এই কদিন আগের কথা। বিশ ফেব্রুয়ারি রাত। চলছে ২০১২।
সময় পেরিয়ে গেছে বারোটার ঘর ছেড়ে। ইংরেজি সংস্কৃতির নিয়মানুসারে তখন একুশে ফেব্রুয়ারি। আমরাও একুশে ফেব্রুয়ারি বলি— এ আমাদের এক ধরণের দীনতা। তবে সে দৈন্য ঢাকার জন্যে আমরা আদর করে তার নাম দিয়েছি ‘একুশের প্রথম প্রহর’। প্রভাতফেরী তখন দূর দিগন্তে বাঁশি বাজায়।
শাহাবাগ পার হয়ে যাচ্ছি। শহিদ মিনার থেকে ভেসে আসছে শহিদ দিবসের গান। আবদুল গাফফার চৌধুরীর (জন্ম: ১২ ডিসেম্বর ১৯৩৪) লেখা এবং শহিদ আলতাফ মাহমুদের (জন্ম: ২৩ ডিসেম্বর ১৯৩৩- অন্তর্ধান ৩০ আগস্ট ১৯৭১) সুর করা সেই চিরন্তন গান— “আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী.. ..”।
ক্যামেরা নিয়ে আমরা গেলাম শহিদ মিনারের কাছে।
শহিদ মিনার— যেনো বিস্তীর্ণ দীঘিতে বিম্বিত চাঁদের আলো। আমাদের প্রাণের মিনার।
আমি সেদিন তীব্র আলোড়িত হয়েছিলাম। আমার ভেতরের বোধগুলো একে একে রূপকথার নায়িকার মতো জেগে উঠছিলো, কথা বলছিলো। কেউ কেউ হৃদয়ের বারান্দায় এসে রোদের বৃত্তে চুল মেলে ধরেছিলো, কপালে তাদের লাল টিপ, যেনো শহিদ মিনারের লাল বৃত্ত।
আমি মানুষের শ্রদ্ধাঞ্জলির ঢল দেখে আলোড়িত হইনি। নিরাপত্তা ব্যবস্থার নিখুঁত আয়োজনে আলোড়িত হইনি। আমি কেবলই আলোড়িত হচ্ছিলাম, এবং তা এই কারণে যে— আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই মুহূর্তে, যে মুহূর্তে সমগ্র বাঙালি জাতি বুঝে কিংবা না-বুঝে পালন করছে ভাষা আন্দোলনের ষাট বছর।
সেদিন এমন অনেক কিছুই ছিলো, যা হৃদয়ে তীব্র বিষাদ জাগায়। ঠিক ‘বিষাদ’ নয়, বিরক্তি— কারণ বিষাদ শব্দটির সাথে একটি রোম্যান্টিকতার স্রোত আছে। সেদিন বিরক্ত হতে পারতাম ঘোষণা মঞ্চে বসে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, যাদের অধিকাংশই বাঙলা বিভাগের শিক্ষক বা আমাদের গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব— তাদের ভুল বাঙলা উচ্চারণ শুনে, বিরক্ত হতে পারতাম যখন বারবার ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’কে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’ লেখা ব্যানারগুলো চোখে পড়ছিল। কিন্তু আমি বিরক্ত হইনি, কেননা, সেদিন সেই ষাট বছর পূর্তির মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমি হয়ে উঠেছিলাম এক মিহিন মুহূর্তের কবি; কবিরা কেবলই ভালোবাসতে জানেন, ‘বিরক্ত’ শব্দটি তাঁদের অভিধানে নেই।
আমি এক প্রাণের মিনারের কথা বলছি
বাঙলাদেশ ও বাঙালি জাতির সাধনা-সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রতীক কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, যা গৌরবের সাথে দাঁড়িয়ে থাকলেও বাঙালি বছরের ৩৬০ দিন তার কোনো পরিচর্যা করে না। এ শহিদ মিনারেরও একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। এ ইতিহাস ভাঙা-গড়ার ইতিহাস, জয়-পরাজয়ের ইতিহাস। ২০১২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের