চলে যাবার জন্যে কোনো সমীকরণ লাগে না; কেউ কেউ চলে যান একেবারে নিভৃতে, কারও কাছে কোনো অভিযোগ পেশ না করেই। কেউ কেউ আছেন, চলে গেলে বৃষ্টি হয়, ঝুম বৃষ্টি- কারও কারও অন্তর্ধানে তৃষিত চোখে হাহাকার নামে; কেউ কেউ আছেন, যাবার আগে পিছন ফিরে তাকান না, আবার কেউ কেউ পিছনেই ফিরে থাকেন- যেনো যেতে হলেও পেছন ফিরেই চলে যাওয়া যায়। কেউ কেউ আছেন- চলে গেলে শিউলি ফুল ঝরে পড়ে; ভারী-ব্যাকুল বৃষ্টি নামে বুকের বারান্দায়, বৃষ্টির একটানা ভিতরে বাহিরে নিরন্তর অবগাহন চলে কান্নার, শতাব্দীর শরীর জুড়ে থাকে কান্নার নিটোল বিউগল।
কিন্তু কেউ কেউ আছেন- চলে গেলে কিছুই হয় না; মনেই হয় না তিনি চলে গেছেন, বরং মনে হয় তিনি আছেন- আরও গভীরে, কোনো এক কিংবদন্তীর কথামালার মতো তিনি প্রোথিত আছেন এবং ক্রমাগত সজীব হয়ে উঠছেন। তিনি চলে গেলে কোনো কিছুতেই কোনো পরিবর্তন হয় না; কেবল ক্যানভাসগুলো নিথর চেয়ে থাকে, ছাপচিত্রকলার ব্যাকরণে ফোটে প্রসন্ন বেলফুল।
তিনি চলে গেলেন। ছাপচিত্রকলার জনক সফিউদ্দীন আহমেদ চলে গেলেন কোনো এক অচেনা গহীন দেশে; চিরযাত্রার দিকে এবং নিশ্চিত অনন্তলোকের পানে তিনি তাঁর মহাশিল্পকলার রথযাত্রা শুরু করলেন। দীর্ঘ নব্বই বছর তিনি বেঁচে ছিলেন এবং শিল্পের সঙ্গে ছিলেন। সেই বেঁচে থাকার অধ্যায়টি তিনি শেষ করলেন; নিভৃতচারী মানুষটি আরেক নিভৃত জনান্তিকে নিজেকে নিয়ে চললেন। তিনি এমন এক অনন্ত যাত্রা শুরু করলেন; যেখানে সকল শিল্পকলা অর্থহীন এবং সব নান্দনিকতার চেয়েও মধুরতম নান্দনিকতা যেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে ঝুলন জোৎস্নার মতো।
এদেশে শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ। ছিলেন প্রচারবিমুখ ও প্রচ্ছন্ন-নিবাসী। তাঁর ব্যক্তিত্বে এমন এক ধরনের ঋজুতা ছিলো, যা তাঁকে আর দশজনের চেয়ে স্বতন্ত্র বলে চিহ্নিত করে। কিন্তু স্বতন্ত্রদের ভয় পায় এদেশের প্রচার বা অন্যান্য মাধ্যম। তাই তাঁকে নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি কোথাও, যদিও শিল্পকলা বিষয়টাই আমাদের আলোচনার বৃত্ত থেকে বহুদূরে থাকে।
সফিউদ্দীন আহমেদ চল্লিশ দশকের মধ্য পর্যায়ে ভারতবর্ষের চিত্রকলা জগতের উদীয়মান উজ্জ্বল নাম, তবে শিল্পকলার লোকজন ছাড়া তাঁকে চেনেন না তেমন কেউ; তিনি কোনো ‘আলো’ কিংবা ‘চিৎকার’ পত্রিকার অলঙ্করণের কাজ করেননি; বরং তিনি করেছেন শিল্পকলার কাজ, করেছেন নিষ্ঠার সাথে এবং তাঁর মহত্তর প্রতিভা দিয়ে তিনি সুউচ্চ সৌধ নির্মাণ করেছেন শিল্পকলার খেলার মাঠে। তেলরঙ, উড এনগ্রেভিঙ, এচিঙ, একুয়াটিন্ট, ড্রাই পয়েন্ট- সব মাধ্যমেই তাঁর সাফল্য চোখে পড়ার মতো। তিনি শিল্পকলা রসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন সহজেই এবং সেটা বড্ডো অল্প বয়েসেই। প্রসঙ্গত কান্টের একটি কথা মনে পড়ে- প্রতিভাকে বয়স দিয়ে পরিমাপ করা যায় না।
কোলকাতা ভবানীপুরের সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে শিল্পীর জন্ম ১৯২২ সালের ২৩ জুন। ১৯৩৬ সালে কোলকাতা সরকারি আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। ভর্তি হয়ে কাজে মন বসাতে পারছিলেন না। শিক্ষক আব্দুল মঈন এগিয়ে এলেন। কাজে উৎসাহ দিলেন, সাহায্য দিলেন। এইভাবে সহযোগিতা পেয়ে ছবি আঁকায় উৎসাহ বাড়লো। এরপর সফিউদ্দীনকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি, প্রতিভাবানদের পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না; পিছনে পড়ে থাকে অপ্রতিভাবানরা, যাদের কাছে রোম্যান্টিকতা মানে কচলানো, তারা নিম্নমানের এবং অত্যন্ত গৌণ।
