প্রায় তিন বছর আগে আমার প্রিয় মানুষদের একজন শিল্পী-সংগ্রামী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের একটি লেখা পড়েছিলাম তাঁর মোবাইলের ড্রাফট-বক্স থেকে। ‘প্রতিদিনের দ্বিজাতিতত্ত্ব’ কথাটি তাঁর সেই লেখা থেকেই নেয়া। পরবর্তীতে লেখাটি কোনো সংকলনে বেরিয়েছে কিনা জানি না, তবে অনলাইনে দেশভাগ ও দ্বিজাতিতত্ত্ব: একটি আবশ্যিক পুনঃপাঠ শিরোনামে লেখাটি পাওয়া যায়। শুভ দা তাঁর লেখায় ভারতের একজন নাগরিক হিশেবে দেখেছিলেন সেখানকার মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের দ্বিজাতিতত্ত্বকে। ভারতের লেন্সটাকে বদলে বাঙলাদেশ করে নিলে প্রায় একইরকম চিত্রই দেখা যায়। বাঙলাদেশের নাগরিকদের প্রতিদিনের জীবনে তো বটেই, উৎসবে-পার্বনে এই দ্বিজাতিতত্ত্ববোধ আরও চড়া হয়ে ওঠে। অথচ কথায় কথায় আমরা বলি দ্বিজাতিতত্ত্বকে কবর দিয়ে মহান মুক্তিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কথাটি সত্য, অবশ্যই সত্য— বাঙলাদেশ অবশ্যই স্বাধীন হয়েছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার দার্ঢ্য বেদীমূলে দাঁড়িয়ে, কিন্তু দেশ তো কেবল মানচিত্র নয়, তার সঙ্গে সে দেশের জনগণও আছে। যে অসাম্প্রদায়িক চেতনাভিত্তিক মুক্তিসংগ্রামের কথা আমরা বলি, জনগণের মগজে তার প্রভাব কতোখানি ছিল? পঞ্চাশ বছর পর এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে হয় হতাশ হবো, নাহয় কুযুক্তি ঝাড়বো। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই বছরটাতে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সশস্ত্র উত্থান আমরা দেখেছি অন্তত দু বার। মুজিববর্ষ উদযাপনের সময় হেফাজতে ইসলামের সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব আর এই দূর্গাপুজোর সময় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব। দু ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার যারপরনাই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অনেকেই হয়তো তেড়েমেরে এসে বলবেন— কেনো, হেফাজতের সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সরকার কি আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি?
করেছে, কিন্তু তার আগেই শাল্লায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের নির্মম শিকার হয়েছেন সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষ। ঝুমন দাসের মতো নিরপরাধ মানুষকে অহেতুক জেল খাটতে হয়েছে। এবারও হয়তো সরকার নড়েচড়ে বসবে। কিন্তু তার আগেই মাটি হয়ে গেছে আমাদের দুর্গোৎসবের আনন্দ। সারাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা যে অসহনীয় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন; বাড়িঘর, উপাসনালয় ও মানুষকে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি, নির্যাতন আর নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছে; এবং সর্বোপরি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের যে নজির আবারও বাঙলাদেশে স্থাপন হয়েছে— তার ভর্তুকি কী হবে? সরকার ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরগুলো সংস্কার করে দিবে? নির্যাতিতদের পাশে আর্থিক সাহায্য নিয়ে দাঁড়াবে? তারপর? যে শিশুটি চোখের সামনে ইসলাম ধর্মের নামে এই ভয়াল দানবদের তাণ্ডব দেখলো, তার কাছে ওই শব্দটির অর্থ কী? যে মানুষটি দেখলেন তাঁরই জন্মভূমিতে তাঁর ধর্ম পালনের স্বাধীনতা নেই, যে পূজারী লণ্ডভণ্ড করে দেয়া মণ্ডপের ধ্বংসাবশেষ দিয়েই পুজো সারলেন— তাঁদের ক্ষেত্রে সরকার ঘোষিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্যাকেজের উপযোগিতা কি?
