রবীন্দ্রনাথের নাকি দুই রূপ— আত্ম-উদ্বোধিতো এবং আত্মঘাতী। আত্ম-উদ্বোধিতো রবীন্দ্রনাথের রূপ ধরা পড়ে নানা রঙে, বনে জঙ্গলে, মাঠে ঘাটে— মোট কথা বাঙালি যেখানে পাওয়া যাবে, সেখানেই পাওয়া যাবে আত্ম-উদ্বোধিতো রবীন্দ্রনাথকে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের আত্মঘাতী রূপের সন্ধান পাওয়া দুষ্কর। এর প্রধান কারণ সম্ভবত এই যে— রবীন্দ্রনাথ একমাত্র বাঙালি, যিনি সারাজীবন নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে বাঙলা সাহিত্যকে করেছেন ঋদ্ধ এবং বাঙলা কবিতাকে নিয়ে গেছেন অনেক দূরে, সম্ভবত পাঁচ হাজার বছর সামনে। যদি এমন হয়— আজ হতে পাঁচ হাজার বছর পরও কেউ বাঙলা কবিতার রস আস্বাদনের জন্যে কবিতার বই খুঁজে বেড়াচ্ছে, সেটার কৃতিত্ব রবীন্দ্রনাথকেই দিতে হবে এবং সেই সঙ্গে, যদি এমন হয় যে— কোনো তরুণ কিংবা তরুণী বাঙলা কবিতা পড়ে পাঁচ হাজার বছর পরেও কলম বা কি-বোর্ডে রবীন্দ্র-কাব্যে পুষ্টিহীনতার মতো আধুনিকহীনতার সন্ধান তুলে ধরেন, তাও রবীন্দ্রনাথই জয়ী।
বলছিলাম রবীন্দ্রনাথের আত্ম-উদ্বোধিতো রূপের কথা, যা অধিকাংশ বাঙালির চোখে পড়ে এবং বাঙালি তার স্বভাবধর্ম, মানে ‘তৈল মর্দন’ ধর্ম দ্বারা তাকে চকচক করে তোলে। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে— একদল কবি রবীন্দ্রনাথের কবিতার মাঝে আধুনিকতা খুঁজে পাচ্ছেন, এমনকি অতি উত্সাহী সাহিত্য সম্পাদকরা রবীন্দ্রকাব্যের উত্তরাধুনিকতা বিষয়ক নিবন্ধও ছাপাচ্ছেন। যদিও রবিঠাকুর আধুনিক হয়ে উঠতে পারেননি মোটেও।
আমি প্রথমেই একটি বিষয় পরিস্কার করে নেই— রবীন্দ্রনাথের কবিতা নন্দনতত্ত্বের বিচারে যতোটা প্রাসঙ্গিক, কাব্যজগতে আধুনিকতার বিচারে ততোটা না। কেননা তিনি আধুনিকতাকে ধারণ করা তো দূরের কথা, গ্রহণই করতে পারেননি। প্রসঙ্গত মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের আধুনিক কাব্য প্রবন্ধটির কথা। ১৩৩৯ এর বৈশাখে প্রকাশিত হয় এটি। নাম আধুনিক কাব্য হলেও এর লেখা মূলত নন্দনতত্ত্ব নিয়ে, রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধের শুরুতেই The Study in Aesthetics শীর্ষক এজরা পাউন্ডের কবিতাটির কথা উল্লেখ করেছেন, এবং এ প্রসঙ্গে আলোচনাও করেছেন। বোঝা যায়— নান্দনিকতার বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ যতোটা উন্মুখ ছিলেন, আধুনিকতার বিষয়ে ততোটা ছিলেন না।
সুতরাং ‘রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নন’— এটা ভাবতে পারছেন না অনেকেই। সম্প্রতি খবরের কাগজে একটি লেখায় দেখলাম একজন স্বনামধন্য শিক্ষক কায়কোবাদ, অক্ষয়কুমার বড়াল, নবীনচন্দ্র সেন, কামিনী রায়ের কবিতাগুলো থেকে মুক্তিলাভ করে আসা রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলোকে আধুনিকতার স্বরূপ বলছেন। স্বরূপই বটে! এখন অধ্যাপক মহাশয়কে তো আর জ্ঞান দিতে পারবো না। আমার মতোন সামান্য কলমচির সে আচরণ খাটেও না।
