না। পৃথিবীতে আর কোনো কলেরা হাসপাতাল পাওয়া যাবে না, যেখানে শ্রী ঋত্বিককুমার ঘটকের রক্তবমনের চিকিৎসা হতে পারে। এই উজ্জ্বল চক্ষু মাতাল দণ্ডিত বন্দীর মতো তাঁর সৃষ্টির চাবুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সভ্যতার সদর দরজায়— এবং আমরা, এই কসমোপলিটন পৃথিবীর বাসিন্দারা, এই ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবীর শবযাত্রায় অংশগ্রহণের পূর্বে তাঁর সৃষ্টির দিকে তাকাতে পারি এবং নির্দ্বিধায় সাহসী হতে পারি এই ভেবে যে— আমাদের স্বর্গাভিযান সম্ভব।
বিপন্ন পৃথিবীর বদলে যাওয়া মানচিত্রে ঋত্বিক ঘটক ক্রমাগত আবিষ্কৃত হচ্ছেন। নিশ্চিতভাবেই আবিষ্কৃত হচ্ছেন তাঁর শিল্পের সেই ইশতেহারে— যেখানে তিনি সর্বাধিক নন্দিত এবং নিন্দিত— অর্থাৎ চলচ্চিত্রে। তারাকোভস্কির মতো তাঁর চলচ্চিত্রও স্পর্শ করেনি দু’ অঙ্কের মিলনরেখা; কিন্তু তিনি মাত্র আটটি চলচ্চিত্র নিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে দাঁড়িয়ে আছেন তপোক্লিষ্ট বোধিসত্বের মতোন। সিনেমার প্রেমে তিনি পড়েননি— এ স্বীকারোক্তি তাঁর নিজের— বরং তিনি নির্মমভাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন চলচ্চিত্রের শক্তিকে। বস্তুত রাজনীতিই ছিলো তাঁর দিগন্তরেখা, সেখানে তিনি মানবসভ্যতার ঐতিহাসিক সংগ্রামের আলো ফেলে গেছেন নিরন্তর।
সুতরাং চলচ্চিত্র ঋত্বিক ঘটকের বুড়ো আঙুলের একটি ছাপ সংরক্ষণ করে রেখেছে নিজস্ব আর্কাইভে। তাই তাঁর জন্মসাল মনে পড়লে আমাদের মনে পড়ে— সেই একই সময়ে আইজান্স্টাইন তাঁর সম্পাদনায় আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন ব্যাটেলশিপ পটেমকিনের দৃশ্য-দৃশ্যান্তরে। ঋত্বিক তাহলে যুদ্ধজাহাজ পটেমকিনের সমবয়স্ক! অর্থাৎ আমাদের সিদ্ধান্তে উপনিত হতে দেরি হয় না যে— ঋত্বিক ঘটক পটেমকিনের মতোই অজেয়। তাই আমাদের কর্তব্য এই অজেয় জাহাজটি বন্দর ছেড়ে যাবার পর তার যাবতীয় মণি-মাণিক্য সংগ্রহ করা এবং আজ যেহেতু ঋত্বিক ঘটক প্রস্তাবিত প্রতিসাংস্কৃতিক বিপ্লব ধ্বনিত হচ্ছে সর্বত্র— আমাদের আরও কর্তব্য সেগুলোর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অন্বয়গুলো পাশাপাশি মেলে ধরা।
ঋত্বিক যতোটা আলোচিত তাঁর চলচ্চিত্রগুলোর জন্য, এমনকি তাঁর নাটক বা চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রবন্ধাবলীর জন্যও; তিনি ততোটাই অনালোচিত তাঁর সাহিত্যে। চলচ্চিত্রের আধিপত্যবাদ এখানে একটি কারণ হতে পারে। কিন্তু আজ যখন মিডিয়ার ম্যাকবেথদের হাতের রক্ত মুছে নিয়েছে সময়ের রুমাল এবং আমৃত্যু প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই