আকাশের কোনো সূচীপত্র নেই, বস্তুত লাগেও না; কোথায় তার শুরু, কোথায় শেষ— তার কোনো ইতিহাস নেই। আকাশের কেবল আছে বিশালতা, অপরূপ সৌন্দর্য, অনন্য অখণ্ডতা; প্রাণময় মহৎ কোনো অনুভূতির মতো আকাশটা কখনো বিবর্ণ আবার কখনো রঙিন আর উচ্ছ্বল অর্থদ্যোতনায় ঋদ্ধ। এই আকাশের মতোই বাঙালির ইতিহাস— ঐশ্বর্যমণ্ডিত, অবিস্মরণীয় ও প্রবাদপ্রতিম। বাঙালি জাতি, বাঙলা ভাষা ও বাঙলাদেশ— একই সূত্রে গাঁথা, একই দীপ্তিতে দেদীপ্যমান, একই প্রেমিকের হৃদপিণ্ডের গান। এই জাতির ইতিহাস তাই দ্রঢ়িষ্ঠ অস্তিত্বমথিত, মহাকাব্যিক সান্ধ্যতমিস্রা জড়ানো এবং ঝিলের টোল খাওয়া জলের মতোই স্নিগ্ধ।
মানতেই হবে— বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম একটি দীর্ঘ ইতিহাসের আকর। এবং সে আকরের পূর্ণাঙ্গ রূপটি ধরা পড়ে উনিশশো একাত্তর সালের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। বর্বর পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নিপীড়ন-নির্যাতনের প্রতিবাদে বাঙালি তার হিমালয়সম রায় দেয় আওয়ামী লীগের পক্ষে, ছয় দফার পক্ষে। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অর্জন করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। কিন্তু ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে পাকিস্তানি গোষ্ঠীর চলে টালবাহানা, প্রতিবাদমুখর বাঙলা হয়ে ওঠে ভিসুভিয়াস— সাতই মার্চেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন বাঙালির স্বাধীনতা।
একটি বর্বর জাতিরাষ্ট্র কোনোভাবেই নিয়মতান্ত্রিকতা মেনে নেবে না, ইতিহাস সাক্ষী— মেনে নেয়নি। জনগণের রায় মেনে না নিয়ে আলোচনার আড়ালে চলে বাঙালি নিধনযজ্ঞের পরিকল্পনা। সে পরিকল্পনার বাস্তবায়নেই পঁচিশে মার্চ রাতে সারা দেশ জুড়ে শুরু হয় নির্মম গণহত্যা। কিন্তু বাঙালি প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি অর্জন করে স্বাধীনতা, পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় একটি নতুন রাষ্ট্র— বাঙলাদেশ।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা আঙ্গিকে কাজ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে। সাহিত্যে-চলচ্চিত্রে-নাটকে-চিত্র ও ভাস্কর্য শিল্পে মুক্তিযুদ্ধ উঠে এসেছে প্রাণেশ্বরী কথামালার মতোই।
চিত্রশিল্পে মুক্তিযুদ্ধ
বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন তীব্র গভীরে প্রোথিত, তেমনি বাঙলাদেশের চারুকলার ইতিহাসও ঋদ্ধ ও প্রাচীন; যদিও পঞ্চাশ ও ষাট— এ দু দশকেই এদেশের চারুকলা যথেষ্ট আধুনিক চরিত্র অর্জন করেছিলো। অনেকেই এর কারণ হিশেবে পাশ্চাত্য শিল্পের শৈলী ও কৌশলাদি অবলম্বনকেই প্রাধান্য দেন। তবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা ও বাঙালির দুর্বার প্রতিরোধযুদ্ধ— মুক্তিযুদ্ধ এদেশের শিল্পীদের ভাবনা ও সৃজন জগতকে নতুনভাবে আলোড়িত করে। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বাঙালির রাজনৈতিক সংগ্রাম ছিলো মূলত আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি ও সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে, আর বাংলাদেশের চূড়ান্ত মুক্তির আন্দোলন শুরু হয় সত্তর দশকের একেবারে শুরুতেই। ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’— এরকম রাজনৈতিক স্লোগানের পরিপূরক শৈল্পিক আন্দোলন ছিলো জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় আয়োজিত ‘নবান্ন’ চিত্রকলা প্রদর্শনী। এ উপলক্ষে জয়নুল আঁকেন তাঁর ঐতিহাসিক পঁয়ষট্টি ফুট দীর্ঘ ‘নবান্ন’ স্ক্রল চিত্রটি। এতে এক সময়ের সোনার বাংলা কীভাবে শ্মমানে পরিণত হয়েছিলো সে কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এ স্ক্রল আঁকায় তিনি ব্যবহার করেছেন তাঁর প্রিয় মাধ্যম, সাদা কাগজে কালো কালি। তুলির বলিষ্ঠ রেখা, সঙ্গে যুক্ত করেছেন জায়গায় জায়গায় কিছু হালকা রঙ এবং মোমের রেখা। কাহিনিনির্ভর এ স্ক্রলটি এর দৈর্ঘ্যের কারণেও বিশিষ্টতা দাবি করতে পারে।
সে-বছরই (১৯৭০) বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বারো নভেম্বর সংঘটিত হয় মানব ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, যাতে তিন লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারায়। জয়নুল আবেদিন আঁকেন তাঁর আরেকটি ঐতিহাসিক স্ক্রল চিত্র ‘মনপুরা ৭০’। এটিও দীর্ঘ জড়ানো পটচিত্র, পঁয়ত্রিশ ফুট লম্বা, চার ফুট প্রশস্ত কাগজে আঁকা। ঝড়ের পরপরই অনুষ্ঠিত হয় তত্কালীন পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন ও বাঙালির ভাগ্যনির্ধারিণী বিজয়। কিন্তু বিজয়ের স্বাদ পেলো না বাঙালি, বরং তাকে শুরু করতে হয় এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। ষোলোই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তাঁর শিল্পকর্মের নিদর্শন একেবারেই সীমিত। একমাত্র দৃশ্যমান দৃষ্টান্ত ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ শীর্ষক স্বাক্ষর ও তারিখবিহীন তাঁর ছোটো একটি স্কেচ, যেখানে দেখানো হয়েছে সাত— আটজন মুক্তিযোদ্ধার একটি আক্রমণাত্মক দল অপারেশনে যাচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সত্তরের দশকের চারুশিল্পে অবশ্যই বড়ো ভূমিকা পালন করেছে, তবে তা আরো অর্থবহ হয়েছে পরবর্তী দশকসমূহে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রবীণ শিল্পীদের মধ্যে ছবি আঁকতে সবচেয়ে বেশি উদ্বুদ্ধ করেছে শিল্পী কামরুল হাসানকে। যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর আঁকা জানোয়ার ইয়াহিয়ার মুখ ‘এই সব জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ শীর্ষক শক্তিশালী পোস্টার অসাধারণ তাত্পর্য বহন করেছে। সত্তর দশকের পুরো সময় ধরে কামরুল হাসান মানুষ-নির্ভর, বিশেষত নারী বিষয়ক, আধা-বাস্তববাদী অসংখ্য ছবি এঁকেছেন। বস্তুত সত্তরের দশক কামরুল হাসানের শিল্পী জীবনের সৃষ্টিমুখর সময়। ১৯৭২ সালে আঁকা ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শীর্ষক তাঁর একটি তেলরঙ ছবি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কাজ হিশেবে উল্লেখযোগ্য। দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ বছর পর্যন্ত তিনি অসংখ্য অনবদ্য চিত্র সৃজন করেছেন— সরাসরি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক না হলেও এগুলোতে ছিলো স্বাধীনতারই চেতনা। যেমন; নায়র (১৯৭৫), গরুর পাল (১৯৭৫), কলসী কাঁখে (১৯৭৪) বা বাংলা একাডেমীর বটতলা (১৯৭৯)।
প্রবীণ শিল্পীদের মাঝে এস এম সুলতান সত্তরের দশকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রায় ভিন্ন আঙ্গিকে নিজেকে উপস্থাপন করেন। প্রথমে ১৯৭৫ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় চারুশিল্প প্রদর্শনীতে এবং অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর বিশেষ একক প্রদর্শনীর মাধ্যমে। বাংলার ভূমিপুত্র কৃষকের সংগ্রাম, গোষ্ঠীগত দ্বন্ধ-সংঘাত ইত্যাদি তাঁর বিশাল ক্যানভাসে উঠে আসলেও— মূল ধারার সুরে মিশে থাকে মুক্তিযুদ্ধ।
