মনে হয়, এ যেনো বৃষ্টির সংসারে হঠাৎ পদার্পন। এমন হয় না মাঝে মাঝে, চলতি পথে হঠাৎ কোনো পরিচিত মুখের সঙ্গে দেখা- বলা নেই কওয়া নেই, ধুম করে সে নেমন্তন্ন করে বসে। তখন তার সংসারে গিয়ে হাজির হতে হয়। এমনই হলো। শিলং এসে প্রথমদিনই বৃষ্টির বেশ গোছানো সংসারের অতিথি হলাম। গোটা আকাশ মেঘের চাদরে মুড়ি দেয়া এক আদ্দিকালের বুড়ো। ঝিরঝির বৃষ্টি- একটানা, অবিরাম আর ধূসর- যেনো অন্য কোনো রঙ তার চেনা নেই। তামাবিল সীমান্তে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মাঝে পাসপোর্ট আর ট্রাভেল ট্যাক্সের কাগজ হাতে দাঁড়ালাম আমরা। ইমিগ্রেশন ফর্ম পূরণ করার সময় বারবার মনে হচ্ছিলো- কার দেশ? কাদের কাছে বলছি নিজের সম্বন্ধে? একটা গোটা সাতচল্লিশ বৃষ্টির সঙ্গে টুপটাপ করে ঝরে পড়ছিলো। আমরা টুকটাক করে নিজেদের কাজ সারছিলাম। বাঙলাদেশ এক্সিট সিল দিয়ে দিলে আমাদের মনে পড়ে- এমন কতো কতো সরকারি সিলে আমাদের ঘর আলাদা হয়ে গিয়েছে, এমন কতো কতো সরকারি স্বাক্ষরে আমরা আত্মীয়ের নামকরণ করেছি ‘বিদেশী’। এভাবে মানচিত্র ভেঙে যায়, ভেঙে পড়ে মানুষের হাতে-হাত রাখা পৃথিবীর শরীর। আমরা পাড়ি দিলাম ‘সীমান্ত’ নামের এমন এক শব্দ- যা আমাদের অভিধানে আছে, অথচ জীবনে নেই; আমাদের মেনে নেয়ায় আছে অথচ মনে নেয়ায় নেই। দুই সীমান্তের মাঝখানে দু হাত বাড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ- কেমন যেনো দেশছাড়া, ঘরছাড়া। এই ঘরছাড়া রবীন্দ্রনাথকে কতোগুলো মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে আমরা সঙ্গে করে নিয়ে এলাম ডাউকির ইমিগ্রেশনে। লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁর ইমিগ্রেশন ফর্ম পূরণ করে দিলাম। তিনি তো পৃথিবীর একমাত্র পার্সনা নন গ্রাটা, যাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলিতে লেগে আছে আমাদের নিয়তির অমোচনীয় কালি।
আমাদের ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ হলো বটে কিন্তু বৃষ্টি শেষ হলো না- হবেই বা কেনো? এই শিলং তো বৃষ্টির সংসার! এখানে রবীন্দ্রনাথের কবিতারাও রেইনকোট পরে পাহাড়ি রাস্তা পার হয়। সীমান্ত থেকে ২.১ কিলোমিটার পথ হেঁটে আমরা যখন ডাউকি বাজারে এলাম- তখন আমাদের ব্যাগগুলো ভিজে গেছে। আমাদের রেইনকোট আর ছাতা বৃষ্টির সংসারে বেশ এক থালার সম্পর্ক পাতিয়ে বসেছে।
আমাদের সঙ্গে কোনো সীতা ছিলেন না, অথচ রাম এসে জানালেন তিনি আমাদের নিয়ে শিলং যেতে চান। আমরা তাকে রাবনের কথা বলতেই তিনি বললেন- লক্ষণকে তিনি সাড়ে তিন হাজার টাকায় নিয়োগ দিয়ে এসেছেন। অতএব তিনি নির্ভয়। এমন নির্ভয় ড্রাইভারকে আমরা সাহস করে একটু ভয় দেখালাম। শেষমেষ রফা হলো। আমরা রবিঠাকুরের কানে কানে বলে দিলাম আজকের ডলার আর রুপির দরদাম। আমরা রামেরও কানে কানে বলে দিলাম- কোথায় কোথায় যেতে চাই।
বৃষ্টির ছেলেমানুষী আমাদের গাড়ির উইন্ডশিল্ড উইপারকে কানামাছির চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে যাচ্ছে। গাড়িটা এগুচ্ছে পাহাড়ি রাস্তার ভিজে শরীর ছুঁয়ে। আমাদের তখন গল্প চলছে তুমুল। গল্প চলছে ডাউকি সীমান্তে দেখা হওয়া লরি ড্রাইভারকে নিয়ে। আমাদের কাছে নিজের পরিচয় দিয়েছেন- ‘আমি হিটলার’ বলে। তো হিটলার তো আজকাল আর অতো আলোচিত হয় না, চারপাশে এতো হিটলার যে- আসল হিটলার ব্রাত্য।
আমরা বোরহিলের কাছে গেলাম। বৃষ্টি ঝরছেই- ঝরবেই তো- শিলং যে বৃষ্টির সংসারের রাজধানী। বোরহিল ঝর্ণা- ঝর্ণারই মতো। পাহাড়ের হৃদয় কেটে প্রমাণ করে চলেছে অভিকর্ষজ ত্বরণের সূত্রাবলী। আমাদের বৃষ্টিভেজা চোখ অপলক সেই ঝর্ণার ভালোবাসার কাছে আত্মসমর্পন করতে চাইছে। আমাদের ছেলেমানুষী, আমাদের হাবা কৈশোর বা পিছলে পড়া তারুণ্যের খানিকটা বেরিয়ে আসে। আমরা অবাক হয়ে আমাদের রেইনকোটের রঙ দেখি, আমাদের ছাতা খোলার শব্দ শুনি। এরপর তথৈবচের মতো কতোগুলো বিক্ষিপ্ত জায়গা- আমাদের ড্রাইভার রামবাবু তাড়া দিলেন- জলদি যেতে হবে। রামবাবু বিহারের লোক। বারবার বলছেন- আমি তো এখানকার নই, বিহারের লোক। রামবাবুকে জিজ্ঞেস করা হয়নি- তোমার বিহার কেমন আছে রামবাবু? বিহার ছেড়ে এই যে শিলঙে আছো- তোমার কেমন লাগে? কী লাভ জানতে চেয়ে? গোটা পৃথিবীটাই তো ঘড়ছাড়া। পুরো মহাবিশ্বই তো আজ উদ্বাস্তু। রামবাবু তো কেবল একটি নাম, অজস্র নামের মধ্যে একটি নাম।
এরপর দীর্ঘ প্রায় আড়াই ঘণ্টা- আমরা বৃষ্টিভেজা রাতের আঁধার কেটে কেটে এগিয়ে এলাম শিলং শহরের দিকে। শহরই বটে! পাহাড়ের গায়ে গায়ে ফানুসের মতো ঘরবাড়ি। অন্ধকারে টিমটিম করে জ্বলছে তাদের ঘরের আলো- যেনো এই উড়ে গেলো আকাশে।
শিলং শহরে এসে দেখি বৃষ্টি পড়ছেই। হয়তো এখন বাঙলাদেশও ভিজছে বৃষ্টিতে, হয়তো বা পৃথিবীর আরও কোথাও কোথাও ঝরছে তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টির কোনো দেশ নেই? পাসপোর্ট লাগে না? তার ভিসার মেয়াদ কতোদিন? বৃষ্টি কোনোদিন কাটাতার ভাসিয়ে নিতে পারে না?