১৯৪২ সালে তাঁর শিক্ষাজীবন শেষ হয়। এরপর ১৯৪৪ সালে টিচারশিপ পড়ার জন্যে ভর্তি হন একই স্কুলে। শিক্ষক হিসাবে পান রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে। শিক্ষক রমেন চক্রবর্তীর উৎসাহে ছাপচিত্রে উৎসাহী হয়ে ওঠেন শিল্পী সফিউদ্দীন। এই সময়েই আমরা উড এনগ্রেভিঙ, এচিঙ, ড্রাই পয়েন্ট- এই তিন মাধ্যমে তাঁর করা অসাধারণ কিছু কাজ দেখতে পাই।
আব্দুল মঈন ও রমেন্দ্রনাথ ছাড়াও অসাধারণ আরো কিছু শিক্ষককে তিনি পেয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিলেন পশ্চিমের শিক্ষায় শিক্ষিত এবং দীর্ঘদিন বিলেতে থাকা শিক্ষক ও অধ্যক্ষ মুকুল দেসহ বসন্তকুমার গাঙ্গুলী, অতুল বসু, প্রহ্লাদ কর্মকার প্রমুখ। কোলকাতা আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ পদে যোগ দিয়ে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসে বিরাট এক পরিবর্তন এনেছিলেন, করে তুলেছিলেন সময়-উপযোগী। শিল্পী সফিউদ্দীনের স্মৃতিচারণে এই শিক্ষকদের কথা ঘুরে ফিরে বারবারই আসতো।
আর্ট স্কুলে শিক্ষাগ্রহণকালে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন অগ্রজদের কাজ আর বেঙ্গল স্কুলের প্রভাবসঞ্চারী স্বতন্ত্র চিত্রভাষা। এঁদের পদচারণা প্রত্যক্ষ করেছেন খুব কাছ থেকে। সে সময়ে ভারতবর্ষে ও পাশ্চাত্যে শিল্প ও সাহিত্যে স্বকীয় ভাষা ও মেজাজ নির্মাণের ভাঙাগড়া চলছিলো, যা তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। আর নিজেকে গড়ার কাজে সব সময়েই সচেষ্ট থেকেছেন। ছাত্র অবস্থায় ছুটি পেলেই বন্ধুদের নিয়ে চলে গেছেন মধুপুর, দুমকা, গিরিডি, জেসিডি, চাইবাসা, সাঁওতাল এলাকায়। বিস্তৃত উঁচু-নিচু মাঠ, পাহাড়, বৃক্ষশোভিত প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য তাঁকে আন্দোলিত করতো। সাঁওতালদের সহজ সরল জীবন, ছন্দোময় প্রকৃতি তাঁকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিলো, যার জন্যে হয়তো সেই ছাত্র অবস্থা থেকে ১৯৪৬-৪৭ পর্যন্ত বারবার তাঁকে ঐ সব অঞ্চলে চলে যেতে হতো। এই সময়ে এবং পরবর্তী কিছু সময়েও তাঁর আঁকা তেল রঙ, উড এনগ্রেভিঙ, এচিঙ, ড্রাই পয়েন্টে এ সব অঞ্চল ঘুরে-ফিরে এসেছে।
১৯৪৬ সাল ছিলো তাঁর জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। কোলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অফ আর্টে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। জীবনের নতুন একটি ধাপে পা রাখলেন। সেখানেও তাঁর একাগ্রতার স্বাক্ষর তিনি রেখেছিলেন। সেই ছেচল্লিশ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সোমনাথ হোর থেকে শুরু করে এ বাঙলার সব নামী দামী শিল্পীই তাঁর ছাত্র ছিলেন।
শিল্পী সফিউদ্দীন উড এনগ্রেভিঙ ও এচিঙ-এর জন্যে বিখ্যাত হলেও তিনি প্রথম কাজের সম্মান পেয়েছিলেন তেলচিত্রে। ছাপচিত্রের পাশাপাশি তেল রঙ-এ ও কাজ করে যাচ্ছিলেন। তেল রঙ-এ ইমেপ্রশনিস্টদের ছাপ পাওয়া যায়। ‘শালবন’, ‘দুমকা’, ‘সূর্যালোকে কুটির’, ‘দুমকা ১’, ‘দুমকা-২’, ‘জড় জীবন’, ‘দিলীপ দাশগুপ্তের প্রতিকৃতি’ এই কাজগুলো সবই ছেচল্লিশের দিকে করা। বাহান্নর ‘ধানঝাড়া’ বা ছাপ্পান্নর ‘সূর্যমূখী’ও এই ধারার। দুমকার অসংখ্য স্কেচে ওদের সরল সচ্ছন্দ জীবন, আকাশ ছোঁয়া প্রান্তর আর অপরূপ সাজের ছন্দোময় প্রকৃতি এতো আলোড়িতো করেছিলো যে স্কেচগুলো তাঁর শিল্পী জীবনে সৃষ্টিশীলতায় নবজোয়ার এনে দিয়েছিলো। যার প্রতিফলন তাঁর একুয়াটিন্ট ড্রাই পয়েন্টে দেখতে পাওয়া যায়। উড এনগ্রেভিঙ-এ ও সে-ই একই বিষয় আছে, কিন্তু মাধ্যমের কিছু ব্যবধানের কারণে, বাধ্যবাধকতায় কিছুটা ভিন্ন রূপ পেয়েছে। কিছু আছে আলোছায়ার খেলা।
