শহিদ জননী,
কী অলৌকিক সমাপতন! ১৯২৯ সালে যখন আপনি জন্ম নিচ্ছেন— বৈশাখে-নিদাঘে অখণ্ড ভারতবর্ষের মুর্শিদাবাদে; প্রায় তখনই এরিক মারিয়া রেমার্ক তাঁর কারুবাসনা ছড়িয়ে দিচ্ছেন অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট উপন্যাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায়। আপনি তাহলে এই অমোঘ উপন্যাসটির সমবয়স্ক! হয়তো এ কারণেই পশ্চিম সীমান্তে হারিয়ে যাওয়া পল ব্যমারের প্রজন্মের সঙ্গে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহিদ রুমীর প্রজন্মের অলিখিত সংলাপ রচনা করেছেন আপনি। ‘হারিয়ে যাওয়া’ এবং ‘আত্মদান’— অভিধানের এই দু’টি শব্দের অর্থগত পার্থক্যের কারণেই এরিক মারিয়া রেমার্ককে আরও দু’টো উপন্যাস লিখতে হয়েছিল। কিন্তু আপনি জানতেন একাত্তরের দিনগুলি সেই মুক্তভাষী স্থিরচিত্র, যাতে আপনার জীবনবৃত্তান্তের ক্ষতচিহ্নগুলো ছাপিয়ে আরও বেশি স্তব্ধতা দান করে আসমুদ্রহিমাচলকে; কার্যত হয়ে ওঠে বাংলাদেশ দর্শনের পাণ্ডুলিপি।
এক কানাগলির সময়ে আমাদের জন্ম। আমরা জন্ম নিয়েছিলাম এমন এক দশকে যখন ইতিহাস বিকৃতির কুৎসিত উৎসব চলছে দেশময়। জন্মের পর আমরা জেনেছিলাম— বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একটি ‘রাষ্ট্রধর্ম’ আছে কিন্তু কোনো ইতিহাস নেই। আমাদের বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়গুলোতে পাঠ্যপুস্তকের নামে পড়ানো হয়েছিল কতগুলো মিথ্যে কথা। আমরা সেই প্রজন্ম— যারা অনেকদিন অব্দি জানতেই পারিনি আমাদের জাতির পিতার কথা। স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ইত্যাদি মৌল বিষয়গুলো নিয়ে ক্রমাগত রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচারের ভেতরে বড় হওয়া একটি প্রজন্ম আমরা। এ তো গেল উপরিকথন। আমাদের প্রজন্মের এমন কাউকেই পাওয়া যাবে না, যারা স্কুলে এই কথা শুনেনি যে— রবীন্দ্রনাথ একজন ‘হিন্দু’ কবি। একাত্তরের দিনগুলিতে আপনি রুমীর শৈশব নিয়ে কিছু লিখেননি; জানি না শৈশবে রুমী ফেলুদা পড়তেন কিনা, ব্যোমকেশকে জানতেন কিনা, চাঁদের পাহাড়ে মগ্ন হতেন কিনা। অনেক বাধা ডিঙিয়ে আমাদের এই বইগুলো পড়তে হয়েছে। কারণ আমাদের শৈশব কেটেছিল এমন এক রাজনৈতিক সরকারের সময়ে, যাদের রাজনীতি আবর্তিত হতো ‘ভারতবিরোধিতা’কে কেন্দ্র করে। ফলে সত্যজিৎ, শরদিন্দু বা বিভূতিভূষণের বই আমাদের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার তালিকায় থাকতো না। আমরা দেশভাগ দেখিনি, মন্বন্তর দেখিনি, মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি, সাতই মার্চের রেসকোর্স দেখিনি, স্বৈরাচারের পতন দেখিনি এমনকি একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সেই অনন্য আন্দোলনও দেখিনি। আপনাকে সামনাসামনি কখনও দেখিনি; আপনার সহযোদ্ধারা যখন তুমুল পরিশ্রম আর প্রজ্ঞায় নির্মাণ করে চলেছিলেন ইতিহাস— তাঁদের সেই কর্মমুখর জীবনকেও আমরা কাছ থেকে দেখিনি। জানি না, উনিশ ও বিশ শতকের বাঙালি মনীষা নিয়ে যখন আলোচনা হয়, বাঙালির অনবদ্য স্বপ্নময় পঞ্চাশ, ষাট বা সত্তর দশকের প্রজন্মকে নিয়ে যখন আলোচনা হয়; তখন আমাদের মতো নব্বই দশকের কপালপোড়াদের নিয়েও আলোচনা হয় কিনা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ক্লাশরুমে যাদের কোন প্রবেশাধিকার ছিল না।