ষাট বছরেও এই শহিদ মিনার নিয়ে নানা বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। কাঠমোল্লারা মসজিদ থেকে খুৎবার নামে শহিদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পনের পবিত্রতম কাজটি সম্বন্ধে নানা রকমের ফতোয়া জারি করছে। আমার মনে হয়েছে— এইসব কুকর্মের বিরুদ্ধে আমি একটি লেখা লিখতে পারি। আমার লেখাই হোক এইসব কূপমণ্ডুকদের বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদ।
বাঙলা ভাষার জন্যে বাঙালি রক্ত দিয়েছিলো বায়ান্নর সালের একুশে ফেব্রুয়ারি অপরাহ্নে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের তদানীন্তন ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে, রক্ত দিয়েছিলো বাইশে ফেব্রুয়ারি পুরাতন হাইকোর্ট ও কার্জন হল মধ্যবর্তী রাস্তায়, নবাবপুর রোডে, বংশাল ও রথখোলার মোড়ে। নিহতদের লাশ আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা পায়নি। তাঁদের কবর দেয়া হয়েছিলো গোপনে, রাতের আঁধারে, কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে। কিন্তু বরকত ও শফিউর রহমান ছাড়া আর সবার কবর হারিয়ে গেছে সেদিনের স্বৈরাচারী শাসকের ষড়যন্ত্রে। সেদিন স্লোগান তৈরি হয়েছিলো— ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’। কিন্তু শহিদ স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্যে প্রতীক চাই। তাই সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদয় হয়েছিলো শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ বা শহিদ মিনারের স্বপ্ন। আর সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছিলো বায়ান্নর তেইশে ফেব্রুয়ারি, রাতারাতি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মেডিক্যাল কলেজের অন্যতম কর্মী আহমদ রফিকের ভাষায়—
প্রথম শহীদ মিনার এক আকষ্মিক চিন্তার যৌথ ফসল, তেমনি এর সমাপনও সমষ্টিগত শ্রমের এক আশ্চর্য ফসল
শহিদ মিনার নির্মাণ প্রসঙ্গে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অপর কর্মী সাঈদ হায়দার লিখেছেন—
এটাকে স্বতঃস্ফূর্ত একটা পরিকল্পনা বলা চলে। দলমত নির্বিশেষে সকল ছাত্র শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করে। একুশে ফেব্রুয়ারি রাত থেকেই শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়। আর ২ শে ফেব্রুয়ারি থেকে শহীদ মিনার তৈরীর কাজ শুরু হয়। ২৩ তারিখ বিকেল থেকে শুরু করে সারা রাত সেখানে কাজ হয় (কার্ফ্যু থাকা সত্ত্বেও).. ..ইট বালির কোনো অভাব ছিলো না। মেডিক্যাল কলেজের সম্প্রসারণের জন্য প্রচুর ইটি বালি ছিলো। ছাত্ররাই ইট বয়ে এনেছে। বালির সাথে সিমেন্ট মিশিয়েছে। দু’ জন রাজমিস্ত্রী ছিলো।.. .. শহীদ মিনারের কাজ শেষ হলে দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিলো এবং নকশাটি সেখানেই টাঙিয়ে দেয়া হয়েছিল।.. ..