১৯৪৫-এ ‘কবুতর’ (একুয়াটিন্ট মাধ্যমে) ছবির জন্যে পেয়েছিলেন একাডেমী প্রেসিডেন্টের স্বর্ণপদক। একাডেমী অফ ফাইন আর্টস থেকে ১৯৪৬ সালে একুয়াটিন্টের জন্যে আরও একটি পুরস্কার। ১৯৪৬ সালে বিহার শিল্পকলা পরিষদ আয়োজিত প্রদর্শনীতে তখনকার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। দ্বারভাঙ্গা মহারাজা এ পুরস্কারটি প্রবর্তন করেছিলেন। দুই বছরে এতোগুলো পুরস্কার তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিলো নিঃসন্দেহে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি হতে থাকেন একা এবং তাঁর আর কোনো জায়গা থাকে না যাবার। নিজের মনের ভেতরে তিনি নিজের মতো করে একটি স্টুডিও করেন, তাকে ভাষা দেন, স্বপ্নময়তার দোলাচলে তাকে দোলান তিনি।
প্যারিসের মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামে বিশ্বের ৪৪টি দেশের বাছাই করা শিল্পীদের কাজ নিয়ে ইউনেস্কো আয়োজন করেছিলো এক প্রদশনীর, ১৯৪৬ সালে। প্রথিতযশা বাঙালি শিল্পীদের মধ্য থেকে তাঁর তিনটি বা চারটি কাজও প্রদর্শিত হয়েছিলো এই প্রদর্শনীতে। পিকাসো, ব্র্যাক, মাতিস, শাগাল এই সব মহৎ ও প্রতিভাবান শিল্পীদের কাজও এই প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছিলো। বাঙালিদের মধ্য থেকে রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, গগণেন্দ্রনাথ, রামকিঙ্কর, যামিনী রায়, অমৃতা শেরগীলসহ জয়নুল আবেদিন ও সফিউদ্দীন আহমেদের কাজ প্রদর্শিত হয়েছিলো। এই সময় অধ্যক্ষ অতুল বসু লেখায় এক অংশে উল্লেখ করলেন
নবীন শিল্পীদের মধ্যে সফিউদ্দীন আহমেদ ইতিমধ্যেই ভারত ও বহির্বিশ্বে নিজের জন্যে এক মর্যাদার আসন করে নিয়েছেন।
দেশ বিভাগের পর ঢাকায় চলে আসেন তিনি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে সবার সহযোগিতায় ও উদ্যমে ১৯৪৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হলো ‘গভর্ণমেন্ট ইনস্টিটিউট অফ আর্ট’। এদেশে চিত্রকলা চর্চার আন্দোলনের শুরু হলো তখনই। সবাই ব্রত হিসাবে নিলেন শিক্ষকতাকে। সফিউদ্দীন আহমেদ ছাপচিত্র বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে এই দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করলেন। ২০০৩ সালেও একাশি বছর বয়সে ছাপচিত্র (প্রিন্ট মেকিং) বিভাগে তাঁকে দেখা যেতো। তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে নিবিষ্ট মনে ছাত্রদের কাজ শেখাচ্ছেন, উৎসাহ দিচ্ছেন, কাজ নিয়ে আলোচনা করছেন। এদেশে যাঁরা এখন শিল্পকলার চর্চা করছেন তাঁদের সবারই শিক্ষক তিনি। তিনি মহত্ত্বর আলোর সোপান।
শিল্পী সফিউদ্দীন চলে গেছেন- তাঁর ‘সকল দুঃখের প্রদীপ জ্বেলে’ তিনি নিভৃতের মানুষ নিভৃতেই আবার পাড়ি জমিয়েছেন। বৃহত্তম, মহত্তম শিল্পকলার দিকে তিনি ছুটে চলছেন; এবং সমস্ত রেখা-রঙ-ক্যানভাস-আলো সবকিছুকে অর্থহীন করে, তিনি মিহিন হারিয়ে গেছেন অন্যলোকে; তিনি হারিয়ে গেছেন- কিংবা আমরা হারিয়ে ফেলেছি তাঁকে; তাঁর অনবদ্য সৃষ্টিকর্মের নিবিড় সুখচারিতায় আবারও হয়তো ধরা পড়বেন তিনি- কোনো এক বিষণ্ন বেলাভূমিতে।
০৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৪১৯
লেখাটি ২০১২ সালের ২০ মে শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের মৃত্যুর দিনই লেখা হয়েছিলো।