আমার জন্ম আজিমপুর ম্যাটার্নিটিতে সুতরাং মৃত্যু যে ভেনিসে হবে না তা বলাই বাহুল্য। এক টুকরো নির্দোষ শৈশবের সুতোয় জীবনের ঘুড়ি আটকে রেখে জীবন পার করার এই বোকামি তাই আমাকে অন্তত মানায়। আমার বা বড়ো করে বললে আমাদের যখন শৈশব তখনও শহরের আকাশ জুড়ে সুউচ্চ দালানের মিছিলগুলো অতো বড়ো ছিলো না। টুকটাক দু একটা চোখে পড়তো; আমরা তলা গুণে এক থেকে বড়ো জোর পনেরো অব্দি প্র্যাকটিস করতাম। তখনও ঢাকা শহরটা আমাদের কাছে নিজেকে মেলে ধরেনি। শহর কেমন হয় এমন প্রশ্নও আমাদের মনে জাগেনি কখনও। আমাদের বাল্যশিক্ষার সম্পূর্ণ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় সতীনাথ বসাক। তাঁর আদর্শ লিপি ও সরল বর্ণ পরিচয় আমাদের মনের ঘরের প্রথম প্রেয়সী। আমাদের কোনো পাঠশালা ছিলো না, কোনো পণ্ডিতমশাই ছিলেন না। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিলো গলির মোড়ের কিন্ডারগার্টেন, সেখানে আমাদের শেখানো হয়েছিলো ‘গুড মর্নিং টিচার’ বলে শিক্ষককে স্বাগত জানাতে হয়। আমাদের মায়েরাও সুপ্রভাতকে ‘গুডমর্নিং’ বলতে শিখিয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষককে ‘সালাম’ দেয়া হচ্ছে না, এই অপরাধ মেনে নেবার মতো অতো স্মার্ট আমাদের মায়েরা ছিলেন না। অতএব আমাদের মায়েদের ভেতরে বিরাট এক দ্বন্দ্ব কাজ করতো নিঃসন্দেহে—তাঁরা ভেবে পেতেন না কোনটা শেখাবেন— ‘গুড মর্নিং’ না ‘আসসালামু আলাইকুম’। সম্ভবত মায়েদের এই দ্বান্দ্বিক চিন্তাধারাই পরবর্তীতে আমাদের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রতি আগ্রহী করে তোলে।
আমাদের শিশুশ্রেণি মোটেও শিশুসুলভ ছিলো না। আর এর যাবতীয় দায়ভার গিয়ে পড়তো এলাকার ভিডিও ক্যাসেটের দোকানের আকবর ভাইয়ের ওপর। বড়োদের ধারণা ছিলো ওই দোকানের বড়ো বড়ো সাউন্ড বক্সের গানগুলোই না কি আমাদের কাঁচা বয়সটাকে পাকিয়ে তুলেছিলো। অথচ আমরা তো জানি, কী নির্দোষই না ছিলো সে-ই গানগুলো। বরং ঝামেলা ছিলো আমাদের বড়োদের মাঝেই। গ্রাহামবেলের টেলিফোন যখন টেসিসের (টেলিফোন শিল্প সংস্থা) হাত ধরে আমাদের বাড়িতে এসে ঢুকলো, তখন আমাদের শেখানো হলো টেলিফোনে কথা বলার কার্টেসি। অপরিচিত কোনো ভদ্রমহিলাকে হয় ‘মিস’ না হলে ‘মিসেস’ সম্বোধন করতে হবে এবং অপরিচিত ভদ্রলোকের বেলায় ‘মিস্টার’। আমাদের মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডেই ছিলো বিখ্যাত অভিনেতা শওকত আকবরের পাঁচতলা বাড়ি। তার দোতলার বাসিন্দা আমারই শিশুশ্রেণির এক সহপাঠী ‘মিস’ আর ‘মিসেসের’ গোঁমড়টা ফাঁস করেছিলো। বিবাহভেদে নারীর সম্বোধন বদলে যায়, পুরুষের নয়। আমরা সেদিনই সুস্পষ্ট বুঝেছিলাম কী অপরিবর্তনীয় এক ধ্যাড়ধ্যাড়া ভাগ্য নিয়ে পুরুষ হিশেবে আমরা জন্মেছিলাম। অ্যাডভেঞ্চার সব ওই নারীদের দখলে।