এই মানুষগুলো জানেন, প্রতিদিন তাঁদের কী পরিমাণ সাম্প্রদায়িক নিগ্রহের শিকার হতে হয়। দৈনন্দিন জীবনের ছোটো ছোটো অসংখ্য ঘটনায় বারবার তাঁদের মনে করিয়ে দেয়া হয়— ‘তিনি আসলে হিন্দু, কার্যত সংখ্যালঘু’। সমাজের ইসলাম ধর্মাবলম্বী শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ভদ্রলোক-অভদ্রলোক প্রত্যেকে বাড়ি থেকে রাজপথ অবধি এটা প্রমাণে ব্যস্ত থাকেন যে— ‘আমরা মুসলমান আর ওরা হিন্দু’। এই ‘আমরা’ ‘ওরা’র দেয়াল নিয়ে কার্যত বাঙলার ‘ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ’ জনগোষ্ঠী তাদের জীবনযাপন করেন। এখন প্রশ্ন হতে পারে, এটা কি কেবল মুসলিমরাই করেন, সনাতন ধর্মাবলম্বী, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বা অন্য ধর্মের মানুষরা করেন না? করেন তো… তাঁরাও করেন— মুসলমানরা করেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার গরিমায় আর তাঁরা করেন কোনো রকমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। সমাজে আপনি ধর্মভিত্তিক বৈষম্য তৈরি করে দুধ-কলা খাবেন আর আপনার ধর্মের যাঁরা অনুসারী নন তাঁরা সম্প্রীতির ব্র্যান্ড অ্যামবাসেডর হবেন— এটা কেবল স্বার্থান্ধরাই আশা করতে পারে। অতএব, আমরা যতোই কমিউনাল হারমোনির থিসিস লিখি না কেনো, সমাজে আমাদেরই হাত ধরে তৈরি হয়েছে ধর্মীয় ও জাতিগত মেরুকরণ। প্রতিদিন আমরা সেটা চর্চা করি। শিক্ষিত হলে একটু ভদ্রস্থ ভাষায় করি আর তেমন না হলে গালিগালাজ করি। এটুকুই যা তফাত।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ঘর, শব্দের দ্বিজাতিতত্ত্ব
এই জঘন্য তত্ত্বের ঠিকুজি-কুষ্ঠি খুঁজতে এখন আর বঙ্গভঙ্গ বা দেশভাগের ইতিহাস হাতড়াতে হয় না, এদেশের অধিকাংশ ঘরই এখন দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষ দিয়ে সাজানো হয়। টেলিভিশনে দূর্গাপ্রতিমার ছবি দেখে একজন শিশু যখন বিস্মিত হবার পরিবর্তে ‘হারাম হারাম’ বলে আঁতকে ওঠে, তখন আপনি বুঝবেন তার বাবা-মা আসলে তাকে মানুষের পরিবর্তে একজন শিক্ষিত সাম্প্রদায়িক শয়তান হিশেবে বড়ো করতে চাইছে।
মুসলিম পরিবারের একজন শিশুকে অতো কিছু শিখে বড়ো হতে হয় না, কারণ অবচেতনেই সে জেনে যায়, তার পরিবারের আচারই রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠের আচার। কিন্তু একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারের শিশুকে সচেতনভাবে রপ্ত করতে হয়— বাড়িতে ‘জল’ বললেও বাইরে গেলে ‘পানি’ বলতে হবে। বাড়িতে ‘স্নান’ সারলেও বাইরে কোথাও গেলে তাকে ‘গোসল’ই করতে হবে। বাংলাদেশে কথায় কথায় ‘হায় আল্লাহ’ বলা গেলেও আমি জানি না আমার সনাতন ধর্মাবলম্বী বন্ধুটি জড়তাহীনভাবে ‘হায় ভগবান’ বলতে পারেন কিনা। নাকি পরিস্থিতি সামলেও তাকে আসলে শব্দটি গিলে ফেলতে হয়। কারণ তিনি জানেন বন্ধু হলেও এরা তো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম। এভাবে শব্দ গিলে একজন শিশু তার সম্প্রদায়কে চেনে, তাকে আবিষ্কার করে এবং যখন পাঠ্যপুস্তকে পড়ে ‘সবার উপর মানুষ সত্য’ তখন সে কি অবাক হয়, নাকি বিরক্ত হয়?
