মাত্র আটটি চলচ্চিত্র- এরপর তিনি মহাপ্রস্থানের পথে এগিয়েছেন। মাত্র আটবার কড়া নাড়ায় মহাকাল তাঁকে দরজা খুলে দেয়; এরপর তিনি প্রবেশ করেন অনন্ত শূন্যলোকে- অর্থহীন সময়কে করে তোলেন অর্থপূর্ণ শুভ্র অথবা কালোত্তীর্ণ জীবনের এপিটাফ। এরকম আশ্চর্য ব্যতিক্রম অবশ্য ঋত্বিক ঘটক ছাড়াও এসেছিলো আন্দ্রেই তারকোভস্কির সময়ে- তাঁর সমাপ্ত চলচ্চিত্রের সংখ্যা সাত। আজ মাঝে মাঝে মনে হয় এঁরা হয়তো সেই অর্থে সিনেমাকরিয়ে না; কারণ, আমাদের মস্তিষ্ক যে অর্থে চলচ্চিত্রের রসাচ্ছাদন করতে ভালোবাসে, তাঁরা সে অর্থে রস সঞ্চার করেননি। তাঁদের চলচ্চিত্র আমাদের হতবাক করে শুধু রক্তমাংস ছাড়িয়ে আত্মায় হাত রাখে বলেই নয়, বরং তাঁদের চলচ্চিত্র আমাদের আত্মার পুনর্জন্ম দেয়। আমরা যারা চলচ্চিত্র দেখতে বসি বাস্তবের জানলা দিয়ে মুখ বের করে কল্পনার ব্যস্ততম রাজপথ দেখবো বলে, তাদের কাছে ঋত্বিক কিংবা তারকোভস্কি আসলে একই সঙ্গে ইতিহাসকার ও দার্শনিক। কথাটা বলছি এজন্য যে, ঋত্বিকের চলচ্চিত্র আমাদের বাস্তবের আয়তন বুঝতে শেখায়, কিন্তু তা কেবলই মস্তিষ্ক বা হৃদয়ের বোঝাপড়ার ভাগাভাগি নয়, বরং তা অস্থির; কখনও মস্তিষ্ক থেকে বিদ্রোহ সেরে তা আশ্রয় নেয় হৃদয়ের করতলে, আবার হৃদয়ছিন্ন হয়ে রক্তাক্ত পথ মাড়িয়ে চলে আসে মস্তিষ্কের একলা ঘরে। তাঁরা বাস্তবের বিন্যাস পাল্টে দিতে চান ও পারেন। এজন্যই- রূপসি ও কিন্নরদলের ক্রীড়াসঙ্গী না হয়ে- তাঁরা যে চলচ্চিত্রকে মানুষের ভাষাগত অভিব্যক্তির মৌল উপাদান ভাবতে চেয়ে তপোক্লিষ্ট হয়েছিলেন- সেই দৃষ্টান্তের সঠিক উত্তর মেলে না। বিশ্ব চলচ্চিত্রকে মগজের বামপাশে রেখে হৃদয়ের বামপাশ দিয়ে বাঙলা চলচ্চিত্রকে দেখলে বোঝা যায়, কেবল ঋত্বিকই একমাত্র, যাঁর চলচ্চিত্রগুলোর কোনো বংশলতিকা নেই। এঁরা নিঃসন্তান।
সংস্কৃতিরও একটি রাজনীতি আছে। একদিকে সমস্ত ভালো আর শুভ্রতার মাঝে রবীন্দ্রনাথ, অন্যদিকে বেশ্যাপাড়ায় সীতার মৃতচক্ষু পাহারারত জীবনানন্দ দাশ; একদিকে রজনীগন্ধা-রবীন্দ্রসঙ্গীত-মোমবাতি আর মোৎসার্টের স্বরলিপির সামনে ধ্যানস্থ সত্যজিৎ রায়, অন্যদিকে অমিতাচার- পাগলা দাশুর মতো মুখে ঋত্বিক ঘটক। আমাদের সাহিত্যে মানিক আর জীবনানন্দ যেমন অবশ্যম্ভাবী অবিনাশী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যেমন ক্ষয়িষ্ণু আর ছেলেমানুষি রবীন্দ্র-প্রতিভার প্রতি এক দুর্ভেদ্য কটাক্ষ; তেমনি ঋত্বিককুমার ঘটক- এলেবেলে সত্যজিৎ আর পতনোন্মুখ মৃণাল সেনের মাঝে এক উজ্জ্বল