প্রিয় বর্ষা,
এই যে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার লাইনটি বদলে দিয়ে তোমাকে লেখা চিঠির শিরোনাম বানালাম—এও কোনো এক দাক্ষিণ্যের জোরে। শহরের উঁচু তলার ঘরগুলোতে আজকাল থাকার জায়গার বড্ডো অভাব। হাজার স্কয়ার ফিটে মানুষ আর আসবাবপত্রের পর তেমন আর কিছু জোটানো যায় না। ফলে কাগজওয়ালার কদর বাড়ে। আমরা যেখানে থাকি, তার ঠিকানা তোমার এড্রেস বুকে নেই। আমাদের পাড়ার রফিক চাচা বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাগজ কিনে আনেন। কোনো এক উঁচু তলার বাসিন্দা, হয়তো অতিরিক্ত ভেবেই বিক্রি করেছিলেন শক্তির পদ্যের একটি বই। পোকায় খাওয়া বইটি রফিক চাচা কতো দিয়ে কিনে এনেছিলেন, আমার জানা নেই। সেখানেই পেলাম কবিতাটি। শক্তি লিখেছেন—“ভারি ব্যাকুল বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে”। আমি বড্ডো অবাক হয়েছি। কী করে হয় এমন? বুকের মধ্যে তুমি কী করে ঝরতে থাকো অবিরল? কই, আমরা তো কোনোদিন টের পাইনি। আমরা পেটের মধ্যে তোমাকে টের পাই। খালি পেটে পানি খেয়ে একটানা বসে থাকলে টের পাই পাকস্থলিতে মেঘের গর্জন। আমাদের একটানা জীবনে কোনো টিফিন টাইম নেই—জানো তো? দাক্ষিণ্যের জোরে আমাদের যা হবার হয়। এই যে এখন তোমাকে লিখছি, এ-ও তোমারই করুণা। ক্লান্ত হয়ে খানিক থেমেছিলে তুমি, আমিও অমনি কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়লাম। না হলে যখন তুমি ঝরো অবিরল, তখন তোমায় চিঠি লিখবো না তোমায় সামলাবো?
আমাদের ঠিকানা তোমার কাছে নেই বলে এই চিঠি পেয়ে তুমি থমকে যেতে পারো। সে-ই কবে থেকে বহুযুগের ওপার হতে তুমি আসছো কেবল নাম জানা কতোগুলো ঠিকানার পায়ে ভর করে। কেনো বাপু! তোমার কনটাক্ট লিস্টটা আপডেট করতে পারো না? তুমি কি ভাবো, লোকে এখনও তোমায় নিয়ে কালিদাসের মতো কেবল মন্দাক্রান্তা ছন্দেই কবিতা লেখেন? কতো কতো ছন্দে এখন তোমার নামকীর্তন চলে। আর তুমি? সে-ই কালিদাসের উঠোন পেরিয়ে ঠাকুরবাড়ির চিলেকোঠা অবধি থেমে রইলে। তাই বলছি, আমার চিঠিটা পাবার পর একটু ভেবে দেখো। দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেছে; পরমাণুর গন্ধ বুকে নিয়ে হিরোশিমা নাগাসাকি নির্ঘুম চোখ মেলে আছে—তা-ও অনেক দিন হয়ে গেলো। তোমার বুঝি এসব ভাবতে নেই? তুমি বুঝি এখনও পূর্বমেঘ আর উত্তর মেঘেই সীমাবদ্ধ? এই যে ফি বছর তুমি আসছো আর তোমায় নিয়ে গীতবিতানওয়ালাদের আদিখ্যেতা; বলি এতে তোমার মন ভরে? তোমার গন্তব্য তো আর অলোকায় থেমে নেই। এই বাঙলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে তুমি কেমন স্বচ্ছন্দ নেচে বেড়াও। তোমায় গান শুনাতে কতো কতো আয়োজন চারপাশে; কিন্তু তুমি জানো কি, এই গান শুনিয়েরা সকলেই দাঁড়িয়ে থাকেন আমাদের অনেক অনেক ওপারে। আমাদের সঙ্গে তাঁদের সম্বন্ধ পাণিণি ও তাঁর টীকাকারের সম্বন্ধের মতোন—আমাদের যাবতীয় দুর্দশার টীকা ও ভাষ্য তারা তৈরি করেন এর বাইরে থেকে। তাই এঁরা যখন গায় ‘আবার এলো যে আষাঢ়’ আমরা তখন অসহায়ের মতো রাস্তার পাশে আমাদের খুপরি ঘরের ছেঁড়া তেরপলের ফুটো মেরামতে নেমে যাই। আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া নেই, তাই হয়তো তুমি জানো না এসব কিছুই।
