ভালোবাসার বৃষ্টি নাকি ভেজায়।
মানে ভিজতে হয়।
চেতনার রঙে সবুজ পান্নার শরীরে জমে ভালোবাসার শিশির; হৃদয়জ এবং তার চেয়েও বেশি কিছু, কিন্তু মোহনীয় নয়- মোহ নেই সে-ই ভালোবাসার প্রবাদ শরীরে।
এমন ভালোবাসার নির্যাস পেতে হলে হৃদয়কে ‘হৃদয়’ করে গড়ে তুলতে হয়। কেবল হৃদয় হলেই হয় না, তাকে দার্শনিক করে গড়ে তুলতে হয়, কখনো ছাঁচে ফেলে, কখনো আকাশে উড়িয়ে। মতিষ্কের সাথে হৃদয়ের মিলন হয় প্রাণময় ঐশ্বর্যের মতোই। তবেই চোখের আরশিতে ঝড়ে শব্নম- ভালোবাসার সর্বরঙা সর্বজয়ী শব্নম।
সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৫-১৯৭৪) এমন এক মহিমান্বিত-প্রলয়ঙ্করী-গিরিপ্রস্তরস্পর্শা-হৃদয় ভাসানো-সীমানা পেরোনো শব্নম উপহার দিয়েছেন ১৯৬০ সালে। এটি লেখকের দ্বিতীয় উপন্যাস। এ কথা বলাই বাহুল্য যে- মুজতবা আলীর ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়েছে বিচিত্র ও মিশ্র উপাদানে। জন্মেছেন সাবেক বঙ্গ প্রদেশের বাইরে। অগ্রজ দুই ভাই-ই সাহিত্যচর্চা করেছেন। পড়াশুনা করেছেন রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায়- শান্তিনিকেতনে, কিছুদিন কায়রোতে, এক পর্যায়ে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে। চাকুরি সুবাদে লাভ করেছেন কাবুল ও বরোদায় বাসের অভিজ্ঞতা। ব্যাপক সফর ও বিদেশ বাসের, অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার যোগফল প্রাচ্য-প্রতীচ্যের অনেকগুলো ভাষায় বুৎপত্তি লাভ। অন্যদিকে এই মানুষটাকেই আমরা পাই সুরসিক, আড্ডাবাজ, সর্বা চলিষ্ণু, ঠিকানা-পরিবর্তন-প্রবণ ও সাংবাদিকসুলভ সজাগচক্ষু- অতএব তিনি শিল্পী, যাঁর বিম্বিত প্রতিফলনে মূর্ত হয় চিন্তার সুরসুতার সাথে রসবোধের মণিকাঞ্চন।
শব্নম গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে ৩ শে বৈশাখ ১৩৬৭ থেকে ১১ই ভাদ্র ১৩৬৭ পর্যন্ত দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসের পটভূমি কাবুল, আফগানিস্তান- যেখানে লেখককে প্রথম জীবনে কর্মসূত্রে বেশ কিছুকাল থাকতে হয়েছিলো। সময়কালটা ছিলো বাচ্চা-ই-সাকার১ অভ্যুত্থান। লেখকের অসামান্য লেখনীর গুণে সে সময়কার কাবুলের এক অন্তরঙ্গ পরিচয় পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। উপন্যাসের নায়িকা শব্নম কাবুলেরই মেয়ে। শব্নম প্রথম গ্রন্থাকারে বের হয় অধুনালুপ্ত ত্রিবেণী প্রকাশন কোলকাতা থেকে, ১৯৬০ সালে। প্রথম সংস্করণের পৃষ্ঠা সংখ্যা ২১৯, দাম ছিলো পাঁচ টাকা।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে শব্নম সৈয়দ মুজতবা আলীর একটি অসামান্য সৃষ্টি। এই উপন্যাসটি পাঠান্তে প্রথমেই আমার মনে হয়েছিলো- শব্নম কী? প্রথম দৃষ্টিতে শব্নম আমাকে সম্মোহিতো করেছিলো, যখন দ্বিতীয়বার চাইলাম- তখন আমি শব্নম-এ আত্মস্থ; আর একেবারে শেষবার, ওই শেষ লাইনটি যখন পাঠ করি- “সে কি আমাকে বলে যায় নি, ‘বাড়ি থেকো। আমি ফিরব’।”- তখন আমি পুনরায় ফিরে চাই শব্নম-এর দিকে মুগ্ধ নয়নে, তাঁর অশ্রুগলিত কবিতা শুনবো বলে।
শব্নম এক অনবদ্য সুকুমার সাহিত্য, ইংরেজীতে যাকে বলে বেলে-লেটার। তবে এটি উপন্যাস কি না সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন মুহম্মদ এনামুল হক২। তিনি বলেছিলেন-
ইহা কি উপন্যাস? হঠাৎ এই প্রশ্নটি মনে উদয় হইল কেন? দেখিতেছি, ইহাতে ‘নায়ক’ (মজনূঁন), ‘নায়িকা’ (শব্নম) অদৃশ্যপ্রায় ক্ষীণ-সূত্র নির্ভর একটি ঘটনা (কাবুলে বাচ্চা-ই-সাকার উত্থান-পতন) এমনকি সংলাপ (আসলে ‘প্রলাপ’) ও ট্র্যাজেডি বা বিষাদান্ত্য পরিণতি (প্রকৃতপক্ষে ‘বিরহ’) প্রভৃতি উপন্যাসসুলভ যাবতীয় বস্তু বর্তমান। তথাপি এই জাতীয় একটা অদ্ভুত প্রশ্ন মনে জাগিয়া উঠিল কেন? কারণ ঘটনাপ্রবাহসঞ্জাত চরিত্র সৃষ্টিই উপন্যাসের মূল উপাদান এবং ইহাই ইহাতে অনুপস্থিত। তবে, ইহা কি একখানি নাটক? না, তা কিছুতেই নহে। কারণ নাটকের কোন লক্ষণই ইহাতে বর্তমান নাই। তবে ‘শব্নম’ কি সাহিত্যের চির অভিজাত শাখা- কাব্য? কিন্তু, ছন্দোবদ্ধ কাব্য তো ইহাতে দেখিতেছি না। কি করিয়া ইহাকে কাব্য বলিব? তথাপি মন সোল্লঅসে বলিয়া উঠে, ভাবমধুর ও রসঘন বাক্যের সমাহার যদি ‘কাব্য’ নামে অভিহিত হয়- তাহা পদ্যে রচিত হউক বা গদ্যে লিখিত হউক- ‘শব্নম’ নিশ্চয়ই একখানা ‘কাব্য’- না, একখানা সৃষ্টিমুখর প্রেমকাব্য।৩
কিন্তু এ লেখায় শব্নম উপন্যাসের কাব্য বৈশিষ্ট্য প্রকাশ সম্ভবপর নয়, বোধ করি মুহম্মদ এনামুল হকও পারতেন না, এমনকি স্বয়ং লেখকও নন। কারণ- কাব্যের রস সৃজনে মাতাল, বহিলে ভানুমতী।
তবে ছান্দসিক ভাষার জোয়ার না থাকলেও আলো-আঁধারের খেলা শব্নম-এ জমে উঠেছে, পুরোদমে। ইরানী কবির এক শ্লোক উদ্বৃত করে নায়ক যখন প্রেম নিবেদন করে, তখনই কাব্যে-সৃষ্টে প্রেমের আকাশ জুড়ে ডানা মেলে কবিতা নাম্নী পাখি।
মা আজ আঘাজ ব আন্জামি জহান বি- খবরীম,
ঔব্বল ব আখিরি ই-কুহনি কিতাব উফ তাদহ অসৎ
(অনুবাদ)
গোড়া আর শেষ এই সৃষ্টির জানা আছে, বলো, কার?