ফাটল, যা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে আধুনিকতা, চলচ্চিত্রের নবধারা, অস্থিরতা আর বিদ্রোহ। শিল্পের কমলবনে এই মত্ত মাতঙ্গকে আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা না জানালেও, অস্বস্তি ও সম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিতে হয়। এখন প্রশ্ন জাগতেই পারে- এই ছিন্নমতির মিছিলে, এই দৃশ্য আর রতির অত্যাচার পেরিয়ে আমাদের চেনা আগুনের বাসিন্দা ঋত্বিক ঘটক কী তবে জগদ্দলেই চড়ে এলেন? নাগরিক (নির্মাণ: ১৯৫২; মুক্তি: ১৯৭৭) নয়, বরং অযান্ত্রিক-ই (১৯৫৮) হোক আমাদের দেখার চোখ- যা নিমেষে মিলছে ঋত্বিকের সেলুলয়েডের সঙ্গে- দ্রোহে আর চিৎকারে, অস্বস্তি আর অস্থিরতায়, মদ্যপ আর বেহুলার সঙ্গমে।
ভালোবাসার রাশপ্রিন্ট
ঋত্বিক নিজেই বলেছিলেন- অযান্ত্রিকে হিরো হলো ড্রাইভার, আর গাড়িটা হিরোইন। অতএব ভালোবাসাকে তিনি অন্য একটি মাত্রায় দেখাতে চাইলেন, যা আমাদের চোখের সঙ্গে হয়তো বেমানান, কিন্তু তা অনতিক্রম্য। অযান্ত্রিক মুক্তি পায় ১৯৫৮ সালের ২৩ মে। বলাই বাহুল্য, অযান্ত্রিক তন্বী শরীরে অন্তহীন আমন্ত্রণবীথি নয়; এটি নিরাশার, উজ্জ্বলতার এক প্রদেশ। ঋত্বিক ঘটক ও তাঁর চলচ্চিত্র সম্বন্ধে আমি যতোগুলো লেখা পড়েছি, তার সবই রুদ্ধবয়ানপ্রতিম। এমনকি সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ও- আমার চোখে যিনি একমাত্র ঋত্বিককে সত্য চোখে দেখতে পেয়েছিলেন। বাকি সবাই মূলত ঋত্বিককে সাক্ষাৎকারেই আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। এই সাক্ষাৎকারপন্থীরা ঋত্বিকের একটি দিকই খুঁজে পেয়েছেন- তা হলো, স্বপ্ন দেখা। কিন্তু ঋত্বিক আসলে স্বপ্ন দেখার চেয়েও বড়ো কাজটি করেছেন। তিনি স্বপ্ন দেখিয়েছেন, মাথায় স্বপ্নের ডালপালা মেলে দিয়েছেন। তিনি স্বপ্নকে ছড়িয়ে দিয়েছেন মৃত্তিকার গহীন থেকে মহিরুহে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে- যেনো লক্ষ বীজের বলাকা। ঋত্বিকের চলচ্চিত্রকর্ম, ঈষৎ প্রণিধানই দেখা যায়, মুক্তধারা। সেই ধারা থেকে যে কোনো অংশেই উপধারা আলাদা করে নেয়া যায়। ঋত্বিকের দেখানোর একটি ভঙ্গী আছে। ১৯৫৯ সালে ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে যখন প্রদর্শনীর জন্য নেয়া হলো অযান্ত্রিক, তার চরিত্রলিপির ব্রুশিয়ারে ঋত্বিক নিজেই সংযোজন করলেন- Chevrolet (1920 Model) as Jagaddal. বাঙলা চলচ্চিত্রের আর কোথাও এভাবে যন্ত্রকে চলচ্চিত্রের চরিত্র করে তুলে, তাকে দিয়েও