এক আকাশ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে খালি পেটে চেরাপুঞ্জীর পথে রওনা হবার পর আমরা আবিষ্কার করলাম— ক্ষুধা ব্যাপারটি হয়তো আপেক্ষিক কিন্তু চা সত্যিই পরম। আমাদের ড্রাইভার রামজী জানালেন— যাবার পথেই চমত্কার খাবার দোকান আছে আর সে দোকানের সামনে পৌঁছে আমরা বুঝলাম— খাবার হোক যেনতেন, চা হোক ভালো। দোকানের মালিকের নাম সুনীল; শুনে আমার মনে হলো— প্রকৃতির ভালোই রসিকতা! আকাশ ভরা মেঘ, ঝুম বৃষ্টিতে শীতের কাঁপুনি আর এদিকে চা বিক্রি করছেন সুনীল বাবু। চেরাপুঞ্জীর পথে পথে মেঘেদের লং মার্চ, বৃষ্টির একটানা বিউগল— আমাদের গাড়ি চলছেই। রামজী বুঝে উঠতে পারছেন না কোন গান ছাড়বেন, আমরাও বুঝে উঠতে পারছি না কার গান শুনবো— আমাদের প্লে-লিস্টে দেবব্রত বিশ্বাস, গুলাম আলী আর সুচিত্রা মিত্র, প্রকৃতির প্লে-লিস্ট জুড়ে কেবল বৃষ্টির সুর— মন্দ্র-মধ্য আর তারায় সে আছড়ে পড়ছে চেরাপুঞ্জীর পথে পথে। ফেরার পথটাও তাই— একেবারে বৃষ্টি-মেঘের চচ্চড়ি। শিলং শহরের হোটেলে যখন ফিরলাম— আমরা তখন কাকভেজা না হলেও আধভেজা। আর কী শীত সে রাতে! গোটা রাত বৃষ্টির সানাই আর আমাদের শ্বাসকষ্ট-সাইনাস-মাথাব্যথা— তাপমাত্রা তখন ১২ ডিগ্রি ছেড়ে আরও নিচে নামতে চাইছে। কী নির্লজ্জ তাপমাত্রা!
এইসব স্যাঁতস্যাঁতে পাঁচালী নিয়েই আমাদের রাত ভোর হলো। শিলং শহরটা তখনও ভিজছে। আমরা যখন কোথাও বেড়াতে যাই— আমাদের সঙ্গে টিকামেট, অ্যাজমাসল, অ্যাবেটিস— এরাও বেড়াতে যায়। সুতরাং তাদের সদ্ব্যবহার করা হলো। এদিকে বৃষ্টিরও যেনো খানিক ক্লান্তি এলো— একটানা তিনদিন ধরে ঝরছে তো ঝরছেই। এবার বুঝি তার আপন খেলার পথ ক্লান্তিতে জুড়ালো। আমরা হেঁটে হেঁটে শিলং শহরটা দেখছি। গুগল ম্যাপ আমাদের বলছে— এদিকে যাও, ওদিকে যাও— আমরা যাচ্ছি। বৃষ্টি ফিরতি ট্রেন ধরলো বলে শিলং শহরটা যেনো জেগে উঠেছে। শহরের মানুষেরা নানাকাজে বেরিয়ে পড়েছেন। ট্র্যাক্সি ড্রাইভারদের হাঁক শুনে মনে হলো— এখানকার এতো মানুষ গোহাটি যান কেনো? রবীন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারে গেলাম, তার পাশেই ব্রাহ্মসমাজের একটি ছোট্ট গেস্ট হাউস। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই পাঠাগারে যাবার পথ দেখিয়ে দিলেন। গিয়ে দেখি সবকিছু এলোমেলো— বই-পত্তর, ছবি, কিছু কাগজপত্র— সব; কেবল রঙিন কাগজে ছাপানো একটি বিজ্ঞপ্তি আছে ঝকঝকে— Donate something for this library. পৃথিবীর কোনো গ্রন্থাগারকে ডোনেট করার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। বাক্সে কতগুলো নোট ফেলে দিলেই কি গ্রন্থাগারের ঋণ শোধ হবে? হবে না। রবীন্দ্রনাথের একটি আলো ঝলমলে ভাস্কর্যের সামনে জীর্ণ গ্রন্থাগারটি যেনো একবিংশ শতাব্দীতে বেঁচে থাকা রবীন্দ্রনাথ। নামে আছেন অথচ সর্বনামে নেই; উদযাপনে আছেন অথচ আদর্শে নেই।