এদেশের মুসলিম বাবা-মায়েরা সন্তানের আরবি শিক্ষার বিষয়ে এতোই সচেতন থাকেন যে, তাদের নাম পর্যন্ত রাখেন আরবিতে, ফলে ফুটপাতে শিশুদের আরবি সুন্দর নাম বইয়ের রমরমা ব্যাবসাও চলে। কিন্তু এই বাবা-মা কিংবা আত্মীয়স্বজনরাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামি শিক্ষা বা ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে চান্স পেলে মুখ কালো করে বসে থাকেন। আরবি কিংবা ফারসি ভাষা ও সাহিত্যে হলে তো ত্যাজ্য ঘোষণারও সম্ভাবনা থাকে। স্থায়ীভাবে বাস করতে হলেও ওই ইউরোপ আমেরিকা, তবে সেখানে গিয়ে আবার হালাল খাবার খোঁজা চাই। এতো এতো দ্বিচারিতা আর আত্ম-প্রবঞ্চনা নিয়ে একটি দেশের একটি ধর্মের জনগোষ্ঠী বিকশিত হবেন কীভাবে?
দ্বিজাতিতত্ত্বের ক্লাসরুম
স্কুলজীবনে দেখেছি ইসলাম ধর্ম ক্লাস শুরুর আগে কয়েকজন বন্ধু ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে যাচ্ছেন। মানে আমাদের চেনানো হলো— এঁরা ইসলাম ধর্ম ক্লাসের ছাত্র নয়। বড়ো স্কুল ছিল বলেই হিন্দু ধর্মের আলাদা ক্লাস হতো, শিক্ষকও ছিলেন; কিন্তু বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী বন্ধুরা আদৌ ক্লাস করতেন কিনা, আমার মনে নেই। এখন শুনি, তখনও শুনেছি কোনো কোনো অতি-উৎসাহী ধর্ম শিক্ষক ইসলাম ধর্মের অনুসারী নয়, এমন শিক্ষার্থীকেও জোর করে ক্লাসে বসিয়ে রেখেছেন। গত ৫০ বছরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা এমন একটি ধারা সংযোজন করতে পারলাম না, যাতে স্কুলের এই ছোটো ছোটো শিক্ষার্থীদের মাথায় ‘আমরা-ওরার’ ধারণাটি না তৈরি হয়। ধর্মশিক্ষার বিষয়ে আমাদের এমনই খতরনাক অবস্থা যে, কায়দা-সিফারা-আম্পারা পড়ে কোরআন খতম দিয়ে স্কুলে হযরত উসমান (রা.) জীবনী মুখস্থ লিখে ধর্মে এ প্লাস পেয়ে বড়ো হয়ে করি চুরি, সুদ-ঘুষ খাই, অন্যের জমি দখল করি।
শ্রেণিকক্ষের শিক্ষকদের অনেকেই যেহেতু এই দ্বিজাতিতত্ত্বে আক্রান্ত, সুতরাং শিক্ষার্থীদের উদ্ধার হবার সম্ভাবনা কম। ছোটোবেলায় নামকরণের সার্থকতায় পড়েছিলাম— নামে কী আসে যায়— এ কথার সারমর্ম আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, যেহেতু আমার নাম মারুফ রসূল; কিন্তু যার নাম যুক্ত প্রিয়তা, তিনি ঠিকই জানেন বাংলাদেশে কতবার তাঁকে এই প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়— তুমি কি হিন্দু?