অভিনয় বের করিয়ে আনার যে দার্ঢ্যতা, তাকে অনেকেই অবশ্য মাতলামি বলেছিলেন সে সময়। কিন্তু তারপরও, একটি প্রশ্ন করা যাক আজ চেতনার গহীন অরণ্যে একলা হয়ে। অযান্ত্রিক দেখতে দেখতে কী একবারও মনে হয়েছিলো যে জগদ্দল আসলে যন্ত্র? আসলে আমাদের ক্ষুদ্র মেধা ও আত্মকেন্দ্রীক মানসিকতা কখনও ঋত্বিককে বুঝে উঠতে পারেনি। এটা ঋত্বিকেরও দুর্ভাগ্য। যে জাতির জন্য তাঁর এতোটা দরোদ ছিলো, এতোটা মায়া ছিলো যে ভাষার জন্য- তাতেই তিনি অবহেলিত রয়ে গেলেন। আমার মনে পড়ে গোদারের প্যাশন (১৯৮২) নিয়ে জঁ-লুই ল্যোত্রার আলোচনা। প্যাশনকে তিনি নির্দেশ করেছিলেন কেন্দ্ররহিত বয়নভঙ্গি হিশেবে; আবিষ্কার করেছিলেন বার্ত-উক্ত ‘পরিপূরকতা’ কীভাবে সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্রটিকে প্রসারণশীল করে রেখেছে।
অতএব, দুর্ভাগ্য কেবলই ঋত্বিকের নয়, দুর্ভাগ্য আমাদেরও যে, আমাদের সমালোচনা আজও অপ্রাপ্তবয়স্ক। আমাদের বাক্যরাশি কেবলই ঋত্বিকের অবিন্যস্ততা ও অসংহতি সন্ধান করে। আহা! উত্তর-অযান্ত্রিক ঋত্বিক এতো অমিতাচারকে প্রশ্রয় দিলেন! কার্তেজীয় নৈপুণ্যের পরেই ভাঙচুর ও নৈরাজ্য, অন্তর্ঘাত ও নাশকতা। সামঞ্জস্য শব্দটিই ক্রমশ লুপ্ত হয়ে গেলো ঋত্বিকের বর্ণমালায়। কিন্তু আজ তো আমরাই দেখতে পাই এই আপাত ‘বিশৃঙ্খলা’ স্বর্গীয়, প্রকৃত প্রস্তাবে, শৃঙ্গারোহনপর্ব। যেমন সালভাদর দালির চিত্রমালার ফাঁকফোকর থেকে ভেসে ওঠে নতুন দ্বীপ- অন্য চিত্রমালা, যেমন জঁ-ককতোর চলচ্চিত্রে চিড় ধরলে প্রবেশ করে কাব্য, তেমনি ঋত্বিকের রচনায় আছে নানা ফাটল, যার স্তরে স্তরে সাজানো থাকে বক্তব্য। মনীষার এই কারুকার্যময় বিন্যাস অনুসরণ করতে না পারলে ঋত্বিক সংক্রান্ত আমাদের যে কোনো ভাবনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। অতএব, ঋত্বিক যে অর্থে সত্যজিতেরও ভাষায় একমাত্র দেশীয়- চলচ্চিত্র সৌকর্যে মৃত্তিকা-সংলগ্ন, তাতে চোখ রেখেই আমরা এগুতে পারি অযান্ত্রিক নামের তীর্থ-দর্শনে।
সাম্প্রতিকতার শাশ্বত অবস্থান
একটি যন্ত্রের থরে থরে ঝরে পড়েছে প্রণয়াঞ্জলি। কী উপমারহিতভাবেই না জঁ জেনে তাঁর আত্মজীবনী চোরের পুঁথিতে মন্তব্য করেছেন-
প্রতিভা হলো বস্তুর প্রতি সৌজন্য; তা হলো যা মূক ছিলো তার ওপর গান আরোপ করা।
