এই লেখাটিকে নানাভাবে সাজানো যেতো। কারণ এই ‘নানাভাবের’ বিন্যাস লেখাটি দাবি করে। হতে পারতো- সাতচল্লিশ সালের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত হওয়া দুটি রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ক্যামিস্ট্রি সম্বলিত একটি বর্ণনা, এখানে থাকতে পারতো চৈতন্যলোকের সাথে সাক্ষাৎ মানবতাবাদের একটি যৌগিক কাঠামোর বিন্যাস এবং নিঃসন্দেহে, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ যে একটি অসাধারণ অসাম্প্রদায়িক আখ্যানকেন্দ্রীক এক অনন্য মহাকাব্য- তার একটা সবিস্তারে বর্ণনা এখানে থাকতে পারতো। আর অবশ্যই লেখার শেষে ঘোষণা করা যেতো- মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপ্রসূত এই অসাম্প্রদায়িক ভাবধারা বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংগ্রামেরই মূল সুর। একে অস্বীকার করা মানে শাশ্বত বাঙালিত্বকেই অস্বীকার করা। যতোদূর আন্দাজ করতে পারি, এই লেখার মন্তব্যগুলোতে ব্লগারগণ হয়তো নব্য রাজাকার সংজ্ঞায়নের প্রয়াস পেতেন, যদিও এরই মাঝে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করতেন- বিষয়টি বায়বীয় এবং অমূলক।
কিন্তু এসবের কিছুই আসলে করা যাচ্ছে না। তীব্র ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও না, হয়তো ইচ্ছেটাও নেই। আপাতত এইটুকুই থাকুক- পুরো বিষয়টায় পড়ে আসছি।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পেছনের কারণগুলো বাঙালি মাত্রেই জানা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙলা তখন আকাশমুখী ভিসুভিয়াস। সাতই মার্চ হয়ে ওঠে কিংবদন্তীর ক্যানভাস। এরপরের ঘটনা সবাই জানেন।
কিন্তু পাকিস্তান সরকার কী করেছিলো? সেটাও জানেন সবাই। ইয়াহিয়া ছিলো নিষ্ঠুর অমানবিক এক যাদুকর- সভ্যতা ধ্বংসের এক নীল কারিগর। সে কিন্তু চালটা ধরেই রেখেছিলো। পঁচিশে মার্চ জঘন্যতম গণহত্যার মাধ্যমে ইয়াহিয়া সরকার বাঙালিকে দাবার ছকে চেকে ফেলে দিলো। জানোয়ারটা ভেবেছিলো বাঙালির খেলা শেষ, কারণ রাজাকার-আলবদর-আলশামসসহ দৈনিক সংগ্রাম তখন ইয়াহিয়াকে কানে কানে বললো- হুজুর বাঙালির ক্যাসলিং করার মুরোদও শ্যাষ!
আহাম্মকেরা বুঝতেই পারেনি- বাঙালি আসলে গেরিলা পদ্ধতিতে খেলবে- ওইখানে ঘোড়ার আড়াই চাল মানে একজন যোদ্ধার আড়াই ব্যাগ রক্ত, গজের কোণাকোণি মানেই মৃত্যুকে চোখ মেরে ‘অপারেশন সাকসেসফুল’। বোড়ের এক ঘর মানেই মানচিত্রজুড়ে মুক্তাঞ্চল আর বাতাসে কান পাতলেই ‘জয় বাংলা’। এভাবেই পঁচিশে মার্চে পাকিস্তানি আর তাদের দোসরদের দেয়া চেকটা বাঙালি একই বছরের ষোলই ডিসেম্বর মেট করে দিয়েছিলো। চেক মেট- রেসকোর্সের ময়দানে নিয়াজির নতমুখে প্রস্থান আর প্রগাঢ় স্লোগানে প্রকম্পিত বাঙলা- জয় বাংলা।
রেসকোর্স ময়দানের নাম বদলে গেছে। আজকে সেখানে গেলে অনেক দৃশ্যই চোখে পড়ে। আজকালের মধ্যে যাঁরা যাবেন তাঁরা পূজার আনন্দ দেখতে পাবেন। কারণ পাশেই রয়েছে রমনা কালী মন্দির ও শ্রী শ্রী মা আনন্দময়ী আশ্রম। একাত্তরের সাথে যাদের রয়েছে নিবিড় সম্বন্ধ। ঊনিশশো একাত্তর সালের ছাব্বিশে মার্চ সকাল এগারোটার দিকে পাকিস্তানি সেনারা এই আশ্রমে প্রবেশ করে। পুরো আশ্রম ঘেরাও করে এরা লোকজনদের আটকে রাখে- বের হতে দেয় না কাউকে। সে সময় এই পিশাচদের সাথে ছিলো পুরোনো ঢাকা থেকে ১৯৭০ এর নির্বাচনে পরাজিত মুসলীম লীগ প্রার্থী পাকিস্তানি সামরিক জান্তার অন্যতম দোসর খাজা খায়েবউদ্দিন। প্রধানত এই হিংস্র জানোয়ারের তৎপরতায়ই ২৭ মার্চের গভীর রাতে রমনা কালী মন্দির ও শ্রী শ্রী মা আনন্দময়ী আশ্রমের হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়।
