একটি দীর্ণ সত্তার সাথে রঙিন প্রজাপতির মিহিন কথোপকথন- কখনো মৃদু, কখনো উচ্চস্বরে আবার কখনো বা কোনো এক প্রান্ত ছোঁয়া নদীর মতো একেবারে শান্ত কিন্তু চলিষ্ণু হয়ে চলছে সে। কিন্তু কোথায়? কোনখানে? প্রশ্নগুলো একবারের নয়, বহুবারের- বহুধারার। এই অনন্যবোধের বাতি জ্বালিয়েই জীবন পাড়ি দেয় অনন্তলোকে, কোনো ঠিকানার পানে নয়, নয় কোনো ঐশ্বরিক শক্তি বা অন্য কোনো অর্থহীনতার কাছে- জীবন পাড়ি দেয় শূন্যে, যেখানে জীবনের বোধে সামিয়ানা টানায় ধূসর ক্যানভাস।
তবে এ বোধ যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিলো না- সে কথা বেশ নির্মোহভাবেই বলা চলে। বাঙালির শাশ্বত এক চৈতন্যের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনি বোধ ও চিন্তার ঊর্ণাজালে বেঁধেছেন মানবাত্মার প্রতিটি দর্শনকে; নাহ- ভুল বললাম, বাঁধতে চেয়েছিলেন- কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেননি। তিনি স্বপ্নময়তার স্রোতে ভেসে জীবন সৌকর্যের গান গেয়েছেন। জীবনের বহুমাত্রিক ধারাকে কখনো প্রলয়মুখর কখনো শান্ত নদীর স্রোতের মতো তুলে ধরেছেন, কখনো অতলস্পর্শী হৃদয়মুখরতার গাম্ভীর্য থেকে তিনি খুঁজে এনেছেন মহিমান্বিত নান্দনিকতা এবং শেষ পর্যন্ত সেই নান্দনিকতার কোলেই রবীন্দ্রনাথ বস্তুত একা হয়েছেন, প্রাণময়ী উষ্ণতায় মেলে ধরেছেন জীবনের সাতরঙ। তাই রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন-দর্শন’ এর মতো তাঁর ‘মৃত্যু-দর্শন’ও গুরুত্বপূর্ণ; কেননা তিনি মৃত্যুকে দেখেছেন জীবনের ওতোপ্রতো অংশ হিশেবেই। বোধ করি, জীবনের প্রতিটি মাধুর্যমণ্ডিত মুহূর্তেই তিনি পরম মমতায় মৃত্যুর অনিবার্য শূন্যতাকে উপলব্ধি করেছিলেন; তাই ছিন্নপত্রাবলীতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
ইচ্ছে করে জীবনের প্রত্যেক সূর্যোদয়কে সজ্ঞানভারে অভিবাদন করি এবং প্রত্যেক সূর্যাস্তকে পরিচিত বন্ধুর মতো বিদায় দিই।
তবে ‘মৃত্যু-দর্শন’ শব্দটি এ লেখায় ব্যবহৃত হলেও এর তাত্ত্বিক কাঠামোগত আলোচনা হয়তো পাওয়া যাবে না। হয়তো আরও প্রগাঢ়ভাবে রবীন্দ্রনাথ পাঠ করলে সে দিকটিও উন্মোচন করা সম্ভব, কিন্তু ‘ফিলোসফি’ যতোটুকু রঙিন হবার কথা ছিলো, আপাতত সে রকম হচ্ছে না- যদিও ‘দর্শন’ শব্দটিতে ‘দেখা’ অর্থের অর্থদ্যোতনায় ‘ফিলোসফি’ও আসবে- আসতে বাধ্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) মৃত্যু-দর্শন গড়ে ওঠে তাঁর প্রায়-তেইশ বছর বয়সে লোকান্তরিতা নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু (১৮৮৪) থেকে; কবির তেরো বছর দশমাস বয়সে প্রয়াত মাতা সারদা দেবীর মৃত্যু (১৮৭৫) থেকে নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতির ‘মৃত্যুশোক’ অধ্যায়ে লিখেছেন-
আমার চব্বিশ বছর (আসলে বাইশ বছর এগারো মাস তেরো দিন) বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে-পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে। শিশু বয়সের লঘু জীবন বড়ো বড়ো মৃত্যুকেও অনায়াসেই পাশ কাটাইয়া ছুটিয়া যায়- কিন্তু অধিক বয়সে মৃত্যুকে অত সহজে ফাঁকি দিয়া এড়াইয়া চলিবার পথ নাই।১
