কী এক অলৌকিক সমাপতন!
১৯৬৭- এর যে হেমন্তের দিনে আজাদ আবুল কালাম জন্ম নিচ্ছেন স্বাধীনতা সংগ্রামমুখর বাঙলাদেশে, প্রায় তখনই গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস তাঁর যাদু-বাস্তবতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন মাসন্দো শহরের বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাত প্রজন্মের মধ্যে। আজাদ আবুল কালাম তাহলে নিঃসঙ্গতার একশ বছরের সমবয়ষ্ক! আর তাই হয়তো হোসে আর্কেদিয়া ও উরসুলা বুয়েন্দিয়ার নতুন গন্তব্যে যাত্রা বৃত্তান্তের মতোই আজাদ আবুল কালামের জীবনবৃত্তান্তেও স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ যুগপৎ হেসে খেলে যাপিত জীবনকে ছলনা করে যায়।
এইটুকু ভূমিকা পর্বের পর— আমরা, যাদের সর্বনামে চন্দ্রবিন্দু লাগে না, শিল্পী আজাদ আবুল কালামকে মধুসূদনের সঙ্গে ভাগ্য বিনিময়ের প্রস্তাব করতে পারি। তাকে আহবান জানাতে পারি আমাদের হৃদয় ও মস্তিষ্কের ক্ষতচিহ্নগুলো নথিভুক্ত করতে এবং তাকে নিশ্চিত করতে পারি এই বলে যে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ ও ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও সঞ্জীব চৌধুরীকেও আমরা একই রকম দায়িত্বে আবিষ্কার করেছি। কিন্তু এই আহবান প্রশ্নাতীত নয়; যেহেতু প্রকৃত প্রস্তাবে এখনও হৃদয়ই শ্রেণিহীনতার সবচেয়ে বড়ো ইশতেহার, সেহেতু শিল্পী আজাদ আবুল কালামকে ঘিরে আমাদের প্রতিপক্ষ সুনিশ্চিত এবং এটি আশাব্যঞ্জক। অতএব তাঁরা— যাঁরা অদ্যাবধি বিশ্বাস রেখে চলেছেন পুতুলের কুচকাওয়াজে, বিজ্ঞাপনের অবিনশ্বর হোর্ডিং যাঁদের রুটিরুজি, যাঁদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে মডেল অপ্সরা এবং ব্যাবসা সফল বিজ্ঞাপনী মঞ্চ, শিল্প যাঁদের কাছে মাংসের স্থাপত্য— নিশ্চিত উদ্ধার করবেন তাকে এই শিল্পিত আত্মহননের পথ থেকে। তাঁরা লাল গালিচা বিছিয়ে আজাদ আবুল কালামকে নিয়ে আসবেন গ্যালারিতে। আলো জ্বলে উঠবে। পর্দা উঠবে শিল্পীর পঞ্চাশ বছরের জীবনের। রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার জীবনরহিত ঢঙে মুখরিত হবে দশদিক। শংসাপত্র রচিত হবে তাকে নিয়ে। জীবিকার দলিলে দস্তখত করা গণমাধ্যমকর্মীরা একটু জীবন ফিরে পেতে পারেন। একটা লাইভ স্ট্রিমিং হতে পারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, যেহেতু দাস ক্যাপিটালের মতো এটিও সত্য। এই সামগ্রিক উদযাপনের মধ্যমণি হয়ে থাকবেন শিল্পী আজাদ আবুল কালাম মুঠোভর্তি জীনতত্ত্ব নিয়ে।