অধ্যাপক মশাইয়ের পুরো লেখাটি পড়ে আমার মনে একটি প্রশ্ন জেগেছে— ‘কবিতার ভাষা কি?’। এর উত্তর খুঁজতে হয় না, অষ্টম শ্রেণিতে থাকতেই এর উত্তর জানা যায়, তা হলো— অনুভূতির প্রকাশমানতা। আমাদের ভাবনা, চিন্তা ও কল্পনার প্রকাশ ভাষার দ্বারাই সম্ভব; কিন্তু সত্যি বলছি— এইটুকু বলা যতো সহজ, বোঝা ততো সহজ নয়; বস্তুত সে কারণেই সূক্ষ্ম, সুকুমার এবং অনন্ত বৈচিত্র্যশীল এবং হৃদয়ের গহনে বহুস্থলেই তা চিৎ-স্পন্দন।
রবীন্দ্রনাথের যে কাব্যগ্রন্থগুলো নিয়ে সেদিনের সেই লেখায় অধ্যাপক মশাই আলোচনা করলেন— দেখালেন উপমার মুক্তি, সেগুলোতে আসলে উপমার মুক্তি ঘটেনি, বরং আড়ষ্ট হয়েছে আরও। কালিদাস থেকে বেরোনোর পথ রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কার করেছিলেন হয়তো, কিন্তু সে পথও ছিলো বহুমাত্রায় কলিদাসকেন্দ্রীক। এ কারণেই ড. সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত বলেছিলেন—
উপমা কালিদাস্য যেমন সত্য, উপমা রবীন্দ্রনাথস্যও তেমনি সত্য। সংস্কৃতে যেমন কালিদাস, বাঙলায় তেমনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে— তারকার আত্মহত্যা, আশার নৈরাশ্য এগুলো রবীন্দ্রনাথ অনেক পরে খুঁজে পেয়েছেন। সেই পুনশ্চতে এসে। এর আগ পর্যন্ত তিনি বহুমুখী ছিলেন না, ছিলেন কালিদাসমুখী। তবে কালিদাস দ্বারা প্রভাবিত হলেও রবীন্দ্রনাথের প্রকাশময়তার প্রকৃতি ছিলো আলাদা। এটা হবেই— কেননা, দুজনের মাঝখানে কমপক্ষে দেড় হাজার বত্সরের ব্যবধান। এই বিরাট কাল-ব্যবধান সাহিত্যরীতির ক্ষেত্রে মৌল পরিবর্তনসূচক— বিষয়ে, বক্তব্যে, ভঙ্গিতে— যে কোনো দিক থেকেই। কালিদাসের কালে উপমা প্রয়োগে নিশ্চয়তা ছিলো, সাদৃশ্য কল্পনায় কোনো জটিলতা ছিলো না। যেমন— ‘মেঘের মতো চুল’, ‘চাঁদের মতো মুখ’, ‘হরিণের মতো দৃষ্টি’ বা ‘বিম্বের মতো অধর’— সোজাসাপটা, তার মানে এই নয় যে আমি কালিদাসকে ছোটো করছি, ওটাই তাঁর বৈশিষ্ট্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘ ত্রিশ বছরের কাব্য জীবনে সেখান থেকে বের হতে পারেননি। পুনশ্চতে এসে বা তারও আগে দু একটা কাব্যে তিনি বের হয়ে এসেছেন। কিন্তু সেটা হলো কালিদাসমুক্তি, এর মানে এই নয় যে— তিনি আধুনিকতার প্রেক্ষণবিহারী হয়েছেন। কারণ, ১৮৯৪ এর ১৩ জুলাই রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে লিখছেন—
আমার মনে হয় বিশুদ্ধ আর্ট হচ্ছে ছবি এবং গান, সাহিত্য নয়
মানে কী? রবীন্দ্রনাথ ‘আর্ট’ এবং ‘বিশুদ্ধ আর্ট’ এর মাঝে একটা কাল্পনিক ভেদরেখা টেনে দিলেন। এটি অভিনব এবং রবীন্দ্রনাথের ‘আধুনিক হতে না পারা’ মানসিকতার সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ। এই স্থ্থূলতা কিন্তু আমরা কল্লোলে পাই না, রবীন্দ্রনাথে পাই। অবশ্য পাশ্চাত্যে ‘Pure art’ কথাটি নেই বিষয়টা তা নয়; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। ১৮৯২ সালের ৩০ মে লেখা আরেকটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—
আর্টের একটা প্রধান আনন্দ হচ্ছে স্বাধীনতার আনন্দ
প্রভাতসঙ্গীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল সেই স্বাধীনতার আনন্দে লেখা। আবার যদি মানসীর মেঘদূতটা পড়ি, তাহলে কী দেখি?
