ফিল্ম রিভিউ ম্যগাজিনে একবার একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছিলো- যার একটি অংশের বাঙলা তরজমা করলে দাঁড়ায়-
পরিচালক অনেকাংশেই চলচ্চিত্রের মূল-কাঠামোতে দৃষ্টি রাখেন, এতে ছোটো ছোটো অনেক ক্ষেত্রে দৃষ্টি দেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। ওই কাজটি একজন দক্ষ অভিনয়-শিল্পী করে থাকেন। এই জাতীয় অভিনয় শিল্পীরাই পরিচালকের ফরমায়েশ পেরিয়ে আরও কয়েক কদম এগিয়ে আসেন- এবং কার্যতই এতে শিল্প যথাযোগ্যের চেয়ে একটু বেশি নন্দনভিত্তিক হয়ে পড়ে.. ..।
এই লেখাটি পরিচালক আব্দুল জব্বার খানের পড়ার সুযোগ হয়নি, কেননা- তিনি যে সময় কাজ করতেন, সে সময় ফিল্ম রিভিউ অতো জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ছিলো না- তাছাড়া লেখাটা তো মাত্র দুই যুগ আগের।
কিন্তু তবুও বাঙলাদেশের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সবাক চলচ্চিত্রের পরিচালক আব্দুল জব্বার শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হককে বলেছিলেন- আমিনুল কনিষ্ঠ হলেও অভিনেতার চেয়ে একটু বেশিই এগিয়ে ছিলো।
মুখ ও মুখোশ চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শনীর প্রধান অতিথি ছিলেন শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক।
সেই অভিনেতার চেয়ে একটু বেশি এগিয়ে থাকা কনিষ্ঠ আমিনুল হক আর নেই। ৩১ জুলাই, ২০১১- রবিবার ভোর সাড়ে চারটায় উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে তাঁর জীবন-অবসান ঘটে।
তিনি চলে গেলেন, শ্রাবণের মাঝামাঝিতে, প্রকৃতিতে শরৎ আসতে যখন আর বেশি দেরি ছিলো না। মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগেই তাঁকে দেখা গেছে ম্যাগজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র একটি নাট্যাংশে অভিনয় করতে।
আমাদের দেশের একটি অদ্ভূত নীতি আছে। যখন কেউ চলে যান চিরদিনের মতো, রেখে যান জীবনের সবটুকু আমাদের জন্য এবং যাঁদের কর্মপথের ধুলোয় আমরা পরবর্তী প্রজন্ম নিজেদের পথ নির্মাণ করি- এই সৃষ্টিশীল প্রেরণাময় মানুষগুলোর জন্যে আমাদের গণমাধ্যমে সিঙ্গেল কলামের খবর আর ‘অমুকের শোক, তমুকের শোকোচ্ছ্বাসের খবর’ প্রকাশিত হয়। অবশ্য আমিনুল হকের ভাগ্য এদিক থেকে ভালো ছিলো। তিনি দেশীয় চণচ্চিত্রে একুশে পদক পেয়েছেন ১৯৯১ সালে। চলচ্চিত্র পরিচালক এবং নির্মাতাদের শ্রদ্ধাও পেয়েছেন- কিন্তু ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রের সেই কিংবদন্তীর অভিনয় দলটির তিনিও যে একজন যোদ্ধা- এ খবর নেহাৎ বিসিএস কিংবা ব্যাংকিং জবের গাইডের যাঁতাকলে না পড়লে আমরা জানি না। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে নূতন প্রজন্মের মাঝে, মানে আমাদের মাঝে, চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করার আগ্রহ অনেককেই ঘরছাড়া করে। আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা পেরিয়ে এখন আমরা ‘অন্য-আধুনিকতার’ বিষয় নিয়ে ছবি বানাতে চাই; কিন্তু ‘মুখ ও মুখোশ’ এর এই অভিনয়শিল্পীর নাম কিংবা তাঁদের মতো যাঁরা নিজেদের অনেকখানি দিয়ে আমাদের জন্য একটি মসৃন পথ করে দিয়ে গেছেন, তাঁদের কথা স্মরণ করি না। অনেকে জানিই না।