শরফুদ্দীন (তাকে আমরা ইঞ্জিনিয়ার বলতাম। সে ভাল অঙ্ক জানতো) শহীদ মিনারের নির্মাণের কাজে যথেষ্ট যত্ন নিয়েছিল। এ-ছাড়াও মাওলা, হাশেম, জাহেদ, আলিম আরও অনেকে শহীদ মিনার নির্মাণে প্রাণপাত পরিশ্রম করে। এছাড়া ছিল আমাদের অনেক বয়-বেয়ারা, এরাই ছিল সেদিনকার বড় কর্মী। নকশায় সাড়ে ন ফুটের পরিকল্পনা হয়েছিল, কিন্তু শেষ করার পর দেখা গেলো মূল পরিকল্পনাকে ডিঙ্গিয়ে গেছে। মিনারটি সম্ভবত এগারো ফুট হয়েছিলো। বদরুল আলমও মিনার নির্মাণের বিষয়ে সাহায্য করেছিলো। তার হাতের লেখা ছিল চমত্কার। কাগজে লিখে মিনারের গায়ে সেঁটে দিলে মর্মর পাথরের মতো দেখাত। আজকের শহীদ মিনার যেখানে, প্রায় তার কাছাকাছি মিনারটি তৈরী করা হয়েছিল। .. ..শহীদ শফিউর রহমানের পিতাকে এনে ২৪শে ফেব্রুয়ারি মিনারটির উদ্বোধন করা হয়েছিল। আমি সেখানে ছিলাম। পরবর্তী সময়ে আবুল কালাম শামমুদ্দীন সাহেব নাকি উদ্বোধন করেছিলেন। হয়ত আরও আনুষ্ঠানিকতা বজায় রাখার জন্যে কালাম সাহেবকে দিয়ে পুনরায় উদ্বোধন অনুষ্ঠান হয়ে থাকবে।.. ..
সাঈদ হায়দারের নকশায় এবং বদরুল আলমের রেখায় মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে নির্মিত প্রথম শহিদ মিনারটি ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে শহিদ শফিউর রহমানের পিতা আর ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে আবুল কালাম শামসুদ্দীন উদ্বোধন করেছিলেন এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালের মধ্যেই এ মিনার হয়ে উঠেছিলো বাঙালির সাংস্কৃতিক তীর্থকেন্দ্র। কিন্তু প্রতিক্রিয়ার কালো হাত এটা মেনে নিতে পারেনি। তাই ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি দুপুর আর অপরাহ্নের মধ্যেই নাজিমুদ্দিন-নুরুল আমিনের সশস্ত্র বাহিনী বাঙলাদেশে বাঙালির প্রথম শহিদ মিনারটি আক্ষরিক অর্থে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলো। কিন্তু তারা জানতো না— ইতোমধ্যেই বাঙালির হৃদয়েই নির্মিত হয়েছে প্রাণের শহিদ মিনার। তাই তিপ্পান্ন, চুয়ান্ন, পঞ্চান্ন, ছাপ্পান্ন, সাতান্ন, আটান্ন, ঊনষাট, ষাট. একষট্টি, বাষট্টি— দশটি বছরের প্রথম তিনটি বছর নিশ্চিহ্ন মিনারের কাপড় ঘেরা স্থানটি আর বাকি সাতটি বছর শহিদ মিনারের জন্য স্থাপিত ভিত্তিটিই ছিলো এদেশের মানুষের শহিদ মিনার। তিপ্পান্ন থেকে তেষট্টি প্রতিটি আন্দোলনে বাঙালি শপথ নিয়েছে ঐ স্মৃতির মিনারে, যা বাঙালিকে দিয়েছে অবিরাম সংগ্রামের অন্তহীন প্রেরণা।
বর্তমান শহিদ মিনারের স্থান নির্বাচন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়েছিলো আবু হোসেন সরকারের মুখ্য মন্ত্রীত্বের আমলে ছাপ্পান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে। পূর্তমন্ত্রী কর্তৃক শহিদ মিনারের স্থান নির্বাচন এবং পরের দিন অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের উদ্যোগ-আয়োজন তদারক করার সংবাদ প্রচার করা হলে জানা যায়— ‘রাতারাতি শহীদ মিনার’ তৈরির প্রস্তুতি চলছে। এতে জনতা