এখন ক্লাশে যেহেতু শেখানো হয়েছে গুড মর্নিং মিস, তাহলে আমাদের শিক্ষকরা সকলেই অবিবাহিত। এই যুক্তিতে কোনো এক ক্লাশে আমি একবার তিন সন্তানের জননী এক ম্যাডামকে প্রশ্ন করে বসলাম—আপনি কবে বিয়ে করবেন মিস? কাঁচা বয়সের প্রেম আর কাঁচা মাথার প্রশ্ন—কারোই সহ্য হয় না। অতএব আমার শিশুশ্রেণির যবনিকা পতন ঘটলো। আমার মা রুটি বেলার বেলন বা ডালঘুটনির বহুমুখী ব্যবহার জানতেন; কেবল জানতেন না যে, মহাপুরুষদের শিশুশ্রেণি কখনও সমাপ্ত হয় না।
কলে জল আটকে গেলে লোকে প্লাম্বারকে ডাকেন, আর মধ্যবিত্ত পরিবারে শিশুশ্রেণিতেই ছেলেপেলে আটকে গেলে মায়েরা মামা-চাচাদের ডাকেন। এটাও মধ্যবিত্তি রীতি। আমাদের কালে বাচ্চার প্রাইভেসি নিয়ে মায়েরা ম্যাগাজিনে কলাম পড়তেন না। সুতরাং আলোচনা সাপেক্ষে সাব্যস্ত হলো পাড়াটা সুবিধের নয়। ছেলে বেয়াড়া বনে যাচ্ছে। কিন্তু চাইলেই তো আর পাড়া বদলানো যায় না, বাড়ি বদলও চারট্টিখানি কথা নয়, অতএব ফ্ল্যাট বদলানো হলো। বাড়ি ঠিক থাকলো, তলাও ঠিক থাকলো, কেবল দু কামরার ফ্ল্যাট ছেড়ে পাশের তিন কামরার ফ্ল্যাটে উঠলাম আমরা। উদ্দেশ্য শিশুশ্রেণিতে আটকে যাওয়া শিশুর উন্নত পড়াশুনার বন্দোবস্ত।
উন্নতি সত্যিই হয়েছিলো। লেখাপড়াতে নয়—সঙ্গীতে। পাঠক, আপনারা যাঁরা খবরের কাগজ বা টেলিভিশনের তারকালাপ মারফৎ সফল সঙ্গীত শিল্পীদের সাধনা সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করেন, তাঁরা আসলে সঙ্গীত সাধনার আরেকটি জগৎ সম্বন্ধে খোঁজই রাখেন না। অথচ একটু ভেবে দেখবেন, আপনারা নিজেরাও এই সাধনার ভেতর দিয়ে গিয়েছেন। আফসোস! সে-ই সাধনায় যাঁরা আমাদের সংগীতগুরু ছিলেন, তাঁদের ওপর ইতিহাসের স্পট লাইট কোনোদিন এসে পড়লো না। হতাশার কথা থাক, কেননা আমাদের শৈশবে ডিপ্রেশন থাকতো ডিপফ্রিজে। আমাদের সময় ছিলো না সেটা বের করে গায়ে মাখবার। তখনও পরিবেশ দূষণ বিষয়ক সেমিনারে এখনকার মতো অতো বরাদ্দ জারি হয়নি। সুতরাং পরিবেশ দূষণের কথা তখন শুনতে পেতাম কম। আর শব্দ-দূষণ বলে যে একটা ব্যাপার আছে, সে তো জেনেছি হাই স্কুলে উঠে। এখনকার মতো ফ্ল্যাট কালচার ছিলো না। গোটা পাড়ায় দু চারটে বাড়ি থাকতো, সেখানকার উঠতি বয়সের তরুণ তাঁর নতুন কেনা ঢাউস সাউন্ড বক্সে সারা পাড়াকে গান শোনানোর দায়িত্বটা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। তাঁরা অনেক উদার এবং মেজাজি ছিলেন। যখন তখন রাস্তাঘাটে গান শোনার মতো বেরসিক যেহেতু তাঁরা ছিলেন না, সেহেতু হেডফোন কানে গুঁজে গান শোনার মতো ছোটোলোকি তাঁরা করতেন না। আমাদের পাড়াতেও ছিলেন হারুন ভাই। ঘাড় অব্দি লম্বা চুল। চাপা জিন্স পরে গলির মুখে আকবর ভাইয়ের ভিডিও ক্যাসেটের দোকানের সামনে বসে থাকতেন। এলাকার মুরুব্বিরা বলতেন—“হারুণ তো ভালো ছেলে.. .. কিন্তু.. ..”