আর এতোক্ষণে এও আমরা বুঝে নিয়েছি যে, অযান্ত্রিক কোনো সুরের দূরপ্রয়াণ নয়, বরং নানা সুরের সমন্বয়ে ঐকতান, মিশ্র স্বরের মন্তাজ, এমনকি কালোত্তীর্ণ কোলাহল। অযান্ত্রিক ঋত্বিক ঘটকের দ্বিতীয় ছবি এবং একমাত্র ছবি, যা সর্বজনপ্রশংসিত; ঋত্বিক-কৃত একমাত্র শিল্পকর্ম, যার উৎকর্ষ নিয়ে মার্কসবাদী থেকে রবীন্দ্রবাদী পর্যন্ত কারোরই কোনো দ্বিমত ছিলো না। এর প্রশংসা করেছেন মিডিয়া ও অধ্যাপক সমানতালে। ঋত্বিকের প্রথম ছবি নাগরিক তো মুক্তিই পেলো না প্রথম দিকে। তাই দ্বিতীয় ছবির এ অভাবনীয় গ্রহণযোগ্যতা ঋত্বিককে উচ্ছ্বসিত করতেই পারতো। কিন্তু করেনি। জর্জ শাদূল (০৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯০৪ – ১৩ অক্টোবর, ১৯৬৭) মন্তব্য করলেন-
ভাষার সীমাবদ্ধতায় অযান্ত্রিক – এর সংলাপ আমার কাছে বোধগম্য ছিলো না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রের ভাষায় আমি পুরো ছবিটি বুঝতে পারি, বুঝতে পারি অন্তর্গত নির্যাস
কিন্তু এই মন্তব্যেও ঋত্বিক নির্বিকার। এছাড়াও সমালোচকদের বক্তব্যে উচ্চারিত হয়েছে এই ছবির আখ্যানভাগ বা আমাদের চেনা আটপৌরে অভিজ্ঞতার বাইরের নানা দৃশ্যকাব্য। অভিনন্দিত হয়েছে গল্প বলার রীতিটুকু- যা রূপসির শরীরের মতোই ডুবে থাকার আধার। তবে এসব আলোড়িত করেনি ঋত্বিককে। কারণ, তিনি তো জানতেন- ক্যামেরার কৃৎ-কুশলতা, আউটডোর লোকেশনের অভিনবত্ব, সম্পাদনার আধুনিক ও নিরাবেগ ক্ষিপ্রতা অথবা পূর্বোক্ত কৃতিত্বসমূহ স্থায়ী শিল্পের নিশ্চিত অভিজ্ঞান নয়। কারণ, তিনি তো জানতেন, ছবির আঙ্গিক দক্ষতা আর গঠন সৌন্দর্য নিয়ে এইসব উচ্ছ্বাসের বাইরেও তিনি আরও কিছু বলেছেন।
সত্যজিৎ রায়ের কল্যাণে মুগ্ধ অবলোকের শিখরে আমরা উন্নীত হয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের চেনা পথের এই আপাত আচ্ছন্নতায় অবলিপ্ত না থেকে ঋত্বিক যা আয়ত্ত করে দেখালেন, তা হলো, মননধর্মের উদ্বোধন। মানুষের অস্তিত্বের ইতিহাস আসলে চেতনার দার্শনিক সম্প্রসারণের ইতিহাস- বাঙলা চলচ্চিত্রে অযান্ত্রিক সেই প্রক্রিয়ার প্রথম সচেতন অভিঘাত।
ঋত্বিকের সৃষ্টি-সাধনার মূখ্য বিষয়টিই হলো সংযুক্তির সাধারণ স্থানাঙ্ক। অর্থাৎ, ঋত্বিক কখনও একা কথা বলেন না, তিনি কথা বলেন তাঁর সমস্ত সৃষ্টি-সমেত; আবার তাঁর সৃষ্টিগুলোও একা চলে না, তাঁরা চলে যৌথ-পদক্ষেপে। তাই নাগরিক থেকে যুক্তি তক্কো গপ্পো (১৯৭৭) পর্যন্ত একটি নিরেট সরলরেখা- যা প্রোথিত আমাদের মনোজগতের নানা আবহে কিন্তু একই সাথে মুক্ত দৃশ্য ও দর্শনের প্রবাহে। তাই অযান্ত্রিক কখনোই আকস্মিক আলোকপ্রাপ্তি নয়। নাগরিকে আলোচ্য শিল্পীর চৈতন্য এমন কয়েকটি অঙ্কুর প্রসব করেছিলো, যা বিকশিত হবার ধারায় অযান্ত্রিক অনিবার্য সোপান।
রাজনৈতিক অভিধা
প্রথমেই বলে নেয়া ভালো ঋত্বিক আসলে একা। যে কোনো সার্থক শিল্পী মাত্রেই একা এবং তাঁর একাকিত্বের নিগূঢ় প্রদেশে খেলা করে ঐশ্বর্যমণ্ডিত চিন্তার রঙধনু। বাঙলা চলচ্চিত্রের জগতে ঋত্বিক একাই যুদ্ধ করেছেন, সব সার্থকতার বাইরে গিয়ে কাজ করেছেন, প্রাধান্য দিয়েছেন চিন্তাকে। সত্যজিৎ রায় ঋত্বিক ঘটকের মৃত্যুর পর দেয়া এক ভাষণে বলেন-
সাধারণভাবে বাঙলা ছবি যখন হলিউড থেকে প্রেরণা পেতো, ঋত্বিক তখন আশ্চর্যভাবে হলিউড প্রভাবের বাইরে চলে যেতে পেরেছিলেন। ঋত্বিকের মধ্যে বরং সোভিয়েত-ঐতিহ্য সক্রিয়।
হলিউড অর্থাৎ মার্কিন ঘরানার সূত্রেই বাঙলা আখ্যানপ্রীতি ও বিনোদন আসক্তি। সত্যজিৎ নিজেও এ পথের পথিক ছিলেন। কিন্তু ঋত্বিক এলেন নতুন ঘোষণা নিয়ে। তিনি বললেন-
ছবিতে গল্পের যুগ শেষ হয়ে গেছে; এখন এসেছে বক্তব্যের যুগ।
গল্প যেহেতু গৌণ, চিন্তাটাই আসল- এমনকি উপলক্ষ্য; সুতরাং সাহিত্যাশ্রয়ী প্রবণতা ঋতুস্তব্ধা নারীর মতোই বন্ধ্যা মনে হলো তাঁর। যেমন বহু আগে গল্পকে গৌণ করে ঠিক এমনই ভেবেছিলেন জেমস জয়েস তাঁর ইউলিসিস উপন্যাসে কিংবা বেরটল্ড ব্রেশ্ট তাঁর ড্রামস ই দ্য নাইট নাটকে। অতএব ঋত্বিক চিন্তাকে প্রাধান্য দিলেন এবং সেই চিন্তার সুতো ধরেই তিনি অযান্ত্রিকে দেখালেন এক প্রকাশ্য রাজনীতি। সেই রাজনীতির আলোচনার সময় মনে রাখতে হবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধ্রুপদি চরিত্র তখনও অক্ষুণ্ন এবং অনুত্তীর্ণ-তিরিশ ঋত্বিকের পক্ষে, স্তালিন প্রয়াণের পরও, সোভিয়েত যুগের মতাদর্শগত বিতর্কের অংশীদার হওয়া অনিবার্য না হলেও স্বাভাবিক। গত শতক শুরু হবার নয় বছর পর মারিনেত্তি সমাধিফলক চূর্ণ করার আহবান জানান, পরামর্শ দেন ভেনিসের সুনাব্য জলপথসমূহকে পয়ঃপ্রণালীবৎ ব্যবহারের জন্য। ফিউচারিস্ট ইশতেহার আসলে গতিবন্দনা ও যন্ত্রের জয়ধ্বনি। তাঁরা ব্রোঞ্জের বিমূর্ততায় উৎকীর্ণ দেখেছিলেন অশ্ব। মায়াকোভস্কি, জিগা ভেরতভ প্রমুখ রুশ নির্মাণবাদীরা বস্তুত এই যন্ত্রস্তবেই উৎসাহ পেয়েছিলেন। মায়াকোভস্কির চিত্রনাট্যে রৌদ্রস্নাতা শ্রেণিযুগের বদলে ভেসে এলো Benz No-22 নামের মোটরগাড়ি। নীলাভনয়না সুন্দরীকে প্রতিস্থাপিত করলো অক্টোবর বিপ্লব। প্রস্তাবিত ছবিটির সগর্ব ঘোষণা-
একমাত্র অক্টোবর, যা মানুষকে মুক্তি এনে দিয়েছে, যন্ত্রকেও মুক্তি এনে দেবে।