প্রাচীন এ-পুঁথি গোড়া আর শেষে পাতা ক-টি ঝরা তার।
কোনো এক আদ্যন্ত-খণ্ডিত পুঁথির পাণ্ডুলিপির সুদক্ষ গবেষকের পক্ষেও এর পূর্ণ পাঠোদ্ধার যেমন অসম্ভব, আদিও নাই, অন্তও নাই এমন প্রেমের যে গ্রন্থ শব্নম তার পূর্ণ পাঠোদ্ধারও বোধ করি সম্ভব নয়।
তবে যে প্রেমের মাহাত্ম্য বর্ণনায় এই অনিন্দ্যসুন্দর কাব্যটি ব্যবহৃত হয়েছে, তা যে শুধু অনন্ত- এমন নয়, এ প্রেম অনাদিও বটে। এ যেনো পঙ্কজপদ্ম স্বরূপ,- যে প্রেম পঙ্কে, তথা কামে, জন্ম নিয়েও অভিব্যক্তিকে পঙ্ক হতে দূরে রেখে একটি স্বতন্ত্র সত্তা- প্রেমে রূপ দিতে পারে, সে-ই প্রেমের প্রমূর্ত রূপ খুঁজে পাই এই শব্নম উপন্যাসটিতে।
শব্নম তিন খণ্ডে সমাপ্ত- তবে এর কোনো খণ্ডেরই কোনো নাম নেই। তাই এর অন্তর্নিহিত তত্ত্ব সম্বন্ধে কাঁচা পাঠকের ধারণা সুস্পষ্ট হওয়া কঠিন। সম্ভবত এ কারণেই- মুহম্মদ এনামুল হক আমাদের মতো কাঁচা পাঠকদের জন্যে বলেছিলেন- ‘উপন্যাসখানা নয়বার পঠন বাঞ্ছনীয়’।
উপন্যাস পাঠে দেখা যায়- এর আরম্ভ একটি নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে- “বাদশা আমানুল্লার নিশ্চয় মাথা খারাপ”। এর মধ্য দিয়েই সামগ্রিক উপন্যাসের একটা ক্ষীণ রেখাচিত্র দেখতে পাওয়া যায়। পাতার পর পাতা পড়ে যেতে থাকলে ধীরে ধীরে আমরা দেখতে পাই- নায়কের প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠা। প্রেমিক শব্দটির সাথে হয়তো প্রবল শব্দটি মানানসই নয়, তারপরও এ উপন্যাসের নায়কের ভেতরে একটা আভ্যন্তরীণ প্রবলতা দেখতে পাই, এবং তার কারণও খুঁজে পাই উপন্যাসের শেষ খণ্ডের সমাপ্তিপূর্ব অনুচ্ছেদের (সপ্তম) শেষে-
কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তা সে নয়- অথচ ইন্দ্রিয়ই সেখানে তন্মাত্র হয়ে আছে।
অর্থাৎ লেখকের বর্ণিত প্রেম সাধারণ প্রেম নয়- হয়ও নি। কামের চশমা পড়ে ‘মোহকে’ যারা ‘প্রেম’ বলেন, এ প্রেম সেই প্রেম নয়। শব্নম এর প্রথম খণ্ডে এমনই এক প্রেম ধীরে ধীরে জন্মলাভ করে থাকে।
উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডই অনেক বড়ো, এখানে প্রেমের তীব্রতাও প্রখরতম। এখানে এসেই কালিদাসের সেই অমর উক্তির তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম হয়-
হে সৌভাগ্যবান মুক্তা, তুমি একবার মাত্র লৌহশলাকায় বিদ্ধ হইয়া প্রিয়ার বক্ষঃস্থলে বিরাজ করিতেছ; আর হতভাগ্য আমি বিরহ-শলাকায় শতবার ছিদ্রিত হইয়াও সেই স্থলে স্থান করিয়া লইতে পারি না।
এ খণ্ডে অগ্নি আছে, দহন আছে, জ্বালা আছে, আত্মাভিমান আছে, আত্মসংবরণও আছে এবং শেষ পর্যন্ত প্রেমের একটা দুর্দমনীয় প্রকাশও আছে। প্রেমের আকৃতিতে এই খণ্ডের আরম্ভ এবং মিলনেই, আরও স্পষ্ট করে, ভাব-সম্মিলনেই এর শেষ। প্রেমের পরিণতিবহ ইঙ্গিত লইয়াই শব্নম এর দ্বিতীয় খণ্ডের আরম্ভ আর তা শব্নম এর জবানিতে প্রকাশ পায়-
আমার বিরহে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না।
এই ক্রমবর্ধিষ্ণু প্রেম পরিণতি লাভ করে শব্নম এর তৃতীয় খণ্ডে। তাও শব্নম এর মুখেই অপ্রত্যাশিতভাবে শোনা গেলো-
তুমি আমার মিলনে অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না।
এরই দৃশ্যকাব্য বহিঃপ্রকাশ উপন্যাসে ঘটেছে। বিরহের পর ‘মিলন’ সকাম, মিলনের পর ‘বিরহ’ নিষ্কাম। বোধ করি এ কারণেই বাঙলার বৈষ্ণবেরা এর নাম দিয়েছিলেন- ‘ভাব-সম্মিলন’। শব্নম- এর তৃতীয় খণ্ডে প্রেমের নিষ্কাম-ভাবমূর্তিটিই অঙ্কিত হয়েছে, চির-বিরহের একটি ছোট্ট ইঙ্গিতের সাহায্যে-
.. ..কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তা সে নয়- অথচ ইন্দ্রিয়ই সেখানে তন্মাত্র হয়ে আছে।
প্রশ্ন জাগে- এখানেই কী শব্নম শেষ হলো? পাঠক হয়তো খুশি না হয়েই প্রশ্ন করবেন- একদিন আসবে না শব্নম?
