‘অবশেষে’ গত ২৯ মে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এখানে ‘অবশেষে’ শব্দটি ব্যবহৃত হলো, কেননা এ নির্বাচনটি নিয়ে বিগত দুই সপ্তাহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে যে প্রশ্ন-সন্দেহ আর অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিলো, তা সম্ভবত আগে কখনোই দেখা যায়নি। অন্যদিকে ডিইউডিএস’এর প্রধান সমন্বয়কারী ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যার অনুপস্থিত, সুতরাং যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেছেন এবং যারা ভোট দিয়েছেন, উভয়পক্ষই ছিলো অনেক বেশি আস্থাহীনতার দোলাচলে বিদ্ধ। তবে সবকিছুর উর্ধ্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতার্কিকগণ তাদের মূল্যবান ভোটের মধ্য দিয়ে একটি প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কালো থাবা থেকে ডিইউডিএস’কে রক্ষা করেছে, তাতেই সকলের আনন্দ। সুতরাং নব-নির্বাচিত সভাপতি আলামিন চৌধুরী সুমন এবং সাধারণ সম্পাদক মোঃ রকিবুল ইসলামকে অভিনন্দন, এবং এ গণতান্ত্রিক বিজয়টি পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যই প্রত্যাশিত ছিলো, কেননা এর ওপরই নির্ভর করছিলো আগামী দিনগুলোতে ঢাবি’র বিতর্ক মঞ্চগুলোতে বিতার্কিকগণ মুক্তিযুদ্ধের কথা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির কথা কতোটা বলতে পারবে।
তবে আমার লেখাটি কেবল অভিনন্দন জ্ঞাপনের জন্যই লিখছি না, কারণ ইতোমধ্যে নব-নির্বাচিতগণ অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসছেন। আমি কেবল কতোগুলো চোখের স্বপ্নের কথা জানাতে চাই, আমার লেখাতে তুলে আনতে চাই কতোগুলো শিক্ষার্থীর অনুচ্চারিত বা মৃদু-উচ্চারিত বক্তব্যকে। বিগত প্রায় দুই সপ্তাহ যাবত যারা সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করেছে, বিনিদ্র রজনী যাপন করে একুশে হল থেকে মৈত্রী হল পর্যন্ত ছুটে বেড়িয়েছে, তারা সাধারণ বিতার্কিক। তারা কার্যনির্বাহি পরিষদের কোনো পদের জন্য নয়, কোনো ব্যক্তিগত মোহে নয়, কেবল মুক্তচিন্তার পরিব্রাজকরূপে, বিতর্কের প্রতি হৃদয়জ ভালোলাগা থেকে এ কাজগুলো করেছেন। তাই এ কমিটির কাছে নানাদিক থেকেই আমাদের প্রত্যাশা অনেক তীব্র। তাই সারাদিন ক্লাশ-টিউশনি-লাইব্রেরি-ল্যাব সামাল দিয়েও রাতের পর রাত ডিইউডিএস’ এর জন্য পরিশ্রম করেছে এই সাধারণ বিতার্কিকগণ। তাই এ বিজয় এবং বিজয়ের আনন্দ কেবল তাদেরই প্রাপ্য।