মুক্ত বাতায়ন হতে যায় তারে দেখা
শয্যাপ্রান্তে লীন তনু ক্ষীণ শশীরেখা
পূর্বগগনের মূলে যেনো অন্তপ্রায়
এবার মূল মেঘদূত পড়ি—
আধিক্ষামাং বিরহ শয়নে সন্নিষন্নৈক পার্শ্বাং
প্রাচীমূলে তনুমিব কালামাত্রশেষাং হিমাংশো
বুদ্ধদেব বসু অনুবাদ করেছেন-
বিরহ শয্যায় শুয়েছে একপাশে শীর্ণতনু মনোকষ্টে
পূর্বাকাশে যেনো কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের শেষকলা উদিত
রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’কে কালিদাসের আক্ষরিক অনুবাদ বললেও ভুল হবে না।
রোম্যান্টিকতা— বাঙলা কবিতা এবং রবীন্দ্রনাথ
হাজার বছর আগে বাঙলা কবিতা নাম্নী এক নারী মধ্যরাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতো। কাউকে খুঁজতো, যে কিনা তাকে পরিপূর্ণরূপে সাজিয়ে দেবে, মনের মতো করে গড়ে তুলবে। চর্যাকারেরা তাকে মিতায়তনিক বন্ধনে মুক্তির ইশারাটুকু দিলো। প্রশস্তিকীর্তনের বাহুল্যে বড়ু তাকে প্রশস্ত করে দিলো। আবার নাতিদীর্ঘ নিবিড়তা ফিরিয়ে আনলো বৈষ্ণবেরা। আখ্যানভূমি মাড়িয়ে নগরের বাইরের কামিনীকে নগরে নিয়ে এলেন ঈশ্বর। দ্বৈত আগ্রহে মধুসূদন একবার তাকে মহাকাব্যের মহিমায় অলঙ্কৃত করলেন, আবার তাকে গীতিকাব্যের তন্বী মাধুর্য প্রদান করলেন। বিহারীলাল দিলেন আবেগের উষ্ণতা। পরক্ষণে হেম-নবীনের উছ্বাস আর উত্তেজনায় হতবিহ্বল হয়ে পড়লো বাঙলা কবিতার স্বপ্ন। কোন দিকে সে যাবে। নিজের অজান্তেই দাঁড়িয়ে জোড়াসংকটে। সেখানে অনতিবয়স্ক এক তরুণ। আটাশি জন কবির ভিড়ে অখ্যাত একজন। কী করে যেনো টের পেলো— এই সেই নারী, যার মধ্য দিয়ে কথা বলতে চায় ‘মূঢ় ম্লান মুখ’ জনপদ। চন্দ্রকলার অস্থিতিশীল হ্রাসবৃদ্ধির মধ্যেও কবিতাকুমারীর মনপছন্দ আঙ্গিক সে তরুণ টের পেয়েছিলো। এখানে উল্লিখিত সেই অপরিণত, অস্ফুট, ভীরু, তরুণের নাম— রবীন্দ্রনাথ।
অতএব রবীন্দ্রনাথ অতীতের নাম কেবল নয়, ঐতিহ্যেরও নাম। তিনি এমন এক গ্রহে জন্মেছিলেন যেখানে সৌকর্য সাধনের তুমুল তরঙ্গ কেবল অন্তর্মুখীনই নয়, অন্তর্গতও। রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করলে তাই স্নান করা হয় ‘নবধারা জলে’ এবং তাকিয়ে থাকা হয় মহাকাশের দিকে, প্রাণময় নিটোল উষ্ণতায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠে সার্থক হয়ে ওঠে সমগ্র অন্তর্লোকে। রবীন্দ্রনাথ তাই সহজ সুন্দর; তার মানে এই নয় যে— সুন্দরকে কেবল সহজই হতে হয়। শরতের সকাল সুন্দর এবং সহজ কিন্তু নারী শরতের সকালের চেয়েও সুন্দর— কিন্তু সহজ নন।
আমি অবশ্য জানি— এ ধরণের লেখার কার্যত কোনো মূল্য নেই; কারণ রবীন্দ্রনাথ এমন এক দেশের কবি, যে দেশের ‘শিক্ষিত’ জনগণ কাব্যবিমুখই শুধু নয়, তারা কাব্যের এবং সকল ধরণের সৌন্দর্যের জন্যে ক্ষতিকর। এবং রবীন্দ্রনাথ এমন এক ভাষার কবি— যে ভাষার ভাষাভাষীগণ নিজেদের ভাষাকে ভালোবাসে না। এ ধরণের মানুষ অবশ্য কিছুই ভালোবাসে না, সত্যি বলতে ভালোবাসতে পারে না।
রোম্যান্টিকতা একটি প্রপঞ্চ। বাঙলায় এর কোনো সার্থক সমার্থক প্রয়োজন হয়নি, নিজেই সার্থক হয়ে ওঠেছে সে, আলোড়িত করেছে বাঙলা কবিতাকে, রবীন্দ্রনাথের ছায়াতে লীন হয়ে চুমু খেয়েছে বাঙলা কবিতার ঠোঁটে। রোম্যান্টিকতা যখন কেবল শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয় তখন সে একটি প্রপঞ্চ আর শিল্প-সাহিত্য-দর্শন-চিত্রকলায় এ এক নিটোল আন্দোলন, হৃদয়মুখী আর সত্তার প্রেক্ষণবিহারী আন্দোলন। গ্রীক ও রোমান সভ্যতায় যে ক্লাসিসিজম এবং নব্য-ক্লাসিসিজমের জন্ম হয়— রোম্যান্টিকতা তার বিরুদ্ধে একটি সচেতন বিদ্রোহ। ক্লাসিসিজম মনে করতো নন্দনতত্ত্বের প্রেক্ষণে থাকে প্রাচীনতার পূর্ণ আবেশ, নব্য-ক্লাসিক তত্ত্ব যদিও সৃষ্টিধারাটা ছেড়ে দিয়েছিলো কিন্তু নিশ্চিত জানতো— অনুপ্রেরণার ধরণ সেই প্রাচীনতার আবেশেই। ক্লাসিসিজমে বা নব্য-ক্লাসিসিজমে যে পরিমিত সৌন্দর্য ও চিরকালীন অবভাস সুদীর্ঘ দিন ধরে মানুষকে একটি বায়বীয় কিন্তু অন্তর্গত সারাত্সারের মধ্যে অবগাহন করার ঘোরের মধ্যে আবিষ্ট করে রেখেছিলো— রোম্যান্টিকতা সেখান থেকে মুক্ত করে শিল্পকে। ক্লাসিসিজমের মধ্যে প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষ অভিনিবেশ এক স্বয়ংক্রিয় এবং স্বতঃস্ফূর্ত দৃষ্টিভঙ্গীর অন্তর্লীনতায় মানুষকে অভ্যস্থ করে রাখতে চেয়েছিলো, রোম্যান্টিকতা তাকেই হটিয়ে দিয়ে নিয়ে এসেছিলো এমন এক আধার, যা এর আগে কেউ প্রত্যক্ষ করেনি। এর মধ্যে ‘প্রয়োজন’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো। তবে যে প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনায় রেখে রোম্যান্টিকতার সূত্রপাত ঘটেছিলো ইউরোপে, তাতে ইতিহাসের পরম্পরাকে যতোটা বিবেচনায় নেয়া হয়েছিলো, অন্তর্গতভাবে তার মৌলিকতাকে ততোটা নেয়া হয়নি। অথচ আধুনিক কবিতার যাত্রা শুরু হয়েছিলো ইতিহাসের ধারাবাহিকতার কথা মনে রেখেও একে একটি প্রপঞ্চ হিসেবে বিবেচনা করে, আরও একটি নতুন প্রপঞ্চ নির্মাণের তাগিদ থেকে। তবে রোম্যান্টিকতা যে প্রকৃতপক্ষে একটি আবেশ, হৃদয়ের গহন গভীর তলদেশে ঢেউ জাগানিয়া এক বিভোর অনুভূতির সারাত্সার, এটা সারা পৃথিবীতেই তেমনভাবে কেউ উল্লেখ করেননি। আর এ কারণেই সামাজিক-রাষ্ট্রিক অস্থিরতার প্রতিক্রিয়ায় অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে সাহিত্য-সংস্কৃতি-চিত্রকলা ও বুদ্ধির আবেগকে ধারণ করে এবং আলোকিতো সমাজ ও রাজনীতির অন্তর্গত আধারকে সাঙ্গীকৃত করে তথাকথিত প্রকৃতিবিজ্ঞানের ঔজ্জ্বল্যের বিরুদ্ধে রোম্যান্টিকতাই হয়ে ওঠে মুখ্য।
বাঙলা কবিতায় রোম্যান্টিকতার স্বরূপ নির্ধারণের আগে স্বভাবতই সাহিত্যের বারান্দায় রোম্যান্টিকতার রোদ্দুরের একটা বিমূর্ত ছবি আঁকা প্রয়োজন। ঐতিহাসিক পরম্পরায় আলোচনাটা ভালো হতো— কিন্তু সেটা লেখার পরিধি বাড়াবে এবং মূল আলোচনায় প্রবেশ বিলম্ব হবে। তাই কম্পোটন-রিকেটের লেখা দ্যা হিস্ট্রি অব ইংলিশ লিটারেচার থেকে উদ্বৃত করছি—
It is one of the curiosities of literary history that the strongholds of the Romantic Movement were England and Germany, not the countries of the romance languages themselves. Thus it is from the historians of English and German literature that we inherit the convenient set of terminal dates for the Romantic period, beginning in 1798, the year of the first edition of Lyrical Ballads by Wordsworth and Coleridge and of the composition of Hymns to the Night by Novalis, and ending in 1832, the year which marked the deaths of both Sir Walter Scott and Goethe. However, as an international movement affecting all the arts, Romanticism begins at least in the 1770’s and continues into the second half of the nineteenth century, later for American literature than for European, and later in some of the arts, like music and painting, than in literature. This extended chronological spectrum (1770-1870) also permits recognition as Romantic the poetry of Robert Burns and William Blake in England, the early writings of Goethe and Schiller in Germany, and the great period of influence for Rousseau’s writings throughout Europe.