যাঁরা সাহিত্য জানেন তাঁরা নিশ্চয় মনে করতে পারেন যে, ট্র্যাজিডি’র উল্লেখযোগ্য তিনটি প্রকার হলো- গ্রীক, এরিস্টটলীয় এবং শেক্সপীয়রীয়। আরেক প্রকার ট্র্যাজিডি আছে- ওর নাম ‘বাঙালি ট্র্যাজিডি’। শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া, দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়, আমিনুল হক, সন্তোষ গুপ্ত, মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক শহিদ বুদ্ধিজীবীই এই ট্র্যাজিডির শিকার। আমাদের প্রজন্মের মানুষেরা তাঁদের সম্বন্ধে জানে না। বোঝেও না যে, এই অজ্ঞতা আসলে পাপ এবং এর কারণেই আমরা ‘মানুষ’ হতে পারলাম না এখনও।
আমার কথা আপনাদের বিশ্বাস হচ্ছে না? একবার দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে ক্যাম্পাসের ভাস্কর্যগুলো সম্বন্ধে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করুন, আপনি লজ্জা পেয়ে ‘শনিবারের চিঠি’কে উৎসর্গ করে পোস্ট দিবেন। নূতন প্রজন্মের, মানে আমাদের প্রজন্মের, নাট্যনির্মাতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা কিংবা বিনোদনকারীদের (আমাদের প্রজন্মের কাউকেই আমার কাছে অভিনয়-শিল্পী মনে হয়নি, তবে তারা যথেষ্ট বিনোদন দান করে) প্রশ্ন করুন আমিনুল হক সম্বন্ধে, কিংবা ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রের কলাকুশলী সম্বন্ধে দেখবেন আপনাকে শুনিয়ে দিয়েছে- ওহ ম্যান, গো ফর দ্যা বেটার ফিউচার।
আহাম্মকেরা জানেই না ‘বেস্ট’ অতীত থেকে কেউ ‘বেটার’ ফিউচারের আশা করে না, ‘বেস্ট অব দ্যা বেস্ট’ ফিউচারটিই নির্মাণ করে।
কথা হচ্ছিলো আমিনুল হক প্রসঙ্গে। তাঁর জীবনসাথীর নাম পিয়ারি বেগম। তিনিও ছিলেন ‘মুখ ও মুখোশ’ এর একজন অভিনয়শিল্পী। তখন তিনি ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন, আর আমিনুল হক চাকুরি করতেন পূর্ব পাকিস্তান বেতার কেন্দ্রে। তাঁর সন্তান রবিউল আলম বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে গ্রাউ– ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করছেন।
গত ১ জুলাই এই বরেণ্য অভিনয়শিল্পী বিরানব্বই বছরে পা দিয়েছিলেন। ১৯২১ সালে তাঁর জন্ম। কোলকাতা শহরে। ১৯৪৪ সালে শিশির কুমার ভাদুড়ীর নির্দেশনায় তাঁর অভিনয়ে হাতেখড়ি। কোলকাতার ‘শ্রীরঙ্গন থিয়েটার’ এ তাঁর অভিনয় জীবন শুরু। ১৯৪৫ সালে বাবু প্রণব রায় রচিত ও বাবু ফণী বর্মণ পরিচালিত ‘মন্দির’ চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম অভিনয় করেন।
১৯৪৪-৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি কোলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে প্রথম ডিভিশনে ফুটবল খেলতেন। এরপর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। বাঙলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান) তাঁর প্রথম ছবি ‘মুখ ও মুখোশ’। এমনকি এফডিসি’র প্রথম চলচ্চিত্র ‘আকাশ আর মাটি’তে তিনি নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি বুলবুল একাডেমী অব ফাইন আর্টস (বাফা)- এ নাট্য-বিভাগের শিক্ষকতা করেন।
কিন্তু এখন তিনি এসব কিছু পেরিয়ে গেছেন। তাঁর স্বাপ্নিক চেতনার কাছে এখন পান্না আর সবুজ হবে না। তবুও হঠাৎই মনে প্রশ্ন জাগে- এই সব আয়োজন ফেলে তিনি কোথায় গেলেন? কতোদূরে?
মুখোশের আড়াল থেকে মুখ বেরিয়ে আসে। কানের কাছে মৃদু বাতাসের স্পর্শের মতো বলে যায়- আমিনুল হক হৃদয়েই আছেন। হৃদয় তখন হৃদয়-ভাষ্যে কথা কয়।
‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে.. ..’