তাছাড়া তেতালায় মাতার মৃত্যুর সময় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নিচের তলায় নিদ্রিত, বড়ো বউঠাকুরাণী সর্বসুন্দরী দেবীর মৃত্যুর (১৮৭৮) সময় কবি আহমেদাবাদে অবস্থান করছিলেন, শিলাইদহে জ্যেষ্ঠ ভগ্নীপতি সারদাপ্রসাদের মৃত্যুর (১৮৮৩) সময় রবীন্দ্রনাথ কোলকাতায় নিজের বিবাহবাসরে। কিন্তু বিয়ের মাত্র চার মাস দশ দিন পর প্রায় দুদিনের করুণ সংগ্রামে পরাজিতা (কবি যাঁকে ‘জীবনের ধ্রুবতারা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন) নতুন বৌঠানের মৃত্যু ঘটলো; বলতে গেলে, তাঁর চোখের সামনেই। রবিজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল লিখেছেন,
কাদম্বরী দেবীর চিকিৎসা বিষয়ে যে ব্যাপক ও বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় তাতে মনে হয়, সুনয়নী দেবীর বর্ণনা-মতো আফিম-সেবনের ফলে মৃত অবস্থায় তাঁর দেহ আবিস্কৃত হয়নি, তাঁর জীবনরক্ষার জন্য বহু ডাক্তার প্রাণপণ চেষ্টা করার সুযোগ পেয়েছেন.. ..৮ ও ৯ বৈশাখ (রবিবার ২০ এপ্রিল) রাত্রে বা ১০ বৈশাখ (সোমবার ২১ এপ্রিল) প্রভাতে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।২
অর্থাৎ রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বর্ণিত ও বহুল প্রচলিত ৮ বৈশাখ, ১২৯১ বা ১৯ এপ্রিল ১৮৮৪ তারিখটি তথ্য সমর্থিত নয়। মৃত্যু তারিখটি নিয়ে বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ এই যে, আত্মহত্যাকারিণীর মৃত্যু-সংবাদটি কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। সেটা না হবার কারণ হয়তো-
নূতন বৌঠাকুরাণীর মৃত্যু হওয়ায় খবরের কাগজে উক্ত সম্বাদ নিবারণ করার জন্যে ব্যয় বিঃ ১ বৌচর.. ..৫২৩।
যাহোক, কাদম্বরী দেবীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময়ে সোমেন্দ্রনাথ, দ্বিপেন্দ্রনাথ এবং অরুণেন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও শ্মশানে উপস্থিত ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের সবিস্তারে প্রত্যক্ষ করা এবং তাঁর সর্বসত্তাকে নাড়া দেয়া এই মৃত্যুটি থেকে পাওয়া প্রথম শোক অপরিশ্রুত রূপ পরিগ্রহ করে পুষ্পাঞ্জলি শীর্ষক সমসাময়িক রচনায়, যা রবীন্দ্র-রচনাবলীর সতেরো নম্বর খণ্ডের ৪৮৬-৯৬ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পাওয়া যাবে। কাদম্বরী দেবীর স্মৃতি-সুরভিত এই সব অনুচ্ছেদ, কবিতা বা গান লেখা হয়েছিলো শোকের গমকে গমকে বিভিন্ন সময়ে, তাঁর মৃত্যুর তিনমাসের মধ্যে- যদিও ছাপা হয়েছিলো এক বছর পর ভারতীর বৈশাখ ১২৯২ সংখ্যায়। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদর্শন বা তত্ত্বজ্ঞান উপলব্ধ হবার অবকাশ তখনও হয়নি বলে লেখাগুলোতে যথেষ্ঠ সাহিত্যগুণ বর্তায়নি। এ-কারণেই লেখক পুষ্পাঞ্জলিকে তাঁর কোনো গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেননি।
মৃত্যুশোকের এই ফুটন্ত ‘ইমোশন রেকালেক্টেড ইন ট্র্যাংকুইলিটি’ হয়ে প্রশান্ত রূপ লাভ করার পরেই কেবল পরিণত রচনা উপহার দিতে পারে। যেমন, পুষ্পাঞ্জলির কিছু রচনা পঁয়ত্রিশ বছর পর লিপিকার ‘সন্ধ্যা ও প্রভাত’, ‘সতেরো বছর’, ‘প্রথম শোক’-এ পরিণতি লাভ করে রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতার পূর্বসূরি বলে উদযাপিত হয়েছে। শেষোক্ত গদ্য কবিতার শেষ সংলাপটি ছিলো-
যা ছিল শোক, আজ তাই হয়েছে শান্তি ৪
এখানেই কবির বিমূর্ত সেই প্রথম শোকের, যে-শোকটি এখানে মূর্তিমতী শান্তি। শোকের এমনি শান্তিতে রূপান্তরণ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-দর্শনের একটা অঙ্গ। শান্তিরূপিণী সেই প্রথম মৃত্যুশোক কবিকে দিয়ে কাব্য রচিয়ে নিয়েছে জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। উদাহরণ, আকাশপ্রদীপ কাব্যগ্রন্থের ‘শ্যামা’ (১৯৩৮), ‘বধূ’ (১৯৩৮) এবং ‘কাঁচা আম’ (১৯৩৯) প্রভৃতি কবিতা, যা আজকের পাঠকের মনকেও স্পর্শ করে। প্রসঙ্গত, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে সম্বোধন করা এই কবিতার বইটির উৎসর্গপত্রের দুটি বাক্য স্মরণযোগ্য-
