শান্তি নিকেতনের বাতাসটা কেমন?
ওখানকার বাতাসে কি রবীন্দ্রনাথ মিশে থাকেন? ওখানকার বৃষ্টিতে, কিংবা রোদের অ্যানাটমি জুড়ে কি রবিঠাকুরের নিবিড় বসত?
রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের দর্শনে সাহিত্যচর্চা করতেন। বোধ করি তিনি সে জন্যই বলে গিয়েছিলেন, ‘তোমারে যা দিয়েছিনু, তা তোমারি দান। গ্রহণ করেছো যতো, ঋণী ততো করেছো আমায়.. ..’। কবিগুরুর কোনো অভিযোগ ছিলো না কারও বিরুদ্ধে। তাই বুঝি তাঁকে যাঁরা ভালোবাসেন, তাঁর গান যাঁদের নিত্য সাধনা— তাঁদেরও কোনো অভিযোগ থাকে না।
এতোদিন আমি বিষয়গুলো ধরেই নিয়েছিলাম। এবার দেখলাম— না, এটাই সত্যি।
আমাদের মৃদুল স্যারেরও কোনো অভিযোগ নেই। একেবারে নিষ্পাপ একটা প্রশান্তি নিয়ে তিনি ঘুমিয়ে আছেন। এ যেনো ঘুম নয়, পাহাড়ি ধুনের সুরে মজে আছেন স্যার।
আমাদের মৃদুল স্যার। মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী। আপনারা হয়তো উনাকে ঠিক চিনবেন না। সম্প্রতি উনার নামটা শুনতে পারেন নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠের অভ্যাসে।
আপনাদের বিরাট রুচি! বিরাট বিরাট রথি-মহারথি ছাড়া আপনারা কাউকে সাধারণত চেনেন না। কী অপূর্ব আপনারা!
আমাদের মৃদুলকান্তি স্যার অতো বিরাট মানুষ ছিলেন না। মৃদু স্বরে কথা বলতেন, ঋজু চলনে তিনি যেনো আল্পনা আঁকতেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। গৌর বর্ণ, মাথায় একটা টুপি।
আমাদের মৃদুল স্যার ১৯৫৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সুনামগঞ্জে। পিতা প্রয়াত মনোরঞ্জন চক্রবর্তী। মায়ের নাম দীপালী চক্রবর্তী। সাত ভাইবোনের মধ্যে স্যার ছিলেন তৃতীয়। বাবা ভালোবাসতেন বাঁশি বাজাতে, আর মায়ের প্রিয় ছিলো সেতার বাদন। বাঁশি আর সেতারের ঠিক মাঝখানটিতে আমাদের স্যার বসে থাকতেন এক কোমল মালকোশ হয়ে। সেজন্যই মনে হয় আমাদের স্যারের নাম ছিলো মৃদুল। কী জানি, ভুলও হতে পারে। কোনোদিন জিজ্ঞেস করিনি তো স্যারকে।
১৯৭৭ সালের কথা। সর্বভারতীয় যুব উত্সবে লোকগীতিতে প্রথম স্থান লাভ করেন তিনি। এই উত্সবের প্রধান বিচারক ছিলেন গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পরিবারের সবাই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। বড়ো বোন রত্না চক্রবর্তীর সাথে মৃদুল স্যার তখন যাযাবর। ভারতের মেঘালয়, শিলং, বালাট, মাইলাম শরনার্থী শিবিরে গান গেয়ে বেড়িয়েছেন তাঁরা। সেই ভয়াবহ সময়েও অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে ‘বাংলাদেশ বুলেটিন’ নামে একটি পত্রিকা বিক্রি করতেন স্যার। সেই বিক্রির টাকা জমা দিতেন তত্কালীন ন্যাপ নেতা প্রয়াত পীর হাবিবুর রহমানের কাছে। শিলং-এ প্রথম বাঙলাদেশ মিশনের পক্ষে আয়োজিত সভায় তিনি ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি পরিবেশন করেন।
শৈশবে পারিবারিক পরিমণ্ডলেই স্যারের সংগীতচর্চা শুরু হয়। বড়ো বোন রত্না চক্রবর্তীর কাছ থেকে তিনি সংগীত শিক্ষা লাভ করেন। পরে শান্তি নিকেতনে অনেক সংগীত গুণীজনের সংস্পর্শে আসেন। প্রাচীন বাঙলা গান, রবীন্দ্র সংগীত ও রাগ সংগীতে তালিম নেন স্যার। স্বর্গীয় মন্মথনাথ রায়, অশেষ বন্দোপাধ্যায়, মোহন সিং থাঙ্গুরা, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, গোরা সর্বাধিকারী, মঞ্জু বন্দোপাধ্যায়, ভিভি ওয়াঝলওয়ার, দেবেন দাস বাউল প্রমুখ বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞের কাছে স্যার তালিম নেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মনোনীত হয়ে বৃত্তি লাভ করে বিশ্বভারতী, শান্তি নিকেতন থেকে যথাক্রমে বি. মিউজিক (১৯৮০) ও এম. মিউজিক (১৯৮২) কোর্স কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করেন। ১৯৯৪ সালে বিশ্বভারতী থেকে ‘বাংলা সংগীতের ধারা ও লোকসংগীতের সুরে রবীন্দ্র সংগীত’ (অষ্টম থেকে বিংশ শতাব্দী) বিষয়ে গবেষণার জন্যে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণা কর্মের একটি অধ্যায়— ‘হাসনরাজা: তাঁর গানের তরী’ (১৯৯২) বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী তাঁর লেখা বই ‘বাংলা গানের ধারা’ (১৯৯৩) প্রকাশ করেছে।
আমাদের মৃদুল স্যারের হাত ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিষয়ক প্রথম পাঠ্যক্রম চালু করা হয়। তারপর বিভাগ এগিয়ে চললো, শিক্ষার্থীরা সংগীতকে প্রাণের মণিকোঠায় ঠাঁই দিতে চাইলো। আর মৃদুলকান্তি স্যার— কেবল বিভাগের শিক্ষার্থীদেরই নয়, অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীদেরও বলতেন— ‘বাঙলা গানে প্রাণডা আছে’।
শিল্পী-শিক্ষক মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীর গাওয়া গান
স্যারের এক শিক্ষার্থী ছিলো, পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। স্যার যখনই তাকে দেখতেন টিএসসি কিংবা লাইব্রেরিতে, তখনই বলতেন— ‘ওরে আইনস্টাইন তো বেহালা বাজাতেন, তুই তো কিছুই বাজাতে পারিস না, তোর যে কী হবে!’