শব্নম আসবে, নিশ্চয়ই আসবে- হৃদয়ের অমরাবতীতে, চৈতন্যের পরপারে। শব্নম- এর ফিরে আসার সেই খণ্ডটি সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী লিখে যাননি, তুলে রেখেছেন পাঠকের জন্যে। সে-ই থেকে পাঠক আজও লিখে চলছে শবনমের ফিরে আসার খণ্ডটি- কখনো চোখের জলে, কখনো বৃথা আষ্ফালনে আবার সব ফুরিয়ে গেলে কেবল এইটুকু আশা নিয়ে- ‘একদিন আসবে না শব্নম’।
তথ্যসূত্র:
[১] মূল নাম হাবিবুল্লাহ কালাকানি (১৮৯০- ০৩ নভেম্বর, ১৯২৯)। ১৯২৯ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আফগানিস্তানের শাসক ছিলেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি হাবিবুল্লাহ খাদেম-ই-দ্বীনী-রাসুলুল্লাহ নাম ধারণ করেন। কাবুলের দক্ষিণপ্রান্তের এক প্রত্যন্ত গ্রাম কালাকানে তাঁর জন্ম। তার পিতার পেশা ছিলো পানি বহন করা। তাই তার নাম হয় বাচ্চা-ই-সাকার (পানি বহনকারীর সন্তান)। তিনি বাদশাহ আমানুল্লাহ খানকে উৎখাত করে ক্ষমতায় আসেন।
[২] ভাষাতাত্ত্বিক ড. মুহম্মদ এনামুল হক একাধারে ভাষাতাত্ত্বিক, গবেষক, সুফিতত্ত্বের ইতিহাসের শেকড়সন্ধানী, বাঙলা সাহিত্যের বহুভাষী জ্ঞানতাপস। জন্ম ১৯০২ সালের ২ সেপ্টেম্বর, চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার অন্তর্গত ইছাপুর পরগণার বখতপুর গ্রামে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৯ সালে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। এরপর প্রাজ্ঞ গবেষক আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে ১৯৩৪ সালে ডক্টর অব ফিলসফি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে আবাহন (কবিতা), ঝর্ণাধারা (কবিতা), চাটগামী বাঙ্গালা ভাষার রহস্যভেদ (১৯৩৫), আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য (১৯৩৫), বঙ্গে সুফি প্রভাব (১৯৩৫), বাংলা ভাষার সংস্কার (১৯৪৪), ব্যাকরণ মঞ্জুরী (১৯৫২), মুসলিম বাংলা সাহিত্য (১৯৫৭), মনীষা মঞ্জুষা (১৯৭৫/৭৬), বুলগেরিয়া ভ্রমণ (১৯৭৮) অন্যতম। এছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেন আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ স্মারকগ্রন্থ। ১৯৮২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
[৩] ১৯৭৫ সালের ৩০ জুন প্রকাশিত শব্নম উপন্যাসের তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকা থেকে উদ্বৃত।