সেখানে যায় এবং দেখে স্বয়ং মন্ত্রীই শহিদ মিনার উদ্বোধনের উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। এতে জনতা আপত্তি জানায় এবং শেষ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহিদ রিক্সাচালক আওয়ালের ছয় বছর বয়স্কা কন্যা বসিরনকে দিয়ে মিনার উদ্বোধন করা হয়। এভাবে ছাপ্পান্ন সালের বিশ ফেব্রুয়ারি রাতে জনতা বায়ান্নর শহিদ আওয়ালের কন্যা বসিরনকে দিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবে বর্তমান শহিদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করায়।
ছাপ্পান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে বর্তমান শহিদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর আনুষ্ঠানিকভাবে স্থাপন করা হয় এবং তা করেন তত্কালীন পূর্ব বাঙলার তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তত্কালীন সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং শহিদ বরকতের মা হাসিনা বেগম। ঐ প্রসঙ্গে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় ছাপ্পান্ন সালের তেইশে ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত প্রতিবেদন—
সকাল নয়টায় পবিত্র কোরান তেলোয়াতের পর মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের পার্শ্বে মওলানা ভাসানী, প্রধানমন্ত্রী জনাব আবু হোসেন সরকার ও শহীদ বরকতের মাতা যুক্তভাবে ‘শহীদ মিনার’-এর পার্শ্বে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের উদ্দেশ্যে জনাব আবু হোসেন সরকার জুতা পায়ে আগমন করিলে উপস্থিত ছাত্র-জনতার মধ্যে দারুণ বিক্ষোভ ও উত্তেজনা দেখা দেয় এবং শেষ পর্যন্ত জনাব সরকার জুতা খুলিতে বাধ্য হন।
আবু হোসেন সরকার মন্ত্রীসভার পূর্তমন্ত্রী আবদুস সালাম খান কর্তৃক শহিদ মিনারের পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং যতো সত্ত্বর সম্ভব সরকারের কাছে পেশ করার জন্যে সরকারি স্থপতিকে নির্দেশ দানের কথা ইতিহাস পাঠে জানা যায়, এখানেও উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আবু হোসেন মন্ত্রীসভার আমলে শহিদ মিনারের পরিকল্পনা প্রণয়ন বা বাস্তবায়নের কাজ আর বিশেষ অগ্রসর হয়নি। ছাপ্পান্ন সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক পার্টির মন্ত্রীসভার পতন ঘটে এবং ০৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খান পূর্ব বাঙলায় প্রথম আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেন। আওয়ামী লীগ চৌদ্দ মাস অর্থাৎ আটান্ন সালের মার্চ মাসের শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলো, এ সময় শহিদ মিনারের কাজ বেশ অগ্রসর হয়েছিলো এবং সাতান্ন সালের ৩রা এপ্রিল আইন সভায় বাংলা একাডেমী অ্যাক্ট ১৯৫৭ পাশ হয়। বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয় সাতান্ন সালের ১০ আগস্ট আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই।