আমার রচনা তোমাদের কালকে স্পর্শ করবে আশা করে এই বই তোমার হাতের কাছে এগিয়ে দিলুম। তুমি আধুনিক সাহিত্যের সাধনক্ষেত্র থেকে একে গ্রহণ করো।৫
এই পর্যায়ে আমরা রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-দর্শনের গঠন প্রক্রিয়াটি অনুধাবন করার চেষ্টা করবো। পুষ্পাঞ্জলিতে মৃত্যুশোকের উচ্ছ্বাসটুকু বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাসের মধ্যেই উপচে পড়ে-যাওয়ার পর, থেকে-যাওয়া অবশেষটুকু গাঢ়ীভূত হতে থাকে এবং মাস দুয়েক পরেই রবীন্দ্রনাথের জীবন-মৃত্যু সম্পর্কিত প্রাথমিক ভাবনা একটা অবধারণীয় রূপ পরিগ্রহ করে ঘাটের কথা (ভারতী, কার্তিক, ১২৯১) এবং রাজপথের কথা (নবজীবন, অগ্রহায়ণ, ১২৯১) নামের দুটো গদ্য-কথিকায় (পরে গল্পগুচ্ছভুক্ত)। সুকুমার সেন লিখেছেন-
গল্প দুটিতেই বিরহিনী নারীর মৌন অন্তর্বেদনা মুখরিত। সদ্য-প্রিয়জন-বিরহী কবি এই দুই কাহিনীর মধ্যে নিজেরই অন্তর্গূঢ় বেদনার প্রতিধ্বনি তুলিয়াছেন। গল্প দুইটি রবীন্দ্রনাথের জীবনভাবনার দুই প্রধান সিম্বল বহন করিতেছে। ঘাট অচল, পথ সচল কিন্তু দুই-ই বহমান জীবনস্রোতের সাক্ষী। ৬
এই ‘অচল ঘাট আর সচল পথ’- ভাববন্ধই পরবর্তী ভাববন্ধে উত্তীর্ণ হয়েছে মাস-দশেক পরে রচিত রুদ্ধ গৃহ শীর্ষক বিচিত্র প্রবন্ধটিতে (‘বালক’, আশ্বিন-কার্তিক, ১২৯২)৭। এই ভাববন্ধটি হলো- মরণ অচল আর জীবন সচল। তবে সিদ্ধান্তের অনুসিদ্ধান্তটিই আসল। সেটি ছিলো- মৃত্যু, গতিময় জীবনের যতি হলেও, বস্তুত জীবনকাব্যের অর্থবোধক দাঁড়ি। প্রবন্ধটির পটভূমি স্মর্তব্য। জাহাজি ব্যবসা শুরু করার পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বেশির ভাগ সময় কাটাতে হতো বরিশালে। কোলকাতায় অবস্থানকালেও তাঁর প্রধান আস্তানা ছিলো মেজ বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়িটি। তাই মহর্ষিভবনের বাহির-তেতালায় তাঁর আবাসগৃহটি স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন অব্যবহারে পড়েছিলো রুদ্ধরূপে। এই স্মৃতি বিজড়িত রুদ্ধ কক্ষটিকে মনে রেখেই রবীন্দ্রনাথ রুদ্ধ গৃহ প্রবন্ধটি লেখেন, যা তাঁর জীবনমরণভাবনার স্থায়ী দিক-নির্দেশক। এ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-
এ জগতে অবিশ্রাম জীবনের প্রবাহ মৃত্যুকে হু হু করিয়া ভাসাইয়া লইয়া যায়, মৃত্যু কোথাও টিকিয়া থাকিতে পারে না.. ..পৃথিবী মৃত্যুকেও কোলে করিয়া লয়, জীবনকেও কোলে করিয়া রাখে, পৃথিবীর কোলে উভয়েই ভাইবোনের মতো খেলা করে।.. ..পৃথিবীতে যাহা আসে তাহাই যায়। এই প্রবাহেই জগতের স্বাস্থ্য রক্ষা হয়। কণামাত্রের যাতায়াত বন্ধ হইলে জগতের সামঞ্জস্য ভঙ্গ হয়। জীবন যেমন আসে জীবন তেমনি যায়। মৃত্যুও যেমন আসে মৃত্যুও তেমনি যায়। তাহাকে ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা কর কেন? হৃদয়টাকে পাষাণ করিয়া সেই পাষাণের মধ্যে তাহাকে সমাহিত করিয়া রাখ কেন? তাহা কেবল অস্বাস্থ্যের কারণ হইয়া উঠে। ছাড়িয়া দাও, তাহাকে যাইতে দাও- জীবনমৃত্যুর প্রবাহ রোধ করিয়ো না।৮