মানুষটি আলোচিত হচ্ছেন প্রতিষ্ঠানে-স্মরণানুষ্ঠানে-কুচকাওয়াজে— সুতরাং তাঁর সাহিত্যের ক্লাসরুমে আমরা পুনরায় ভর্তি হতে পারি। গুমোট আবহাওয়ায় হঠাৎ বজ্রপাতের মতো আবির্ভূত হতে পারে তাঁর গল্পসমগ্র— বলাইবাহুল্য, রামকিঙ্করকে নিয়ে করা তাঁর প্রামাণ্যচিত্রটির মতো এটিও সম্ভবত অসমাপ্ত। অর্থাৎ তাঁকে আবিষ্কারের কোনো সুনিশ্চিত সঞ্চারপথ এখনও আমাদের জানা নেই। দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ঋত্বিক ঘটকের গল্প গ্রন্থে মোট গল্প আছে ১৭টি কিন্তু ঋত্বিক মেমরিয়াল ট্রাস্টও নিশ্চিত নয়— এর বাইরে তিনি আরও গল্প লিখেছেন কি না। অর্থাৎ আজও তিনি অধরাই থেকে গেলেন।
এই ১৭টি গল্পে তাঁকে অনুসন্ধান করতে গেলে আমরা দেখি আমাদের শ্রম নিরর্থক হয়ে যাচ্ছে এবং তাঁকে খুঁজে বের করার প্রয়াস বারবার পরিণত হচ্ছে আমাদেরই আত্ম-প্রতিকৃতি অঙ্কনে। ১৭টি গল্পে ছড়িয়ে আছে আমাদের রক্ত পরীক্ষার প্রতিবেদন কিন্তু চিকিৎসক প্রতিটি প্রতিবেদন তৈরি করেছেন ভিন্ন পদ্ধতিতে। মেঘে ঢাকা তারা-য় যে ঋত্বিককে আমরা দেখি ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে’ গানের সঙ্গে অনায়াসে চাবুক পেটানোর শব্দ ব্যবহার করছেন নীতার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে সীলমোহর দেবেন বলে; তিনিই— আবারও বলছি— সে-ই তিনিই আকাশগঙ্গার স্রোত ধরে ও অয়নান্ত গল্প দু’টিতে অনায়াসে চলে যাচ্ছেন সুরিয়েলিজমের বারান্দায়, তাতে টেনে দিচ্ছেন ভাবালু রঙের পর্দা এবং শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছেন মুক্তির যতিচিহ্নে। আমরা হোঁচট খাই, কেননা, ছোটোগল্পের যে চিরায়ত সংজ্ঞা, তা নির্বিচার বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাহলে চলচ্চিত্রের মতো গল্পেও ঋত্বিক ভেঙেছিলেন? বা বলা ভালো ভাঙবেন বলেই তিনি এক্সট্যাসি বা ভূস্বর্গ অচঞ্চল-এর মতো গল্প লিখেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া খুব সহজ নয়, অন্তত আমার মতো সামান্য কলমচির পক্ষে তো নয়ই; কারণ তাঁর স্ফটিকপাত্র, চোখ ও কমরেড গল্প তিনটি পর পর পড়লে আমরা বিভ্রান্ত হই। সুবর্ণরেখা চলচ্চিত্রে বেশ্যালয়ে সীতার মৃতদেহ পড়েছিলো ঈশ্বরকে অভ্যর্থনা জানাবে বলে— প্রসঙ্গ না পাল্টে, সিনেমার জাম্প কাটের মতো ঠিক তার পরপরই যদি আমরা পড়ে নেই এজহার গল্পটি— একজন নির্দয় শিল্পী আমাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন মাথা উঁচু করে। আমার বিবেচনায়— বাঙলা গল্পে অতোটা নির্দয় সম্ভবত কমলকুমার মজুমদারও ছিলেন না। সুবর্ণরেখা সিনেমাটি এখনও আমাদের চৈতন্যের পর্দায় চলছে, আমরা দেখছি সিনেমার