তার মানে ধর্ম কী— এ প্রশ্ন শুধু রাষ্ট্রই করে না, প্রতিদিন এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় এমন অনেককেই, যাঁদের নামে মোহাম্মদ, ইসলাম, আহমেদ বা আলম নেই। যদিও বা থাকে, তাহলে জনৈক অনিন্দ্য ইসলামকেও শুনতে হয়— মুসলমানের ছেলে, তোমার হিন্দুয়ানি নাম কেনো?
এই যে নামের দ্বিজাতিতত্ত্ব— এর একটি শব্দতাত্ত্বিক ইতরামিও আজকাল চোখে পড়ে। ‘মালাউন’সহ আরও হরেক রকমের অশ্লীল শব্দ ব্যবহারে যাদের সামাজিক মর্যাদাহানির সম্ভাবনা আছে, বা মননে সাম্প্রদায়িক হলেও যে বা যারা জীবনের প্রয়োজনে অসাম্প্রদায়িকতার মুখোশ পরতে বাধ্য হয়েছে, সে বা তারা অবলীলায় বলে থাকে— ‘বুঝলেন না! ওই বাঙলা নামওয়ালারা…’। পাকিস্তান আমলে বাঙলা ভাষার হিন্দুয়ানি ব্যাখ্যা খোঁজা মুসলমানের বংশধররা এখনও সগর্বে হেঁটে বেড়ায়। এগুলো তার ছিটেফোঁটা উদাহরণ মাত্র।
খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনের দ্বিজাতিতত্ত্ব
‘হিন্দুরা নিরামিষ খায়, ডালে পাঁচফোড়ন দেয়’— মানে ভাবটা এমন যে মুসলমানরা যেটা খায় সেটা কেবলই চাইনিজ ভেজিটাবল আর পাঁচফোড়নের গায়ে লেখা আছে— ‘ইহা হিন্দুদের মশলা’। এই যে খাদ্যাভ্যাসের বজ্জাতি, এর উৎকট রূপ হচ্ছে বাড়িতে সনাতন ধর্মাবলম্বী কোনো বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করে খাবার টেবিলে গরুর মাংস সাজিয়ে রাখা। কোনো কোনো ইতর আবার জোরও করে, ভদ্রস্থ গলায় বলে— ‘ঝোল খেলেও সমস্যা হবে’। অথচ এরাই কিন্তু সুপারশপে গিয়ে বলে ‘এটা হালাল তো’। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্যান্টিনে গরুর মাংস রান্না বা এ সংক্রান্ত সমস্যাবলী নিয়ে গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়েছে। তাতে কার কী যায় আসে।
আমি জানি না যাঁরা এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন, তাঁরা কীভাবে মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেন। হয়তো পারেন না, নিজের সঙ্গে নিজেই যুদ্ধ করেন এবং রাতদিন পরাজয় স্বীকার করে বসে থাকেন।
মন্দিরে নামাযের সময়সূচি টাঙিয়ে রাখতে হবে, কিন্তু মসজিদের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে কথা উঠলে সংখ্যাগরিষ্ঠের তত্ত্ব হাজির হয়। কোরবানি ইদের সময় যে পশু জবাই করেন, খোঁজ নেন আশেপাশের সনাতন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বা অন্য কোনো মতাদর্শের মানুষের সমস্যা হচ্ছে কি না। তিন-চার বছর আগেও এক কোরবানি ইদে পশুর বর্জ্য ফেলে রাখা হয়েছিল মন্দিরের পাশে। এ লেখাটি পড়লে সে সময়ের প্রতিক্রিয়াটি জানতে পারবেন। এসব প্রশ্ন উঠলে ইমানি জোশে আপনারা প্রশ্ন তুলেন— ‘এখন কি তাহলে ইদও করতে পারবো না’। তা পারবেন না কেনো, আপনারা ইদ করতে পারবেন কিন্তু সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পুজো করতে পারবেন না। কারণ, আপনি প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত আপনার যাবতীয় ইতরামিসমেত প্রমাণ করেন যে, তাঁরা সংখ্যালঘু।
ব্যক্তিগত বিদ্বেষকে ধর্মের পরিধিতে টেনে আনা এই অঞ্চলের মানুষদের একটি পুরোনো বদভ্যাস। চাকুরিতে সহকর্মীর সাথে দ্বন্দ্ব, কী জমি-জমা সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব, কী অন্য যে কোনো ইস্যু— সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির ধর্ম চলে আসে। কিন্তু এ লোকগুলোই আবার ইয়াহিয়া খান বা গোলাম আযমের ধর্ম, বিন লাদেনের ধর্ম বা হলি আর্টিসানের জঙ্গী সন্ত্রাসীদের ধর্ম ধরে কথা বললে, গোল গোল মুখে বলে ওঠেন— ‘ব্যক্তির অপরাধে আপনি ধর্মকে টেনে আনেন কেনো?’