পত্রিকায় প্রবন্ধটি পড়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের (১৮৪৯-১৯২৫) বন্ধু এবং রবীন্দ্রনাথের গুণগ্রাহী অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী (১৮৫০-৯৮) লেখকের বক্তব্যের বিরুদ্ধ মতবাদ জানিয়ে একটি চিঠি লেখেন। সোলাপুর থেকে লিখিত দীর্ঘ প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর রুদ্ধ গৃহ প্রবন্ধের মূল ভাবটি ব্যাখ্যা করেন। দুটি পত্রই উত্তর প্রত্যুত্তর শিরোনামে পৌষ সংখ্যা ‘বালক’-এ মুদ্রিত হয়। পত্র-দুটি থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি জরুরি। কারণ দুই অসমবয়সী বন্ধুর এই বাদানুবাদের সুবাদে জীবন-মৃত্যু সম্পর্কিত রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বজ্ঞানের মূল ভাবটি পূর্ণ সম্প্রসারিত হয়েছে।
অক্ষয়চন্দ্র লিখেছিলেন-
‘রুদ্ধ গৃহ’ এর ভাব ধরিতে পারিলাম না। একজনের মধ্যে রুদ্ধ হইয়া থাকা, একজনকে লইয়াই চিরদিন শোক করা আপনি গর্হিত বলিয়াছেন। কিন্তু কি করা যায় বলুন!.. ..একদিকে চাহিয়া থাকা, একের চারি দিকে ঘোরাই প্রকৃতির নিয়ম, তাহাই প্রকৃতির বন্ধনের কারণ। আজ যদি পৃথিবী বলিয়া বসে- আমি সূর্যের চারিদিকে ঘুরিব না, কেননা সূর্যকে মেঘে ঢাকিয়াছে, সূর্য আমাকে আর আলো দেয় না, আমি অন্য আলোকের চেষ্টা দেখি, তাহা হইলে প্রকৃতির বন্ধন ছিন্ন হয়, পৃথিবীর মৃত্যু হয়।৯
প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-
জগতের মধ্যে আমাদের এমন ‘এক’ নাই যা আমাদের চিরদিনের অবলম্বনীয়। প্রকৃতি ক্রমাগতই আমাদিগকে ‘এক’ হইতে একান্তরে লইয়া যাইতেছে- এক কাড়িয়া আর এক- দিতেছে। আমাদের শৈশবের ‘এক’ যৌবনের ‘এক’ নহে। ইহজন্মের ‘এক’ পরজন্মের ‘এক’ নহে। এইরূপ শতসহস্র ‘এক’ এর মধ্য দিয়া সেই এক মহৎ ‘এক’ এর দিকে লইয়া যাইতেছে। সেই দিকেই আমাদিগকে অগ্রসর হইতে হবে, পথের মধ্যে বদ্ধ হইয়া থাকিতে আসি নাই। .. ..কিছুই থাকিতে চায় না, অথচ আমরা রাখিতে চাই, ইহাই আমাদের যত শোক দুঃখের কারণ। সকলকে যাইতে দাও এবং তুমিও চলো- জগতের সহিত নিষ্ফল সংগ্রাম করিও না।.. ..যখন আমরা নিতান্ত একজনের মধ্যেই আচ্ছন্ন হইয়া থাকি তখন আমরা জানিতেই পারি না আমাদের কতখানি ভালবাসিবার ক্ষমতা। একটি ক্ষুদ্র বস্তুও যখন চোখের নিতান্ত কাছে ধরি তখন মনে হয় সেই ক্ষুদ্র বস্তুটি ছাড়া আমাদের আর কিছুই দেখিবার ক্ষমতা নাই। সেই ব্যবধান অপসারিত করিয়া দাও, বৃহৎ জগত তাহার সৌন্দর্যরাশি লইয়া তোমার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইবে।
এখানে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-দর্শনের একটি অনুষঙ্গ ধরা পড়ে, যার নাম- বিস্মৃতি। তাই ‘প্রত্যুত্তরে’ তিনি শোক দুঃখের অনুষঙ্গ থেকে চলে গেলেন বিস্মৃতির অনুষঙ্গে এবং লিখলেন-
মৃত্যুকে আমরা যেমন ভয় করি বিস্মৃতিকেও আমরা তেমনি ভয় করি। কিন্তু অনেক সময় সে ভয় অকারণ। বিস্মৃতি মাঝে মাঝে আসিয়া স্মৃতির শৃঙ্খলা কাটিয়া দিয়া যায়। আমাদিগকে কিছুক্ষণের মতো স্বাধীন করিয়া দেয়। যখন কোনো কার্য বা ঘটনা হইতে তাহার সমস্ত ফললাভ করিয়া চুকাইয়া দিয়াছি বা তাহারা নিষ্ফলভাবে আমাদের কাছে স্তূপ বাঁধিয়া আছে, তখন বিস্মৃতি আসিয়া সেই সমস্ত উচ্ছিষ্ট-অবশেষ ও আবর্জনা ঝাঁটাইয়া ফেলিয়া দেয়।১০