২৭ মার্চ গভীর রাতে সান্ধ্য আইন চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মন্দির ও আশ্রম ঘেরাও করে। সেনাবাহিনীর সার্চ লাইটের আলোতে গোটা রমনা এলাকা আলোকিত হয়ে যায়। তারপরই শুরু হয় গুলিবর্ষণ। রমনা কালীমন্দিরে প্রবেশ করে প্রতিমা গুঁড়িয়ে দেয় এই অসভ্য বর্বর সেনাবাহিনী। তারপর গোলাবর্ষণ করে- মন্দির ও আশ্রম পরিণত হয় এক ধ্বংসাবশেষে।
সেখানেই তারা হত্যা করে রমনা কালী মন্দিরের অধ্যক্ষ স্বামী পরমানন্দ গিরিকে। ইতিহাস পাঠে জানা যায়- এই সাধক মৃত্যুর আগে আশ্রমের অন্যান্যদের উদ্দেশে বলে গিয়েছিলেন- আমি তোমাদের বাঁচাতে পারলাম না, কিন্তু আশীর্বাদ করি- দেশ স্বাধীন হবেই।
রমনার কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমে একাত্তরের শহিদদের তালিকা
১। শ্রীমৎ স্বামী পরমানন্দ গিরি
২। রঘু লাল দাস
৩। ধীরেণ লাল ঘোষ
৪। শ্রীমতি লক্ষ্মী চৌহান
৫। হীরা লাল পাশী
৬। বাবু লাল
৭। সূর্য
৮। রাম গোপাল
৯। সন্তোষ পাল
১০। সুনীল ঘোষ
১১। মোহন দাস
১২। রাম বিলাস দাস
১৩। জয়ন্ত চক্রবর্তী
১৪। বিরাজ কুমার
১৫। ভোলা পাশী
১৬। বাবু লাল দাস
১৭। গণেশ চন্দ্র দাস
১৮। সরষু দাস
১৯। বসুন্ত মালী
২০। শৈবল্লি
২১। কিশোরী ঠাকুর
২২। বারিক লাল ঘোষ
২৩। বাবুল দাস দ্রুপতি
২৪। বাদল চন্দ্র রায়
২৫। ত্রিদিব কুমার রায়
২৬। রামগতি
২৭। শিব সাধন চক্রবর্তী (সাংবাদিক)
২৮। পুরণ দাস
২৯। মানিক দাস
৩০। বিভূতি চক্রবর্তী
৩১। নান্দু লাল
৩২। সরোজ
৩৩। রাজকুমার
৩৪। গণে মুচি
৩৫। বলিরাম
৩৬। সুরত বল্লি
৩৮। রমেশ ধোপা
৩৯। বাবু নন্দন
৪০। হিরুয়া
এছাড়া ক্ষতিগ্রস্থদের তালিকাটাও বেশ বড়ো। আরোও অনেক কিছু আসলে লেখার দরকার ছিলো। মাঝে মাঝে মায়েদের দিকে তাকিয়ে ভাবি- আমাদের মায়েদের বয়স হয়ে যাচ্ছে। তাঁদের সন্তানেরা অক্ষম, অস্থির আর প্রতিনিয়ত ভ্যাবলামার্কা একটা চেহারা নিয়ে খবরের কাগজ পড়ে। খবরের কাগজের বড়ো পৃষ্ঠা জুড়ে ছাপা হয় জামাত-শিবিরের ফোকাস কোচিং-এর ভর্তি বিজ্ঞাপন। সংবাদ ছাপা হয় এই মর্মে যে- জামায়াতে ইসলামী এখন নতুন কৌশলে আগাচ্ছে- ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা চালাচ্ছে। দেখে দীর্ঘশ্বাস গোপন করে।
মা দূর্গা আসবেন- সত্যিই কি আসবেন? নাকি আসবেন না- বা আসলেও কি আগের মতো ‘মাতৃরূপেন সংস্থিতা’ হয়ে আসবেন? আমাদের বুড়িয়ে যাওয়া মায়েদের দিকে তাকাই- তাকাতে কষ্ট হয়, তবুও তাকাই। তাকিয়ে সাহস বাড়াই।
রমনা কালী মন্দিরে অনুষ্ঠানের সুর শুনি, গ্রন্থাগারগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের বই নেই, ফোকাসের ক্লাশে ভর্তির মহড়া, ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম উত্তরোত্তর বাড়ে কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপে টাকার বোঝা.. …ডাকসু চত্বরে প্রতি শুক্রবারে আবৃত্তির আসর বসায় সাবেক শিবির নেতা- প্রধানত মুক্তিযুদ্ধের কবিতাই পাঠ্য! তবুও লোকের কানে সন্দেহের সাহানা।
তবুও আমি সাহসের চোখে চোখ রাখি।