পঞ্চাশের দশকের শিল্পী আমিনুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক, রশিদ চৌধুরী, মুর্তজা বশীর, কাইয়ুম চৌধুরী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর প্রমুখ সত্তরের দশকে তাঁদের কাজে সমৃদ্ধি দেখিয়েছেন। প্রত্যেকের কাজেই মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব অথবা প্রতীকী প্রভাব প্রত্যক্ষ করা গেছে। কাইয়ুম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ ও পল্লী নিসর্গকে অসাধারণ আধা-বিমূর্ত আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন। পরবর্তী দীর্ঘ সময়েও তিনি সচল ও শক্তিশালী শিল্পী। ৭ই মার্চ, ৭১ (১৯৭২), প্রতিবাদ (১৯৭২), বাংলাদেশ’৭১ (১৯৭২), স্বাধীনতা (১৯৭২) ইত্যাদি কাজ উল্লেখযোগ্য। কাজগুলো বেশ জটিল কম্পোজিশন, তবে পরবর্তী সময়ে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী ‘আমার গ্রাম’ শীর্ষক ও অন্যান্য অনেক সাজানো সুন্দর ছবি এঁকেছেন। মুর্তজা বশীরের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিভিত্তিক বিমূর্ত সিরিজ ‘এপিটাফ’ সত্তর দশকের চমত্কার গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
ষাটের দশকের প্রবীণ শিল্পী আবু তাহের সত্তরের দশকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ শিল্প সৃষ্টি করেছেন। বিশেষভাবে স্মরণীয় তাঁর ‘তিন শহীদ’ শীর্ষক একটি কাজ, যেটি সত্তরের দশকে জাতীয় জাদুঘরে প্রদর্শিত হতো। আধা-বিমূর্ত অবয়বভিত্তিক কাজ। হাত পিছমোড়া করে দুচোখ বাঁধা অবস্থায় তিনজন মুক্তিকামী বাঙালিকে হত্যা করে খাদে ফেলে রাখা হয়েছে। টেক্সচার প্রধান তেলরঙ। যুদ্ধের অমানবিকতার প্রাণস্পর্শী শিল্পকর্ম।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাকে বাস্তববাদী অথবা আধা-বিমূর্ত আঙ্গিকে তুলে ধরেছেন শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। তিনি নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন— মুক্তিযুদ্ধ তাঁর ব্যক্তিসত্তা ও শিল্পীসত্তাকে পরিপূর্ণভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাই হয়ে উঠেছে তাঁর কাজের মূল অনুপ্রেরণা। বছরের পর বছর তিনি এই একই বিষয় নিয়ে কাজ করতে থাকেন— নিজস্ব শৈলী নির্মাণ করেন। বিক্রমশালী, পেশিবহুল, দ্রুতগামী মুক্তিযোদ্ধা, ক্যানভাসে হয়তো শুধু একজন যোদ্ধা, অথবা একাধিক, কখনো দলবদ্ধ। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নিয়েও তিনি কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে করেছেন অবিস্মরণীয় কিছু কাজ। আশির দশকের শেষ দিকে তিনি বঙ্গবন্ধু ও ভাসানীকে নিয়ে বিশাল ক্যানভাস প্রদর্শন করেন।
মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রীক চিত্রশিল্প নিয়ে বড়ো কলেবরে গবেষণা হওয়া বাঞ্ছনীয়। খুব ক্ষুদ্র পরিসরে কয়েকটি স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কাজগুলো। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্রশিল্পের সঠিক সংরক্ষণ ও ইতিহাস নথিবদ্ধ করতে পারলে— এগুলোই হবে আগামী দিনের অন্যতম ইতিহাস।
ভাস্কর্যশিল্পে মুক্তিযুদ্ধ
বাংলাদেশে প্রথম আধুনিক ধারার ভাস্কর্য কবে স্থাপিত হয়?
