ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক— বইয়ের সঙ্গে কিন্তু আমাদের জীবনের অনেকখানি সময় কাটে। কেউ বই পড়তে ভালোবাসেন, কেউ বই বেঁচতে ভালোবাসেন। আজকাল অবশ্য একটি সৌখিন শ্রেণি তৈরি হয়েছে, যারা বই সাজিয়ে রাখতে ভালোবাসেন। বিষয়টি চমকপ্রদ। বই আমাদের চিন্তার সৌন্দর্য বর্ধনের সঙ্গে সঙ্গে ঘরেরও সৌন্দর্য বর্ধন করছে। উপযোগিতা বাড়ছে। এটাও তো একটি প্রাপ্তি। স্কুলে পড়ার সময় নতুন বছরে নতুন ক্লাশে গিয়ে দেখতাম ক্লাশরুম রঙ করা হয়েছে। একবার দেখলাম রঙ করে আবার বিখ্যাত মনীষীদের উক্তিও লেখা হয়েছে। তো সেখানেই একটি উক্তি ছিলো প্রতিভা বসুর নামে— “বই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ আত্মীয়, যার সঙ্গে কোনোদিন ঝগড়া হয় না, মনোমালিন্য হয় না”। আমি জানি না, উক্তিটি প্রতিভা বসুরই কি না, বা হয়ে থাকলেও তিনি ঠিক এমনই বলেছিলেন কি না। তবে এই ঝগড়া না হওয়ার ব্যাপারটায় ‘বই’কে তখন আমার খুব নিরীহ গোবেচারা টাইপের মোনে হয়েছিলো। কিন্তু বড়ো হতে হতে মোনে হলো ধারণাটা ঠিক নয়। যে ঝগড়া করে না, তার অন্য কোনো ফন্দি নিশ্চয়ই আছে। রবীন্দ্রনাথ প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনের কথা বলেছিলেন, কিন্তু বইয়ের ফাঁদ পাতা ভুবনে না পড়লে বোধ করি স্বয়ং রবিঠাকুরও ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারতেন না। তা এই যে বই— ফোঁসফাঁস, ঢুসঢাস, উৎপাত কিছুই করে না, আবার দুধভাতও চায় না— অথচ তাকে নিয়ে আমাদের উৎসব, মেলা, ডিসকাউন্ট, কপিরাইট, ভ্রু কুঁচকানো, সাতান্ন ধারা.. .. মানে রাজ্যের আদিখ্যেতা। বই পড়ে কতো লোকে কতো কিছু জেনেছেন, বই লিখে কতোজন বিখ্যাত-অমর-নন্দিত-নিন্দিত হয়েছেন, বই বেঁচে কতোজনে কতো কিছু করে ফেললেন কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে খুব চালাকি করে বই নিজেকে বইয়ের বাইরেই রেখে দিলো। ব্যাপারটা জটায়ুর ভাষায় ‘হাইলি সাসপিশাস’।
এটা যেহেতু ভাবা যাচ্ছে না যে, কোনো এক শীতের সকালে গরোম চায়ের সাথে ধুম করে বই এসে হাজির হলো আমাদের কাছে, সেহেতু বইয়ের একটি ইতিহাস আছেই। পৃথিবীর নানা প্রান্তে গড়ে ওঠা প্রাচীন সভ্যতাগুলো থেকে সেই ইতিহাস খোঁজা যেতে পারে। মানবসমাজে প্রথম বই এসেছে সুমের সভ্যতার হাত ধরে। ইতিহাসের বইয়ে আছে, সভ্যতা প্রথম গড়ে উঠে উত্তর অফ্রিকায় ও এশিয়ায়। পশ্চিম এশিয়ায় ছিলো টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদী। নীলনদটা ছিলো উত্তর আফ্রিকায়সময়টা তখন খ্রিস্ট জন্মের আগে প্রায় চার হাজার বছর। এশিয়ার এই দুটো নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিলো সুমের সভ্যতা। এখন কেমন ছিলো সেই সুমের সভ্যতার প্রথম বই? পোড়া মাটির পাতে উৎকীর্ণ ছিলো চিত্রধর্মী লিপি। একেকটা অক্ষর একেকটা ছবি। এই টালিগুলোই ছিলো বই। নলখাগড়া কেটে তৈরি হতো কলম। তখন কিন্তু ‘লেখা’ মানে ‘আঁঁকা’। এই কিছুদিন আগে শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক স্বকৃত নোমানের ফেসবুক পোস্টে দেখলাম, দীর্ঘদিন ধরে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করে তা প্রকাশকের হাতে তুলে দেবার পর লেখকের যে বেদনা, তার প্রকাশ। পরিশ্রমী