কী এক অলৌকিক সমাপতন! ১৯২০এর যে চৈত্রের দিনে গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীর তীরবর্তী টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্ম নিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু, প্রায় তখনই মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে সত্যাগ্রহ আন্দোলন ভারতের শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। বঙ্গবন্ধু তাহলে সত্যাগ্রহ দর্শনের সমবয়স্ক!
আর তাই হয়তো বাংলার মানুষের জাতীয়তাবাদ উন্মেষের প্রতিটি আন্দোলনের বাঁক নির্মাণ করে একটি জাতিকে স্বাধীনতার অনন্য রৌদ্রে দাঁড় করিয়ে দেবার মধ্য দিয়েই তিনি পেরিয়ে গেছেন রাজনীতির সীমানা– কার্যত ‘ব্যক্তি’ বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছেন একটি ‘দর্শন’। তাঁর জীবনবৃত্তান্তে মিশে থাকা স্বপ্ন ও সংগ্রামে আমাদের চক্ষুদান পর্ব সমাপ্ত হয় এবং আলো ফুটবার পরই আমরা আবিষ্কার করি কী অপূর্ব গতিময়তায় বঙ্গবন্ধু দর্শনই হয়ে উঠেছে আমাদের আধুনিক চৈতন্যের পাণ্ডুলিপি।
পৃথিবীর ক্ষণজন্মা মহাপুরুষদের খুঁজতে গিয়ে আমরা হয়তো ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি হই এবং তাঁরই নির্দেশে বেরিয়ে আসি ইতিহাসের ক্লাসরুম থেকে। আমাদের ফিরে আসতে হয় বাংলার শাশ্বত ইতিহাসের কাছে, মৃত্তিকা ও মানুষের দিনলিপির কাছে এবং সেখানেই আমরা শালপ্রাংশু মহীরূহের মতোন বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পাই। ঘাড় উঁচু করে তাঁকে দেখি এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, বুড়ো আঙুলের ছাপ অদ্বিতীয় হলেও বঙ্গবন্ধুকে খুঁজতে হবে তাঁর তর্জনীর মানচিত্রে।
জন্মদিনে অভিনন্দন কিংবা ইতিহাসের ট্র্যাজিক নায়কের মতো তাঁর রক্তস্নাত মর্মন্তুদ প্রস্থানে এলিজি নির্মাণই কেবল নয়; বরং বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের সাধনালব্ধ যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দর্শন, তাকে জীবনাচরণে নথিভুক্ত করাও আমাদের দায়িত্ব। দলীয় খোঁয়াড়ি ঝেড়ে ফেলে ইতিহাস যদি মুক্তভাষী হয়, তাহলে কি আমরা দেখি না যে, এই নির্দেশই তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন? আজ যখন আমাদের রাজনীতি মানুষের জয়গান ছেড়ে হয়ে উঠেছে পুতুলের কুচকাওয়াজ, নষ্ট পুঁজ গায়ে মেখে ইতিহাসের নামে মিথ্যাচার করে যাচ্ছে কতিপয় নরকের কীট, গণমানুষের ইতিহাস আর নেতাকে প্রতিষ্ঠানবন্দি করছে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় বুদ্ধিজীবী আর লাল ফিতের মাস্টাররা; তখন পঞ্জিকার পাতা ধরে সতেরোই মার্চের উদযাপন অনুষ্ঠানে আমরা কি খুঁজে পাব জাতির জনককে?
