বাংলার মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস পাঠে আমরা যতটা নিবিড় হই, ততই আবিষ্কার করি— কী অসামান্যতায় তা বিস্তৃত হয়েছিল পৃথিবীর মানবিক ইতিহাসের মানচিত্রে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর জেনোসাইডের বিরুদ্ধে অপারেশন জ্যাকপট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর সমুদ্রবন্দরে পাকিস্তানি জাহাজ অবরোধ, বাংলার মানুষের জন্য বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের বীরত্ব থেকে ফরাসি নাগরিক জ্যঁ ক্যুয়ের ভালোবাসা কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে ম্যাডিসন স্কয়ার— বাংলার মুক্তিসংগ্রামের আলোকোজ্জ্বল ইতিহাস ব্যাপ্ত। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সে ব্যাপ্তিকে আমরা কতখানি ধারণ করতে পেরেছি? কতটুকুই বা ছড়িয়ে দিতে পেরেছি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে?
এ প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হয়েছে গত প্রায় দেড় বছর ধরে চলমান মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উদযাপনকে কেন্দ্র করে। পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশকে ঘিরে আমাদের স্বপ্ন-প্রত্যাশা-প্রাপ্তির সমীকরণগুলো যেমন নানামাত্রায় তলিয়ে দেখা হয়েছে, রচিত হয়েছে নানা গ্রন্থ, নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র, সংগীত ও নাটক; তেমনিভাবে প্রায় প্রতিটি আয়োজনকে ঘিরেই কিছু সমালোচনা, কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। এ তো গেল, একদিকের চিত্র। মুক্তিযুদ্ধে যারা বিরোধিতা করেছিল, যারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দর্শনের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি দর্শনকে আজও মনে-মগজে লালন করে, তাদের ষড়যন্ত্র তো পুরো সময়টা জুড়েই অব্যাহত ছিল।
এ প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হয়েছে গত প্রায় দেড় বছর ধরে চলমান মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উদযাপনকে কেন্দ্র করে। পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশকে ঘিরে আমাদের স্বপ্ন-প্রত্যাশা-প্রাপ্তির সমীকরণগুলো যেমন নানামাত্রায় তলিয়ে দেখা হয়েছে, রচিত হয়েছে নানা গ্রন্থ, নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র, সংগীত ও নাটক; তেমনিভাবে প্রায় প্রতিটি আয়োজনকে ঘিরেই কিছু সমালোচনা, কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। এ তো গেল, একদিকের চিত্র। মুক্তিযুদ্ধে যারা বিরোধিতা করেছিল, যারা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দর্শনের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানি দর্শনকে আজও মনে-মগজে লালন করে, তাদের ষড়যন্ত্র তো পুরো সময়টা জুড়েই অব্যাহত ছিল।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসবাদী দল হেফাজতে ইসলামের অপতৎপরতা এবং গত মার্চ মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে ঘিরে তাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ— এগুলোর সবই ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসবকে ম্লান করে দেবার পূর্ব-পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। ২০২০-২১ সাল ছিল নিঃসন্দেহে বাংলার মানুষের জন্য একটি মাহেন্দ্রক্ষণ। নাগরিক হিসেবে এ আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, আমরা জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদযাপনের মুহূর্তে সেটা প্রত্যক্ষ করতে পেরেছি। সামনে বাংলাদেশে হয়তো আরও সুন্দর সময় আসবে, কিন্তু সুবর্ণ জয়ন্তীর মুহূর্ত আর ফিরে আসবে না। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হয়তো আরও গবেষণা, চলচ্চিত্র বা নানা সৃষ্টিশীল কাজ হবে; কিন্তু তার জন্মশতবর্ষের এই হীরণ্ময় মুহূর্তটি আর ফিরে আসবে না।