বর্ষা তুমি জানো—যখন তোমার ঝুম বর্ষণে কারও কারও মনে হয় ‘আজি যেমন করে গাইছে আকাশ’, তখন আমাদের চুলোয় হাড়ি উঠে না বাবা কাজে যেতে পারেননি বলে। আমার বাবা একজন দিনমজুর। আমার বাবার মতো আরও কতো বাবারা আছেন, যাঁরা সারাদিন তোমার অবিরল বর্ষণের দিকে তাকিয়ে থাকেন নিথর চোখে। কতো বাবারা হয়তো সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে রিকশা টানেন, টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে তোমার ক্লান্তির প্রার্থনা করেন। তুমি বা তোমার উঁচু তলার সমঝদারেরা সে সত্যটুকু জানেন না। তাঁদের কাছে তুমি মানে আগেই নির্ধারণ করে রাখা বৃষ্টির প্লে-লিস্ট, চুলায় চড়ানো ভুনা খিচুরি আর প্রেশার কুকারে মৃদু রোম্যান্টিক শিস।
তুমি তো অবিরল ঝরেই যাও। কতো কতো লোক তোমায় নিয়ে শখের পদ্য লেখে ফেসবুকে, তার কিছু হয়তো জানো তুমি। কিন্তু তুমি জানো না, আমরা আগে বরং একটু আড়াল পেতাম। তখন আমাদের নিবাস ছিলো বহুদিন ধরে নির্মাণ হতে থাকা মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের তলা। আজকাল সেখানে আর থাকতে পারছি না। শুনেছি এর নির্মাণ ব্যয় বেড়ে গেছে, তাই এর নিচে থাকতে হলেও দিনে গুণতে হয় কুড়ি টাকা। জনগণই তো রাষ্ট্রের আয়ের মূল উৎস। থাক এসব কথা। তোমায় অর্থনীতি বুঝিয়ে কী লাভ? না তুমি বাজেট পেশ করো, না তুমি বাজেটে পিষে মরো।
তুমি খবরের কাগজ পড়ো? ঢাকার জলাবদ্ধতার কোনো সংবাদ আছে তোমার কাছে? টক শো, প্রতিবেদন কিছুই দেখো না নিশ্চয়ই। তোমার তো ফেসবুক টুইটারে অ্যাকাউন্টও নেই। তবে আর বলছি কেনো তোমায় ব্যাকডেটেড? রবিঠাকুরের যুগ পেরিয়েছে বহুদিন আগেই। এটা নিবারণ চক্রবর্তীর যুগ। “বাণী দাও বাণী দাও” বলে এখন আর কেউ কাকুতি করে না, এখন সকলেই বাণী দিচ্ছেন। বরং শোনারই কেউ নেই। তাই বলছি একটু আপডেটেড হও। খোঁজ-খবর নাও। বাঙালি গ্লোবালি ‘উবার’ ব্যবহার করলেও বর্ষা এলে বাঙালির ভরসা লোকাল কুবার। কুবার মানে কুবেরের বাহন। পদ্মা নদীর মাঝির কুবের। মনে নেই! খবরের কাগজ উল্টে দেখতে পারো, কীভাবে রিকশা, ভ্যান বা কখনও কখনও ভারি যানবাহন অবধি উল্টে যাচ্ছে। তুমি এলোকেশী ঝড়ো জল নিয়ে আসো কিন্তু তা হজম করতে পারে না আমাদের নগরী। অগত্যা জলাবদ্ধতা! নগর পিতার গুষ্ঠি উদ্ধার। তোমার ন্যাশনাল আইডি কার্ড নেই বলে বাঁচোয়া; নইলে নগর ভবন থেকে একটা ৫৭ ধারা ঠুকে দেয়া কোনো ব্যাপারই ছিলো না।
তুমি পাহাড়ের খবর জানো? ১৩২টি লাশ। শুনতে পাও, ১৩২টি লাশ। না জানি, তোমার তাতে দায় নেই। পাহাড়ের মাটি তো আর তুমি কেটে বেঁচো না। বনের গাছ তো আর তুমি সাফ করে দালান তোলো না। কিন্তু হয়েছে কি জানো, তোমার এই একপেশে আচরণে আমাদের মনে বারবার প্রশ্ন জাগছে—দাও ইউ বর্ষা! বর্ষা তুমিও। তুমি অ্যানার্কিস্ট না হয়ে এই যে ট্রটস্কাইডপনা শুরু করেছো—এতেই যতো সন্দেহ। না হলে তুমি কবিগুরুর বর্ষা, তোমার পেছনে লাগা কেনো বাপু!