আমরা ঋত্বিকের রাজনৈতিক পুরোভূমিটি বুঝতে পারছি। এমন নয় যে, কথিত চিত্রনাট্যটি সম্বন্ধে ঋত্বিক অবহিত ছিলেন, কিন্তু অযান্ত্রিক রচনার যে-সমস্ত সূত্রের কথা সংশ্লিষ্ট পরিচালক উল্লেখ করেন, তা থেকে স্বচ্ছ হয়ে আসে যে, সোভিয়েত সাংস্কৃতিক সংগ্রামের বিবরণ তাঁর খুব অজ্ঞাত ছিলো না। গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে ঋত্বিক ‘যন্ত্রের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক’ অযান্ত্রিকের মূল ব্যঞ্জনা হিশেবে নির্দেশ করেন। সমগ্র ঔপনিবেশিক মায়াজালটিকে পরীক্ষা করে তাঁর সুনিশ্চিত মন্তব্য-
আমাদের ঐতিহ্যের মধ্যে বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে আমরা যদি আবার অনুপ্রবেশ না করি তা হলে কোনো জাতীয় শিল্পই গড়ে উঠতে পারবে না।
ততোক্ষণে কিন্তু শিক্ষিত বাঙালির কাছে মেশিন ও অমানবিকতা সমার্থবাহী। সামাজিক দায়িত্বপরায়ন ঋত্বিক তাই আসন্ন ভবিষ্যতের মুখ চেয়ে একটি মোটরযানের সঙ্গে মানুষের আত্মিক যোগসূত্রের বিষয়টি আলোকপাত করেন। প্রসঙ্গত আমরা মনে করতে পারি, মারিনেত্তি ১৯১২ সালে লন্ডন শহরে বাসের গর্জনে অভিভূত হয়ে পড়েন। বিপ্লবের অগ্নিবলয় এমনভাবে চোখ ধাঁধিয়ে দেয় যে আমাদের মনে হয়, জড় হয়তো চৈতন্যও অর্জন করেছে। অযান্ত্রিকে জগদ্দলের কয়েকটি কম্পোজিশন তো নিশ্চিত তারই অভিব্যক্তি। যেমন- পানি ঢালার সময় যে সাউন্ড ট্র্যাক বা নারী যাত্রীটি যখন গাড়ি থামাবার জন্য ড্রাইভারের গায়ে হাত রাখে, তখন জগদ্দলের কম্পোজিশন- যেনো সে তার প্রেমিকের গায়ে অন্য নারীর হাতটি সইতে পারছে না।
আবার ফিরে আসি ঋত্বিকের চিন্তার আকাশে। সেখানে নাট্যান্তর্গত চিন্তাস্রোতের চাইতে নাট্যোর্ধ্ব বা নাট্যাতিরিক্ত চিন্তাপ্রবাহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই অযান্ত্রিকের বয়নভঙ্গি নববাস্তবতাপন্থী নয়। আগেই একবার জর্জ শাদূলের কথা উল্লেখ করেছিলাম- ঋত্বিকের প্রতি ছিলো তাঁর সপ্রেম আগ্রহ; তারপরও তিনি ভুল করেছেন। অযান্ত্রিক কখনোই নিউরিয়্যালিস্ট ছবি নয়- না বক্তব্যে, না আঙ্গিকে। ফরাসি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দি সিকার বাইসাইকেলের একটি প্রতিচিত্র ঋত্বিকের জগদ্দলের মধ্যে মিলতে পারে; আউটডোর লোকেশন, নক্ষত্রশূন্য অভিনয়- সবই সত্য কিন্তু অযান্ত্রিকের ওঁরাও নৃত্যের অংশটি কাহিনির দৈনন্দিনতা হরণ করে। সঙ্গে যুক্ত হয় নায়কের অস্বাভাবিক প্রায় ভূতগ্রস্থ চরিত্র।