আমাদের সে-ই মৃদুলকান্তি স্যার চলে গেলেন। না, মিথ্যে বললাম— তিনি চলে যাননি, তাঁকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
তিনি নাকি ল্যাবএইডে নির্ধারিত ফি এর মধ্যে এক হাজার টাকা দিতে দেরি করেছিলেন। তাই তাঁর চিকিত্সা করলো না ল্যাব এইড। লেখাটার পর ‘দাড়ি’ই দিলাম। আশ্চর্যবোধক চিহ্ন দিয়ে কী হবে? কেউ কী আশ্চর্য হবেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে গত বছর প্রতুল মুখোপাধ্যায় এসেছিলেন, গান শোনাতে। আমরা তো তাঁকে নিয়ে অস্থির। আমাদের অস্থিরতা দেখে প্রতুল হেসে বললেন, ‘আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হচ্ছেন কেনো? মৃদুলকান্তিকে নিয়ে ব্যস্ত হউন। আমরা গান ফেরি করি, মৃদুলকান্তি বাঙলা গানকে মনে ধরে রেখেছেন। এমন করে আর কেউ রাখেননি’।
সেই মানুষটা এখন ঘুমিয়ে আছেন, এতোটুকু অভিমান নেই কারও বিরুদ্ধে। তাঁর শবদেহটা যখন অপরাজেয় বাংলার সামনে আনা হলো— চারপাশটা শোকে মুহ্যমান। আমাদের ঘাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা অপরাজেয় বাংলার পাথরের তিন মূর্তিও সেদিন কেঁদেছে। সে কী কান্না!
স্যার আপনি তো ঠোঁটে হাসি নিয়েই চলে গেলেন। যেনো হাসি দিয়ে বুঝিয়ে গেলেন— ‘আমার কোনো অভিযোগ নেই’। আপনি চলে যাবার পর আরও দুই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ হয়েছে। কেটে গেছে আরও কয়েকটা দিন। সংবাদপত্রের এক কলামের খবর আর সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় আয়োজনও এখন শেষ। বাকি আছে কিছু সাহিত্য পত্রিকায় আপনাকে নিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। ঈদের ছুটির পর তাও শেষ হয়ে যাবে।
এরপর?
এরপর আবার ১৫ই আগস্ট, আপনার প্রয়ান দিবসের জন্য অপেক্ষা করা। পুষ্পার্ঘ্য, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, আরও কতো কী। আমি জানি এগুলোর কোনোটাতেই আপনার কিচ্ছু আসে যায় না। আপনি নক্ষত্রপুত্র ছিলেন, পেয়েছিলেন নক্ষত্রের অগাধ ভালোবাসা। সেই নক্ষত্রের কোলে আপনি আজও ঘুমিয়ে আছেন। আপনার ঘুমে পল্লী সুরের লোবান, রবীন্দ্র রাগের মায়া। এ ঘুম ভাঙবে না কোনোদিন।
কিন্তু আমরা ভালো নেই স্যার। নির্লজ্জের মতো বেঁচে আছি। আমাদের জীবনযাপনে অসুরের দানবীয় পদচ্ছাপ প্রতিনিয়ত।
মৃদুলকান্তি স্যার— আপনি কোথায় গেলেন? আমাদের নিয়ে চলুন সেখানে। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো। আপনার সাথে গানের দেশে যাবো আমরাও। সেখানে আমাদের সুরের ক্লাশরুম বসবে। ‘মুক্তিযুদ্ধের গান’ নিয়ে আপনার সাত পর্বের লেকচারটা আপনি আবার দেবেন। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনবো।
স্যার তাড়াতাড়ি চলুন, সুরের ট্রেনটা ছাড়লো বলে। রবীন্দ্রনাথ সেই কখন থেকে উঠে বসে আছেন। আর কাউকে সঙ্গে নেবো না। শুধু আমরা, আপনি আর বাঙলাদেশ— সুরের তীর্থে এ এক শাশ্বত যাত্রা।