এখন আমরা যেহেতু জেনে গেছি শিল্পের সমস্ত তাত্ত্বিক সংজ্ঞায়ন আসলে শুভঙ্করের ফাঁকি এবং এটুকুও অর্জন করেছি যে— শিল্প মানে আর কিছু নয়, কেবল ও কেবলমাত্র সত্যি কথাটি বলা, সেহেতু শিল্পী আজাদ আবুল কালামকে ঘিরে এই কুয়াশার কার্নিভ্যাল আমাদের কাছে কেবলই দৃশ্যের মিছিল, কেবলই শ্রুতির স্লোগান। কেননা, আমরা সে-ই সভ্যতারই অংশীদার যে সভ্যতাকে অভ্যর্থনা জানাবে বলে মর্গে বেঁচে ছিলো অজস্র শ্রমিকের মৃতচক্ষু। এই নৈশ বিজ্ঞপ্তি আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন শিল্পী আজাদ আবুল কালাম এবং তিনিই প্রথম চোখে আঙুল দাদা হয়ে আমাদের দেখালেন যে— মর্গের ওপারেই মঞ্চ, লাশের ওপারেই মানুষ। দ্রোহের উপকরণ যোগাড় করতে না পারলে ইতিহাসের পুনর্বিন্যাস সম্ভব নয়। অতএব আমাদের ব্রতী হওযাই কর্তব্য। ব্রেখটের নাটক যেমন তুমুল ঠাট্টা করে যায় বাস্তবের বাস্তবতাকে, তেমনি দৃশ্যত সকল উদযাপনের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে আমরা একটি নৈরাজ্যবাদী পরিকল্পনায় অংশ নিতে পারি। গোটা উদযাপনে আমরা পাঠিয়ে দিতে পারি একবিংশ শতাব্দীর এক তরুণকে। মার খাওয়া, লাথি খাওয়া, বিভ্রান্ত হওয়া, নষ্ট হওয়া, গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেয়ে হতাশার ইথারে ভেসে যাওয়া, কম্পিউটারে মুখ গুঁজে থাকা, নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা সে-ই উজ্জ্বল চক্ষু তরুণ তবুও পুনর্বার বাঁচবে বলেই পেরিয়ে যেতে পারে সমস্ত করতালি এবং গিয়ে দাঁড়াতে পারে শিল্পী আজাদ আবুল কালামের সামনে। সকলের মতো তার হাতে ফুলের তোড়া নেই, আছে একবিংশ শতাব্দীর কোটি কোটি তরুণের চৈতন্যের পাণ্ডুলিপি। ব্যক্তি আজাদ আবুল কালাম থমকে যেতে পারেন, বিব্রতও হতে পারেন খানিকটা, যেহেতু তাকেও বাস করতে হয় সমাজ নামক ইউটোপিয়ান কনসেপ্টে; কিন্তু শিল্পী আজাদ আবুল কালাম নিশ্চিতভাবেই সে-ই তরুণের হাতে হাত রেখে মাড়িয়ে আসবেন উৎসব মঞ্চের সমস্ত আয়োজন। কেননা, দেবতা ও আমোদ-প্রমোদ অধিকর্তাদেরই কেবল ভক্তের প্রয়োজন থাকে, শিল্পীর নয়। শিল্পী স্বয়ম্ভূ এবং ভয়ঙ্কর নিশ্চিতভাবেই উদ্ধত। বস্তুত এ কারণেই শিল্পী মাত্র কয়েকজন, বাকিরা বিনোদনকর্মী।
এই তো! এই তো আলাপে বেজে উঠছে আমাদের দুর্জয় বেহালা। বাতানুকূল প্রেক্ষাগৃহের লাল সূর্যোদয় পেরিয়ে আসছেন শিল্পী আজাদ আবুল কালাম। খঞ্জ বর্তমান নিয়ে কোনো মতে বেঁচে থাকা একুশ শতকের এক হাবাগোবা তরুণের হাত ধরে ওই তো আসছেন শিল্পী আজাদ আবুল কালাম। ইতিহাসের লং শটে দাঁড়িয়ে আমরা উপলব্ধি করি, আজকের দিনে তিনিই ঋত্বিক ঘটকের সে-ই কাঙ্ক্ষিত নাগরিক— যিনি চৈতন্যবান, নিজস্ব স্বপ্ন ও যৌথ বিস্মরণকে জনতার মুখরিত সখ্যে প্রতিহত দেখতে চান। অতএব, আমাদের নৈরাজ্য সফল। জন্মদিনের শুভেচ্ছা হিশেবে আমরা শিল্পীর হাতে তুলে দিতে পারি আমাদের যাবতীয় বিক্ষুব্ধ পঙক্তিমালা। যাঁরা শিল্পী নন, কিন্তু শিল্প করে খান, তাঁরা আমাদের এই পরিকল্পনাকে ‘ষড়যন্ত্র’ বলে চালিয়ে দিতে পারেন এবং নিন্দার ভাষারও যেহেতু শ্রেণিকরণ সম্ভব, সেহেতু ‘ট্রটস্কি’ বলে দেয়াটাও দোষের কিছু নয়। কিন্তু এই নৈরাজ্য ততোটাই ষড়যন্ত্র, মায়াকোভস্কির পাৎলুনপরা মেঘ যতোটা সপ্রেম, স্তব্ধ রাতে তুমি কেনো বাইরে যাও — সমর সেন এই চরণে যতোটা রাজনৈতিক।
