বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ব্যাপ্ত ইতিহাস বর্তমানে নানা বইপত্রে স্থান পাচ্ছে। একটা সময় পর্যন্ত ধারণা করা হতো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রীক; বড়ো জোর কিছু শহরকেন্দ্রীক আন্দোলন। কিন্তু গত এক দশকের গবেষণায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নানামুখী দলিল-দস্তাবেজ পর্যালোচনা করে বাঙালির আত্মপরিচয় উন্মেষের এই প্রথম আন্দোলনের সঙ্গে বাঙলার নানাপ্রান্তের মানুষের অংশগ্রহণের দিকগুলো উঠে এসেছে। ভাষা আন্দোলনের আটষট্টি বছর পর এই মহাবিপ্লবের ইতিহাস রচনায় আমরা কতোটা ব্রতী হতে পেরেছি— এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া সহজ নয়। সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার প্রসঙ্গেও খুব জোর গলায় এই উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। তবুও, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তিগুলোকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা গেছে। কিন্তু একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলোর একটি বৃহৎ অংশ প্রকাশ্যে ও গোপনে বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ক্ষেত্রে বিরোধিতা করেছিলো। প্রক্রিয়াটিও একই ছিলো। ইসলামকে বর্ম হিশেবে ব্যবহার করে যারা উর্দূর পক্ষে সাফাই গেয়েছিলো, একাত্তর সালে তারাই ধর্মের নামে নির্বিচারে গণহত্যা আর নির্মম নারী নির্যাতন করেছে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় হলো, ধর্মের ধ্বজা ওড়ানো এইসব পরজীবী দলগুলোর পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছে দেশের সাধারণ মানুষ। উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যারা উঠে পড়ে লেগেছিলো, তারা নানা অজুহাতে বাঙলা ভাষাকে অপমান করেছে। বাঙলা ভাষার বিপক্ষে এসব বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারের জবাবও দিয়েছে এই জনপদের মানুষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সূর্যমুখী মিছিল এগিয়ে যাচ্ছে, সারাদেশের নানা জায়গায় তখন রচিত হচ্ছে রাষ্ট্রভাষা বাঙলার দাবিতে প্রত্যেকের নিজস্ব প্রতিবাদের ধারা। এ এক অনন্য যূথবদ্ধ উদ্বোধন। এই যূথবদ্ধতার পথ ধরেই বাঙালি মাথা উঁচু করে এসে দাঁড়িয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মহাবাদলে।
উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা করার পাকিস্তানি চক্রান্তের সরাসরি সহযোগিদের মধ্যে অন্যতম ছিলো জমিয়তে ওলামায়ে এছলাম। ১৯৪৫ সালে মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সমর্থনে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে এই সাম্প্রদায়িক দলটির জন্ম হয়। দেশভাগের পর, ১৯৫২ সালে, এরা মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে নেজামে ইসলাম পার্টি গঠন করে। এরা মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিশেবে গণহত্যা, নারী নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধসমূহে প্রত্যক্ষ অংশ নেয়। বর্তমানে এরা বিএনপি’র সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে।
১৯৫১ সালে জমিয়তে ওলামায়ে এছলাম (বর্তমান নাম নেজামে ইসলাম পার্টি) উর্দূকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র সমর্থন করে উর্দূর পক্ষে পঞ্চাশ পয়েন্ট শিরোনামে একটি পুস্তিকা বের করে। বলাই বাহুল্য, নানা তথ্য বিকৃতি ও বিভ্রান্তিতে ভরা এই পুস্তিকাটি তারা বাঙলাতেই ছাপিয়েছিলো। পাকিস্তানের সরকারি মদদে ভুল-বিভ্রান্তে ভরপুর এই পুস্তিকাটি সারাদেশে সরবরাহ করা হয়। তখন প্রথম এর প্রতিবাদ করে বাঙলা ভাষার পক্ষে বায়ান্নর পাণ্ডুলিপি: বাঙলা বনাম উর্দূ রাষ্ট্রভাষা বিতর্ক শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয় তৎকালীন ঢাকা জেলাস্থ এবং বর্তমানে নরসিংদী জেলার বেলাবো উপজেলা থেকে।