কোনো কারণে এই দ্বন্দ্বে যদি ধর্মটা মিলে যায়, তখন আসে আঞ্চলিকতা— ‘বরিশাইল্যা, নোয়াখাইল্যা, ঢাকাইয়্যা…’— মানে নিজের দোষ কোথাও নাই, ব্যক্তির দোষও না। হয় ধর্মের দোষ, নাহয় জায়গার দোষ।
গত কয়েকদিনের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে লক্ষ্য করলাম— সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একদল খুব করে বলছেন, ‘আমরা তো পুজোয় যাই’, ‘প্রকৃত ধর্ম এসব মানে না’, ‘আমি হিন্দু বন্ধুদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাবার খাই’, ‘আমাদের ধর্মে তো আছে…’ প্রভৃতি প্রভৃতি। এসব কথা যখনই শুনি আমার মনে হয়, বক্তার প্রতিটি পকেট কিংবা ভ্যানিটি ব্যাগ ভর্তি হয়ে আছে একেকটি জিন্নাহ, ভুট্টো, সাভারকার কিংবা শ্যামাপ্রসাদে। আপনার ধর্মে কী আছে বা আপনার জীবনাচরণ কেমন, তার ওপর নির্ভর করে অন্যকে ধর্মপালন বা নিজস্ব জীবনাচরণ তৈরি করতে হবে?
সুবিধাবাদীর দ্বিজাতিতত্ত্ব
এর বিকল্প একটি শিরোনাম আমি ভেবেছিলাম— প্রগতিশীলের দ্বিজাতিতত্ত্ব। এ কথা বোধ করি দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তারাও ভাবতে পারেনি যে, একদিন একে সার্বজনীন করে তুলবে সুবিধাবাদীরা। কথাটি পরিস্কার করে বলার আগে সুবিধাবাদীদের বক্তব্যগুলো পরিস্কার করে নেয়া দরকার। বাঙলাদেশের প্রতিটি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের পর একটি পক্ষ পাওয়া যায়, যারা সমস্যার শুরু করেন সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির আঁতুরঘর থেকে। মানে সে বড্ডো দূরের পথ। অতো পথ পাড়ি দিয়ে সমাধান নিয়ে তাদের আর বাঙলাদেশে ফেরা হয় না। গত কয়েকদিনের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের পর দেখলাম তারা পাশ্চাত্যের ইসলামফোবিয়া থেকে শুরু করে ভারততত্ত্ব, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্ব ইত্যাদি নানা কিছু আওড়ালেন।
আরে ভাই, সমস্যাটা স্থানীয়— সত্যিই স্থানীয় এবং জাতীয় রাজনীতির দুর্বলতা। সমস্যাটা মুসলিম হিশেবে এক ব্যক্তির আগ্রাসী মনোভাবের, যার প্রভাব গিয়ে পড়ছে তার বাড়ির পাশের পূজামণ্ডপে। সমস্যাটা একটি সম্প্রদায়ের, যারা নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাবে এবং অন্যদের মনে করে সংখ্যালঘু। সমস্যা হলো পাশের বাড়ির মুখার্জিদের পুরোনো বাড়িটা জমিসমেত জলের দামে কিনে নিতে পারলে বা দখল করতে পারলে সেটা ডেভলাপারের কাছে বেচা যাবে। সমস্যা হলো ভূমি অফিসে ঘুষ দিয়ে দেবোত্তর সম্পত্তির সিএস আরএস পর্চার নম্বর নাম ইত্যাদি বদলে ফেলা যায়। এবং এই সবকিছু হয় আমাদেরই নীতিহীনতা, রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতা আর প্রশাসনের উদাসীনতার জন্য।
