শিল্পের সমাপিকা ক্রিয়াকে প্রশ্রয় দেয় না। খুব আটপৌরে শাদামাটা যে কোনো কিছুকে শিল্প করে তোলে আসলে ইতিহাস। সময় আর ইতিহাসের এই হাত ধরাধরি করে পথ হাঁটার গল্পে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেন কেউ কেউ— বস্তুত তিনিই নির্মাণ করেন গোটা শিল্পকে। অবশ্য এ দেখার চোখ সকলের নেই, থাকাটাও বাঞ্ছনীয় নয়। এ হলো সে-ই বীজমন্ত্রের মতো, যা থাকে অমিত রায়ের মুখে আর লাবণ্যের কানে। আমি বোধ করি সে-ই আশ্চর্য শিল্পস্রষ্টার দিকেই মুখ ফিরিয়েছিলাম এবং মুহূর্তেই ভীষণ অর্থপূর্ণতায় ঋদ্ধ হয়ে উঠলো গোটা আয়োজন; আলো ছড়িয়ে এবং কিছু আলো নিভিয়ে তিনি আসলে গোটা আত্ম-বিভাজনের খেলায় খুব গোপনে সৃজন করেছিলেন। প্রসঙ্গত আমরা মোনে করতে পারি আন্দ্রেই তারাকোভস্তিকর সেই বেহালাসর্বস্ব চলচ্চিত্রটিকে। চারপাশে কঠিন বরফ আর জীবনহীন শ্বেত শুভ্রতার মাঝেও আমরা কী আশ্চর্য জীবন্ত দেখেছি মায়াকোভস্কির কবিতাকে। অতএব দর্শক মানুক বা না মানুক, শিল্পী জানুক বা না জানুক সেদিন গ্যালারি টুয়েন্টি ওয়ানে বোদলেয়ারের আশ্চর্য মেঘমালার মতোন কেউ একজন ছিলেন। আমি যুগপৎ ভাগ্যবান এবং ভাগ্যাহত হয়ে তাঁকে আবিষ্কার করি; নিনাদে-আর্তনাদে খুঁজে পাই এপিক থেকে এপিটাফ অবধি জীবনের স্রোত।
তুমুল বাদ্যে যখন শিল্পী ভাঙছেন (বা ভাঙার চেষ্টা করছেন), ক্যানভাসগুলো কখনো কখনো সরে যাচ্ছে, নড়ে যাচ্ছে; অনেকে তাকিয়ে আছেন কিংবা ভাবছেন অথবা শামিল হতে চাইছেন এই ভাঙার খেলায়; আলোর প্রক্ষেপ নিয়ন্ত্রণহীনতার উর্ধ্বে চলে যাচ্ছে এবং এরই মাঝে তুমুল বিদ্রোহী এক জোড়া চোখ তার হাসির কাব্যে মুক্তিযুদ্ধের মতোই বিদ্রোহ করে উঠলো। এই বিদ্রোহটুকুই এ প্রদর্শনীর শেষ কথা। বিভাজনের বিরুদ্ধে আসলে ঐক্যের পায়রা। আমাদের জাতীয় জীবন থেকে ব্যক্তিজীবন পর্যন্ত সবখানেই তুমুল বিভাজন। ভাঙতে ভাঙতে আমরা ছোটো হচ্ছি। এ ভাঙন কেবলই আমাদের চলার পথকে একলা করে দিচ্ছে। স্বাধীনতার পর বাঙলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির মধ্যে যতোগুলো ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে, বিপক্ষ অপশক্তি ততোই ষড়যন্ত্রে চৌকোষ হয়েছে। একাত্তর থেকে ২০১৫— বামপন্থী শক্তির ভাঙন ধরেছে উনিশবার। বিপরীতে মৌলবাদী শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে এবং আমাদের রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতার দরুন এরা ক্ষমতাতেও এসেছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই প্রসঙ্গগুলো মিথুন আহামেদের প্রদর্শনী ব্যাখ্যায় গুরুত্বপূর্ণ কি না। আমি শিল্প সমালোচক নই; মিথুন আহামেদ আমাকে আমার অনুভূতি লিখতে বলেছেন। খুব মোটা দাগে আমার অনুভূতি হলো— আত্মবিভাজনের যে খেলা মিথুন আহামেদ ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সর্বত্র, তাতে তিনি সম্পূর্ণ পরাজিত হয়েছেন। দীর্ঘকাল দেশে না থাকার কারণেই হোক আর শিল্পকে ব্যক্তিগত আয়নার প্রতিবিম্ব হিশেবে বিবেচনার কারণেই হোক— তিনি বুঝতে পারেননি, ভাঙতে ভাঙতে আমরা আসলে ক্লান্ত। আমাদের এখন সৃজন প্রয়োজন, প্রয়োজন ঐক্যের।