দুই
Look here upon this picture and on this: Have you eyes?— হ্যামলেটের এই প্রশ্ন বহুকাল আগেই আমরা রেখে এসেছি শিল্পী আজাদ আবুল কালামের কাছে। আমরা, আগেই বলেছি যাদের সর্বনামে চন্দ্রবিন্দু লাগে না; আমরা, যারা নিতান্ত মধ্যবিত্ত ঘরে মায়ের শাসন ডিঙিয়ে রাতের খাবার খাওয়ার সময়টুকু টেলিভিশনে নাটক দেখতাম; আমরা, যারা পথে-ঘাটে, শপিং মলে, শাহাবাগ বা টিএসসিতে অন্য অনেকের মতোই টেলিভিশনে দেখা ‘সেলিব্রেটিদের’ বাস্তবে দেখলে ফিসফাস করতাম। আমরা তারাই, যাদের মায়েরা হাত ধরে মঞ্চ নাটক দেখাতে নিয়ে যেতেন না, যাদের বাবারা মোনে করেন, সন্তানের সঙ্গে নাটক-সিনেমার গল্প করাটা এক ধরনের বখাট্য যুক্তি। আমরা মঞ্চ নাটক চিনেছি অনেক পরে— সুতরাং প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেবল আজাদ আবুল কালামের সঙ্গে এই অলিখিত সংলাপ আমাদের রচিত হলো কেনো? আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন, আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম। কেবল শিল্পী আজাদ আবুল কালামকেই নয়; একের পর এক ধুন্ধুমার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র করার পরও আমরা হুমায়ুন ফরীদিকে খুঁজে পেয়েছিলাম; আমাদের সময়ে পর্দায় প্রায় অনুপস্থিত খালেদ খানকে খুঁজে পেয়েছিলাম। এইটুকু বলার পর আমরা শিল্পের একটি সংজ্ঞায়ন করতে পারি। আমরা বুঝতে পারি, আজকাল বা অতীতেও—নিদেনপক্ষে আমাদের শৈশব-কৈশোর কাটানো নব্বই দশকেও শিল্পের নামে যা কিছু আইসক্রিমের মতো রূপসীদের ঠোঁটে মিলিয়ে যেতে দেখেছি, সে সব আসলে কুর্ণিশকরিয়েদের কারসাজি। আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, যিনি শিল্পী—তিনি আসলে অমান্য করবেন, কুর্ণিশ নয়। সুতরাং, আমাদের প্রাথমিক বোধগম্যতায় শিল্পের বামপন্থা অনুমোদিত হয়েছিলো। কিন্তু বিপ্লবীকেও সোনা রূপা ভালোবাসতে হয়। অতএব, শিল্প আমাদের মানসকাঠামোর নিখিলে আবির্ভূত হয় নিজস্ব পথে। এই সেই পথ, যে পথে হেঁটে নীলক্ষেত-পল্টন-বাঙলাবাজার ফুটপাথের হাজার হাজার বই থেকে শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের হাতছানি দেয়। এই একই পথে শিল্পী আজাদ আবুল কালামের সঙ্গে আমাদের কারও কারও কোনোদিন দেখা না হলেও একটি অলিখিত চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে শিল্পের দলিলে আদর্শের কলমে। শিল্প এবং মানুষ শেষ পর্যন্ত যুগপৎ পরষ্পরকে নিয়ে যায় নশ্বরতা থেকে অমরতায়। তাই শিল্পী আজাদ আবুল কালামের সঙ্গে আমাদের অভিসার অডিটরিয়ামের জাতীয় নাট্য-উৎসব থেকে রাজপথের মিছিল অব্দি সম্ভব। এই অধিকারবোধ থেকেই আমরা শিল্পী আজাদ আবুল কালামকে দায়িত্ব দিতে পারি তারুণ্যের চক্ষুদান পর্ব সমাপ্ত করতে। তাই তার কাছেই আমরা প্রশ্ন রাখতে চাই—কেমন আছে বাঙলাদেশ? আপনি