বাংলাদেশের শতবর্ষ বা বঙ্গবন্ধুর জন্মের সার্ধশত বা দ্বিশতবর্ষ উদযাপিত হবে ভবিষ্যত প্রজন্মের নেতৃত্বে। সে সময়ের আলোতে স্নান করার অলৌকিক সৌভাগ্য আমাদের প্রজন্মের আর হবে না। তাছাড়া এটিও তো আমাদের জন্য গৌরবের— আমরা এমন একটি সময়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন করেছি, যখন তার অনেক সহযোদ্ধাই জীবিত, তাদের স্মৃতিচারণ আমাদের এখনও সমৃদ্ধ করে। মুক্তিসংগ্রামের সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা আজও জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে তাদের প্রবাদপ্রতিম সংগ্রামের ইতিহাস প্রত্যক্ষ শুনতে পাই। শহিদ পরিবারের প্রথম প্রজন্মের কাছে শুনতে পাই তাঁদের ত্যাগ আর গৌরবের ইতিহাস।
সুতরাং এ মুহূর্তগুলো আর ফিরে আসবে না, এটা নিশ্চিত। কিন্তু এ ফিরে না-আসা মুহূর্তগুলোকে আমরা কতখানি তুলে রাখতে পারলাম আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে? আমাদের অগ্রজগণ ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষের উদযাপনকে বাংলার মুক্তিসংগ্রামের রঙে রঙিন করে তুলেছিলেন, তাকে নথিভুক্ত করেছিলেন আমাদের ইতিহাসের পাতায়। রক্তকরবীর নন্দিনীকে তারা সমাপতিত করেছিলেন বাংলার অগণিত স্বাধীনতা সংগ্রামী নারীর জীবনালেখ্যে। আজও ইতিহাসের সে বিস্ময়ে আমরা বিস্ময়াভিভূত।
এই মাহেন্দ্রক্ষণ উদযাপনের সময়টি নানামাত্রিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে সম্পন্ন করতে হয়েছে। একে তো বিশ্বব্যাপী কোভিড মহামারির তাণ্ডব, তার সঙ্গে বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের অপরাজনীতির তাণ্ডব, বিজয় দিবসের প্রাক্কালেই কূটনৈতিক নানা ষড়যন্ত্র এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে উদযাপন পর্ষদের দায়িত্বহীনতা। এই যে মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে ‘মুজিববর্ষ’ বানানটিই ভুলভাবে লেখা হলো— এটুকুও কি হবার কথা ছিল? একটি উদযাপনের ক্ষেত্রে এ তো একেবারেই প্রাথমিক একটি পদক্ষেপ। প্রশ্ন হতে পারে— ‘সামান্য’ এই বানান ভুলটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা কেনো? কারণ, এ উৎসব কেবল সরকারের নয়, কেবল উদযাপন পর্ষদের নয়; বরং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ উৎসব বাংলার আপামর জনসাধারণের। এ গৌরব বাংলার প্রতিটি মানুষের গৌরব বলেই এর ত্রুটি-বিচ্যুতিতে আমরা ব্যথিত হই। জবাব চাই— কারণ সে অধিকার বঙ্গবন্ধুই আমাদের দিয়ে গেছেন সংবিধানে— প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি জনযুদ্ধ বলেই এ যুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু একজন জনমানুষের নেতা। এ যুদ্ধ জনযুদ্ধ বলেই এর ইতিহাস কার্যত জন-ইতিহাস। যুগ যুগান্তরে এই জন-ইতিহাস-আশ্রিত বোধই হবে বাংলার মানুষের প্রকৃত সঞ্চারপথ। ফলে সে ইতিহাসবোধকে লালন করার দায়িত্ব আমাদেরও আছে। এ কথা আমরা কতটা মানি, জানি না; কিন্তু যারা আমাদের ইতিহাসের এই আলোকিত উদযাপনগুলোকে নস্যাৎ করতে চায়, তারা মানে। আর মানে বলেই তারা রাজনীতিতে বিভ্রান্তির চেয়ে জনমনস্তত্ত্বে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কৌশলকেই বারবার অবলম্বন করে। সে কারণেই এ বছরের মার্চ মাসে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী সংগঠন হেফাজতের সন্ত্রাসের খবরও এসেছে। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর আগেই আলোচনায় এসেছে মানবাধিকারের প্রশ্ন তুলে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ সাতজন রাষ্ট্রীয় কর্মচারীকে নিষিদ্ধ করা, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা কমবেশি সকলেই জানি।
ডিসেম্বরের ১০ তারিখ, যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসকে সামনে রেখে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন যাবত ১৯৭১ সালে সংঘটিত জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি করে আসছে, সেদিনই তারা এ ঘোষণাটি দিয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক এই সংস্থাগুলোর কাছে আজও অমীমাংসীত রয়ে গেছে ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে পাকিস্তানের বিচারের বিষয়টি; এখনও সুরাহা হয়নি পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের প্রাপ্য সম্পদের হিসাব-নিকাশ ও প্রাপ্তির নিশ্চয়তা।
সুতরাং আমাদের স্বাধীনতা যেমন সহজে আসেনি, তার উদযাপনও বোধ করি সহজ হবার নয়। ঠাট্টাচ্ছলে বা গুরু-গম্ভীর তাত্ত্বিক আলোচনাতেও অনেককেই বলতে শুনেছি, ‘১৯৭১ সালের কথা আর কত বলবেন?’ আমার মতো বোধ করি অনেকেরই এমন অভিজ্ঞতা আছে। এই যে ইতিহাসকে কতগুলো দিন-তারিখে বন্দি করে তার বৃহৎ পরিসরটিকে ছোটো করে দেখার প্রবণতা— এ তো আমাদের মাঝে একদিনে তৈরি হয়নি। ইতিহাসবোধকে লালন করার যে আত্মিক আকর, তাকে ধ্বংস করার মাধ্যমেই এই প্রবণতাগুলো তৈরি করা হয়েছে। ফলে দিনশেষে আমাদের সমস্ত সমালোচনার কেন্দ্র যত ছোটই হোক না কেন, আমাদেরই মুদ্রাদোষে তার পরিধি গোটা আয়োজনটিকেই গ্রাস করে ফেলে। ফলে মুজিববর্ষের যে আয়োজনটি জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত হলো, তার নানা সৌকর্য ঢাকা পড়ে গেল ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির ‘মুজিববর্ষ’ বানান ভুলের দায়িত্বহীনতায়।
কিন্তু তা কি হবার কথা ছিল? দেশের প্রথিতযশা শিল্পীবৃন্দের পরিবেশনা আমরা দেখেছি এই আয়োজনে। বিদেশি অতিথিদের বক্তব্য শুনেছি। শিশুশিল্পীদের পরিবেশনা দেখেছি। এত মানুষের মেধা-শ্রম আর সৃজনশীলতা একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বহীনতায় ফিকে হয়ে যেতে পারে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না। একই সঙ্গে আমি এটাও মনে করি না যে, এমন দায়িত্বহীন কাজটি যারা করলো, তারা কোনো প্রকার তদন্ত ও বিচার ছাড়াই পার পেয়ে যেতে পারে।
সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠন যার যার সাধ্যমতো বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছে। মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে প্রতিটি ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার বাংলাদেশে পঞ্চাশ বছর পর মুক্তিসংগ্রামের আদর্শের প্রতিটি ঘরেই ওড়েছে লাল-সবুজের বিজয় নিশান। এ উদযাপন আমার গৌরবের, এ উদযাপন ত্রিশ লক্ষাধিক শহিদের আত্মদানের প্রতি আমাদের আভূমিনত শ্রদ্ধাঞ্জলি। এই পবিত্র দৃশ্যকল্পের দিকে চোখ রেখেই এগিয়ে যেতে চাই স্বাধীন বাংলাদেশের শতবর্ষের দিকে, শতবর্ষের হীরকজয়ন্তীর দিকে।