গভীর গহিন থেকে উঠে এসে নিমজ্জমান স্মৃতির ঘাই মারার স্বাক্ষর রবীন্দ্রনাথের নানা রচনায় বিধৃত হয়েছে। তিনি যেনো বারবার উপলব্ধি করেছিলেন- ‘স্মৃতি’ শোকের বিষণ্নতাকে ধরে রাখতে চায়, অন্যদিকে ‘বিস্মৃতি’ যা তাকে ছেড়ে দিয়ে প্রসন্নতা আনতে চায়। অন্যদিকে রবীন্দ্র নাট্যসাহিত্যের দিকে তাকালে দেখা যাবে- মৃত্যু-দর্শন পাতন-প্রক্রিয়াধীন এবং ইতোমধ্যেই শান্তির তীর্থযাত্রী। এই উপলব্ধিটুকুই পুর্ণব্যক্ত হয়েছে শ্রীযুক্ত অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তীর জ্যেষ্ঠভ্রাতার আত্মহত্যার পর তাঁকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবরের সান্ত্বনাপত্রে। তিনি লিখেছেন-
এক সময় যখন আমার বয়স তোমারই মত ছিল তখন আমি যে নিদারুণ শোক পেয়েছিলাম, সে ঠিক তোমারই মত। আমার যে পরমাত্মীয় আত্মহত্যা করে মরেন.. ..তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে.. ..আমার জগৎ শূন্য হল.. ..সেই শূন্যতার কুহক কোনোদিন ঘুচবে না, এমন কথা আমি মনে করতে পারিনি। কিন্তু তারপর সে প্রচণ্ড বেদনা থেকেই আমার জীবন মুক্তির ক্ষেত্রে প্রথম প্রবেশ লাভ করলে। আমি ক্রমে বুঝতে পারলুম, জীবনকে মৃত্যুর জানালার ভিতর থেকে না দেখলে তাকে সত্যরূপে দেখা যায় না। মৃত্যুর আকাশে জীবনের যে বিরাট মুক্তরূপ প্রকাশ পায় প্রথমে তা বড়ো দুঃসহ। কিন্তু তার পরে তার ঔদার্য মনকে আনন্দ দিতে থাকে। তখন ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখ অনন্ত সৃষ্টির ক্ষেত্রে হালকা হয়ে দেখা দেয়।১১
মৃত্যুর এই ঔদার্য রবীন্দ্রনাথের ‘মনকে আনন্দ দিতে’ শুরু করেছিলো বৌঠানের প্রয়াণের মাসখানেকের মধ্যেই, যে- আনন্দের দ্বিধাগ্রস্ত প্রথম প্রকাশ সরোজিনী প্রয়াণ– নামক ভ্রমণবৃত্তান্ত রচনায়। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন-
যে- ভাবাবেগ অশ্রান্ত ও অদম্য দীর্ঘশ্বাসরূপে আপনাকে অপচয় করিতেছিলো, তাহাই এক গভীর জীবনসত্যের আধারে বিধৃত হইয়া আর্টের অবিনশ্বরতা লাভ করিলো। মৃত্যুর প্রেতায়িত নিশ্চলতার সহিত জীবনের সবল আনন্দপ্রবাহের যোগ হইয়া জীবন ও মৃত্যু পরস্পরের স্বাভাবিক সুস্থ সম্পর্কে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হইল।.. .. মর্মান্তিক দুঃখের আঘাতে লেখকের দার্শনিক ও শিল্পিমনের অর্ধরুদ্ধ কপাট পূর্ণভাবে উন্মোচিত হইল।১২ [আলোচ্য উদ্ধৃতিতে লেখক নিজেই ‘শিল্পীমন’কে ‘শিল্পিমন’ লিখেছেন]
মৃত্যুর অভিঘাত নির্ভর করে সম্পর্কের গুণগত ও মানগত ধরণের উপরে। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিলো। এর একটি প্রমাণ পাওয়া যায় হাতের কাছেই। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর একমাস তেইশ দিন পরেই একই বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ (যিনি স্বকালের ইংরেজি পড়ানোর তরঙ্গভঙ্গ করে ঠাকুরবাড়ির বালকদের বাঙলা শেখাবার ব্যবস্থা করেছিলেন) মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে। অথচ তাঁর এই অকালমৃত্যুটি সম্পর্কে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি রবীন্দ্রনাথ। হতে পারে, মৃত্যু যে জীবনকে মুক্ত ও সত্যরূপে দেখার একটি জানালামাত্র, সেটি তিনি এরই মধ্যে উপলব্ধি করে ফেলেছিলেন। তাঁর সেই উপলব্ধিকে স্বচ্ছ থেকে স্বচ্ছতর করে তুলেছিলো মহর্ষি পরিবারের আরো তিনটি মৃত্যু- ভ্রাতুষ্পুত্রী (হেমেন্দ্রনাথের কন্যা) সুকণ্ঠী অভিজ্ঞা দেবীর মৃত্যু (১৮৯৬), ভ্রাতুষ্পুত্র (বীরেন্দ্রনাথের পুত্র) সুসাহিত্যিক বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু (১৮৯৯) এবং রবীন্দ্রনাথের ‘লালবাড়ি’র স্থপতি, ভ্রাতুষ্পুত্র (দ্বিজেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র) নীতীন্দ্রনাথের মৃত্যু (১৯০১)। সম্ভবত এই জন্যই নতুন বৌঠানের মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে-সাময়িক ‘একটা সৃষ্টিছাড়া রকমের মনের ভাব ও বাহিরের আচরণ’ দেখা দিয়েছিলো, স্ত্রীর মৃত্যুতে (১৯০২) তাঁর মধ্যে সে-ধরনের কিছু দেখা যায়নি- এমনকি মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর মাত্র দশ মাস পর নববিবাহিতা দ্বিতীয়া কন্যা বারো বছরেরও কমবয়সী রেণুকার মৃত্যুতেও (১৯০৩) না