বলুন, কেননা পেশাদারিত্বের খাতিরে আপনার সহকর্মী হিশেবে টিকে যাওয়া সিংহভাগই আমাদের প্রতিনিয়ত মিথ্যে বলে চলেছে। কেউ বলছে না আজ বাঙলাদেশের গভীর অসুখ। কিন্তু আপনাকে বলতে হবে। কেননা, টেলিভিশনীয় মুগ্ধতা ছাপিয়ে আমরা আপনাকে আবিষ্কার করেছি ল্যাম্পপোস্টের ধারে। আপনার সামনে দাঁড়িয়ে কোনোদিন মনে হয়নি শ্রদ্ধায় মাথা নত করতে হবে, কেননা—ছেলেবেলা স্কুলের মাঠে অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে জাতীয় পতাকাকে স্যালুট জানানোর সময়ই শিখেছিলাম মাথা উঁচু করেই শ্রদ্ধা করতে হয়। কিন্তু আপনি আপনার সম-সাময়িক অনেকের মতোই আমাদের এই উদ্ধত শ্রদ্ধাকে অচ্ছুৎ ঘোষণা করলেন না; বরং আলিঙ্গন করলেন। ২০১৩ সালে শাহাবাগের লক্ষ জনতার ভিড়ে আপনাকে সত্যি খুঁজিনি আমরা, কিন্তু যেদিন শাহাবাগে মিছিলে হাঁটা মানুষের চেয়ে পুলিশের সংখ্যা বেশি ছিলো, যেদিন পঞ্চাশ জনের একটি মিছিল প্রতিহত করতে মেট্রোপলিটন পুলিশের দুটো জলকামান গাড়ি সদা-তৎপর ছিলো—সেদিন আপনাকে দেখেছি, বুক-পকেটে স্লোগান পুষে রাখা আমাদের স্বপ্নিল সহযোদ্ধা। আপনি ছাড়া আর কে জানে যে, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় ও তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে মানুষের সুতীব্র উদ্বোধনের চলমান আন্দোলনে রাজীব হায়দার, জগৎজ্যোতি তালুকদার, আরিফ রায়হান দীপ, অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয়, নীলাদ্রী নীলের মতো কতো তরুণকে জীবন দিতে হয়েছে। মানুষের রক্তে রামপাল, বাশখালি, রূপপুরের মতো কতোগুলো চুক্তি পাশ হয়ে গেলে ফ্লাইওভারের বাঁক পেরোয় নির্জীব ভোগবাদী মধ্যবিত্ত। আপনি ছাড়া আর কার কাছে প্রজন্ম শিখবে শিল্প আসলে বিপ্লবেরই দুয়োরানী। আমাদের বাতায়ন পাশে আজ মাইক্রোপ্রসেসরখচিত সন্ধ্যা, সুইচ টিপলেই আমরা প্রবেশ করি বিভ্রান্তির হীরক রাজার দেশে। আমরা দাঙ্গা দেখিনি, মন্বন্তর দেখিনি, দেশভাগ দেখিনি, দীর্ঘ শরণার্থীর লাইন দেখিনি, মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন দেখিনি। সুবিধাবাদী মধ্যবিত্তি শৈশব আমাদের ঠেলে দিয়েছে একটি হাবা যৌবনের দিকে। এই উদভ্রান্ত পথে দ্রোহ আর শিল্পের মোহনায় আপনিই তো আমাদের সে-ই নথিভুক্তিকার, যার কাছ থেকে যুগপৎ আমরা এবং উত্তর প্রজন্ম জানবো বঙ্গবন্ধুর অমিয় উচ্চারণ— মহৎ অর্জনের জন্যে প্রয়োজন মহৎ আত্মত্যাগ। অতএব, এই পঞ্চাশতম জন্মদিন তো শিল্পী আজাদ আবুল কালামের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার। শিল্প যে তন্বী শরীরের অন্তহীন আমন্ত্রণবীথি নয় বরং মানবজীবনের এক উজ্জ্বলতম প্রদেশ— মৃত্তিকা থেকে মহীরূহে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে লক্ষ বীজের বলাকায় এই কথাই তো আপনি আমাদের বলে চলেছেন। জন্মভূমি যদি জননী হয়, তবে শিল্পের ব্যাকরণে আমাদের কাছে আপনিই একমাত্র পুরাণপুত্র, জন্মসনদে যিনি তার জননীর অগ্রজ। এই প্রবল কথাটির পক্ষে যুক্তি হলো এই যে, নাটকের কাজই হলো অস্থিতি ঘোষণা করা— মহাপরিচালক হিশেবে শিল্পকলায় যে-ই থাকুক। আগের বাক্যটির প্রকাশ যতোটা রাজনৈতিক, বিকাশ ততোটাই দার্শনিক।