প্রতি বছরই এ প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি আমাদের করতে হবে যদি-না জাতিগতভাবে আমরা স্বীকার করি যে, আমাদের মননধর্ম রূপান্তরের অলিখিত ইশতেহার আসলে বঙ্গবন্ধু-দর্শন।
যে মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ, তা কেবলই নয় মাসের একটি সশস্ত্র যুদ্ধ ছিল না। বাঙালির ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আমরা এগিয়ে গিয়েছি মুক্তিযুদ্ধের দিকে। এই ধারার সমান্তরালে হেঁটে বাঙালির হাজার বছরের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেদনা-বিক্ষোভ ও আবহমান বাংলার ঐতিহ্য নিজের চেতনায় আত্মস্থ করে বঙ্গবন্ধুও পরিণত হয়েছেন বাংলার এক অনবদ্য স্বতন্ত্র দর্শনে। তাঁরই কণ্ঠে গান গেয়ে উঠেছিল সাড়ে সাত কোটি বিপন্ন কোকিল, তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের এক মূর্ত প্রতীক।
এই প্রসঙ্গে শৈশব থেকে তাঁর বেড়ে ওঠার সময়কালের রাজনৈতিক ইতিহাসটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ইতিহাসের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সূচনাকাল হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির পরবর্তী সময়টি চিহ্নিত করা হয়। এতে বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে তাঁর স্থান নির্ণয় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। কেননা, যুগ যুগ ধরে মানব মুক্তির জন্যে পরিচালিত সংগ্রাম, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন নেতার দর্শন বঙ্গবন্ধুর মানস-কাঠামো নির্মাণে প্রভাব বিস্তার করেছে।
তিনি জন্মেছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাধীন জনপদে এবং বেড়ে উঠেছিলেন সেই ঔপনিবেশকতার বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রামের ধারায়। তাঁর পিতা একই সঙ্গে ছিলেন পেশাজীবী ও ভূমি-মালিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। উপমহাদেশের বিশ শতকের রাজনীতির ইতিহাস পড়লে দেখা যায়, রাজনৈতিক নেতা হিসেবে যাঁরা ইতিহাসের স্বীকৃতি পেয়েছেন, তাদের প্রায় সকলেই ছিলেন ব্রিটিশ-সৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এই মধ্যবিত্তের শ্রেণি-চরিত্র প্রাথমিকভাবে শিল্প-পুঁজির ভিত্তিতে নির্মিত হলেও অচিরেই তা ধর্ম-বর্ণ ও সম্প্রদায়গত রূপ লাভ করে।
তাই ঔপনিবেশিক ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মূলত হিন্দু উচ্চবর্ণের আধুনিক মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটার প্রায় একশ বছর পর বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটতে থাকে, যদিও উনিশ শতকের মতো এটিও ছিল হিন্দু-প্রধান।
দেশভাগ পরবর্তী সময়ে হিন্দু মধ্যবিত্তদের একটি বড় অংশ ভারতে চলে যাওয়ায় স্বভাবতই এ অঞ্চলের মধ্যবিত্ত হয় মুসলিম-প্রধান। কিন্তু এতে জাতিরাষ্ট্রের প্রশ্নে মধ্যবিত্তের সঙ্কটের কোনো সমাধান হয় না; কারণ ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ট এ শ্রেণির মধ্যে অবাঙালি মুসলমানরাই স্থান পায় এবং তাদের মাঝে ভাষা-সংস্কৃতি ও বোধের ত্রিভুজে গড়ে ওঠা জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনো প্রতিফলন ঘটে না।
মনে রাখতে হবে, এই স্বপ্নভঙ্গের পথেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দীক্ষার সূত্রপাত। তাই পাকিস্তান আন্দোলনের সময় মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্যে পৃথক রাষ্ট্রের দাবিকে বিপ্লবী এম এন রায় যখন জাতীয় সংখ্যালঘুর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার হিসেবে দেখেছেন, তখন নিখিল বঙ্গ প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক আবুল হাশিমের ভারত-ভাগের সময় বাংলাকে খণ্ডিত না করে ঐক্যবদ্ধ রাখার প্রয়াসের সঙ্গে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করছেন তরুণ বঙ্গবন্ধু। দ্বিজাতিতত্ত্বের করাল গ্রাসে বাংলা ভাগ হল বটে কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে নবগঠিত পাকিস্তান যে একটি বুদ্বুদ ছাড়া কিছুই নয়, তা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি তাঁর।