আতাউর রহমান খানের মুখ্য মন্ত্রীত্বের আমলে শহিদ মিনারের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে তদানীন্তন চীফ ইঞ্জিনিয়ার এম. এ. জব্বারের ওপর। ছাপ্পান্ন সালের শরত্কালে শিল্পী হামিদুর রাহমান শিল্পকলা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা সমাপন করে ইংল্যান্ড থেকে দেশে প্রত্যাবর্তন করলে চীফ ইঞ্জিনিয়ার জব্বার এবং শিল্পী জয়নুল আবেদীন তাঁকে অনুরোধ জানান শহিদ মিনারের জন্য একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে। তাঁদের অনুরোধ অনুযায়ী শিল্পী হামিদুর রাহমান শহিদ মিনারের একটি মডেল ও বায়ান্নটি নকশা ও পরিকল্পনার কাগজপত্র পেশ করেন। অন্যান্য শিল্পী ও স্থপতিরাও প্রতিযোগিতামূলক নকশা দিয়েছিলেন। কিন্তু বিখ্যাত গ্রীক স্থপতি ডক্সিয়াডেস (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের নকশাকার), চীফ ইঞ্জিনিয়ার জব্বার এবং শিল্পী জয়নুল আবেদীন সমন্বয়ে গঠিত কমিটি হামিদুর রাহমানের নকশাটিকে অনুমোদন করেন। শিল্পী হামিদুর রাহমানের পরিকল্পনা অনুসারে সাতান্ন সালের নভেম্বর মাসে শহিদ মিনারের নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং একটানা কাজ চালিয়ে আটান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারির মধ্যে শহিদ মিনারের ভিত্তি মঞ্চ এবং তিনটি স্তম্ভ তৈরি সমাপ্ত হয়। এর মধ্যে ভাষা আন্দোলনের ওপর হাজার বর্গফুটের একটি ম্যুরাল চিত্রের দুই স্তরের কাজ হামিদুর রাহমান শহিদ মিনারের নিচের ঘরে সমাপ্ত করেন। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ পাকিস্তান বাহিনী শহিদ মিনার ধ্বংস করার সময় ঐ মূল্যবান ম্যুরালটি নষ্ট করে দেয়। এছাড়া পরিকল্পিত শহিদ মিনারের জন্যে শিল্পী নভেরা আহমেদ তিনটি ভাস্কর্যের কাজও ঐ সময়ে শেষ করেন।
শহিদ মিনারের স্তম্ভগুলোতে এখন লোহার শিক দেয়া হয়েছে। কিন্তু শিল্পীর মূল পরিকল্পনাতে ছিলো অজস্র চোখের নকশা। লেবু-হলুদ আর গাঢ় নীল রঙ এর স্টেইন্ট গ্লাসে তৈরি হবে চোখগুলো আর মিনারের সামনে প্রশস্ত জায়গাতে মার্বেল পাথর— এই ছিলো শিল্পীর পরিকল্পনা। সামনের মেঝেতে স্টেইন্ট গ্লাসের বিভিন্ন রঙিন চোখের আলোকিত প্রতিফলন পড়লে সূর্যের সাতরঙা বর্ণালী মেঝেতে সৃষ্টি হতো। পুরো মিনারটির সামনে একটি রেলিং থাকার কথা ছিলো। রেলিংটি আগাগোড়া বর্ণমালা দিয়ে তৈরি করার স্বপ্ন ছিলো শিল্পীর। আর একটি কথা রেলিঙে বার বার লেখা থাকার কথা ছিলো— ‘একুশে ফেব্রুয়ারি, তোমায় কি ভুলিতে পারি’। যে প্রশস্ত জায়গাটি মিনারের সামনে রয়েছে সেখানে বেশ কিছু রক্তমাখা পায়ের ছাপ শহিদদের স্মরণে আর কিছু বিশাল কালো পায়ের ছাপ দানবের প্রতীক হিসেবে থাকার কথা ছিলো। আর এই মিনারের পাশেই থাকার কথা বাঙলা সাহিত্যের একটি পাঠাগার। সেই পাঠাগারের দেয়ালে তৈলচিত্র রাখার পরিকল্পনা ছিলো। মিনারের সামনে একটি সুন্দর ঝর্ণা থাকার কথা ছিলো। চোখের মতো অনেকটা দেখতে হবে এর আকৃতি। কালো