শেষদৃশ্যে এক শিশুর পবিত্র বেসুরে কণ্ঠে গান, তার ক্যামেরার লেন্সের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকা থেকে আমরা অন্য একটি প্রেক্ষাগৃহে চলমান বাড়ি থেকে পালিয়ে সিনেমার প্রায় পুরোটা দেখে চট করে ঢুকে পড়ি শিখা গল্পটিতে এবং আমাদের অস্থিরতা সমাপতিত হোক শিখার শিশু মনস্তত্বের সঙ্গে। আমাদের সম্মানিত পণ্ডিতগণ ঋত্বিকের মাদার আর্কিটাইপ নিয়ে এমনভাবে কথা বলেন, যেন ঋত্বিক ঘটক ইয়ং-এর মাদার কম্প্লেক্সকে সমূলে ঝেড়ে দিয়েছেন চলচ্চিত্রে। এটা তাঁরা করেন, কেননা ঋত্বিকের গল্প আমাদের অধিকাংশেরই অপঠিত। ফলে মাদারইজমের যে একটি বঙ্গীয় সংস্করণ স্বয়ং ঋত্বিক ঘটকই প্রণয়ন করেছিলেন, এবং তা ইয়ং-এর ধারণার সঙ্গে অনেকটাই তফাতে— এর সপক্ষে আমার যুক্তি হলো তাঁর শিখা গল্পটি।
রাজা ঋত্বিক ঘটকের আরেক নাগরিক— তবে খানিক ভিন্ন আঙ্গিকে। রাজা গল্পটি যাঁদের পড়া আছে, তাঁরা নিশ্চয়ই আমার এ মন্তব্য মানবেন না; কেননা গল্পে একজন না-বদলে যাওয়া মানুষের সঙ্গে নাগরিক চলচ্চিত্রের কোনো মিলই নেই। যাঁরা দ্বিমত করবেন তাঁদের সঙ্গে একমত হবার একটি ছল হিশেবে আমি তবে পাল্টা জানতে চাইতে পারি— তবে কি রাজা তাঁর যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’র নীলকণ্ঠ বাগচী? কারণ, এই যে বদলে যাবার প্রত্যয় নিয়েও, ভালো হয়ে যাবো বলেও রাজা শেষ পর্যন্ত বন্ধুর পকেটই কাটে— এ তো নীলকণ্ঠ বাগচীও করতেন। স্ত্রী’র সঙ্গে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন মদ খাবেন না, কিন্তু আমৃত্যু তো খেলেনই। আর নাগরিক-এর প্রসঙ্গে আমার যুক্তি, এই পৃথিবীর নাগরিকরা কি রাজার মতোই নয়? বারবার তারা বিশ্বাস করে— এবার ঠিক বদলে যাবো কিন্তু তারা আগের মতোই থাকে। তাদের বদলে যাবার ইচ্ছেটা স্বপ্ন, বদলাতে না পারার অক্ষমতাটুকু নিয়তি। রাজা গল্পের রাজাও তো তা-ই— স্বপ্ন আর নিয়তির দোলাচলে এক জটিলদোলক।
ঋত্বিকের গল্পগুলো তাহলে আত্মবলোকন— ওই বোরহেসের গল্পে যেমন থাকে? এ সিদ্ধান্তে আসা আমার মতো নগন্যের পক্ষে কঠিন হলেও আমি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি— গল্পগুলো ঋত্বিকের আমৃত্যু লড়ে যাওয়া আদর্শের আত্মজীবনী। ব্যক্তিগত কালবোশেখির দূরবীনে ঋত্বিক চোখ রেখেছেন জনতার যৌথ বসন্তের আকাশে যামিনী আর শশীর সংযোগরেখা আঁকবেন বলে। আজীবন তিনি ‘না’ বলতে পেরেছেন যাবতীয় আপোসকামীতায়, হয়ে উঠেছেন আমাদের মতো ‘বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো’ তারুণ্যের প্রত্যাখ্যানের মাতৃভাষা। এজন্যই তাঁর রক্তবমির দাগ এখনও আমরা খুঁজে বেড়াই— কী চলচ্চিত্রে, কী গল্পে বা কবিতায়।