সাহিত্যিকগণ মাত্রেই অনেক সময় নিয়ে থাকেন একটি ভালো সাহিত্য সৃষ্টিতে। এখন স্বকৃত নোমান সুমের সভ্যতায় থাকলে কিন্তু অতো সময় পেতেন না। কারণ নরোম মাটির টালি শুকিয়ে গেলে তাতে আর লেখাই যেতো না। সুতরাং আজকের দিনে পাণ্ডুলিপি দিচ্ছি দিবো করেও যে লেখকরা সময় মতো পাণ্ডুলিপি দিচ্ছেন না, প্রকাশকরা তাঁদের ক্ষেত্রে সুমের সভ্যতার উদাহরণ দিতে পারেন। আবার লেখকরাও প্রকাশিতব্য বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রসঙ্গে প্রকাশকের চেক বইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। এই ‘বই বনাম চেক বই’ ব্যাপারটিও কিন্তু বইয়ের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। আশুরবিনপাল ছিলেন সিরিয়ার রাজা। তিনি রাজত্ব করতেন খ্রিস্টজন্মের ৬৫০ বছর আগে। তাঁর গ্রন্থাগারে কুড়ি হাজার মাটির টালির বই পাওয়া গেছে। এসব বই তিনি তৎকালীন প্রচলিত মুদ্রা ব্যবস্থার বিনিময়েই লেখকদের দিয়ে লিখিয়ে সংরক্ষণ করতেন। সুমের সভ্যতার নিদর্শন স্বরূপ নিনেক শহরেও একটি গ্রন্থাগার পাওয়া গেছে। মহাকাব্য, ইতিহাস, জ্যোতিষ প্রভৃতি বিষয়ে বই ছিলো সেখানে। বাগদাদের পুরাতাত্ত্বিক সংগ্রহশালায় দুটো মাটির ফলক রয়েছে। ১৯৮৪ সালে সিরিয়ার তেল বার্ক নামক স্থানে এই দুটো ফলক পাওয়া গেছে। পুরাতাত্ত্বিকদের মতে, ওই ফলক দুটো পৃথিবীর প্রথম বইয়ের দুটো পৃষ্ঠা। প্রাচীন মিশরীয় মানুষ তাদের বই তৈরি করতেন প্যাপিরাসের ছাল ব্যবহার করে। প্যাপিরাস থেকেই ‘পেপার’ কথাটি এলো। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে প্যাপিরাসের পরিবর্তে পার্চমেন্ট ব্যবহূত হতে শুরু করে। পশুর চামড়া থেকে পার্চমেন্ট তৈরি হতো। মানুষ পাথরের গায়ে খোদাই করেও বই লিখেছেন। পিরামিড তার সবচেয়ে বড়ো নিদর্শন। আমাদের উপমহাদেশে রাজা অশোক প্রজামঙ্গলের অনেক কথাই পাথরে খোদাই করে লিখে গেছেন। পাথরের বইয়ের একটি গল্প আছে সৈয়দ শামসুল হকের। গল্পটা বললাম না, তাঁর ‘বই পড়া ভারি মজা’ বইয়ে গল্পটা পাওয়া যাবে। এছাড়াও পারস্যের মানুষ কাঠি দিয়ে বালির উপর লিখে রাখতেন।
বই ছাপার আদি প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিলো কাঠের ব্লক তৈরির মধ্য দিয়ে। এভাবে ছাপানো প্রথম বই বুদ্ধের স্ক্রোল। পনেরো শতকে জার্মানির স্বর্ণকার জোহেন্স গুটেনবার্গ সর্বপ্রথম অ্যান্টিমনি ও সীসার শঙ্কর ধাতু থেকে বর্ণমালা তৈরি করে ছাপাযন্ত্র তৈরি করলেন। সেখান থেকে বের হলো বাইবেল। তাঁর পদ্ধতিতে ১৯০টি বাইবেল ছাপতে তিন বছর সময় লেগেছিলো। বাঙলা বই বহুকাল হাতে লেখার যুগে ছিলো। সেটা আমাদের ইতিহাসে পুঁথির কাল। এরপর তা মুদ্রণে গেলো। পার্থক্য হলো— হাতে লেখা পুঁথি একনাগাড়ে লেখা হতো, মুদ্রণ পর্যায়ে এসে তা পঙক্তি বিবেচনায় সাজানো হলো।
বই সম্বন্ধে খোঁজ-খবরে এইসব বিক্ষিপ্ত ইতিহাস ‘বই’ আকারে বের হয়নি খুব বেশি। এটাও বোধ করি আপাত নিরীহ বইয়েরই কারসাজি। কল্পনাতে বইকে কোনোদিন সংবর্ধনা দেয়া হলে তার শংসাপত্রে লিখতেই হবে— এই প্রচারবিমুখ নিভৃতচারী ‘বই’ সকলকে প্রচারের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজে বোসে বোসে মজা লুটছেন। আসুন সংবর্ধনার মাধ্যমে আমরা তার মাথায় একটু কাঁঠাল ভেঙে খাই।