তিন
সংস্কৃতির একটি রাজনীতি আছে। এই বিশুদ্ধ বাক্যটি ক্রমেই বাঙলাদেশে এমন এক পরিস্থিতি ধারণ করেছে যে, সংস্কৃতির ভিতরে বিরাজমান রাজনীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ দাঁড়িয়ে গেছে Politricks. ফলে রাষ্ট্রের একদিকে আজ রজনিগন্ধা ও রবীন্দ্রসঙ্গীত অন্যদিকে স্বজনের লাশ খুঁজতে আসা ক্লান্তিহীন মানুষ। এই দুই পক্ষের মাঝখানে আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয় বাতিলজনদের রুটিরুজি, না হয় মধ্যবিত্তের প্রসাধনসামগ্রী অথবা যাপিত জীবনের আয়নায় একটি অস্বস্তিকর ফাটল— এবং সেটাই জরুরি। একে উপেক্ষা করার চেষ্টা করা হয় কিন্তু বাতিল করা যায় না। এই আয়নায় যতোক্ষণ মুখ দেখবেন শিল্পী আজাদ আবুল কালাম, ততোক্ষণ তিনি আমাদের—অর্থাৎ তিনি শিল্পী। কিন্তু যাঁরা উন্নয়নের রোদে পিঠ পেতেছেন; আকাশে শান্তি, বাতাসে শান্তি বলে ভাতঘুম দিচ্ছেন—তাঁরা তো পোষ মানাতে চাইবেনই। প্রদর্শিত হবার নিম্নমানের যোগ্যতাও তাঁরা বিলি করে থাকেন। দিনশেষে তাঁরাও শিল্পের সাংবিধানিক শিষ্টাচারের রামায়ন পড়েন। সুতরাং ব্রতভ্রষ্ট হবার পরও আমাদের মধ্যপদলোপী কর্মধারয় বুদ্ধিজীবীমহলে শিল্পী আজাদ আবুল কালাম প্রতিসাংস্কৃতিক উপস্থিত হিশেবে অনুমোদিত হন। কিন্তু সেখানেও তিনি নিশ্চিত জানেন, মূল ধারার মতাদর্শ বিকল্প ধারাটিকে আত্মসাৎ করতে চাইবেই। সুতরাং শিরস্ত্রাণহীন শিল্পী আজাদ আবুল কালামকে দেখে অবাক হবার কিছু নেই। তারপরও যদি প্রশ্ন থেকেই যায়, তবে পাল্টা প্রশ্ন করা যেতে পারে—কে কে আছেন যারা খবরের কাগজের কলমচির বাকবিভূতির সঙ্গে র্যাঁবোর শব্দহীনতার তুলনা করবেন? অতএব, এই শিরোভূষণহীনতাই তুলনায় ভালো, কারণ শিল্পীকে সাধারণ মর্ত্যচারীদের মধ্যে অশনাক্ত থাকতে হয়।
পঞ্চাশতম জন্মদিন উদযাপন একটি উপলক্ষ্য মাত্র; মূল লক্ষ্যটি হলো শিল্পী আজাদ আবুল কালাম যে এখনও আমাদের—এই সত্যটি জানিয়ে দেয়া। মার্কস প্রথম কমিউনিস্ট ইস্তাহারে ১৮৪৮ সালে খেয়াল করেন যে, বুর্জোয়াতন্ত্র শিল্পীর জ্যোতির্বলয় কেড়ে নিয়েছে, সে আর স্রষ্টা নয়, মজুরি শ্রমিক মাত্র। পাদটীকায় মার্কসকে রেখে আমরা এই সত্যটিও নির্দ্বিধায় জানাতে পারি যে, শিল্পী আজাদ আবুল কালাম এখনও বুর্জোয়াতন্ত্রের ফুলদানি হয়ে যাননি বলেই আমাদের দেবদূত। তার বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ষ্পর্শ করার জন্যে এই জন্মদিন উদযাপন একটি নিমিত্ত মাত্র। কেননা বুড়ো আঙুলের ছাপের কোনো নকল হয় না। ওতেই লেখা থাকে একজন শিল্পীর সরণচিহ্ন— যা শাশ্বত, ধ্রুব এবং প্রথম চুম্বনের মতোই অদ্বিতীয়।