আমাদের সেই ঝড়ের রাতে তবুও আপনার অভিযান অবিচল ছিল। চেতনার সন্ধিতে দৃষ্টি বিনিময় অপ্রাসঙ্গিক— আপনি জানতেন। ফলে আমাদের সেই স্কুলগামী পা-গুলো থমকে দাঁড়িয়েছিল শহরের দেয়ালজুড়ে সেঁটে দেয়া নির্মূল কমিটির পোস্টারগুলোর সামনে। আমরা সেই প্রথম শিখলাম— কী করে পোস্টারের সঙ্গে কথা বলতে হয়। আমরা শিখে নিলাম ‘ঘৃণা’ শব্দটির কার্যকর সমার্থক শব্দ হলো ‘রাজাকার’। আমাদের পাঠ্যবইগুলোতে তখন শেখানো হচ্ছে ঘুমপাড়ানির গান, ছড়ানো হচ্ছে বিভ্রান্তি; কিন্তু আমরা জেনে গেলাম— জাতি হিসেবে আমাদের সংগ্রামের একটি ইতিহাস আছে, রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত মিথ্যাচারে আমার ইতিহাস নেই। আমার ইতিহাস প্রোথিত আছে দেয়ালে সেঁটে দেয়া নির্মূল কমিটির সেই পোস্টারগুলোতে। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন চলছে দেশময়, তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার এই আন্দোলন দমনে চালাচ্ছে নানা নির্যাতন; কিন্তু তারা জানতেই পারেনি যে আপনি ও আপনার সহযোদ্ধারা আরেকটি আন্দোলন চালাচ্ছিলেন আমাদের মগজের ভেতরে। কারণ, আপনি তো জানতেন— বিপ্লব মানে কেবল পতাকার রঙ বদল নয়, বিপ্লব মানে মননধর্মের রূপান্তর। আমরাও তখন বড় হচ্ছি, স্কুলের ক্লাশ টপকে যাচ্ছি এবং আমাদের স্কুলব্যাগে ঠাঁই করে নিচ্ছে একাত্তরের দিনগুলি। আমরা খবরের কাগজ পড়তে শিখে গেছি এবং ততদিনে আমাদের জানা হয়ে গেছে— আমাদের রাষ্ট্র এখনও একাত্তরের পরাজিত অপশক্তির হিংস্র নখরে বিদ্ধ। কানাগলিতে বড় হওয়া একটি হাবা প্রজন্মকে এক হ্যাঁচকা টানে আপনি এনে দাঁড় করালেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক মহাসৈকতে। আমাদের মগজের কোষে কোষে জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভেঙে গেল নিমেষেই, আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম— আপনি ও আপনার সহযোদ্ধারা কেবল আমাদের ইতিহাসের ক্লাশরুমেই নয়, প্রবেশাধিকার দিয়েছেন আমাদের স্বপ্ন ও কল্পনার রাজ্যেও। আমার বারবারই মনে হয়েছে— এই কথাটি আপনাকে কেউ কখনও বলেনি। মায়েদের তো অজানা কিছুই থাকে না, তবুও মায়ের অনেক জানা কোনো কথাকেই নতুন করে বলে মা-কে চমকে দেবার একটি আনন্দ সন্তানের থাকে। সেই কারণেই আপনাকে জানানো যে— আপনার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনটি কেবল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্বন্ধেই চক্ষুদানপর্ব সমাপ্ত করেনি; বরং আমাদের মনস্তাত্ত্বিক নান্দীপাঠও সম্পন্ন হয়েছিল এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ঐতিহাসিক সত্যগুলোকে একে একে পরিবেশনই শেষ কথা নয়, তাকে মনন উপযোগি করে তোলাও তো আন্দোলনের একটি অংশ। এটি আপনি ও আপনার সহযোদ্ধারা জানতেন। আর জানতেন বলেই সাতটি তারার ঝিকিমিকি লিখেছিলেন। একটি ইতিহাস সচেতন প্রজন্ম ততক্ষণ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না, যতক্ষণ না সে তার ইতিহাসকে সৃজনে-সংগ্রামে রক্ষা করতে না শেখে। আপনি তো কেবল আমাদের দেখেননি, দেখেছিলেন উত্তরকালকেও। ফলে গজকচ্ছপ লেখার পরই আপনি হাত দেন বুকের ভেতর আগুন উপন্যাসে এবং তার পরই রচনা করেন বিদায় দে মা ঘুরে আসি। আপনার সহযোদ্ধারাও আমাদের চৈতন্যে সমানভাবে বিচরণ করছেন, গড়ে তুলছেন আমাদের মননকে, ভবিষ্যত বাংলাদেশের জন্য। একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায়— বইটি এক ধাক্কায় আমাদের বড় করে তুলেছে। আমাদের প্রস্তত করেছে; আমরা জেনেছিলাম— আমাদের এখনও অনেক দূর হাঁটতে হবে। আমাদের পায়ের তলার মাটি এখনও ঘাতকমুক্ত হয়নি।
১৯৯৪ সালে পৃথিবীর কাছে আমাদের একা করে চলে যান আপনি। আপনার মহাপ্রস্থানের দিনগুলোর কোনো স্মৃতি আমার কাছে নেই। ‘শহিদ জননী জাহানারা ইমাম নেই’— এই উপলব্ধিটি আমার প্রথম হয়, যখন আমি অসহায় বসেছিলাম টেলিভিশনের সামনে আর এক নরপিশাচ যুদ্ধাপরাধী পৈশাচিক হাসি দিয়ে গণমাধ্যমকর্মীকে বলছিল— দেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই। মা-হারা শিশুর অনুভূতি নিয়ে মাথা নিচু করে চলা প্রজন্মকে সেদিন আপনার সহযোদ্ধারা আবার জানিয়েছিলেন— শহিদ জননী আছেন। রাষ্ট্রীয় তোপকে অস্বীকার করে নির্মূল কমিটির সেদিনের সেই প্রতিবাদটি আমরা সযত্নে তুলে রেখেছিলাম বুকের তোরঙ্গে।
‘শাহাবাগ আন্দোলন শহিদ জননীর আন্দোলনের উত্তরাধিকার’— ২০১৩ সালে শাহাবাগের প্রজন্ম চত্বরে সূর্যমুখী স্লোগানের পাশাপাশি যখনই এই কথাটি উচ্চারিত হচ্ছিল, হাজার হাজার মানুষ উঁচু করে তাকাচ্ছিলেন আপনার দিকে। আপনার চশমার কাঁচ কি তখন খানিকটা ঝাপসা হয়ে এসেছিল? আপনার সহযোদ্ধাদের কাছ থেকে সেদিন আমরা জাতীয় পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিলাম। এমন হস্তান্তর কাব্যের অধিক, রূপকের বাইরে।
আপনার জন্মদিনে শহিদ রুমী একটি আধফোটা বনি প্রিন্সের কলি উপহার দিয়েছিল। আমরা কী দেব? মা-কে কিছু দিতে পারার অক্ষমতাই তো সন্তানের সবচেয়ে বড় গৌরবের। কারণ সেই দিতে না-পারার মাঝেই যে অনেক কিছু দেয়া যায়। ইতিহাস বিকৃতির সময়ে প্রায় হারিয়ে যাওয়া যে প্রজন্মের হাতে আপনি একাত্তরের দিনগুলি তুলে দিয়েছিলেন, যাদের সাক্ষী রেখে আপনি আকাশমুখী বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিরুদ্ধে; সেই প্রজন্ম আজ বড় হয়ে গেছে শহিদ জননী। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পোস্টার দেখে বড় হওয়া প্রজন্ম এখন নিজেরাও পোস্টার লিখতে শিখে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য লড়াই করতে শিখে গেছে। আগামী প্রজন্মের কাছে যখন আমরা আপনার বার্তা নিয়ে যাই, আপনার সহযোদ্ধারা তখনও আমাদের পাশে থাকেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা নিজেদের ঋদ্ধ করি। তারপর নির্দোষ চায়ের ক্যান্টিনে বা আড্ডায় যখন আমরা ফিরে আসি, তখন নিজেদের মধ্যে বলাবলি করি— মায়েরা এমনই হন; নিজেরা তো দক্ষ মাস্টারমশাই হনই, আবার সন্তানের অনাগত দিনের জন্য যোগ্য মাস্টারমশাইদের নিয়োজিতও করে যান।
শুভ জন্মদিন শহিদ জননী।
ইতি
আপনার আন্দোলনের উত্তরাধিকার