তাই ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ভারত-পাকিস্তানকে স্বাধীনতা প্রদানের অঙ্গীকার ঘোষণার পরপরই বঙ্গবন্ধু কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ‘সিরাজদ্দৌলা হলে’ ছাত্র ও যুব রাজনৈতিক কর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন এবং বলেন:
‘‘মুসলিম লীগ ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু বাংলার জনগণ চায় নবাব-জমিদার-মহাজন প্রভৃতি শোষক শ্রেণির হাত থেকে মুক্তি, তাদের অর্থনৈতিক জীবনের মুক্তি। সেই মুক্তিদানের লক্ষ্যেই আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে যেতে হবে, কেননা আমার আশঙ্কা হচ্ছে, এ স্বাধীনতা সত্যিকারের স্বাধীনতা নয়।’’
পরবর্তীতে তাঁর আন্দোলন ও সংগ্রামের গতিপথ নির্মানের দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাই তিনি জোর দিয়েছিলেন পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন, তার ধর্মনিরপেক্ষ জাতিচরিত্র ও সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের ওপর। বাঙালির বিস্মৃত জাতিসত্তা জাগ্রত করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটিয়েছেন। আমাদের সংবিধানের চারটি মূল স্তম্ভের মধ্যে এসেছে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
বঙ্গবন্ধু যে জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা তা উনিশ শতকের সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ নয়; বরং বিশ শতকের আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদ।
দুই
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় তা বিশ্লেষণপূর্বক আমরা তাঁর আদর্শের একটি পরিকোঠামো নির্মাণ করতে পারি। ১৯৭২-৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর শাসনামল নিয়ে নানাবিধ আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারায় তার বিশ্লেষণ সম্ভব হয়নি। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া কয়েকটি ভাষণের অংশবিশেষ লক্ষ্য করলে আমরা স্বাধীন বাংলার স্থপতির চিন্তার চোখে আমাদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশটি দেখতে পারি।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন জাতীয়করণ কর্মসূচি। তিনি ঘোষণা করেন:
‘‘আমার সরকার অভ্যন্তরীন সমাজবিপ্লবে বিশ্বাস করে। এটা কোনো অগণতান্ত্রিক কথামাত্র নয়, আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটা নতুন সমাজব্যবস্থার ভিত রচনার জন্য পুরাতন সমাজব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ব।’’
অর্থাৎ স্বাধীনতার সুফল সকল মানুষের জন্যে, এ কথা তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দেন। একই সঙ্গে জাতীয়করণের আওতায় আনার জন্যে যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয় সেগুলোর মালিকদের দেশপ্রেমে উদ্বুব্ধ হয়ে বাংলাদেশের জনগণকে নতুন মালিক হিসেবে সহযোগিতা প্রদানের জন্য আহবান জানানো হয়। কেবল জাতীয়করণের প্রশ্নেই নয়, তিনি সুস্পষ্টভাবেই বাংলার সম্পদকে জনগণের সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। খাসমহলের জমিতে ভূমিহীন কৃষকের অধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে (৭-৮ এপ্রিল, ১৯৭২) দেওয়া বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ নীতিনির্ধারণী ভাষণের একটি অংশ তিনি বলেন:
‘‘বাংলাদেশ যেমন লক্ষ লক্ষ শহীদের জন্ম দিয়েছে, তেমনি বেঈমানও রয়েছে। এখানে রাজাকার, আল-বদরও হয়েছে। এসব পরগাছার শিকড় তুলে তা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। তা না হলে স্বাধীনতা বিপন্ন হবে। কেউ কেউ আবার অতি-বিপ্লবের নামে তলে তলে ষড়যন্ত্র করছে।’’
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর এই বক্তব্যের বাস্তবায়ন যেমন শুরু করেছিলেন, তেমনি ধর্মের ধুয়া তুলে যেসব অপগণ্ডরা রাজনীতির মালাই চাটার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধেও হুঁশিয়ার উচ্চারণ করেন। বঙ্গবন্ধু প্রশ্ন রাখেন:
‘‘যারা ইসলামের নামে গত ২৪ বছর এদেশকে শোষণ করেছিল তারা কি মুসলমান?’’
