প্রতি বছর সাতাশে ফেব্রুয়ারি এলে একবার করে ফিরে যাই ২০০৪ সালে; খবরের কাগজে প্রকাশিত প্রতিভাবান লেখক ও বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত মুখের সে-ই ছবিটির কথা মনে পড়ে। আজ ষোলো বছর পেরিয়ে গেলেও সেই রক্তের ধারা থামেনি; বরং অধ্যাপক আজাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও কতোগুলো নাম— রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়, ফয়সল আরেফীন দীপন। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর মুক্তচিন্তার আদর্শ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে আমাদের অমর একুশের গ্রন্থমেলা। প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ হচ্ছে, প্রকাশককে গ্রেফতার করা হচ্ছে, বই বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে মৌলবাদীদের ইশারায়— এক কথায়, পুরো বইমেলাকে ঘিরে ফেলা হচ্ছে আপোসকামীতার চাদরে। ষোলো বছরেও হুমায়ুন আজাদ চত্বর হিশেবে বইমেলার কোনো একটি প্রান্তরকে ঘোষণা করতে পারেনি বাংলা একাডেমি, অথচ ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের কাজগুলো আন্তর্জাতিক মানের। বইমেলা চত্বর সম্প্রসারিত হয়েছে, আলোকসজ্জা বেড়েছে; কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের চোখ দিয়ে দেখলে বোঝা যায়, প্রতি বছর কতোটা ক্লিশে আর অন্ধকারাচ্ছন্ন হচ্ছে এই বইমেলা।
অধ্যাপক আজাদের ওপর বর্বরোচিত হামলার কোনো বিচার গত ষোলো বছরেও হয়নি। ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট, বর্বরোচিত হামলার মাত্র পাঁচ মাস পর, তাঁর মৃত্যু হয়। যখন তিনি সেরে উঠছিলেন একটু একটু করে, ফিরে আসছিলেন তাঁর বইপত্র আর লেখালেখির কাছে, তখন বৃত্তি নিয়ে জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের ওপর গবেষণা করার সময় সুদূর জার্মানিতে তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। এ রহস্যের আর কোনো কিনারা হয়নি। বস্তুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হিমাগারের কোথায় অধ্যাপক আজাদের ওপর হামলা ও তাঁর রহস্যজনক মৃত্যুর মামলাগুলো রাখা আছে, তা-ও আমরা জানি না। অথচ মৌলবাদীদের এই কাপুরুষোচিত আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন সারা বাঙলার মানুষ, তৎকালীন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এখন তারা সরকার পরিচালনা করছেন, অথচ এই মামলার কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। এই বিচারহীনতার সুযোগে উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী দাঁত-নখ খিঁচিয়ে বড়ো হচ্ছে, তারা একের পর এক হামলা করছে মুক্তচিন্তার মানুষদের ওপর। ব্লগার, লেখক, গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী, প্রকাশক, শিক্ষক, গণমাধ্যমকর্মীসহ যাঁরাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপ্রসূত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য কথা বলছেন, যাঁরাই বক্তব্যে-লেখায়-সমালোচনায় সোচ্চার হচ্ছেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে, তাঁদেরই হত্যা করা হচ্ছে একে একে। ২০১৩ সালের পর থেকে এই টার্গেট কিলিং বেড়েই চলছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় জঙ্গী-সন্ত্রাসীগোষ্ঠী এসব হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বক্তব্য দিচ্ছে। তবুও তারা রয়ে যাচ্ছে আইনের বাইরে। এক ভয়াল মেঘমালার নিচে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের মতো আমাদের প্রত্যেকেরই প্রশ্ন—
আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম?