আমি মনে করি না বাংলাদেশের প্রশাসন এতো ঠুনকো, ক্ষয়িষ্ণু আর দুর্বল যে, তারা এই ঘটনা মোকাবেলা করতে পারে না। কেনো করে না— সে প্রশ্নের উত্তর আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি অনুমানের ওপর ভর করেই উত্তর দিবো— কারণ আমি প্রশাসনের কেউ নই। তবে এই কথাটি পরিস্কার যে, বাঙলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থা মুখে যতো কথাই বলুক অন্তরে তা বিশ্বাস করে না। করলে সরস্বতী পূজার দিন নির্বাচনের তারিখ পড়ে কীভাবে? পুজোর সময় চাকুরির তারিখ পরে কীভাবে? কীভাবে একটি কাগজে-কলমে হলেও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ইদের ছুটি হয় তিনদিন আর পুজোর ছুটি একদিন। প্রশাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সৎ হলে এই সমস্যা মোকাবেলা করতে তিনঘণ্টাও লাগার কথা নয়। তার মানে প্রশাসন সৎ নয়, তার মানে প্রশাসন বা রাষ্ট্রব্যবস্থা নিজেদের বর্গা দিয়ে রেখেছে মৌলবাদী ইতরদের কাছে।
আজ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসগুলোর ঠিকঠাক বিচার হয়নি— এ দায় রাষ্ট্রের ও বিচারব্যবস্থার। আজ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে আক্রান্ত এলাকায় আমাদের একদিনের বেশি কোনো সফর হয় না, ঘটনার পর আমরা নামকাওয়াস্তে একটা দর্শন দিয়ে চলে আসি। কিছু তদন্ত-ফদন্ত করি, যেগুলোর মুখ কেউ দেখেও না, দেখলে মানেও না। অতএব সমস্যাটা আমাদের, আমাদের দুর্বলতার এবং ভীরুতার। তাতে বহির্বিশ্বের কিছুই করার নেই। আমাদের সমস্যাটা আমাদেরই সমাধান করতে হবে।
একুশ শতকের ডিজিটাল দ্বিজাতিতত্ত্ব
প্রযুক্তির নানাবিধ ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাবের কথা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করা যায়— কিন্তু বাঙালি মুসলিম মানসিকতার প্রেক্ষাপটে আমার মনে হয় প্রযুক্তি তার পরিচয় সংকটকে প্রকট করে তুলেছে। চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের বাঙালি মুসলিম মনীষা পাশ্চাত্যের জ্ঞান আহরণ করতেন বই পড়ে, আর এখনকার বাঙালি মুসলিম— যে না মেধাবী, না মাধবী— সে তথ্য আহরণ করে ফেসবুক দেখে, তারও আবার অর্ধেকই গুজব। সে খুরমা-খেজুর খাইয়ে মোনাজাত ধরে বিয়ে করে কিন্তু বিয়ের পোষাক নির্বাচনের সময় চোখ থাকে বলিউডে। ওয়েডিং ফটোগ্রাফির তরিকা নকল করে ইউটিউব দেখে। তার হলুদের গানে থাকে হিন্দি, পায়েশের ওপর ডালিমের দানা দিয়ে লেখা থাকে ‘আল্লাহু’, মেকাপে প্রাধান্য পায় প্রিয়াংকা চোপড়া, নিমন্ত্রণপত্রের ভাষা থাকে ইংরেজি কিন্তু অনুষ্ঠানের নাম হয়ে যায় ‘নিকাহ’ আর হানিমুন প্ল্যানে থাকে ইউরোপ বা নিদেনপক্ষে থাইল্যান্ড। এ এক বিচিত্র বাঙালি ডিজিটাল মুসলিম মানস! তার রোযা হয়ে গেছে ‘রামাদান’, সেহেরী হয়ে গেছে ‘সাহারী’, স্লামালাইকুম বলার বদলে সে কৃত্রিমভাবে টেনে টেনে বলে ‘আসসালামুআলাইকুম’— যেনো বানান করে পড়ছে রোমিও এন্ড জুলিয়েট। এখন আপনি হয়তো বলবেন, শুদ্ধ করে উচ্চারণ করবে না? শুদ্ধ উচ্চারণে তো আপনি পাঁচমিনিট বাঙলাতেই কথা বলতে পারেন না, আর এটা তো আরবি-ফার্সির বিষয়।
অধিকাংশ মুসলমানের ‘ভালো আছি’, ‘সুন্দর’ ইত্যাদি কথাগুলো ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘মাশাল্লায়’ রূপান্তরিত হয়ে গেছে। কিন্তু কী আশ্চর্য, একবারও তারা ভাবে না, একজন আরবি না জানা বা ইসলাম ধর্মের অনুসারী নন এমন ব্যক্তি এই কথার কী অর্থ বুঝবেন?