বিরাট চোখটাই একটা ঝর্ণা। অনবরত অশ্রুর মতো ঝরবে পানি। সেই পানি আবার জমা থাকবে, মনে হবে মহাকাল থেকে ঝরছে এই অশ্রুধারা। এই ঝর্ণার পর পরই তত্কালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন, বর্তমানের মেডিক্যাল কলেজের পাঁচিল ঘেঁষে আবার মিনারের মতো একটা উঁচু বেদী উঠে যাবার কথা। যাতে দুই দিকে ঢেউ এর প্রতিক্রিয়া থাকে এবং একটি বিশাল এলাকা জুড়ে শহিদ মিনারের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। শিল্পীর পরিকল্পনা ছিলো মেঝেতে পড়া বর্ণালীর মাধ্যমে একটি কাল্পনিক ঘড়ি প্রতিষ্ঠা করা, যেমন: আটটা বাজলে বেগুনী রঙ। বারোটাতে নীল। পাঁচটায় কমলা। এমনি। দেখতে দেখতে ঘড়িটার রঙ পরিচিত হয়ে যেতো। আর একটি ঘড়ি থাকার কথা ছিলো, উঁচু টাওয়ার ঘড়ি, তার সময়গুলো বাঙলা সংখ্যায় লেখা হতো। শহরের একটি প্রধান সময় দেখার কেন্দ্র হিসেবে মিনারের এই ঘড়ি একটি দৈনন্দিন অভ্যেসে পরিণত হয়ে যেতো। এক হাজার বর্গফুটের একটা ম্যুরল চিত্র যেটা মিনারের ভেতরের কুঠুরিতে রাখার পরিকল্পনাও ছিলো শিল্পীর। যদি এই শিল্পকর্মটি হতো তাহলে এটি হতো পৃথিবীর দীর্ঘতম শিল্পচিত্রগুলোর অন্যতম। এর কাজও শুরু করেছিলেন তিনি, মাত্র দুটো স্তরের কাজ বাকি ছিলো।
নেমেসিসের অন্ধকার
পরিকল্পনা অনুযায়ী সাতান্ন সালের নভেম্বর থেকে আটান্ন সালের মার্চ মাস পর্যন্ত হামিদুর রাহমানের তত্ত্বাবধানে শহিদ মিনারের কাজ চলছিলো। কিন্তু সাতান্ন সালের মার্চ মাসে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে শিল্পী হামিদুর রাহমানকে শহিদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে বের করে দেয়া হয়, আর অক্টোবর মাসে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হলে শহিদ মিনারের কাজ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। আটান্ন থেকে বাষট্টি সাল এই পাঁচ বছর শহিদ মিনারের জন্যে নির্মিত অসম্পূর্ণ বেদীটিই ছিলো এ দেশের শহিদ মিনার। এই পাঁচ বছর শহিদ দিবসে মানুষ এখানেই ফুল দিয়েছে, সভা করেছে, শপথ নিয়েছে। তারপরে বাষট্টি সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের তদানীন্তন গভর্নর লে. জেনারেল আজম খান শহিদ মিনার নির্মাণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য ড. মাহমুদ হোসেনকে সভাপতি করে একটি চৌদ্দ সদস্যের কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির সদস্য ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মমতাজউদ্দিন আহমদ, ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, অধ্যাপক মুহম্মদ আব্দুল হাই, বাংলা একাডেমির পরিচালক সৈয়দ আলী আহসান, ইসলামিক একাডেমির পরিচালক আবুল হাশিম। অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী এই কমিটির সদস্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই কমিটিকে বাষট্টি সালের পহেলা মে’র মধ্যেই শহিদ মিনারের নির্মাণের বিষয়ে তাদের