শোনো। এই চিঠি পড়ে তোমার মনে হতে পারে, এই হলো প্রলিতারিয়েতের ম্যানিফেস্টো। ফস করে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করে বোসো না। মধ্যবিত্তের ছবিঘরেও কিন্তু আজকাল আর মেঘদূত নেই। গীতবিতান আছে—কেবল শুক্রবার ছুটির দিনে। সকালে অফিসে যাবার সময় মাথায় ছাতা ধরতে যেমন বাঙালির অরুচি, তেমনি ফেরার পথে বৃষ্টি ভেজা জ্যামে বাঙালির আর যাই হোক, রোম্যান্টিকতা নেই। সুতরাং এ হলো নকশালপন্থার মেঘদূত। ছাতা মাথায় চারু মজুমদার কখনও হেঁটেছেন—এমন কথা শোনা যায়নি।
প্রিয় বর্ষা। আমাদের যাপিত জীবনটা অন্যরকম। তুমি যাদের জন্য অবিরল ঝরে যাও, ওদের মতো টরেন্ট থেকে বিষণ্নতা নামাই না আমরা। আমাদের বিষণ্নতা জমে থাকে রোজগারের রোজনামচায়। উনুনে ভাতের হাড়ি চাপালে একটা কেমন গন্ধ হয়—ভাতের গন্ধ; মোটা চালের ভাত, তা কেনার পয়সাও এখন জোটে না আমাদের। ওই ভাতের গন্ধই আমাদের গীতবিতান, আমাদের বিদ্যাপতি শতক।
আমাদের কথা যদি ছেড়েও দাও তবুও নিস্তার নেই তোমার। মধ্যবিত্তের ঝুল বারান্দায় এখন আর শ্রাবণের ধারার মতো রাত্রি মাখা স্বপ্ন ঝরে পড়ে না। আবগারি শুল্ক আলপিন দিয়ে গাঁথা আছে সেখানেও। সুতরাং এক হিশেবে তুমি এখন হয় গুটি কয়েকের হার্ড ডিস্কে রাখার বর্ষা, না হয় তুমিও রবীন্দ্রনাথের মতো একা। পথে যেতে যেতে আমাদের দল ভারি হচ্ছে। এটা সুসংবাদ না দুঃসংবাদ—সে জানি না। গ্যাসের দাম বেড়েছে, বাজারের মূল্য তালিকাও বাড়তির দিকে। জিডিপি’র তালিকা ধরে দরবেশ আর ফকিরের পার্থক্য ঘুচানো গেলো কই? মধ্যবিত্তও এখন আর মধ্যবিত্ত নেই। হয় উচ্চবিত্ত ইতর হয়ে গেছে, না হয় নিম্ন-মধ্যবিত্তের খাতায় নাম লেখিয়েছে। সুতরাং তুমি বুঝি আর আমাদের হয়ে রইলে না।
একটা কথা বলি তোমায়! হয়তো বিরক্ত হবে, তবুও ভেবে দেখো। একবার, কেবল একবার তুমি আসবে আমাদের প্রতিনিধি হয়ে। গীতবিতান থেকে নয়, আমাদের দুঃখবিতান হবে তোমার উদযাপন মন্ত্র। কেমন আশ্চর্য জাদুকরি বর্ষণ হবে সেবার—ভেসে যাবে সব উঁচু উঁচু দালান, সরকারি ভবন, উপাসনালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিচারালয়, সেনানিবাস। ভেসে যাবে সব রাজনৈতিক ছেনালী আর রাজনীতিবিদ্গণের মুখোশ। কেবল শুকনো আর রৌদ্রময় থাকবে গ্রন্থাগার, শিশুদের খেলার মাঠ, শ্রমিকের শ্রমের বাজার, কৃষকের মাঠ, কবিদের কবিতা। সারা বাঙলার কৃষকেরা সেদিন ত্রাণ-সামগ্রী বিতরণ করবেন। শ্রমিকেরা তাঁদের একদিনের মুজুরি দান করবেন গণভবন আর বঙ্গভবন মেরামতের জন্য। কোমর পানি ডিঙিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসে দাঁড়াবেন ত্রাণের লাইনে।
না থাক। অতো কিছু দরকার নেই। তার চেয়ে বরং তুমি জাদুকর হও। আমাদের ভাতের হাড়িটা ভরে উঠুক শাদা ভাতে। মায়ের আনা বাসি তরকারি দিয়ে আমি পেট ভরে ভাত খাবো। তারপর তুমি ঝুম ঝরতে থাকবে, আমি তাতে ভিজবো। আমার শরীরের প্রতিটি অঙ্গে জড়াবো তোমার স্পর্শ।
একবার, জীবনে একবার আমি ভরপেটে তুমুল বর্ষায় ভিজতে চাই।
ইতি
তোমাকে আড়াল করবো এমন ছাদ নেই যাদের— তারা।