বরঞ্চ স্ত্রীর মৃত্যুর একমাস পর রবীন্দ্রনাথ পুত্র-কন্যাদের নিয়ে শান্তিনিকেতনে মহাসমারোহে ব্রাহ্মোৎসব পালন করেন ৭ পৌষ। রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, শ্যামসুন্দর মিশ্র, অক্ষয়কুমার মজুমদার ও কাঙালীচরণ সেন প্রমুখ খ্যাতনামা বহিরাগত গায়কগণ উৎসবের শোভাবর্ধন করেন।১৩
তবে অন্তরে একেবারেই নির্বিকার ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ। বৌঠানের মৃত্যুর পর তাঁকে হারানোর বেদনার সঙ্গে যেমন ‘মুক্তির দিক দিয়া দেখিয়া একটা উদার শান্তি’ বোধ করেছিলেন, স্ত্রীর মৃত্যুর পরে কেবল সেই উপলব্ধিতেই সুস্থির থাকতে পারেননি তিনি। উপলব্ধিটি পরবর্তীস্তরে উন্নীত হয়েছিলো। এই উত্তরণের কথা রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনীর মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পরে শান্তিনিকেতন থেকে মোহিতচন্দ্র সেনকে লিখেছেন-
ঈশ্বর আমার শোককে নিষ্ফল করিবেন না। তিনি আমার পরম ক্ষতিকেও সার্থক করিবেন তাহা আমার হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিয়াছি। তিনি আমাকে আমার শিক্ষালয়ের এক শ্রেণী হইতে আর এক শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করিলেন।১৪
সুতরাং এইটুকু পরিস্কার যে, কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুপরবর্তী-স্তরের উপলব্ধিটি ছিলো এ রকম
জগৎটা আমাদের জীবনের সঙ্গে ত্বকের মতো অবিচ্ছেদ্য নয়, মরণের মাধ্যমে জগৎ থেকে জীবনের বন্দীত্ব ঘুচে যায় এবং জীবন মুক্তি লাভ করে।১৫
অন্যদিকে মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুপরবর্তী-স্তরের উপলব্ধিটুকু ছিলো-
একবার সম্পূর্ণ মরতে হবে- তবেই নূতন করে ভগবানে জন্মানো যাবে.. ..পুনর্জন্মের পূর্বে এখন সেই মৃত্যুবেদনা.. ..এসো মৃত্যু এসো- এসো অমৃতের দূত এসো-১৬
অতএব, মুক্তিজনিত উল্লিখিত ‘উদার শান্তি’ লাভের জন্য কবি তাঁর দৈহিক মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবেন না, জীবনের মধ্যেই তাঁকে ‘একবার সম্পূর্ণ মরতে হবে’। চেতনার এই স্তরে উন্নীত হতেই জাগতিক রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হলো এবং ‘অন্য এক’ রবীন্দ্রনাথের জন্ম হলো- যাঁকে বলা চলে আধ্যাত্মিক রবীন্দ্রনাথ।১৭
উৎসর্গ কাব্যের নয় নম্বর কবিতাটির (কুঁড়ির ভিতরে কাঁদিছে গন্ধ) ব্যাখ্যা-প্রসঙ্গে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে লিখেছিলেন-
ওটা গন্ধের পুষ্পগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসার বেদনাজনিত কান্না: ‘বাহিরে যাহার সার্থকতা, বাহিরে আসিবার পূর্বে সে তীব্র বেদনা অনুভব করে- বস্তুত এই বেদনাই জানায় যে তাহাকে বাহিরে আসিতে হইবে, ইহাই গর্ভবেদনা- এবং মৃত্যুবেদনারও নিঃসন্দেহে এই তাৎপর্য।১৮