সুপারিশ পেশ করতে বলা হয়। ঐ কমিটি শিল্পী হামিদুর রাহমানের সাতান্ন সালের শহিদ মিনারটির মডেলভিত্তিক সহজ ও ছোটো আকারে শহিদ মিনার নির্মাণের যে সুপারিশ করে সেই অনুসারে কাজ শুরু হয়ে যায় এবং ১৯৬৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শহিদ মিনারের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। হামিদুর রাহমানের পরিকল্পনায় যেখানে শহিদ মিনারের স্তম্ভে যে চোখের নকশা থাকার কথা ছিলো তার পরিবর্তে সেখানে লোহার শিক গলিয়ে দেয়া হয়। সূর্যের প্রতিফলন, ঝর্ণা, ঘড়ি, ভাস্কর্য, ম্যুরল সব বাদ পড়ে।
এই শহিদ মিনারই হয়ে ওঠে বাঙালির ইস্পাত কঠিন চেতনার ভাস্বর রূপায়ন। ছেষট্টির ছয় দফাভিত্তিক স্বাধিকার আন্দোলন, ঊনসত্তরের আগড়তলা মিথ্যা মামলাভিত্তিক মহান গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ— সকল আন্দোলনেই এই শহিদ মিনার আমাদের দিয়েছে অফুরান প্রেরণা। তাই একাত্তরের পঁচিশে মার্চে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী যখন গণহত্যা শুরু করে তখন তারা ভারী গোলাবর্ষণ করে শহিদ মিনারের স্তম্ভগুলো ধ্বংস করে দেয়।
.. ..এবং পুনরুত্থান
স্বাধীনতার পর বাহাত্তর সালের একুশে ফেব্রয়ারিতে বাঙলাদেশের স্বাধীন মানুষ তাদের প্রথম শহিদ দিবস পালন করেছিলো ভাঙা শহিদ মিনারে। স্বাধীন বাঙলাদেশে বাহাত্তরের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে সভাপতি করে শহিদ মিনার পুনঃনির্মাণের জন্যে কেবল স্থপতিদের কাছ থেকে বাহাত্তর সালের পনেরোই ফেব্রুয়ারির মধ্যে নকশা ও পরিকল্পনা আহবান করা হয়। শিল্পী হামিদুর রাহমান স্থপতি ছিলেন না, তাই তিনি বিশিষ্ট স্থপতি এম. এস জাফরের সঙ্গে মিলিতভাবে একটি সংস্থা গঠন করে স্বাধীন বাঙলাদেশের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের জন্যে নকশা ও পরিকল্পনা পেশ করেন। সাতান্ন সালের নকশা ও পরিকল্পনাই ছিলো তার মূলভিত্তি। তবে, এর একটি নতুন ব্যাখ্যায়ন করা হয়। বলা হয়— মিনার এবং তার স্তম্ভগুলো, মাতৃভাষা-মাতৃভূমি তথা মাতা এবং তার শহিদ সন্তানদের প্রতীক। সাতান্ন থেকে একাত্তর সাল— এ চৌদ্দটি বছর ঐ চেতনাই ছিলো শহিদ মিনারের রূপকল্প, যা হামিদুর রাহমানের সাতান্ন সালের পরিকল্পনায় প্রথম প্রতিফলিত হয়েছিলো, যা আংশিকভাবে হলেও তেষট্টি সালের নির্মিত শহিদ মিনারে উপস্থিত ছিলো। নতুনভাবে শহিদ মিনারের নকশা করতে গিয়ে হামিদুর রাহমান সে চেতনাকে অক্ষুন্ন রেখেছিলেন। মাতা এবং সন্তানের প্রতীক স্তম্ভ নিয়ে গড়ে ওঠা শহিদ মিনার এ দেশের মানুষের চেতনায় স্থায়ী হয়ে গিয়েছিলো।