The early Romantic period thus coincides with what is often called the “age of revolutions”–including, of course, the American (1776) and the French (1789) revolutions–an age of upheavals in political, economic, and social traditions, the age which witnessed the initial transformations of the Industrial Revolution. A revolutionary energy was also at the core of Romanticism, which quite consciously set out to transform not only the theory and practice of poetry (and all art), but the very way we perceive the world. Some of its major precepts have survived into the twentieth century and still affect our contemporary period.
রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য রোম্যান্টিক ধারায় স্নাত ঊনবিংশ শতাব্দীর এক আলোকিতো ও প্রোজ্জ্বল প্রতিনিধি এবং একমাত্র সার্থক প্রতিনিধি। এই রোম্যান্টিকতার সঙ্গে তিনি প্রাচ্যের উপনিষদ, ভাববাদ এবং জাতির শাশ্বত ঐতিহ্যকে আত্তীকরণ ও আত্মীকৃত করে যে নতুন রোম্যান্টিকতার জন্ম দেন— তা হয়ে ওঠে বিস্ময়করভাবে আবেগমথিত এবং অন্য ঘরানার। রোম্যান্টিসিজমের উদ্বেল সংবেদনশীলতা, যা উত্সরিত হতে থাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাগুলো থেকে— তাতে আলোড়িত হই আমরা; যদিও সে আলোড়ন বিব্রত করে আমাদের তবুও তাকে অতিক্রম করতে পারি না আমরা। রোম্যান্টিসিজমকে বলা হয় ইউরোপের চৈতন্যের সঙ্কট, তবে এটি এমন এক সঙ্কট— যা মানুষকে পৌঁছে দেয় অন্য জগতে, তাই রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বাঙলা কবিতায় যে রোম্যান্টিকতার মেঘ জমে তা বাঙলা সাহিত্যের এক মহাবাদল, ভাঙন ধরিয়ে দেয় তত্কালীন সাহিত্যের মেরুদণ্ডে। একথা সত্য যে— বিশ্বসাহিত্য বিচারে প্রকৃত কবিতা সৃষ্টিই করেন রোম্যান্টিকরা, আর বাঙলা কবিতা ‘কবিতা’ই হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের সময়ে।
রোম্যান্টিসিজমের একটি মূলমন্ত্র হলো ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ’— যা একদিকে বেশ ভয়ঙ্কর। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ হলো নিজেকে বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ মনে করা; এ হচ্ছে অহমিকাবাদ। সামাজিক এলাকায় অবশ্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ খুবই চমত্কার, গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র লুকিয়ে আছে এরই ভেতরে। সামাজিক ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ সমাজ ও রাষ্ট্রের থেকে বেশি গুরুত্ব দেয় ব্যক্তির অধিকারকে। ব্যক্তির অধিকারবাদ থেকেই এসেছিলো স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্ব, সাম্যের ধারণা— যার ফলে ঘটেছিলো ফরাশি বিপ্লব। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের চরম রূপটি গ্রহণ করেছিলেন রোম্যান্টিক কবিরা, এমনকি রবীন্দ্রনাথও।
আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ/ চুনি উঠলো রাঙা হয়ে— হৃদয়ভাসানো পঙক্তি— কিন্তু এরই মাঝে লুকিয়ে আছে রোম্যান্টিকতার মূলসুর ‘অহমিকাবাদ’ বা ‘আমিময়তা’। তিনি কোনো কিছুকেই মেনে নিচ্ছেন না বস্তুগতভাবে, স্বীকার করছেন না কারও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকেই; সবকিছুতেই তিনি সঞ্চারিত করে দিচ্ছেন নিজেকে। পান্না চুনির নিজস্ব রঙ যেমন স্বীকার করছেন না, তেমনি স্বীকার করছেন না সূর্যকে এবং গোলাপের সৌন্দর্যকে— তাঁর কাছে এসবই স্বীয় সত্তার সম্প্রসারণ।
এখানেই আসে কল্পনাপ্রতিভা; রোম্যান্টিক কবি বস্তুগতভাবে নয়, কল্পনাপ্রতিভার সাহায্যে উপলব্ধি করেন বিশ্বজগত। অহম তাঁর মহাজগতের কেন্দ্র। রোম্যান্টিক কবি বলেন— শোনো শুধু নিজেকে, চারপাশ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নাও, দেখো তোমার অভ্যন্তরকে, তোমার বাইরের কিছুই মূল্যবান নয়— মূল্যবান কেবলই তুমি এবং তুমি নিজে। আপন আন্তর সত্তাকে মুখ্য করে রোম্যান্টিসিজম হয়ে ওঠে অহমিকাবাদ বা আত্মকেন্দ্রিকতাবাদ। তবে কোনো কোনো রোম্যান্টিকতা প্রচণ্ড অহমিকা পরায়ন হলেও তাঁদের অনেকেই বিনয়ী এবং গণতন্ত্রবাদী; এবং চারপাশের দিকে সব সময়ই মেলে ধরেছেন মুগ্ধ চোখ। ইংরেজ রোম্যান্টিক কবিরা নিজেদের সাধারণই মনে করতেন, তবে জার্মান বা ফরাশি রোম্যান্টিক কবিরা ছিলেন প্রচণ্ড এবং অহমিকার ঋদ্ধতায় সুন্দর। শ্লেগেল বলেছিলেন—
মানুষ অন্য প্রাণীদের কাছে যেমন, শিল্পী অন্য মানুষের কাছে তেমন
আগে বাঙলা কবিতা হিশেবে গণ্য হতো কয়েকটি দক্ষতা ও নিয়মকানুনের কৌশল, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পর তা হয়ে ওঠে অনবদ্য রহস্যময়তার আধার, কেননা রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেন রোম্যান্টিক এবং তাঁর কবিতাগুলো উত্সরিত হয় সংবেদনশীলতা থেকে। রোম্যান্টিক কবিতা তাই প্রকৃতির কবিতা, এমন ধারণা বড়ো হয়ে উঠেছিলো এক সময়। মিথ্যে নয় যে— রোম্যান্টিক কবিরাই প্রথম প্রকৃতিকে দেখেন প্রকৃতরূপে, এবং উপস্থাপন করেন জীবন্ত রূপে। বাঙলা কবিতাতেও প্রকৃতিকে এক সময় মনে করা হতো যন্ত্র, যা পূর্ব নির্ধারিত নিয়মে যান্ত্রিকভাবেই চলছে। রবীন্দ্রনাথই প্রথম এই যান্ত্রিক প্রকৃতি ধারণা বাদ দিয়ে নেন এক সজীব গতিময় প্রকৃতির ধারণা। তবে রবীন্দ্রনাথ এইস্থানেও প্রকৃতিকে নিয়েছেন নিজেরই সত্তার সম্প্রসারণ হিশেবে।
আগেই উল্লেখ করেছিলাম— রোম্যান্টিক কবির মূলশক্তি হলো কল্পনাপ্রতিভা, যা দিয়ে তিনি দেখেন এবং পূর্ণসৃষ্টি করেন বিশ্বজগত। তিনি নিজেই তাঁর সৌরজগতের কেন্দ্র এবং তিনিই তৈরি করেন তাঁর দেখার সীমানা। তিনি কল্পনাপ্রতিভার সাহায্যে উপলব্ধি করেন; বাইরের চোখ দিয়ে তিনি দেখেন না, দেখেন আন্তর চোখ দিয়ে। যেমন ব্লেইক বলেছেন— তিনি চোখ দিয়ে দেখেন চোখ দ্বারা দেখেন না। তেমনি রবীন্দ্রনাথের কাব্যে পাই—
কবি, তব মনোভূমি
রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।