অতি-বিপ্লবীদের বিষয়ে তিনি যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, তা আজকের বাংলাদেশেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ১৯৭২-৭৫ শাসনামলে এই অতি-বিপ্লবীদের চেহারা আমরা ইতিহাস থেকে জেনেছি। বস্তুত এসব কারণেই সংসদে চতুর্থ সংশোধনীর ওপর দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে বলতে হয়েছে:
‘‘আজকের এই সংশোধন কম দুঃখে করি নাই।… যে নতুন সিস্টেমে যাচ্ছি তাও গণতন্ত্র। এখানে আমরা শোষিতের গণতন্ত্র রাখতে চাই।… সিস্টেম পরিবর্তন করেছি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য।’’
সর্বশেষ অংশটুকু আমরা নিতে পারি ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটিতে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে। সেখানে তিনি বলেন:
‘‘আমি ফেরেস্তা নই। শয়তানও নই। আমি মানুষ, আমি ভুল করবই। আমি ভুল করলে আমার মনে রাখতে হবে, আই ক্যান রেকটিফাই মাইসেলফ। আমি যদি রেকটিফাই করতে পারি, সেখানেই আমার বাহাদুরি।… এই সিস্টেম ইনট্রোডিউস করে যদি দেখা যায় যে, খারাপ হচ্ছে, অলরাইট রেকটিফাই ইট। কেননা আমার মানুষকে বাঁচাতে হবে। আমার বাংলাদেশে শোষণহীন সমাজ গড়তে হবে।’’
এই বক্তব্য সম্ভবত ইতিহাসের একমাত্র আত্মকথন, যেখানে একজন রাজনীতিবিদ্ নিজেই তাঁর দর্শনের উপর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অবারিত আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত করে গেছেন আর এখানেই দর্শন হিসেবে তার চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা।
তাই পঁচাত্তরের বর্বর হত্যাকাণ্ডের পর আমরা যে বাংলাদেশের ইতিহাস পাই, তা মূলত পাকিস্তানপন্থী বাংলাদেশের ইতিহাস; একটি মধ্যযুগীয় বর্বরতার ইতিহাস। কেবল রাষ্ট্র-কাঠামোতে নয়, নাগরিকের জীবনেও যেন বঙ্গবন্ধু দর্শনের আলো পড়তে না পারে, তার সব রকম কূটকৌশল তখনকার সেনা ও মোল্লাতন্ত্রের শাসকগোষ্ঠী নিয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, বঙ্গবন্ধু-দর্শন বাংলার নদীর স্রোতের মতোই নীরবে বহমান– প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
তিন
পঁচাত্তরের পর একুশ বছর বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করে রেখেছে তৎকালীন ক্ষমতাসীন পাকিস্তানি দোসর জিয়া-এরশাদের শকুনেরা। একুশ বছর পর আবারও বাংলাদেশ ফিরতে শুরু করে তার আপন মানচিত্রে। কিন্তু ফেরার সে পথ মোটেও সহজ হয় না। যেমন সহজ ছিল না স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্নেও। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ মহান মুক্তিযুদ্ধে যে প্রবাদপ্রতীম ভূমিকা রেখেছে তার কতটুকুর বিকাশ ঘটেছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে চলতে শুরু করা স্বাধীন বাংলাদেশে?