পুস্তিকাটি রচনা করেছিলেন ফোকলোর সংগ্রাহক ও গবেষক মোহাম্মদ হানীফ পাঠান (১৯০১-১৯৮৯)। জমিয়তে ওলামায়ে এছলামের উর্দূর পক্ষে পঞ্চাশটি যুক্তির অসারতা তিনি ধর্ম-দর্শন ও তৎকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করেন। বস্তুত, ঢাকার বাইরে এটাই প্রথম একুশের পুস্তিকা, যা প্রকাশিত হয়েছিলো রাষ্ট্রভাষা হিশেবে বাঙলার মর্যাদার যৌক্তিক আলোচনা। পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। সে সময়ে পুরো নরসিংদী এলাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রশ্নে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম এই পুস্তিকার প্রভাবে আরও বেগবান হয়। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে যখন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর— এই নামগুলো নক্ষত্রপুঞ্জের মতো থোকা থোকা ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের মনন আর মগজে, তখন মোহাম্মদ হানীফ পাঠান সে সময়কার হিশেবে ঢাকা থেকে অনেক দূরে বসে লিখছেন বায়ান্নর পাণ্ডুলিপি। কেবল লিখছেন না, তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁর সাধ্য মতো। একই সঙ্গে সংগঠিত করছেন তরুণদের, ভাষা শহিদদের আত্মদানকে সফল করে তুলতে। তৎকালীন ঢাকা (বর্তমান নরসিংদী) জেলার রায়পুরা অঞ্চলে বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষা হিশেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে লাখপুর, লক্ষ্মীপুর, নারায়ণপুর, মরজাল প্রভৃতি হাইস্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে সভা করেছেন। ধর্মকে ব্যবহার করে বাঙলা ভাষার বিরুদ্ধে চালানো নানা ধরনের অপব্যাখ্যার জাল ছিঁড়েছেন সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে আরও জোরদার করার জন্যে মোহাম্মদ হানীফ পাঠানের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করেন সামসুল হক মোল্লা (প্রধান শিক্ষক, লাখপুর হাই স্কুল), আজিম উদ্দিন আহমেদ (শিক্ষক লাখপুর হাই স্কুল, পরবর্তীতে এডভোকেট), আবদুর রহমান মাস্টার (শিক্ষক, মরজাল হাই স্কুল), আবদুস সালাম (প্রধান শিক্ষক, নারায়ণপুর হাই স্কুল), মতিউর রহমান প্রমুখ বিদ্বৎজন।
স্বাধীনতার পর মোহাম্মদ হানীফ পাঠান লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। বাঙলা প্রবাদ পরিচিতি (১ম খণ্ড, ১৯৭৬; ২য় খণ্ড: ১ম পর্ব, ১৯৮২; ২য় পর্ব, ১৯৮৫) গ্রন্থে তিনি বাঙলা প্রবাদ নিয়ে পরিশ্রমী কাজ করেছেন। নরসিংদীর ছড়া শিরোনামে লোকসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি গ্রন্থের লেখক তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর, ১৯৯০ সালে এটি প্রকাশিত হয়। বাঙলাদেশের প্রাচীনতম বন্দর-নগরী উয়ারী বটেশ্বরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ ও গবেষণার তিনিই প্রথম উদ্যোক্তা। কী অলৌকিক সরণচিহ্ন! আমাদের নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসের আলোকবিন্দু থেকে আত্মপরিচয়ের ভাষা আন্দোলন অবধি মোহাম্মদ হানীফ পাঠান কেমন বাঙলা ভাষার মতোই সতত সন্তরণশীল।
দুই
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের উদ্দেশে বায়ান্নর পাণ্ডুলিপি বিক্ষিপ্তভাবে প্রকাশিত হলেও, তার পূর্ণাঙ্গ রূপটি আমরা পাই বৈশাখ ১৪১২ (এপ্রিল ২০০৫) সালে। মোট তিন ভাগে বিভক্ত ছোট্ট তীব্র এই গ্রন্থটির থরে থরে সাজানো আছে রাষ্ট্রভাষা বাঙলার পক্ষে ক্ষুরধার যুক্তিগুলো। জমিয়তে ওলামায়ে এছলামের পঞ্চাশটি প্রশ্নের প্রতিটি উল্লেখ করে সেগুলোর আলাদা আলাদা আলোচনা করা হয়েছে। প্রশ্নগুলো লিপিবদ্ধ থাকায় আমরা বুঝতে পারি —কোন মানসিকতা থেকে রাষ্ট্রভাষা বাঙলার বিরোধিতা করেছিলো তৎকালীন কাঠমোল্লারা। প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গিয়ে হানীফ পাঠান একদিকে যেমন লক্ষ্য রেখেছেন ধর্মীয় উদারনৈতিক দর্শন, তেমনি উল্লেখ করেছেন তৎকালীন আন্তর্জাতিক ভাষা পরিস্থিতি। তাঁর রচনা থেকে বোঝা যায় ব্যক্তিগতভাবে তিনি ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। কিন্তু রচনায় যেভাবে তিনি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এমনকি নিরীশ্বরবাদীদের মনোজাগতিক চেতনার বিশ্লেষণ করেছেন, তাতে বোঝা যায় তাঁর চিন্তাধারা থেকে আমরা কতোটা পিছিয়ে। দু পৃষ্ঠার ‘আরজ’ অংশে তিনি নিবেদন বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষা হিশেবে মূল্যায়ন করতে না পারার রাজনৈতিক ব্যর্থতা, ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব এবং ভাষিক প্রশ্নে জাতিগত সম্মানবোধ। এরপরের সাড়ে এগারো পৃষ্ঠায় রাষ্ট্রভাষা হিশেবে উর্দূর অসারতা প্রমাণ করেছেন চিন্তা আর ইতিহাসের পাথুরে প্রমাণে।