কল্পনাকে প্রাণ দিয়েছেন রোম্যান্টিক কবিরা এবং তাকে উজ্জ্বল করেছেন সর্বময়। প্লেটো থেকে আঠারশতক পর্যন্ত মনে করা হতো— মন হচ্ছে আয়না, যার কাজ বাইরের জগতকে প্রতিফলিত করা। সে বোধের চৌকাঠ পেরোন রোম্যান্টিকেরা, তাঁরা মনে করতে থাকেন— মন বা হৃদয় হলো প্রদীপশিখা, যা উদ্ভাসিত করে মহাজাগতিক অন্ধকারকে। তাঁরা অ্যারিস্টটলের অনুকরণবাদ ছুঁড়ে ফেলে দেন এবং তৈরি করেন শিল্পকলার নতুন এক ব্যাখ্যা— যা উদ্ভাসন, এবং যা প্রণয়বিথারে আবদ্ধ হয়েও কল্পনাবিহারী। অনেক চতুর্দশশ্রেণিভুক্ত সাহিত্যবোদ্ধারা মনে করে যে— রোম্যান্টিকতা মানেই হলো একটি ভাবালুতা, কিন্তু এটি মূলত মানবিক আবেগানুভূতি।
বিশ্বের শ্রেষ্ঠতর রোম্যান্টিকদের মাঝে রবীন্দ্রনাথ একজন, সম্ভবত শ্রেষ্ঠতমও (অন্তত বিষ্ণু দে’র বিচারে শেলীর পরেই রবীন্দ্রনাথের স্থান)। রবীন্দ্রনাথের মাঝে পাই রোম্যান্টিসিজমের শ্রেষ্ঠ প্রকাশ, যা পূর্ব-পশ্চিমের আর কারও মাঝেই তেমন একটা পাওয়া যায় না। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, অহমিকা, মৌলিকত্ব, কল্পনাপ্রতিভা, স্বতস্ফূর্ততা, আবেগানুভূতি এবং আরও অনেক ব্যাপার যেমন ব্যাপক-গভীর-তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতা ও গানে— তা আর কোথাও হয়নি। তীব্রতায় তিনি অদ্বিতীয়; বিষ্ণু দে যদিও শেলীর পরে তাঁকে রেখেছেন, আমার ব্যক্তিগত বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথ শেলীর চেয়েও তীব্র রোম্যান্টিক। বিলেতের পাঁচ রোম্যান্টিক ওয়ার্ডওঅর্থ, কোলরিজ, শেলী, কীটস, বায়রন— মিলে যা করে গেছেন, বাঙলায় রবীন্দ্রনাথ করেছেন তারও বেশি এবং তিনি করেছেন একা। তিনি একাই ছিলেন এবং নিজেকে দেখেছেনও সেইভাবে এক ‘বাঁশিওয়ালা’ রূপে, বারবার বলেছেন বাঁশি বাজানোর কথা, মধ্যাহ্নের অলস গায়কের মতো বাঁশি বাজানোই তাঁর আনন্দ, তিনি সমাজের নন, সব সময়ই সমাজে তিনি ‘আগন্তুক’; তিনি প্রবেশ করেননি প্রথাগত সমাজে।
তিনি বলছেন যে সৃষ্টিছাড়া সৃষ্টি মাঝে বহুকাল সঙ্গীহীন রাত্রিদিন বাস করেছেন, যাঁর চোখে স্বপ্নাবেশ আর শরীরে অপরূপ বেশ, আর জগতে আসার দিন ‘কোন্ মা’ তাঁকে দিয়েছেন ‘শুধু খেলবার বাঁশি’। এ কেবল রবীন্দ্রনাথের কাব্য নয়, এ হলো রবীন্দ্রনাথের আমৃত্যু উপলব্ধি। এমন উপলব্ধি কীটসের ‘অৌড টু দ্যা নাইটেঙ্গেল’ বাদ দিলে আর কোনো ইংরেজি রোম্যান্টিক কবিতায়ও পাই না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় অষ্টাদশ শতকের রোম্যান্টিকতায় অবগাহন করেছিলেন বটে, কিন্তু তিনি সেখানেই তাঁর যাত্রাকে থামিয়ে দেননি; বরং তিনি দেখিয়েছিলেন ক্লাসিসিজম ও নব্য-ক্লাসিসিজমের বিরোধীতাই কেবল রোম্যান্টিকতা নয়; অনুভবের অন্তস্থলের অবচেতনাও রোম্যান্টিকতার এক অবিচল প্রবণতা। তিনি নিজেকে যে ধারায় ভাঙতে চেয়েছিলেন, তা পারেননি— তিনি ছিলেন মূলত বহিস্থিত, এবং সকল সময়ের আগন্তুক— আর ছিলেন নান্দনিক প্রকাশময়তার উজ্জ্বল সারথি। তাই কিশোর বয়সের যে কাব্যগুলো তিনি বাতিল করেছেন, সেই ‘কবিকাহিনী’, ‘বনফুল’, ‘ভগ্নহৃদয়’, ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’— তার মধ্যেও আমরা এক নিবিড় রোম্যান্টিক রবীন্দ্রনাথকে পাই, যিনি বিব্রতবোধ করেছিলেন নিজের কৈশোর জীবনের নিজস্বতাকেন্দ্রীক বহিরস্থিততাকে।