। ওই ‘কিন্তু’ পর্যন্তই আমাদের শৈশবে বখাটের সংজ্ঞা। আমরা বখাটেপনা মানে বুঝতাম শিস দেয়া আর লম্বা চুল রাখা। আর গোল্লায় যাওয়া বলতে সিগারেট ধরা। আমাদের যুগে ওই শিস দেয়া, লম্বা চুল রেখে সিগারেটে টান দেয়া হারুন ভাইদের প্রেমিক হতে দেখেছি। এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে অনেক পিএইচডিওয়ালারা দেদারসে যৌন নিপীড়ক হয়ে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গ থাক। তো কথায় আছে না, রাজা-বাদশাহরা হাত ঝাড়লেই পর্বত; তেমনি আমাদের হারুন ভাই গান ছাড়লেই স্বর্গ। দিবসের একেক সময়ে একেক ধরনের গান। অনেকটা রাগ সঙ্গীতের মতো। এই ব্যাপারটা এখনও আছে—একেক সময়ের জন্য একেক প্লে-লিস্ট। সকালের দিকে, মানে লোকে যখন অফিসে চলে যেতো, কী হতো কে জানে, হারুন ভাই শুনতেন বেশ কড়া বিটের ইংরেজি গান। কথা বুঝতে পারতাম না, তবে শুনতে শুনতেই জেনে গেছি ওটা মাইকেল জ্যাকসন। উনি গান ছেড়ে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেন। উনার বারান্দাটা ছিলো আমার জানালার পাশেই। মাঝে মাঝে বারান্দা থেকে কথা হতো। কোনো কোনো সকালে তিনি একটানা শুনে যেতেন জর্জ ব্যানসন— Hold me now/touch me now/I don’t want to live without you. কোনো কোনোদিন জর্জ মাইক্যালের Last Christmas আর Careless Whisper. জর্জ মাইক্যালের গান তিনি অনেক শুনতেন। তাঁর ঘরে একটি ছবিও টাঙানো ছিলো জর্জ মাইক্যালের। নিজের চুলগুলোও ছিলো সে রকমই। আমার বিটলস শোনার কানেখড়ি ছিলেন হারুন ভাই। বেলা খানিকটা বাড়লে, তিনি লাইনল রিচি আর ক্যানি রগার্স শুনতেন।
যখন দুপুর নেমে আসতো আমাদের পাড়ায় কোনো বাড়ির ছাদে মেলে দেয়া শাড়ির আঁচল ধরে, তখন আমি চলতে চলতে থেমে গেছি আর তুমি নির্জন উপকূলে নায়িকার মতো— পিন্টু ভট্টাচার্যের এ দুটো গান কেমন অলস সুরে ভেসে আসতো প্রায় দিনই। এরকম কতো গান তিনি বাজিয়ে যেতেন দুপুরবেলা। সুবীর নন্দী, সৈয়দ আবদুল হাদী, মাহমুদুন নবী আর গীতা দত্তের গাওয়া বাঙলা গানগুলো একের পর এক শুনতেন তিনি, শুনতাম আমরাও। জানি না, এই চার ভাই চম্পার ক্যামিস্ট্রিটা কী ছিলো। বিকেলে, যখন আমাদের বাড়ির অন্যান্য বাসিন্দাদের সঙ্গে আমরাও ছাদে যেতাম, তখন আমাদের ভাড়া বাড়ির অন্যান্য ফ্ল্যাটের বড়ো আপুদের জন্যই কি না জানি না, তিনি