সন্ধ্যা পেরোতেই শহরের ব্যস্ততা যেনো আরও বেড়ে গেলো। পাহাড়ি ঢলের মতো মানুষ ফিরছেন বাজারে-দোকানে-ফুটপাতে। আমাদেরও শিলং-এর রাত ফুরোবে। আমরা রাতের বুকে কান পেতে বসে রইলাম— কেবল মনে হয়, বৃষ্টির শব্দ পাই, অথচ বৃষ্টি নেই। এই বৃষ্টিহীনতার পথ ধরেই একটা রোদ-চশমা পরা সকাল এলো। আমাদেরও শিলঙের রাস্তা ফুরোলো। ট্যাক্সি ধরে আমরা চলছি লাইলুমের পথে— আসলে বৃষ্টি বাড়ির নেমন্তন্ন সেরে যাচ্ছি মেঘের বাড়িতে। মেঘেরা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের। এই যে পথটি দেখলাম মাত্র, মুহূর্তেই তা মেঘের আড়ালে চলে গেলো। ধূসর-রঙা একটি গাঢ় চিত্রনাট্য মুহূর্তেই হালকা শাদায় বদলে গেলো, পাল্টে গেলো সংলাপ— আর গলদঘর্ম হয়েছে আমাদের লেন্সের ফোকাসের মটর। সবখানে অটো-ফোকাস চলে না। ফোকাল পয়েন্ট বদলাতে থাকে বারবার— কখনও ফোরগ্রাউন্ড হারিয়ে যায় তো ব্যাকগ্রাউন্ড চোখ মারে, কখনও ল্যান্ডস্ক্যাপ লুকিয়ে থাকে মন-ভুলানো দৃশ্যের সিঁড়িতে।
এরপর যে যাত্রা— তা যেনো অশেষ। এবার আর আমাদের ড্রাইভার রামজী নন, তাঁরই পরিচিত বিজয়। বিজয় নেপালের মানুষ। ওর ভাঙা বাঙলা আর আমাদের যাচ্ছেতাই হিন্দী— দিব্যি আড্ডা চালিয়েছি আমরা। আমাদের যাত্রার শেষ লক্ষ্য সোনেংপেডেং— একটা পাহাড়ি গ্রাম— উংগট নদীর কূল ঘেঁষে। সে কী রাস্তা— একেবারে মনে রাখার মতো। যেখানে থাকবো, সেখানে যেতে হলে যে কটা সিঁড়ি ভাঙতে হয়— ঢাকায় এসব বললে আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতাম। পাহাড়ি নদীর তীরে একটা টুপ করে নেমে যাওয়া সন্ধ্যা আমাদের চোখের পলকে রঙ পাল্টে নিলো। দু একটি বিচ্ছিন্ন দল এদিকে ওদিকে বসে নিজেদের ভাষায় গান গাইছেন। কেউ কেউ আবার যন্ত্রে গান শুনছেন। আমরা ভাষা বুঝি না কিন্তু এটুকু তো জানি— পৃথিবীর সব ভাষাতেই একটি সুর থাকে। আমরা তো আসলে ভাষায় ততোটাই সীমাবদ্ধ, সুরে যতোটা সীমাহীন।
মানুষের যাত্রা তো শেষ হয়— হবারই কথা! শিলং শহরে আমরা যে হোটেলে ছিলাম— তার ম্যানেজারের নাম সাঈদ আহমেদ। আসামের মানুষ। কথায় কথায় শেষদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এনআরসি’র বিষয়ে। জানালেন— উনার নাম নেই। তারপর একটু হেসে বললেন— ক্যায়া ফারাক পরতা হে ভাই।
তাই তো! পার্থক্য কোথায়? বাংলাদেশে অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়, ভারতে হত্যা করা হয় সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে। আমরা ভাবি— আমাদের কী? পৃথিবীর নানা প্রান্তে আদিবাসীদের ওপর চলে নির্বিচারে আধিপত্যবাদ— আমরা ভাবি— আমাদের তাতে কী? বুলেট-বেয়নেটে শিশু হত্যা চলে পৃথিবীতে— আমরা হয়তো ভাবি— আমাদের শিশু নিরাপদে আছে। অথচ সাঈদ আহমেদ জানেন— ক্যায়া ফারাক পরতা হে!
পৃথিবী বিপন্ন হলে— ‘আমি ভালো আছি’ বাক্যটিও বিপন্ন। কোমায় থাকা পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে— ‘আমি বেঁচে আছি’ বাক্যটিও আসলে নিষ্প্রাণ। ঘাড় উঁচু করে শেষবার মেঘালয় পর্বতমালার দিকে তাকিয়ে কেবল এ কথাগুলোই মনে হয়েছে। মনে হচ্ছে। মনে হতেই থাকবে।