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দেখা যায়— ঢাকার শাহাবাগে জাতীয় জাদুঘর প্রাঙ্গণে ‘পরিবার’ শিরোনামে দাঁড়িয়ে আছে সিমেন্টের তৈরি একটি মুক্তাঙ্গন ভাস্কর্য। বিভিন্ন প্রকাশনায় ‘কাউ উইথ টু ফিগারস’ নামে পরিচিত এই ভাস্কর্যটি নির্মিত হয় আনুমানিক ১৯৫৮ সালে। ঢাকার ফার্মগেট এলাকার এক ধনী ব্যবসায়ীর বাড়ির বাগানে এটি স্থাপিত হয়েছিলো। এটিই বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক ধারার প্রাঙ্গণ ভাস্কর্য। আর যিনি নির্মাণ করেন এটি— তাঁর নাম নভেরা আহমেদ (জন্ম ১৯৩০- মৃত্যু ২০১৫)।
আজকের বাংলাদেশের আধুনিকতাবাদী মূলধারার দৃশ্যশিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা প্রকৃত অর্থে সূচিত হয় বিশ শতকের চল্লিশের দশকের শেষ পর্বে। ১৯৪৭-১৯৭১, আত্মপরিচয় নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠার যুগপৎ সংগ্রামে মুখর সামাজিক পটভূমিতে এদেশে আধুনিক ধারার দৃশ্যশিল্প তার প্রাথমিক রূপ পায়। তবে নভেরা এগুলো থেকে খানিক বাইরেই ছিলেন। তিনি চট্টগ্রামের নারী। ১৯৫০ সালে ইংল্যান্ডে যান। ১৯৫৬ সালে দেশে ফিরে আসেন। নভেরা ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় প্রায় একশতটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের দেয়ালে করা তাঁর রিলিফ ভাস্কর্যটিও এদেশের কোনো জনপ্রতিষ্ঠানে করা আধুনিকধারার প্রথম রিলিফ ভাস্কর্য। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহিদদের পূণ্যস্মৃতির উদ্দেশে নির্মিত শহিদ মিনারের নকশা ও পরিকল্পনায় শিল্পী হামিদুর রাহমানের (১৯২৮-৮৮) প্রত্যক্ষ সঙ্গী ছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নিয়ে আলোচনায় নভেরার প্রসঙ্গটি আসার মূল কারণ হলো— নভেরা একটি ধারা তৈরি করে দিয়ে গিয়েছিলেন— যা আধুনিকতাস্পর্শী; এবং সে ধারার স্নানেই স্নাত হয়েছে স্বাধীন বাঙলাদেশের ভাস্কর্যধারা।
চারুকলা বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৬৩ সালে ভাস্কর্য বিভাগের সূচনা হয়। নভেরার স্বপ্রজন্মের শিল্পী আবদুর রাজ্জাকের (১৯৩২-২০০৫) নেতৃত্বে ১৯৬৪ সাল থেকে বাংলাদেশে আধুনিক ভাস্কর্যের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হয়। ফরিদপুরে জন্মগ্রহণকারী শিল্পী রাজ্জাক ঢাকা চারুকলা থেকে চিত্রকলায় স্নাতক হলেও— তিনি পরবর্তীতে ভাস্কর্য গড়াতে মনোযোগী হন। সেনাবাহিনীর উদ্যোগে ঢাকার প্রবেশমুখ গাজীপুর চৌরাস্তার সড়কদ্বীপে স্থাপিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বহিরাঙ্গন ভাস্কর্য ‘মুক্তিযোদ্ধা’ (১৯৭২-৭৩)। রি-ইনফোসর্ড সিমেন্ট ঢালাইয়ে নির্মিত আঠারো ফুট উঁচু একটি বেদির ওপর প্রতিষ্ঠিত, দৃঢ়ভাবে ভূমির সঙ্গে আবদ্ধ দুই পায়ে স্থির অচঞ্চল দাঁড়িয়ে থাকা গ্রাম্য মুক্তিযোদ্ধার এই অবয়বধর্মী ভাস্কর্যটির এক হাতে রাইফেল অন্য হাতে উদ্ধত গ্রেনেড। যে-কোনো আক্রমণ প্রতিরোধে প্রস্তুত- এমন বোধের জন্ম দেয়াটাই যেনো ভাস্করের উদ্দেশ্য ছিলো। এর প্রণেতা শিল্পী আবদুর রাজ্জাক। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে এই ভাস্কর্যটিই সম্ভবত তাঁর নব্য-ধ্রুপদী ঢঙের শেষ রচনা।