যেদিন স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিলো নির্ঝরের, সেটা ছিলো, শুধু বাঙলা কবিতার জন্যেই নয়, বিশ্ব কবিতার জন্যেই এক মহাশুভদিন। ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতাটি তাঁর ইশতেহারের মতো; এতে তিনি চরণে চরণে যা ঘোষণা করেছেন, সারাজীবন বাস্তবায়ন করেছেন তাই। তবে তিনি কবিতায় কোনো ছক মেনে চলেননি। অবলীলায় যেমন লিখেছেন অজস্র বিশুদ্ধ কবিতা, তেমনি রচনা করেছেন প্রচুর ছন্দোবদ্ধ রচনা; যেমন লিখেছেন তীব্রতম হাহাকার, তেমনি লিখেছেন আটপৌরে কাহিনি। বহু রোম্যান্টিকের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন যে— কবির মহান কাজ লৌকিকের সাথে অলৌকিক পরম সত্তার সম্বন্ধ তৈরি। সে সম্বন্ধ তৈরির চেষ্টা তিনিও করেছেন সারাজীবন, বিভ্রান্ত এলিয়টের মতো। তবুও অবিশ্বাসীদের কাছেও রবীন্দ্রনাথ গুরুত্বপূর্ণ, কেননা তাঁর কবিতা মানবিক ও প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ, তীব্র আবেগে কম্পিত, এবং অসামান্য উপমারূপচিত্রকল্পের সৌন্দর্যে শোভিত।
জীবন-শিল্প ও কবিতার চিরপ্রধান বিষয় হলো প্রেম— হৃদয়-শরীরের এক অবর্ণনীয় আলোড়ন। রবীন্দ্রনাথের কবিতায়ও প্রধান প্রেম; শুধু তাই নয়, এমন তীব্র কাতর নিরন্তর অহমিকাহীন নিবেদিত প্রেমিক বাঙলায় আর জন্মেনি। রোম্যান্টিকদের প্রথম সম্পদ ও সমস্যা হলো হৃদয়; তাঁরা পীড়িত মহাবিশ্বের চেয়েও বৃহৎ হৃদয়ভারে; তাঁদের হৃদয় কোনো সুখ জানে না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম প্রেমের কবিতাটি লেখেন একুশ বছর বয়সে। ‘রাহুর প্রেম’ নামের কবিতাটি। এটি সম্ভবত তাঁর একমাত্র অরাবীন্দ্রিক প্রেমের কবিতা। তবে ধীরে ধীরে তিনি তাঁর কবিতার প্রেমিকদের সংযত করেন, সংশোধন করেন ‘সুরদাসের প্রার্থনা’য়, এবং তাকে চূড়ান্ত রোম্যান্টিক রূপ দেন ‘অনন্ত প্রেম’ এ। ‘কড়ি ও কোমল’ এ পাই প্রেমরে তীব্র শরীরী কামনা এবং এখান থেকেও উঠে আসেন তিনি। তবুও তাঁর প্রেম কখনোই নিষ্কাম হয়নি। বিস্ময়কর রোম্যান্টিক হিসেবে তাঁকে পাই গানে, সেখানে পুজো হয়ে ওঠে প্রেম, প্রেম হয়ে ওঠে পুজো।
রবীন্দ্রনাথের কবিতার দুটো সঙ্কলন রয়েছে— চয়নিকা (১৯০৯) ও সঞ্চয়িতা (১৯৩১); এর মধ্যে প্রথমটি বিলুপ্ত, দ্বিতীয়টি সুপরিচিত। কেবল সঞ্চয়িতা রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো ধারণ করতে পারেনি, তাই রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠে নিজেকে নিমগ্ন করতে হয় রবীন্দ্র রচনাবলীর কাছে। সেখানে গিয়ে চোখ খুলে দেখতে হয়, প্রাণ দিয়ে গাইতে হয়, হৃদয়ভরে বেঁচে উঠতে হয়।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোম্যান্টিক কবি— যিনি আধুনিক কবি নন, এবং যাঁকে আধুনিক বানানোর তুমুল প্রয়াস চলছে চারপাশে। রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতির জন্যে যা দিয়ে গেছেন, তা দিয়ে বাঙালি নির্বিঘ্নে পৃথিবীর ইতিহাসে বেঁচে থাকবে আগামী অন্তত এক হাজার বছর। তারপর বাঙালি সম্ভবত আর টিকে থাকবে না; কারণ টিকে থাকার মতো কিছুই করছে না বাঙালি, এমনকি পড়ছে না রবীন্দ্রনাথও।
২৭ কার্তিক ১৪১৮