বঙ্গবন্ধু তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা জাতীয় চার নেতাকে সঙ্গে নিয়ে একা লড়াই করেছেন দলের ভেতরে বাইরে; বারবার তিনি দেশপ্রেমের কথা বলেছেন, ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে উঠে দেশের জন্যে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু দিনের পর দিন আওয়ামী লীগের মধ্যে থেকেই বেড়ে উঠেছে খন্দকার মুশতাকেরা।
ইতিহাসের এই সত্যটুকু ধারণ করে যদি আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দিকে তাকাই, তাহলেও কি একই ধরনের শঙ্কা আমাদের আচ্ছন্ন করে না? ইতিহাসের কী আশ্চর্য পুনরাবৃত্তি! স্বাধীনতার পঁয়তাল্লিশ বছর পর আজও বঙ্গবন্ধু-কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই জনগণের বিশ্বাস নিয়ে একা দাঁড়াতে হয় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাতিঘর হিসেবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে গোটা আওয়ামী লীগের অধিকাংশেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ছিঁটেফোঁটাও আমরা দেখি না।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক বিকাশধারায় বাংলার প্রান্তিক মানুষ জড়িয়ে ছিলেন ওতপ্রোতভাবে। আর আজকের আওয়ামী লীগ? তৃণমূলের আওয়ামী লীগ নেতারা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন জনগণের আস্থা আর ভালোবাসায় তাদের রাজনৈতিক জীবন সিক্ত?
যে পাকিস্তান অপ-আদর্শের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু বাংলার আদর্শ নির্মাণ করেছিলেন, সেই পাকিস্তানি পুঁজজাত যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের দেশদ্রোহীরা যখন আওয়ামী লীগের নেতাদের হাতে ফুল দিয়ে রঙ বদলায় আর গণমাধ্যমে সে চিত্র উঠে আসার পরও যখন দলের নিরবতা লক্ষ্য করি– তখন স্বীকার করতেই হয় বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রতিষ্ঠিত দলের কাছে ছবি আর আনুষ্ঠানিকতার প্রতীক হয়েই আছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর যে আমৃত্যু ইস্পাতসম অবস্থান, দেশের সম্পদকে জনগণের সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে জীবনাচরণের যে অনবদ্য দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধু স্থাপন করেছিলেন– বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই বোধ করি এগুলো রূপকথার গল্প ভেবে রাজনীতি করেন।
আর রাজনীতির কথা যখন এলোই, তখন এ প্রশ্ন করতে হয়: আজ কারা রাজনৈতিক নেতা হয়ে উঠছে? সকল সময়ে সুবিধাভোগী আমলা, সেনা-কর্মকর্তা আর কালো টাকার ব্যবসায়ীরাই কি বর্তমানে রাজনীতির কর্ণধার হয়ে উঠছে না? বাংলার মানুষের মধ্য থেকে উঠে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু, হয়ে উঠেছিলেন রাজনীতির কবি; কিন্তু আজকের নেতাদের সেই জনসম্পৃক্ততা কোথায়? পাঁচতারা হোটেলের সেমিনার কক্ষে বাংলার মানুষের কণ্ঠস্বর পৌঁছায় না, বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে হলে মিশে যেতে হয় মানুষের মাঝে। তখন মানুষের কণ্ঠস্বরেই রচিত হয় রাজনীতির ভাষ্য।
ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু সেই রাজনৈতিক ভাষ্যেই নির্মাণ করেছিলেন বাংলাদেশের দর্শন, নির্মাণ করেছিলেন তার সংজ্ঞা এবং ব্যাপ্ত গণমানুষের মাঝে তা ছড়িয়ে দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের দর্শন। সে সূর্যমুখী দর্শন আজও আমাদের রাজনীতিতে অচর্চিত বর্ণমালা হয়েই রয়ে গেল।
ইতিহাসনিষ্ঠ হলে, এ সত্য আমাদের স্বীকার করতেই হবে।
তথ্যসূত্র
১. M. N. Roy, Pakistan and Democracy Bombay: M. N. Roy edited Weekly Independent India, 1950
২. Sheikh Mujibur Rahman, My Leader: Messenger of Peace, Karachi: The Morning News, Suhrawardy Supplement, Karachi, 5 December, 1968 [p. 143]
৩. দৈনিক বাংলা, ২৭ মার্চ, ১৯৭২
৪. দৈনিক বাংলা, ৯ এপ্রিল, ১৯৭২
৫. মুনতাসীর মামুন, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ, ঢাকা: মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত ও সংকলিত গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ভূমিকা অংশ থেকে [পৃ. ৪৬]