সুতরাং আত্মবিভাজনের খেলা শুরু হলেই আমি তাঁকে দেখি— প্রথমে বামদিকে, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন সামান্য ঘাড় কাৎ করে, যেনো নিবিড় অরণ্যে আসলে স্মৃতিচারণ করছেন প্রাগৈতিহাসিক বিদ্রোহের ইশতেহার; এবং আমি মোনে করতে পারি প্লাসোলিনির চলচ্চিত্র দর্শনকে, যেখানে তিনি দস্তয়ভস্তির সঙ্গে মেতে উঠেছিলেন অলিখিত সংলাপে এবং সৃজনে। মুহূর্তকাল পরেই তিনি মাঝামাঝি কোথাও এসে দাঁড়ান, বস্তুত আমার মুখোমুখি— তাঁর দুটি হাত পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ— কী আশ্চর্য! আমার মোনে পড়ে বুনুয়েল থেকে তারান্তিনো অবধি সিনেমাকরিয়েদের যাঁদের প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রে দ্ব্যর্থবোধকভাবে এসেছে আলিঙ্গনাবদ্ধ হাতের কোলাজ প্রমিথিউসদের পুনরুত্থানের গল্পের মতোন। অনেকটা সময় আমি তাঁর দিকেই তাকিয়ে থাকি এবং মন্তব্যবিহীনভাবে দেখতে পাই আমাদের পুরাঘটিত বর্তমানকালকে। তারপর তিনি খানিক স্থান বদল করেন আর তাঁর একটি দীর্ঘ ছায়া পড়ে অগোছালো ক্যানভাসের শরীরে। আমি নিশ্চিত হই ভাঙনের বিরুদ্ধে সৃজনের বৈপ্লবিক বিজয়ে। বাদ্য থেমে যায়, কোলাহল থামে না; প্রদীপগুলো নিভে যায়, কিন্তু তার পুড়ে যাওয়া সলতের কান্না থামে না; শূন্য ক্যানভাসগুলো পূর্ণ হয়, কিন্তু তার রক্তক্ষরণ থামে না। এরপর একটি এক্সট্রিম ক্লোজ আপ শটে আমি তাঁর মুখোমুখি দাঁড়াই। তাঁকে অভিননন্দিত করি মোনে মোনে। এরপর তিনি চলে যান।
তাঁর প্রস্থানটি আগমনের মতোই ঐতিহাসিক। ১৩০৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে লেখা একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ শকুন্তলার বর্ণনা দিতে গিয়ে তাঁকে তুলনা করেছিলেন কোমগান্ধারের সঙ্গে, ১৯৫০ সালে বিষ্ণু দে ‘নাম রেখেছি কোমলগান্ধার’ কাব্যগ্রন্থে সে-ই ইতিহাসেরই একটি নতুন সংজ্ঞায়ন করেছিলেন, ১৯৬০ সালে ঋত্বিক ঘটক আরেক অর্থে ইতিহাসেরই পুনর্বিন্যাস ঘটিয়েছিলেন তাঁর ‘কোমলগান্ধার’ চলচ্চিত্রে। ২০১৫ সালে বোসে এই তিন সৃষ্টির মাঝে একটি সরলরেখা আঁকার চেষ্টা করলে অনেকেই হোঁচট খাবেন। আমিও খেতাম, যদি না সেদিন আমি মুখোমুখি হতাম তাঁর এবং একই সঙ্গে দেখতে না পারতাম তাঁর চোখ এবং হাসির অনস্বীকার্য কাব্যকে। অতএব, ইতিহাসের সে-ই লুকোনো বিন্দুটি আমি সেদিন আবিষ্কার করেছিলাম, অন্তত সে-ই অর্থে শিল্পী মিথুন আহামেদের এই প্রদর্শনীটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আর বাকি যা কিছু, কেবলই কথার কথা।