কবির এই উপলব্ধিটি জেগেছে স্ত্রীর মৃত্যুর পরপরই, শান্তিনিকেতনে বাসকালে। তিনি নিজেই দেখতে পাচ্ছিলেন যেনো, তাঁর স্ত্রী মৃত্যুবরণ করে এই জগজ্জীবনেই একটি জগত-বহির্ভূত জন্ম লাভ করেছেন। সুতরাং একটি আধ্যাত্মিক মনোবৃত্তির স্ফূরণ ঘটে, যা তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে প্রভাব বিস্তার করে। এই আকুতি প্রাধান্য বিস্তার করে খেয়ার যুগ থেকে; যে-কাব্যের আগমন কবিতাটিতে কবি তাঁর শূন্য ঘরে ‘দুঃখরাতের রাজা’কে অভ্যর্থনা করেন১৯। অতঃপর এই হৃদয়াবেগ গোরা উপন্যাসসহ গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-গীতিকা প্রমুখ কাব্যত্রয়ীকে আধ্যাত্মিক আলোকে উদ্ভাসিত করে ‘পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়’।
এই ‘পূর্ণতা প্রাপ্তি’র প্রসঙ্গটি এনেছেন আবদুশ শাকুর, রবীন্দ্রনাথের মরণদর্শন নিয়ে আলোচনার সময়ে। এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়- আধ্যাত্মিকতাবাদ কী সত্যিই রবীন্দ্র-সাহিত্যে পূর্ণতার আলো জ্বেলেছিলো? রবীন্দ্রনাথের ধর্মবিশ্বাস বেশ আনন্দদায়ক- কাব্যজীবনের প্রাথমিক স্তরে তিনি স্রষ্টাকে ‘নাথ’ বলে সম্বোধন করেছেন, মধ্যজীবনে তিনি স্রষ্টাকে করে নিয়েছেন ‘জীবন-দেবতা’ কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে তিনি স্রষ্টাকে ‘সখা’ নামে ডেকেছেন। এবং সন্দেহ নেই তিনি বিভ্রান্ত হয়েছিলেন, সংশয়বাদীতা আচ্ছন্ন করেছিলো তাঁকে। অপ্রযোজনীয় ‘ঈশ্বর ধারণা’কে তিনি লালন করেছিলেন- যে যুক্তিতেই হোক, তিনি শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখতে পেরেছিলেন বলে আমার মনে হয় না। কেননা, মৃত্যুর কিছু আগে- ১৯৪১ সালের জুলাই মাসের ৩০ তারিখে সকাল সাড়ে নয়টায় তিনি তাঁর শেষ কবিতাটি লেখেন। কবিতার অংশ-
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছো চিহ্নিত,
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।
মৃত্যুর আগে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস টলে গিয়েছিলো, তিনি সংশয়বাদী হয়ে উঠেছিলেন।
জায়া-কন্যার মৃত্যুর তুলনায়, ১৯০৫ সালে পিতার মৃত্যুতে অন্তরেও শান্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তবে সেটি এজন্য নয় যে- মহর্ষি মৃত্যুবরণ করেছিলেন আটাশি বছরের পরিপক্ক বয়সে। কারণ কিছুটা অনুমিত হয় কবির নিজের ভাষায়-
পরিপক্ক ফল যেমন বৃন্তচ্যুত হয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ দান করে- তেমনি মৃত্যুর দ্বারাই তিনি তাঁর জীবনকে আমাদের দান করে গেছেন। মৃত্যুর ভিতর দিয়া না পেলে এমন সম্পূর্ণ করে পাওয়া যায় না। জীবন নানা সীমার দ্বারা আপনাকে বেষ্টিত করে রক্ষা করে.. ..২০
১৯০৭ সালে বালকপুত্র শমীন্দ্রনাথের আকস্মিক মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ যেনো সমাধি লাভ করেন। তাঁর সেই সমাধির অভ্যন্তরে প্রচুর ভাঙচুর চলে এবং এর ফলে কবির মৃত্যু-দর্শনের সমস্ত অঙ্গ বিকশিত ও সমন্বিত হয়। এই মৃত্যুটির আঘাত এতো প্রচণ্ড কেনো সেটি বোঝার জন্য পিতার হৃদয়ে কনিষ্ঠ পুত্রের জায়গাটা একটু জরিপ করা প্রয়োজন। ইন্দিরা দেবী লিখেছেন-
লোকে বলে যে রবিকাকার ছোটো ছেলে শমীন্দ্রই বেশি তাঁর মতো দেখতে ছিলো। শমী অল্প বয়সেই বিসর্জনের মতো শক্ত নাটকের কবিতাও অনর্গল মুখস্থ বলতে পারতো। দুলে দুলে রবিকাকার উপাসনা করাও নকল করতো। হেমলতা বৌঠানের কাছে শুনেছি, বাপের টেবিলে বসে নাকি তাঁর মতো লেখক হবার অভিনয় করতো।২১
অনুমিত হয় যে- ডাকঘর (১৯১১) নাটকের অমল শমীন্দ্রনাথেরই আদলে গড়া। ছয় বছর বয়সে মাতৃহারা এই শিশুটিকে মনে রেখেই কবি শিশু (১৯০৩) গ্রন্থের কবিতাগুলো লেখেন।