স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণীয় করে রাখার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিশেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনেও একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই ভাস্কর্যটি তৈরি করতে এগিয়ে আসেন শিল্পী সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ (জন্ম ১৯৪৫- মৃত্যু ২০১৭)। অপরাজেয় বাংলা (১৯৭৯) শিরোনামের আঠারো ফুট উচ্চতার তিনটি বাস্তবধর্মী অবয়বের সমন্বয়ে রচিত এই ভাস্কর্যগুচ্ছও রি-ইনফোসর্ড সিমেন্টে ঢালাই দেয়া।
মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় করে বহিরাঙ্গন ভাস্কর্য নির্মাণ পরবর্তীকালে একটি জনপ্রিয় বিষয়ে পরিণত হয়। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় ও সেনানিবাসসমূহে এবং জেলা পর্যায়ে ব্যাপক নির্মাণ তত্পরতা লক্ষ্য করা যায়। হামিদুজ্জামান খান (জন্ম ১৯৪৬, কিশোরগঞ্জ) স্বাধীনতার আগেই ভাস্কর্য অনুশীলনে নিযুক্ত হন। তিনিও চিত্রকলার ছাত্র। ধাতব ঢালাই ও সংযোজনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা প্রভৃতিকে বিষয় করে ‘স্মৃতি ৭১’ শিরোনামে সিরিজ ভাস্কর্য রচনা করেন। মাধ্যম ও বিষয়ের অনবদ্য সমন্বয়ে তাঁর এই ভাস্কর্যগুলোর প্রকাশবাদী চরিত্র এদেশের সমকালীন ভাস্কর্যে নতুনমাত্রা যোগ করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ভবনের সামনে ধাতু মাধ্যমে ‘সংশপ্তক’ (১৯৯০) শিরোনামে তিনি একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। এটি বিমূর্ত— তবে প্রকাশধর্মী অবয়বনির্ভর।
অলোক রায় (জন্ম ১৯৫০, ময়মনসিংহ) ঢাকার চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে চিত্রকলায় স্নাতক হন ১৯৭৩ সালে। ভাষা-জাতীয়তাবোধ ও মুক্তিযুদ্ধ তাঁর ভাস্কর্যের অন্যতম প্রেরণা। ‘মাটির কান্না’ (১৯৮১), ‘আবদ্ধ’ (১৯৮৩) এবং ‘শহীদ’ (১৯৮৫) শিরোনামের তিনটি প্রদর্শনীতে তিনি নতুন ধারার সাথে চেতনার সম্মিলন ঘটিয়েছেন
শামীম শিকদার (জন্ম ১৯৫৩, ফরিদপুর) মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য রচনায় অনন্য অবদান রাখেন। ঢাকা চারুকলা মহাবিদ্যালয়ে ভাস্কর্য বিভাগ থেকে ভাস্কর্যে স্নাতক হন এবং পরবর্তীকালে লন্ডনের জন ক্যাশ স্কুল থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন। তিনি মূলত প্রতিমূর্তি নির্মাণে বিশেষ মনোযোগ নিবন্ধ করেন এবং এক্ষেত্রে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন।
ভাস্কর্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে অবয়ব ফুটে উঠেছে— তা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক; তবে অনেকক্ষেত্রেই ভাস্কর্যের সঠিক দলিলাদি সংরক্ষণ করা হয় না।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নানা প্রকরণ হতে পারে। ইতিহাস যেমন সমকালীন সংবাদ-সঙ্গীত-সংবাদপত্রের ক্লিপিংস, তেমনি যে কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে নির্মিত কোনো ভাস্কর্য কিংবা কোনো চিত্রশিল্পও ইতিহাসের অনন্য দলিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের স্বীয় সত্তার সবটুকু; তাই আমাদের সঙ্গীতে যেমন মুক্তিযুদ্ধ প্রভাব রাখে, তেমনি রাখে আমাদের সাহিত্যে-শিল্পে-সংস্কৃতিতে, এমনকি আমাদের ব্যক্তিত্বেও। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এগুলো অংশ— একেবারে নিখাদ অংশ।