দুই
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার আগে তাঁকে নানাভাবে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিলো। ২০০৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বিএনপি-রাজাকার জোটের তৎকালীন সংসদ সদস্য যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী স্বয়ং এই হুমকি দিয়েছিলো। সংসদে ব্লাসফেমি আইন পাসের দাবিও জানিয়েছিলো এই উগ্র ধর্মব্যবসায়ি রাজাকার। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করেছেন। শাহাবাগ আন্দোলনের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধনের গণদাবির প্রেক্ষিতে এই বিচারের ক্ষেত্রে আইনের সংশোধন হয়েছে। বেশ কয়েকটি যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় হয়েছে, শাস্তি কার্যকর হয়েছে; কিন্তু রক্তের ধারা আজও বন্ধ হয়নি। আজও জামাত-শিবিরের ছাতার নিচে থাকা উগ্র ধর্মান্ধ জঙ্গীগোষ্ঠীগুলো হিংস্র ছোবল দিয়েই যাচ্ছে। ২০০৪ সালে জামায়াতের সাঈদী ব্লাসফেমি আইনের দাবি জানিয়েছিলো, ২০২০ সালে সেই একই দাবি জানাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। একই সুরে মুক্তচিন্তার মানুষদের কতল করার হুমকিই কেবল তারা দিচ্ছে না, গুপ্ত হত্যা করে তারা মেধাশূন্য করছে বাঙলাদেশকে। একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যার অসমাপ্ত কিলিং মিশন সমাপ্ত করার পথে হাঁটছে তারা। দীর্ঘ সময় ধরে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই দেখিয়েছেন জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জামাত-শিবিরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট ছয় দফার একটি জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি। কিন্তু আজ পর্যন্ত সরকার এ বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন না। রাজনীতিতে জামাত-শিবিরের সক্রিয়তার প্রমাণই হলো জামাতজীবী হেফাজতের আষ্ফালন। ধর্মকে বর্ম বানিয়ে বর্তমান সরকারের আদর্শিক ফাঁক-ফোকর দিয়ে এরা একদিকে যেমন ধ্বংস করছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, অন্যদিকে বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য, কৃষ্টি আর স্থাপত্যগুলো ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছে। পাঠ্যপুস্তক থেকে হেফাজতের দাবি অনুযায়ী যখন অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের কবিতা বাদ দেয়া হয়, তখন মূলত তাঁর অসাম্প্রদায়িক দর্শনকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে হাত মিলায় রাষ্ট্র নিজেই। আর এই সুযোগে রাজাকারজীবী উগ্র ধর্মান্ধ সংগঠনগুলো এখন আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের দিকে আঙুল তোলার সাহস দেখাচ্ছে।
এই পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। মৌলবাদীরা কেবল যে মুক্তচিন্তার মানুষদের হত্যাই করেছে তা নয়, তারা সব সময় এই মুক্তচিন্তকদের আদর্শকে মাটি চাপা দিতে চেয়েছে। অন্যদিকে রাষ্ট্র বছরের পর বছর বিচারের নামে প্রহসন করে যাচ্ছে। ফলে অপরাধীরা আরও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। গুপ্ত হত্যা, বোমাবাজী ইত্যাদির মাধ্যমে তারা সমাজে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। কিন্তু বর্তমান সরকার তো মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সরকার। তারাও কেনো পিছিয়ে পড়ছে একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে প্রতিহত করার লড়াইয়ে?
“ভোটের রাজনীতি”— রাজনীতির এই বিশেষ ধারাটি তাৎক্ষণিক হলেও দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ে এর নেতিবাচক প্রভাব ছাড়া কোনো প্রভাব নেই। যাদের হাতে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের রক্ত লেগে আছে, তারাই কিন্তু একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা, আহসানউল্লাহ মাস্টার ও শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ অসংখ্য মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক নেতা-কর্মীর হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। এরাই কথায় কথায় কতল করার হুমকি দেয়, শহিদ মিনার ভাঙচুর করে, ব্লাসফেমি আইনের দাবি তুলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে। এদের প্রতিহত করতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক লড়াই প্রয়োজন, যেহেতু আমাদের আদর্শের উৎসবিন্দু এক— মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
তিন
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ তাঁর তীক্ষ্ম সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে আমাদের মনোজগতে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছেন। তাঁর গবেষণালব্ধ কাজগুলো আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে, সৃষ্টি করেছে চিন্তার নতুন সোপান। তাঁর সাহসী প্রবন্ধগুলোও কী আশ্চর্য কবিতাময়! বাঙলা সাহিত্যে তিনি সঞ্চার করেছিলেন এমন এক আবহ, যা একই সঙ্গে চিন্তাশীল এবং স্বপ্নময়। বাঙলার রূপ যেভাবে তাঁর সাহিত্যে আলোচিত হয়েছে, সেভাবেই উন্মোচিত হয়েছে বাঙালির মানসিকতা। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে একাত্তরের পরাজিত মৌলবাদী রাজনীতি গ্রাস করেছে আমাদের প্রিয় স্বদেশকে। তিনি নিজেও তার নির্মম শিকার। তিনি ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন বইমেলা চত্বরে, অভিজিৎ রায়কেও হত্যা করা হয়েছিলো বইমেলা চত্বরেই ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি।
এক গভীর অন্ধকার অক্টোপাসের মতো আটকে রেখেছে বাংলাদেশকে। আমরা তাকিয়ে আছি কোনো এক অলৌকিক ইস্টিমার– এর প্রতীক্ষায়। আমাদের মুষ্টিবদ্ধ হাতে হুমায়ুন আজাদের কবিতার অক্ষরমালা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে নিয়ে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল এখনও হাঁটছে এক উজ্জ্বল উদ্ধারের দিকে।