শুনতেন ব্যান্ডের গান। তখন এলআরবি’র ফেরারী এ মনটা আমার গানটি নতুন এবং তুমুল জনপ্রিয়। আমাদের বাড়ির সে-ই আপুদের একজন, ইতি আপু, আমাকে দিয়ে বারবার গানটি বাজানোর কথা বলাতেন। পরবর্তীতে আমি ইতি আপু এবং হারুন ভাইয়ের ডাকপিয়ন হিশেবেও কাজ করেছি। গানপিয়ন থেকে ডাকপিয়নের চাকুরিটা আমার জন্য লাভজনক ছিলো। প্রতি তিনটা চিঠিতে একটা মিমি চকলেট জুটতো। আজকের দিনে যারা কিন্ডার জয়ে মেতে থাকে, তারা কোনোদিন জানবে না সে-ই কমলালেবুর ছবিওয়ালা কালো রঙের প্যাকেটটায় কী অসামান্যতা লুকিয়ে থাকতো।
সন্ধ্যায় কিছু বাজতো না। তবে এই সময়টাতে পাড়ার আকবর ভাইয়ের দোকান আমাদের পুষিয়ে দিতো। তখনকার মানুষদের রুচিই ছিলো আলাদা। সাজন ছবির গান চলতে চলতে হঠাৎ এক পেয়ার কা নাগমা হ্যায়। রাস্তার উল্টোপাশের পানের দোকানটার টেপ রেকর্ডারটা তখন বন্ধ থাকতো। সন্ধ্যার কিছু পর সেখানে বাজতো পেয়ার হুয়া ইকরার হুয়া, ছোটি সে কাহানিসে, ইয়ে রাত ভিগি ভিগি সহ আরও কতো কতো পুরোনো হিন্দি গান। আর বাঙলা ছবির গানগুলো চলতো গলির আরেক মাথায় লন্ড্রির দোকানে। সেখানে পুরোনো গান বেশি শোনা যেতো না, তবে নতুন সিনেমার গানগুলো একেবারে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো। সালমান শাহের ছবি তখনও দেখিনি কিন্তু গান মুখস্থ করে বসে আসি। ওই শুনে শুনে। বিটিভির কল্যাণে তখন জাফর ইকবাল ববিতার সিনেমার গানগুলো আমাদের এমনিতেই মুখস্থ ছিলো। কিন্তু নতুন ছবি তো টিভিতে দেখাতো না। হলে গিয়ে ছবি দেখার মুরোদ তখনও হয়নি। তাই লন্ড্রির দোকানই ভরসা।
রাতের বেলা হারুন ভাই সঙ্গত কারণেই ভলিউম কমিয়ে গান শুনতেন। আমার তখন পড়ার সময়। যেহেতু সকল কাজের ফলাফল তার নিয়তের ওপর নির্ভর করে, সেহেতু আমার গানটা ভালো শোনা হতো। তপন চৌধুরী আর শুভ্র দেব— এ দুইজনের গান খুব শোনা হতো তখন। সঙ্গীতশিল্পী শুভ্র দেবের গান আমার মামারাও খুব শুনতেন। ‘নীলাঞ্জনা’-কে আমরা নচিকেতা দিয়ে চিনিনি, চিনেছিলাম শেখ ইশতিয়াকের কণ্ঠে। এই গানটাও রাতে খুব শুনতেন। আরেকটা গান আমি সাগরের নীল নয়নে মেখেছি কতোবার যে শুনেছি গানটি। তখন আবু হেনা মোস্তফা কামালকেও চিনতাম না, আব্দুল আহাদের সুরের মহিমাও জানতাম না, ফেরদৌসী রহমানের মতো অতো গুণী শিল্পীও ছিলেন আমাদের অধরা। আমরা কেবল জানতাম সাগরের নীল কখনও কখনও নয়নে মেখে মধু প্রহরে চলে যাওয়া যায়। এরকম কতো কতো গান, সব লিখে শেষও করা যাবে না। আমাদের সে সময়ের নষ্ট না হওয়া মস্তিষ্ক অনায়াসে সুরটা তুলে নিতো, গানের কথাগুলো মুখস্থ হয়ে যেতো।
দুই