আমি জানি, সকলেই জবাব দিবেন, কেনো বাঙলাদেশে থাকতে থাকতে তাদের তো এগুলো শিখে যাওয়া উচিত। এখন আমার প্রশ্ন হলো— আমেরিকায় থাকতে থাকতে আপনি কি পোর্ক স্ট্যাক খাওয়া শিখে যান? আল্লাহ বাদ দিয়ে জিসাস ক্রাইস্টের কাছে প্রার্থনা করতে শিখে যান?
এখনকার বাঙালি মুসলিম মানসিকতা দেখলে আমার মনে হয়— এরা ‘মোর মর্ডান, মোর মুসলিম’ সিনড্রোমে আক্রান্ত। ডিজিটাল দুনিয়া তাকে ভোগবিলাসে গা ভাসিয়ে চলার তরিকা শেখায় আবার ডিজিটাল মাধ্যমেই সাম্প্রদায়িক আজাহারী তাকে বিভ্রান্ত মুমিন হতে শেখায়। ফলে তার দুই পা এখন দুই নৌকায়। সে টাকনুর উপর প্যান্টও পরে আবার ইয়াবাও খায়। ওয়াজও শুনে আবার পর্নোগ্রাফিও দেখে। আধ-খেঁচড়া আর ভুল উচ্চারণে ইংরেজিও বলে আবার সঙ্গে আরবিও লাগায়। সিনেমা করে পয়সা কামিয়ে মাঝবয়সে এরা সিনেমারই বদনাম করে। পয়লা বৈশাখের ভাতাও খায় আবার ফেসবুকে ‘বাঙলা নববর্ষ হারাম’ বলে স্ট্যাটাসও লেখে। মানসিকভাবে বিকৃত এমন এক সম্প্রদায়কেই কাজে লাগায় এই দেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি।
আমি জানি না, প্রতিদিনের এই দ্বিজাতিতত্ত্বের শেষ কোথায়। সর্বাঙ্গে ব্যথা হলে অসুধ কোথায় লাগাতে হয়— আমার জানা নেই। আমার রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চরিত্র মানে তো আমারই সাম্প্রদায়িক চরিত্র। যতোই তত্ত্ব আওড়াই, এ কথা তো অস্বীকার করা যাবে না। বাঙলার কোনো মানুষ যদি তাঁর আত্মজীবনীতে লেখেন— “আমার এই দেশেতে জন্ম— যেখানে জন্মোৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল মেপে, যেনো পাশের মুসলিম বাড়ির কানে না যায়; যেনো এই দেশেতেই মরি— যেখানে হরিবোলও দিতে হয় ঘাড় নিচু করে প্রায় নিঃশব্দে”— তাহলে এই দেশের নাগরিক হিশেবে ব্যর্থতার দায় আমারও— কোনো প্রজন্মই আমাকে ক্ষমা করবে না।