হামিদুর রাহমানের বায়ান্ন সালের এ পরিকল্পনাতেও শহিদ মিনারের স্তম্ভগুলো মায়ের প্রতীক, অর্ধবৃত্তাকারে মাতা তার শহিদ সন্তানদের নিয়ে দণ্ডায়মান। মা অনন্তকাল ধরে সন্তানদের রক্ষা করছেন, যাঁরা তাঁর মর্যাদা রক্ষার জন্যে নিজেদের বিসর্জন দিয়েছেন, আর সেই জন্যেই গৌরবান্বিত মা তাদের আদর করছেন, সন্তানদের আত্মত্যাগের মহিমায় মা ঝুঁকে পড়ছেন একটু স্নেহে, আর চারটি সন্তানের মধ্যে দিয়ে তিনি দেশের লক্ষ লক্ষ সন্তানকে দেখতে পাচ্ছেন। এই পরিকল্পনাতেও মায়ের দৃষ্টির প্রতীক স্তম্ভগুলোতে চোখের নকশা ছিলো। স্তম্ভগুলো বিশুদ্ধ শ্বেত মর্মের চৌদ্দ ফুট উচ্চ মঞ্চের উপরে স্থাপিত হবে, সিঁড়ি, রেলিং সবই শাদা মার্বেল পাথরে করা হবে, শ্বেত মর্মরে সম্পন্ন সমগ্র মিনারটিতে একটি স্বর্গীয় পবিত্রতা ফুটে উঠবে। স্তম্ভগুলোর পাদদেশে পুষ্পার্ঘ নিবেদনের সর্বশেষ ব্যবস্থা এবং দু’ পাশের বেষ্টনীতে শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবিদের অবিষ্মরণীয় স্তবক লৌহ-লিপিতে উত্কীর্ণ হবে, বিশেষ আলো-ব্যবস্থায় রাতেও মিনার এবং স্তবকসমূহ পরিদৃশ্যমান থাকবে। মিনারের প্রবেশ পথে থাকবে দুটি ভাস্কর্য এবং দুটি সিঁড়িঘরে ছোটো পদ্মপুকুর, ভাস্কর্য দুটি থেকে অবিরাম পানি প্রবাহিত হবে ঐ পুকুর দুটিতে। মিনার ছাড়াও পরিকল্পনায় সংশ্লিষ্ট ছিলো ঘড়িঘর, পাঠাগারসহ যাদুঘর, ভাস্কর্যসহ মিনারের চতুর্দিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃজন, মিলনায়তন, শিল্পকলা ইত্যাদি।
শেষ পর্যন্ত তিহাত্তর সালের পাঁচই মে বাঙলাদেশ সরকারের পূর্ত সচিবের দপ্তরে এক সভায় জানানো হয় যে, স্থপতি এম. এস জাফর এবং শিল্পী হামিদুর রাহমান কৃত শহিদ মিনারের নকশা ও পরিকল্পনা সরকার চূড়ান্তভাবে অনুমোদন এবং গ্রহণ করেছেন। সরকার ও তাঁদের মধ্যে শহিদ মিনার পুনঃনির্মাণ লক্ষ্যে একটি চুক্তিপত্রের খশড়াও চূড়ান্ত হয় এবং তা তিহাত্তর সালের ০৭ ডিসেম্বর পূর্ত সচিবের কাছে পেশ করা হয়।
দুঃখের বিষয় হলো— এরপর আর এ বিষয়ে কিছুই জানা যায়নি। ইতোমধ্যে, মানে তিহাত্তর সালের একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই বাঙলাদেশ সরকারের সিএবি বিভাগ ইয়াহিয়া-টিক্কা বর্বর বাহিনীর ধ্বংস করা শহিদ মিনারের স্তম্ভগুলো যেনোতেনোভাবে মেরামত করে। সেই জোড়াতালির শহিদ মিনার আজও কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, এর স্তম্ভের উচ্চতার ঠিক নেই, সামনের দিকে বেশি ঝুঁকে গেছে এবং শহিদ মিনারের নির্মাণ বৈশিষ্ট্যের আনুপাতিক সামঞ্জস্যতা রক্ষা করা হয়নি।
এভাবেই স্বাধীন বাঙলাদেশের চল্লিশ বছরেও স্বপ্নের শহিদ মিনার বাস্তবতা দেখেনি, বাঙালি আজও সেই প্রাণের শহিদ মিনারটি পায়নি।
শহিদ মিনার কেবল একটি স্মৃতিচিহ্নই নয়, এর ইতিহাস জুড়ে আছে জ্যোত্স্নালোকিতো রক্তধারার ফেনিল জোয়ার, এর বৃত্তান্ত সুদীর্ঘ, বিপদসঙ্কুল তিনটি দশকে ব্যপ্ত। তাই শহিদ মিনার শতশরেও ধ্রুব, অবিচল; আমাদের চেতনার প্রেক্ষণবিহারী গাঙচিল। তাই সুতীব্র, কর্কশ, অযাচিত কোলাহলমুখরতার মাঝেও বিশুষ্ক চৈতালী ঘূর্ণি ছাড়িয়ে নিটোল দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের প্রাণের শহিদ মিনার; অজর-অমর-অব্যয়-অক্ষয় আর অসম্পূর্ণ বাঙলাদেশের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার।
১২ ফাল্গুন ১৪১৮