পঞ্চাশটি যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে তিনি যে আলোচনাগুলো করেছেন, তা থেকে একদিকে যেমন তৎকালীন সমাজের মনোরৈখিক বিবরণ পাওয়া যায়, তেমনি সে সময়ের বিবেচনায় প্রায় অসম্ভব কিছু স্বপ্নের ছবি আমরা দেখতে পাই।
এই আলোচনাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
-
-
-
-
- এক, রাষ্ট্রভাষা-বিতর্কে ধর্মের অপ্রাসঙ্গিকতা প্রসঙ্গে;
- দুই, জ্ঞানার্জন ও যোগাযোগের মাধ্যম হিশেবে মাতৃভাষার গুরুত্বকে নথিভুক্তিকরণ;
- তিন, মাতৃভাষার দার্ঢ্যতার আলোয় ভবিষ্যতের স্বপ্ন-পথ নির্মাণ।
-
-
-
প্রথম ভাগের আলোচনায় তিনি খুব স্পষ্টভাবে জমিয়তে ওলামায়ে এছলামের ইসলাম-কেন্দ্রীক অন্তঃসারশূন্য ধারণাগুলো খণ্ডন করেছেন নিজের ধর্মীয় প্রজ্ঞা দিয়ে। তাঁর আলোচনাগুলো পড়লে আমরা বুঝতে পারি ধর্মের মূল দর্শন থেকে যোজন যোজন দূরে থাকা কিছু সুবিধাবাদী রাজনৈতিক দল কীভাবে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে রাজনীতির পরিবেশ নষ্ট করছে। এই চিত্র আজও বিদ্যমান। এদের মূল লক্ষ্য কখনোই ধর্ম নয়; বরং এদের কাছে মুখ্য হলো রাজনীতিকে একটি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে পরিণত করা। ধর্ম এদের হাতিয়ার মাত্র। এরা নিজেরাও ধর্ম সম্বন্ধে তেমন কিছুই জানে না। কতোগুলো মুখস্থবিদ্যার ওপর ভর করে বিবেচনাবোধহীন কিছু রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদানই এদের মূল লক্ষ্য।
দ্বিতীয় ভাগে আমরা মাতৃভাষার গুরুত্ব বিষয়ে হানীফ পাঠানের আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণের পরিচয় পাই। ১৯৫২ সালে বেলাবোতে বসে তিনি কীভাবে এই তথ্যগুলো আত্মস্থ করে একটি পরিশীলিত বিশ্লেষণে উপনীত হয়েছিলেন, তা যে কোনো বোদ্ধা পাঠকের চিন্তাকে শাণিত করবে। তিনি একাধিক মাতৃভাষার স্বীকৃতির প্রশ্নে রাশিয়া, কানাডা ও সুইজারল্যান্ডের উদাহরণ দিয়েছেন। অন্য ভাষার প্রতি তাঁর যে শ্রদ্ধাশীল বক্তব্য, তা আজকের দিনে আমাদের নিজেদের অবস্থানকে নতুন করে ভাবতে শিখায়। বাঙলাদেশে বসবাসরত অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর মাতৃভাষার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি যে কতোটা সংকীর্ণ, তা এই বইটি পাঠ করে পাঠক বুঝতে পারবেন। তাছাড়া জমিয়তে ওলামায়ে এছলামের আলোচনায় ন্যাক্কারজনক ভাষায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সমালোচনা করায় তিনি প্রতিবাদ করে লেখেন—
পৃথিবীতে ইসলাম আসিয়াছে সমগ্র মানবজাতিকে সংশোধন করিতে, পৌত্তলিক, নাস্তিক, অগ্নি উপাসক বা হিন্দুয়ানী বলিয়া কাহাকেও বর্জন করিতে নয়।
সর্বশেষ অংশে তিনি কিছু স্বপ্ন যাত্রার কথা উল্লেখ করেছেন। ধারাবাহিকভাবে নয়; অনেকটা হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো সেগুলো উদ্ভাসিত হয়েছে আলোচনার নানা অংশে। যেমন ষোলো নম্বর পয়েন্টের আলোচনায় তিনি পশ্চিম পাকিস্তানিদের জবরদস্ত নীতির সমালোচনা করে বলছেন—
ইহা আযাদীর নামে নূতনতর গোলামী মাত্র।
তাঁর এই বক্তব্যে কী স্বাধীনতার রাশপ্রিন্ট আমরা দেখতে পাই না?
বইটি শেষ হয়েছে একটি দেড় পৃষ্ঠার উপসংহারের মাধ্যমে। উপসংহারটি শেষ হয়েছে দু লাইনের দুটি স্লোগান দিয়ে—
পূর্ব বাংলা গণশক্তি অমর হোক/ বাঙলা ভাষা অমর হোক।
১৯৫২ সালেই মোহাম্মদ হানীফ পাঠান বুঝেছিলেন বাঙলা ভাষার অমরতার প্রশ্নে শেষ ভরসা গণ-মানুষ। তাঁদের মুখে মুখেই তৈরি হয় ভাষার মানচিত্র, নির্মিত হয় তার চলার পথ। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এই নির্মোহ সত্যটি কি আমরা উপলব্ধি করতে পারছি?