আজ এতো বছর পর সে-ই শৈশবে শোনা গানগুলোর কথা লিখতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছে আমাদের পাশের বাড়িগুলোও কতো বড়ো শিক্ষক ছিলো। এখন আমাদের গান হয়তো আমরা নিজেরা শুনলেই লজ্জা পাই, সুর-তাল-লয় কিচ্ছু নেই আমাদের। কিন্তু সঙ্গীত তো কেবল শোনার জন্যেই নয়, যদি হতো তাহলে বেটোফেনের জন্ম হতো না। সঙ্গীত তো কানের কাছে ধরে রাখা সকল দুখের প্রদীপ, যার আলো হৃদয়ের বারান্দায় মুনলাইট সোনাটা হয়ে আছড়ে পড়ে। আমরা তো গান গাইতে শিখিনি, কিন্তু শুনতে শিখেছি।
আজকের আইটিউনস আর গুগল মিউজিকের যুগে আমরা টরেন্ট থেকে বিষণ্নতা নামাই। সে-ও কপিরাইট আইনের প্যাঁচে পড়ে নিষিদ্ধ। আমাদের অনুভূতির মালিকানা চলে গেছে আইপি ঠিকানার অঙ্কগুলোতে। আজ আর আমাদের নিজেদের পাড়া বলে কিছু নেই, একটা এঁদো গলিতে শৈশবের কতোটা লুকিয়ে থাকে ট্যাব আর মোবাইলসর্বস্ব শিশুরা তার কী-ই বা জানবে। আমাদের অভিধানে এখন ‘আমাদের’ শব্দটি নেই। কেবল ‘আমার’। হেডফোনের তরঙ্গে দেবব্রত যতোটা কাঁদেন আমি তার মাপে হৃদয় বিছিয়ে দিতে পারি না। আজকের শিশুদের অতো বড়ো জানালা নেই, মাইক্রোসফটের জানালাতেই তাকে জীবন বাজি রাখতে হয়। ইদে কিংবা পুজোয়, বাঙলা বা ইংরেজি নববর্ষে কিংবা কোনো উৎসব ছাড়াই একান্ত আপন মনে যদি বা কারও বাড়িতে বাজানো কোনো গানের সুর আমাদের কানে আসে— আমরা বিরক্ত হই। আজকে যারা শৈশবের কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে আছে, তাদের কানে মাহমুদুন নবীকে পৌঁছে দেবে কে? কার বাড়ি থেকে মান্না দে বা সতীনাথের নাথের গান ভেসে এসে কারও শৈশবে বুনে দেবে মিহিন আদর। কে আছে, যার সাউন্ড বক্স উপচে উঠবে তুমি আমার প্রথম সকাল, একাকী বিকেল, ক্লান্ত দুপুরবেলার সুরে আর তা ভেসে যাবে পাশের বাড়িতে, মিটে যাবে বহুদিনের পুরোনো কোনো মান-অভিমান। আমাদের হোম থিয়েটারে কোনো থিয়েটার নেই, হোমটুকু বন্দী করা গেছে সাউন্ড প্রুফ দেয়ালে।
আজকের যে শিশু একটু একটু করে বড়ো হচ্ছে, তার হয়তো গান শেখানোর মাস্টারমশাই আছেন, কিন্তু গান শোনানোর সে-ই অনার্য সঙ্গীতগুরুরা নেই। আমাদের আকাশের মতো শৈশবটা আজ উইন্ডোস্ক্রীনে এসে ঠেকেছে। কিন্তু যাদের ছোটোবেলাটাই শুরু হয়েছে উইন্ডোস্ক্রীনে, ন্যানো টেকনোলজির কোন অধ্যায়ে তাদের বড়োবেলাটা মিশে থাকবে?
আমরা আর্য সমাজের সঙ্গীতশিল্পী হতে পারিনি সত্যি, কিন্তু এই যে এখনকার পপকর্ণসর্বস্ব সঙ্গীত শুনে আমাদের বিষ্ময় জাগে না তার কারণ শৈশবে আমাদের অনার্য সঙ্গীতগুরুদের দীক্ষা। তাঁরাই তো আমাদের শিখিয়েছেন— ‘কাকে বলে গান আর কাকে সোনা তেল আর কাগজের খনি’। তাঁদের ঋণ তো কোনোদিন শোধ হবে না, তবুও তাঁদেরই নিবেদনে এই সামান্য গুরুদক্ষিণা।