এখন বরং তাকানো যাক আরেকটি দিকে, অযান্ত্রিকের আরেকটি চরিত্র, যাকে ঋত্বিক করে তুলেছেন প্রধান হাতিয়ার, আমাদের মনোজগতের গলিতে উপগলিতে বার্তা পৌঁছে দেবার জন্য। স্মরণ করতে পারি অযান্ত্রিকের সেই ছোট্ট শিশুটিকে। এই শিশুটি কে? কেবলই ট্যাক্সিপাড়া কিংবা গ্যারেজে পড়ে থাকা কেউ? তার তো কোনো পরিচয় ঋত্বিক দেননি। না, ভুল হলো। ঋত্বিকের বলার ভঙ্গিমাতেই একটা প্রচ্ছন্নতার ছোঁয়া থাকে। যন্ত্র ও মানুষের যে ফারাক- যে শূন্যতাতে দাঁড়িয়ে ঋত্বিক নির্মাণ করেছেন এই সম্পর্কের সংযোগ সেতু- সেখানেই তিনি এঁকে রেখেছেন এই শিশুটির পরিচয়। এর জন্য আমাদের একটু খুঁজে আসতে হবে চলচ্চিত্রটির কাহিনির সামান্য অংশ। শিশুটি প্রায়ই জগদ্দলে চড়ে যাবার আবদার করে। একবার সে সুযোগও আসে। যাত্রী হিশেবে তখন একজোড়া নর-নারী, যাদের পরিচয় আমরা পরে পেয়েছিলাম। নারীটি বিয়ের কন্যা আর পুরুষটি তার পাড়ার দাদা। পালিয়ে এসেছে। একটি বাংলোতে তাদের নামানোর পর হঠাৎ শিশুটি জগদ্দলকে চালাতে শুরু করলো। দুটো বিপরীতধর্মী দৃশ্য এরপরই ঋত্বিক আমাদের দেখান। এক- ড্রাইভার হতভম্ব; দুই- নারীটি হাসছে। এরপর শিশুটির বক্তব্য- থামাতে পারছি না। এই সংলাপে চমকে উঠি আমরা। এই শিশুই কি তবে জগদ্দলের অবচেতন মন? জগদ্দলের হৃদয়? ড্রাইভার ও জগদ্দলের যে প্রেম- তার মাঝেও তো আছে ঈর্ষা-মান-অভিমান; এই শিশুটিই তবে তার প্রকাশক? ঋত্বিক আমাদের নিশ্চিত করেন, যখন আমরা দেখি ড্রাইভার লাফ দিয়ে উঠে যায় গাড়িতে, গাড়িটি থামায়। জগদ্দল এসে থামে হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়া নারীটির কাছে। কে তবে প্রমত্তা ভীষণা? কেনোই বা তার প্রলয়রূপ? কে তাকে থামালো ভালোবাসায়? এরপর যখন জগদ্দল নিয়ে ফিরছে ড্রাইভার আমরা শিশুটির একটা ক্লোজশট দেখি- নিচের ঠোঁট কামড়ে মিটিমিটি হাসছে সে। এ কী তবে অনুনয়? সভ্যতার অধিক বয়সি ঋত্বিক ইতিহাস ও ভূগোলের চেনা পরিসরের বাইরে এসে সমাজতত্ত্বের পাশ কাটিয়ে যে প্রেমের বয়ানটি উল্লেখ করে দিলেন, তার কী আর কোনো দ্বিতীয় নজির আছে?
ঋত্বিক আপাদমস্তক ইতিহাসের প্রণয়প্রার্থী ছিলেন। তিনি এও জানতেন যে, সময়প্রবাহ ছলনাময়ী, নিষ্ঠুর ও চলৎপ্রতিভাময়ী কিন্তু একই সঙ্গে ক্লিওপেট্রাপ্রতিম অনন্তযৌবনা। ইতিহাসকে বুকের গভীরে নিয়ে, রাজনৈতিক ডিসকোর্সের ভেতরে থেকেও মগজ ও মননের যে সংযোগ- তাতে ঋত্বিকের অযান্ত্রিক গোটা বাঙলা চলচ্চিত্রে সম্ভবত প্রথম প্রয়াস। একদিন সবকিছু শেষ হবে। আমাদের চেনা স্বর বদলে যাবে। আমাদের দেখার চোখ পাল্টে যাবে, শোনার ইন্দ্রিয় স্তব্ধ হবে। সেদিনও বাতাসে উড়বে আমাদের সভ্যতা আর ইতিহাসের কিছু রঙিন পালক। আমি দেখতে পাচ্ছি- অযান্ত্রিক অনিবার্যভাবেই সেই রঙিন পালকগুলোর মাঝে সবচাইতে রঙিন।