মৃত্যু-দর্শনের প্রশ্নে দ্বিধাদ্বন্ধ রবীন্দ্রনাথের নিজের মনেও অবশিষ্ট ছিলো, যা তাঁর কল্যাণরূপিণী পত্নীকে অসময়ে হারিয়ে বেড়ে উঠেছিলো সংগত কারণেই। প্রিয়জনদের নানারকম দুঃখ-সওয়া এবং দুঃখ-দেওয়া অকালমৃত্যুগুলি প্রত্যেকটিই একটিমাত্র প্রশ্ন করে বসে আছে রবীন্দ্রনাথের মনে- মানুষের জীবনে দুঃখের ভূমিকা কী? উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেক ভাবনাই ভেবেছিলেন তিনি, কিন্তু গুছিয়ে নিতে পারছিলেন না যেনো। অবশেষে তাঁর ‘শমী ঠাকুর’ এর মৃত্যু এতো দুঃখ নিয়ে এলো যে, কবি বুঝি বলে উঠলেন- আরো দুঃখ! রাখবো কোথায়? আবার দুঃখও বুঝি রবীন্দ্রনাথকে বলে উঠলো- আমাকে আবার রাখবে কি? আমি যে তোমার প্রাপ্য রাখার আধার। এরপর দুঃখকে পুরোপুরি বুঝলেন কবি, তাঁর মৃত্যু-দর্শনের স্নিগ্ধতা কোজাগরী পূর্ণিমার মতোই তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখলো।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-দর্শনের প্রেক্ষণবিন্দুতে আছে একটি বোধ, তা হলো- মৃত্যু তার শোক ও দুঃখের মাধ্যমে জীবনের- সত্যের, মুক্তির ও শক্তির- ত্রয়ীরূপকেই ফুটিয়ে তোলে। সুতরাং সুখের মতো দুঃখকেও স্বাগত জানাও, স্বাগত জানাও জীবনের মতো মৃত্যুকেও।
এবং একটি সময় এলো- রবীন্দ্রনাথও সেই দর্শনের নিশ্চিদ্র নিরালায় হারিয়ে গেলেন। বাইশে শ্রাবণের অনন্ত রোদন তাই কখনো সঙ্গীত, কখনো প্রেম, কখনো বৃষ্টির এক টানা সাহানা সুর- আবার কখনো সব কিছু মিলিয়ে গেলে- একজন রবীন্দ্রনাথ; প্রেরণা-সুখে-দুঃখে-প্রাণময় অভিমানে-সীমানা পেরোনো ভালোবাসায় যিনি এক পশলা বৃষ্টির মতোন ছুঁয়ে যান, ছুঁয়ে যান, ছুঁয়ে যান.. ..
রবীন্দ্রনাথ হারিয়ে গেলেও, তাঁকে নিয়েই একলা হতে হয় আমাদের- তিনি-ই আমাদের দৃষ্টি জোড়া বিষণ্নতা, সৃষ্টিছাড়া সুখ।
তথ্যসূত্র
১। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ১৭, পৃষ্ঠা: ৪২৩
২। রবিজীবনী, খণ্ড দুই, পৃষ্ঠা: ২০৬
৩। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ২০৭
৪। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ২৬, পৃষ্ঠা: ১০৭
৫। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ২৩, পৃষ্ঠা: ৭৩
৬। বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, সুকুমার সেন, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা: ৩০৭
৭। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা: ৪৭৭-৭৮
৮। প্রাগুক্ত
৯। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা: ৫৬০-৬৪
১০। প্রাগুক্ত
১১। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ১৭, পৃষ্ঠা: ৪৮৫-৮৬, চিঠিপত্র ১১, পৃষ্ঠা ৮
১২। রবীন্দ্র-সৃষ্টি-সমীক্ষা, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৩৬, সুবর্ণজয়ন্তী সঙস্করণ
১৩। রবিজীবনী, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১০১
১৪। রবিজীবনী, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৯৬-৯৭
১৫। মরণ, রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ১৪, পৃষ্ঠা ৩৬৭
১৬। প্রাগুক্ত
১৭। রবীন্দ্রনাথের মরণদর্শন, আবদুশ শাকুর
১৮। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ৬৪৬
১৯। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ১০৩-০৫
২০। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ১৪, পৃষ্ঠা ৩১১-১২
২১। স্মৃতিকথা, মীরা দেবী, পৃষ্ঠা ১৮