একথা সত্য যে, ডিইউডিএস-এ এখন বিতর্কের নামে যা হয় তা হলো ‘বিতর্ক রাজনীতি’। রাজনীতি অত্যন্ত দরকারি এবং অবশ্য প্রয়োজনীয়, তবে তা যখন বিতর্ককে মাটি চাপা দেয়, তখনই ঘটে বিপত্তি। বিতর্কের জন্য পাঠচক্র আয়োজন না করে, যখন নতুন বিতার্কিকদের নিয়ে হলে হলে মহড়া দেয়া হয়, তখন কিন্তু ডিইউডিএস আর তথাকথিত ও প্রশ্নবিদ্ধ রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে তফাৎ থাকে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত দুইটি শিক্ষাবর্ষে যে সংখ্যক মান সম্পন্ন এবং সম্ভাবনাময় বিতার্কিক এসেছে তা সত্যিই এ বোধহীন বিমুখ বিতর্ক প্রান্তরে এক আশা জাগানিয়া গান। আমরা স্বপ্ন দেখতে চাই নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আমাদের সেই গানকে ধরে রাখবেন এবং আরো সম্ভবনাময় করে তুলবেন। ডিইউডিএস-এর লাইব্রেরিকে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি না করে নবীনদের জন্য উন্মুক্ত করে দিবেন। বিতর্ককে করে তুলবেন পড়াশুনাকেন্দ্রীক, কেবল বস্তাপচা বিষয় আর সংজ্ঞায়নে আবদ্ধ না রেখে নতুন নতুন মাত্রা যোগ করবেন এতে। বছরে দায়সারা গোছের একখানা মলিন, ভুলে ভরা আর কেবল প্রচ্ছদনির্ভর জীর্ণ প্রতিবাক বের না করে বিভিন্ন গবেষণাধর্মী ও বিষয়ভিত্তিক প্রকাশনা বের করারও উদ্যোগ নিন। বাঙলাদেশের সংবিধান ও বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশসহ বিভিন্ন বিষয়গুলো নিয়ে প্রতি সপ্তাহে পাঠচক্রের আয়োজন করুন। বিতর্ক আর যুক্তিকে কেবল ডায়সে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে ছড়িয়ে দিন বিতার্কিকগণের ব্যক্তি মানসে, তাহলেই দেখবেন নির্বাচনে আসলে ‘প্রতিক্রিয়াশীল বিতার্কিক’ নিয়ে বিপদে পড়তে হবে না। প্রকৃত বিতার্কিক কখনোই প্রতিক্রিয়াশীল বা সাম্প্রদায়িক হয় না, ডিইউডিএস-এর ব্যর্থতাই বিভিন্ন সময়ে প্রকৃত বিতার্কিক তৈরি করতে পারেনি।
আমরা স্বপ্ন দেখতে চাই, কারণ ‘ডিইউডিএস’ আমাদের অনেক প্রত্যাশা আর আবেগের জায়গা। বিগত সময়গুলোতে এ সংগঠনটিকে নিয়ে নানা রকম রশি টানাটানি খেলা চলেছে; তবুও সার্থকতা, সারা বাঙলাদেশ যখন যুদ্ধাপরাধী ও তার দোসরদের শাসনে ছিলো, বিশ্ববিদ্যালয় যখন ক্ষমতাসীন সাম্প্রদায়িক দলের ছাত্র সংগঠনের নোংরা হাতে জিম্মি ছিলো, তখনো ‘ডিইউডিএস’কে স্পর্শ করতে পারেনি তারা। এটা সম্ভব হয়েছিলো কেবল সেই সাধারণ বিতার্কিকদের জন্যই, যারা প্রতি বৃহস্পতিবার টিউশনির বেতন থেকে রিকশা ভাড়া দিয়ে টিএসসি’তে আসে কেবল সাপ্তাহিক সেশনটি অংশ নেয়ার জন্য, চোখের সামনে দিয়ে স্বাক্ষরের খাতাটি ঘুরে গেলেও তার মোহ জন্মায় না, হয়তো ডায়াসে দাঁড়িয়ে তার পাঁচ মিনিটের স্ক্রিপ্ট দুই মিনিটেই শেষ হয়ে যায়, তার উচ্চারণ শুনে হয়তো অনেকেই হাসে, তবু সে স্বপ্ন লালন করে, মেনে নিতে না-পারা বক্তব্যের বিরুদ্ধে সে জানিয়ে যায় তার যুক্তি। তাদের ভোটে, তাদের জন্যই কিন্তু আপনারা আজ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক আরো কতো কী। এই সাধারণ বিতার্কিকদের সবই সাধারণ, কেবল অভিমানটুকু ছাড়া। স্বপ্নভঙ্গের অভিমানে তারা কিন্তু ভিসুভিয়াস হয়ে উঠে। আশা করবো পুরো এক বছর এটুকু মনে রেখেই আপনারা ইতিহাস হবেন।